আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুর্ধর্ষ তিন জঙ্গি ছিনতাই

গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে প্রিজনভ্যানে করে জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত তিন আসামিকে ময়মনসিংহ আদালতে আনার পথে নিষিদ্ধ সংগঠনটির সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পুলিশের ওপর বোমা হামলা ও গুলি চালিয়ে ফিল্মি স্টাইলে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশালের সাইনবোর্ড নামক এলাকায় গতকাল সকাল ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ছিনতাইকৃত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি হচ্ছেন সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানি ও রাকিব হাসান এবং যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত বোমা মিজান ওরফে বোমারু মিজান। এ সময় জেএমবি সন্ত্রাসীদের গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যান গাজীপুর পুলিশের কনস্টেবল আতিকুর রহমান ওরফে আতিক। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন এসআই হাবিবুর রহমান (৫০) ও কনস্টেবল সোহেল রানা (২৫)।

এ সময় জেএমবির সশস্ত্র ক্যাডাররা মুখে কালো কাপড় বাঁধা অবস্থায় ছিলেন। পরে রাকিব হাসানকে টাঙ্গাইলের সখিপুর থেকে পুলিশ ও র‌্যাব যৌথ অভিযান চালিয়ে আটক করেছে। এ ঘটনায় গাজীপুর, ময়মনসিংহসহ আশপাশের জেলাগুলোতে রেড অ্যালার্ট জারি করে পুলিশ প্রশাসন। ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়কের ময়মনসিংহ অংশের চারটি পয়েন্টে র্যাব ও পুলিশের চারটি চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। ঘটনার পরপরই চিরুনি অভিযানে টাঙ্গাইলের সখিপুর থেকে একটি মাইক্রোবাসসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

এ সময় একটি পিস্তল ও গুলিসহ কয়েকটি বোমা উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলো মাইক্রোবাস-চালক জাকারিয়া, জঙ্গিচক্রের দুই সদস্য ময়মনসিংহ মুক্তাগাছা উপজেলার রায়হান (৩০) ও গাজীপুরের সখিপুরের রাসেল (৩৫)। ময়মনসিংহ পুলিশ ও গাজীপুরের কাশিমপুর কারা কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, রবিবার সকালে কাশিমপুর-১ কারাগার থেকে জেএমবির সালেহীন ওরফে সানি, কাশিমপুর-২ কারাগার থেকে বোমা মিজান এবং কাশিমপুর-৩ হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে রাকিব হাসানকে ময়মনসিংহে আনার উদ্দেশ্যে প্রিজনভ্যানে তোলা হয়। তাদের মুক্তাগাছা থানার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ১৬/০৩/২০০৬ ও কোতোয়ালি থানার ০৭/১২/০২ তারিখে সিরিজ বোমা হামলাসহ পাঁচটি মামলায় হাজিরা দিতে ময়মনসিংহ আদালতে আনা হচ্ছিল। এদিকে দুপুর ২টার দিকে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুই পুলিশ সদস্যকে দেখতে যান।

যাওয়ার আগে ঘটনাস্থল ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, 'সাধারণত এ ধরনের আসামিকে মুভমেন্ট করানোর সময় কারা কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট পুলিশকে অবহিত করে। কিন্তু ময়মনসিংহ পুলিশের এসপি জানিয়েছেন, তাকে এ বিষয়টি অবহিত করা হয়নি। ' তিনি বলেন, 'ইতোমধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুরো বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। কারও কোনো গাফিলতি থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আসামি ধরার ব্যাপারে সব রকম চেষ্টা অব্যাহত আছে। ' তিনি নিহত পুলিশ কনস্টেবল পরিবারকে এক লাখ টাকা ও আহতদের সর্বোচ্চ সেবা প্রদানের কথা জানান। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকালে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহ আদালতের উদ্দেশ্যে জেএমবির মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সালেহীন ওরফে সানি ও রাকিব হাসান এবং যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত বোমারু মিজানকে আনা হচ্ছিল। এ সময় প্রিজনভ্যানে এক এসআই হাবিবুর রহমান, দুই কনস্টেবল আতিক ও সোহেল রানা এবং চালক সবুজ ছিলেন। তবে প্রিজনভ্যানের আগে-পিছে কোনো প্রটেকশন ছিল না।

সকাল সাড়ে ৯টার দিকে প্রিজনভ্যানটি ত্রিশাল উপজেলার সাইনবোর্ড নামক স্থানে পেঁৗছলে সামনে থাকা একটি ট্রাক গতি কমিয়ে দেয়। প্রিজনভ্যানটি এ সময় গতি কমাতে বাধ্য হলে এর সামনে-পেছনে থাকা সাদা ও কালো রঙের দুটি মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেটকার থেকে কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা ১৫-২০ জন জঙ্গি কমান্ডো স্টাইলে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। এ সময় রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকেন এসআই হাবিবুর রহমান, কনস্টেবল সাহেল রানা ও আতিক। পরে চালক সবুজের কাছ থেকে চাবি নিয়ে প্রিজনভ্যানের তালা ভেঙে আসামিদের ছিনিয়ে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা। ঘটনার সময় ককটেল বিস্ফোরণ ও উপর্যুুপরি গুলির শব্দে আশপাশের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

কিছুক্ষণ পর স্থানীয় জনতা রক্তাক্ত অবস্থায় ঘটনাস্থল থেকে গুলিবিদ্ধ কনস্টেবল আতিকের লাশ উদ্ধার করে এবং গুরুতর আহত এসআই হাবিবুর রহমানকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও কনস্টেবল সোহেল রানাকে প্রথমে ত্রিশাল স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্ েও পরে অবস্থার অবনতি হলে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। চালক সবুজ জানান, প্রিজনভ্যানের সামনে একটি ট্রাক ছিল এবং পেছনে দুটি মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেটকার ছিল। ট্রাকটি সামনে থেকে প্রিজনভ্যানের গতিরোধ করলে পেছন থেকে কালো কাপড়ে মুখ ঢাকা ১৫-২০ জন দুর্বৃত্ত ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে। এসআই হাবিবুর রহমান বলেন, 'সন্ত্রাসীরা প্রিজনভ্যানের সামনে এলাপাতাড়ি গুলি ও বোমাবাজি করলে আমি গুলিবিদ্ধ হই। পরে সন্ত্রাসীরা চালক সবুজের কাছ থেকে ভ্যানের চাবি নিয়ে আসামিদের ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

' এরপর কী হয়েছে কিছুই বলতে পারেননি তিনি। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় ইউপি মেম্বার শাজাহান বলেন, 'সাইনবোর্ড এলাকায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জঙ্গিরা ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে আসামিদের ছিনিয়ে কালো রঙের একটি মাইক্রোবাস ঢাকার দিকে এবং অপর একটি মাইক্রোবাসে ময়মনসিংহের দিকে চলে যায়। খবর পেয়ে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মঈনুল হক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হারুন-অর-রশিদ হাসপাতালে ছুটে যান এবং ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, একটি ট্রাক সামনে থেকে প্রথমে ভ্যানটিকে ব্যারিকেড দেয়।

পরে কালো কাপড়ে মুখ বাঁধা কয়েকজন সন্ত্রাসী ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করে। টাঙ্গাইলের সখিপুর থেকে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, বেলা ১১টার দিকে কালো রঙের ভঙ্ িমাইক্রোবাসটি (ঢাকা মেট্রো-চ ১১-৬০৪৮) সাগরদীঘি-সখিপুর সড়কে পালানোর সময় সখিপুর থানার সামনে পেঁৗছলে পুলিশ ও জনতা গাড়িটির গতি রোধ করতে ব্যর্থ হয়। পরে তারা গাড়িটির পিছু নেয়। অবস্থা বেগতিক দেখে ঢাকা-সখিপুর সড়কের প্রশিকা এলাকায় গাড়িটি রেখে আসামিরা পালিয়ে যায়। এ সময় স্থানীয় জনতা গাড়ির চালক জাকারিয়াকে (২৫) আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে।

এ সময় পুলিশ গাড়ি থেকে দুই রাউন্ড গুলি, একটি পিস্তল, চারটি মোবাইল সেট ও রড কার্টারসহ বেশ কয়েকটি তাজা বোমা উদ্ধার করে। এরপর সখিপুরের তক্তাখলা বাজার এলাকা থেকে জঙ্গিচক্রের দুই সদস্য ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার রায়হান (৩০) ও গাজীপুরের সখিপুরের রাসেলকে (৩৫) আটক করে। পালিয়ে যাওয়া জঙ্গিদের ধরতে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সদস্যরা সখিপুর ও আশপাশ এলাকায় চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে। কাশিমপুরের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-১-এর জেলার আবদুল কুদ্দুস জানান, পার্ট-১-এর হাজতি সালাউদ্দিন সালেহীন ওরফে সানিকে ২০১০ সালে কাশিমপুর কারাগারে আনা হয়। সানি জেএমবির শূরা সদস্য।

তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় ৪০টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি মামলায় তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ রয়েছে। তিনি নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার ৫৮ সেন রোড এলাকার রফিকুল ইসলামের ছেলে। কাশিমপুরের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পার্ট-২-এর সুপার মো. জাহাঙ্গীর কবির জানান, হাজতি বোমারু মিজান জামালপুর সদরের শেখের ভিটা এলাকার সুজা মিয়ার ছেলে। তার বিরুদ্ধে ১৯টি মামলা রয়েছে।

এর মধ্যে সাজা হয়েছে পাঁচটি মামলায়। এর একটিতে যাবজ্জীবন হয়েছে। কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সুপার আবদুর রাজ্জাক জানান, রাকিবুল হাসানের বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা রয়েছে। একটি মামলায় তার ফাঁসি, তিনটিতে যাবজ্জীবন, একটিতে ১৪ বছর, একটিতে সাত বছরের দণ্ড হয়েছে। তিনি জামালপুরের মেলান্দহ থানার বংশীবাড়ী গ্রামের আ. সোবাহানের ছেলে।

জড়িতরা অচিরেই গ্রেফতার হবে : পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছেন, দেশে জঙ্গি তৎপরতা এখনো বন্ধ হয়নি। তবে তা নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উদ্বিগ্ন নয়। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আল-কায়েদার হুমকি নিয়েও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিচলিত নয়। যে কোনো হুমকি মোকাবিলায় পুলিশ প্রস্তুত রয়েছে।

গতকাল টি-২০ বিশ্বকাপের ভেন্যু সিলেট বিভাগীয় স্টেডিয়াম পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন আইজিপি। তিনি বলেন, প্রিজনভ্যানে বোমা মেরে দণ্ডপ্রাপ্ত জেএমবির তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা অনভিপ্রেত। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে এবং অচিরেই তাদের গ্রেফতার করা হবে। এ সময় তার সঙ্গে র্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমানও ছিলেন।

পুলিশ বরখাস্ত : প্রিজনভ্যান থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় এক পুলিশকে সাময়িক বরখাস্ত এবং অপরজনকে ক্লোজড করা হয়েছে।

গাজীপুরের পুলিশ সুপার মো. আবদুল বাতেন জানান, দায়িত্বে অবহেলার জন্য গাজীপুর পুলিশ লাইনের রিজার্ভ ইন্সপেক্টর (আর.আই) সাইদুল করিমকে পুলিশ লাইনে ক্লোজড এবং একই পুলিশ লাইনে কর্মরত ফোর্স সুবেদার আবদুল কাদেরকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এদিকে ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি এসএম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান জানিয়েছেন, ছিনতাই হওয়া বাকি দুই জেএমবি সদস্যকে ধরিয়ে দিতে পারলে প্রতিজনের জন্য ২ লাখ টাকা করে পুরস্কার প্রদান করা হবে।

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.