আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অভিশপ্ত আয়না একটি রোমহর্ষক ভৌতিক গল্প



এক
আয়নাটির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুপ্তি। চমৎকার ডিম্বাকৃতি আয়না, চারপাশে লাল আর কালোর অদ্ভূত নকশা করা বর্ডার। কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর হচ্ছে আয়নার উপরে বসানো ময়ূর দুটি। ময়ূর দুটির লেজ আয়নার দুই পাশে ঝুলে রয়েছে। চোখ গুলিতে কি পাথর বসানো কে জানে, লাল রঙ এর চোখগুলো আলো না পড়লেও যেন ঝিকমিক করছে।

প্রথম দৃষ্টিতেই আয়নাটির প্রেমে পড়ে গেলো সে। এরপর পুরো ঘরে এক চক্কর দিয়ে আবার সেই আয়নার সামনেই এসে দাঁড়িয়েছে। মনের কল্পনায় দেখছে, আয়নাটিকে তার রুমের ওয়ার্ডরোবের পাশের দেয়ালে কি চমৎকারই না দেখাচ্ছে। আয়নার দাম যে তার নাগালের বাইরে হবে, সে নিয়ে সুপ্তির মনে কোন সন্দেহ নেই। তার স্কলারশিপের টাকা বেশীর ভাগই সে মনের আনন্দে উড়িয়েছে।

সেটা নিয়ে এখন তার অনেক মন খারাপ হলো।
সে এসেছে তার মায়ের সাথে পুরান ঢাকার গলির মাঝে তস্য গলির তিনতলা এক বাড়ীতে। বাড়ীটি এত পুরনো যে যে কোন সময়ে ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়বে। সেই কোন আমলের জমিদার বাড়ি, বয়স প্রায় ৩০০ বছর। অনেক বছর বাড়িটি বন্ধ থাকার পর কে বা কারা যেন পেপারে বিজ্ঞাপন দিয়েছে যে অ্যান্টিক পুরনো আসবাবপত্র বিক্রি হবে।

তার মার সখ অ্যান্টিক শো পিসের, একারনেই শুক্রবারের সকালে আরাম ছেড়ে তারা এখন এই পুরনো বাড়ীর বৈঠক খানায় দাঁড়ানো। সুপ্তি পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে, তৃতীয় বর্ষে। শুক্রবারে তাকে বেলা ১২টার আগে বিছানা থেকে তোলা কষ্টসাধ্য নয়, একেবার দুঃসাধ্য কাজ। আজকে সেই কাজটি তার আম্মু, নাসরিন বেগম ওরফে নাসু, করতে সক্ষম হয়ে আব্বুর কাছ থেকে বাজীর ৩০০০ টাকা আদায় করেছে। সেই টাকা নিয়েই নাসরিন ঢু মারতে এসেছে এই পোড়ো বাড়িতে।

তার আম্মুর ইতোমধ্যে একটা পানের বাটা আর একটি ফুলদানি খুবই পছন্দ হয়েছে। এখন সে দরদাম করতে ব্যস্ত সাদা চুলের বুড়োর সাথে। সেই এই বাড়িটি দেখাশোনা করে। বাড়িটির বর্তমান মালিক জন্মের পর থেকেই আমেরিকা। একবারো দেশে আসেনি।

এখন সে চায় সব কিছু বিক্রি করে দেশের সাথে সম্পর্ক একেবারেই মিটিয়ে দিতে।
এক ফাঁকে সুপ্তি বাড়ির নীচতলা পুরোটাই ঘুরে এসেছে। সবকিছুরই ঝুরঝুরে দশা। দোতলার একটি ঘর কোনমতে আস্ত আছে, যেটিতে বুড়ো চৌকিদার থাকে। তিনতলায় কেউ ওঠে না প্রায় ১০০ বছর হয়ে গেছে নাকি।

নীচ তলার রুমগুলি এখনো কিছুটা আস্ত আছে বটে, কিন্তু ভ্যাপসা গন্ধ আর প্রচন্ড ধূলা। এক কালের রঙিন কাঁচ গুলো অবহেলা আর পরিচ্ছন্নতার অভাবে ধূলি ধূসরিত। ঘুরতে ঘুরতে একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে পড়ে সুপ্তি। বিশাল কাঠের দরজা, অতীতে হয়ত চমৎকার কাঠের কাজ করা ছিল; এখন তার উপরে কয়েক পরত ধূলার আস্তরন। সুপ্তি টানাটানি করতেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে খুলে গেলো।

রুমটি বেশী বড় নয়, মাঝারি আকৃতির। ভিতরে ঢুকে সুপ্তি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। চারপাশে বিশাল বিশাল সব আলমারি, আর তাতে না হলেও হাজার দশেক বই হবে। এ বাড়ির লাইব্রেরী বোধ হয়। মাকড়সার জাল সরিয়ে সরিয়ে ঢুকতে হয়, অবস্থা এতই করুণ।

ঝটপট শব্দ হচ্ছে, তার মানে ইঁদুরের সাম্রাজ্য। সাথে চামচিকাও অবশ্যই আছে। ঘরের কোনে একটা লাঠি পেয়ে সেটা নিয়েই সুপ্তি এগুতে থাকে জাল সরিয়ে। একটা আলমারি টানাটানি করে খুলতে ব্যর্থ হয়। সব মনে হয় তালা দেয়া।

ঘরের এক কোনে একটা টেবিল আর ইজি চেয়ার। চেয়ারের কোন দশা নেই, কি করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে তা এক বিস্ময়। টেবিলের উপরে এখনো কিছু বই ইতঃস্তত পড়ে আছে। শত বছর আগে এই টেবিলে বসেই কেউ লিখতো, বই গুলি পড়তো – ভাবতেই সুপ্তির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। সবকিছুর উপর শত বছরের ধূলা।

সুপ্তি ভাবলো তার মা এই রুমে এলেই সর্বনাশ। মার প্রবল ডাস্ট এলার্জি। বাসার সব ধূলা ঝাড়াঝাড়ি সুপ্তি আর তার বাবাকেই করতে হয়। সুপ্তি টেবিলের রাখা বইগুলোর উপর থেকে হাত দিয়েই ধূলা সরাতে থাকে। কালো মলাটের একটি মোটা বই, প্রথম পাতা খুলতেই ঝুর ঝুর করে সব খসে পড়লো।

পাতা নেই বললেই চলে, যা আছে সব ইঁদুর আর পিঁপড়া মিলে ভোগে লাগিয়েছে। কিসের বই বোঝার কোন উপায় নেই। বইটির পাশে ছোট একটি ডায়েরী। সুপ্তি অবাক হয়ে দেখলো সবকিছুর ধূলার সাম্রাজ্যে ঢাকা হলেও ডায়েরীটি যথেষ্টই পরিস্কার। কেউ যেন নিয়মিত এর ধূলা ঝাড়ে।

পাশেই কালির দোয়াত, তার মাঝে পাখির পালকের কলম। ধূলায় রঙ অস্পস্ট। সুপ্তি ডায়েরীটি তুলে নিল।
“এখানে কি চাই?” – গম্ভীর রাগী গলায় কেউ একজন প্রশ্ন করলো।
সুপ্তি ভয়ে চেঁচিয়ে উঠে হাত থেকে ডায়েরী ফেলে দিলো।

আতংকে তার গলা রুদ্ধ হয়ে গেলো, কোনমতে পিছনে ফিরে দেখলো বুড়ো চৌকিদার কোন ফাঁকে চলে এসেছে। এত তন্ময় হয়ে সুপ্তি সব দেখছিলো যে সে বুঝতেই পারেনি অন্য কেউ ঘরে প্রবেশ করেছে। তোতলাতে তোতলাতে সুপ্তি বললো,
“এই তো, এমনি। এমনি আমি সব ঘুরে দেখছিলাম”।
বুড়ো চৌকিদারের চোখ রাগে ধক ধক করে জ্বলছে।

চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
“কখনো এমন কোথাও যেতে হয় না যেখানে তুমি অবাঞ্চিত। এমন কোন কিছু স্পর্শ করতে হয় না যা তোমার নয়। তোমার কৌতুহল তোমাকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, সে সম্পর্কে তোমার কোন ধারনা নেই”।
সুপ্তির কাঁপুনি বেড়ে গেলো। আজকাল সে অনেক সাইকো থ্রীলারের ছবি দেখে তার বন্ধু চৈতীর পাল্লায় পড়ে।

এই লোকটিও সাইকো নয় তো?
“আমি…… আমি দুঃখিত। বুঝতে পারিনি”। কাঁপা কন্ঠে কথা গুলো বলেই লোকটির পাশ দিয়ে দৌড় দিলো সুপ্তি। দরজা দিয়ে বের হতে হতে সে শুনতে পেলো লোকটি কারন ছাড়াই হাসছে।
বাইরে বৈঠক খানায় এসে দেখলো তার মা চার পাঁচটি প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে।

যেতেই সুপ্তি ধমক খেলো।
“অ্যাই পাজি মেয়ে, কোথায় ছিলি তুই? জানিস আমি কতক্ষন ধরে খুঁজছি। বাসায় যেতে হবে না? রান্না কি ভূতে করে দিয়ে যাবে?”
সুপ্তি কথার উত্তর না দিয়ে দৌড়ে দরজা দিয়ে বাইরে বেড়িয়ে গেলো। রাস্তায় লোকজনের মাঝে না গেলে তার কাঁপুনি কমবে না। অদ্ভুত কিছু একটা আছে এই বাড়ীতে।

এক মূহুর্ত সে এখানে থাকবে না।
বুড়ো চৌকিদার ততক্ষণে ফিরে এসেছে। সুপ্তির মা তার দিকে তাকিয়ে লজ্জিত ভাবে বললেন,
“মেয়েটা আমার বড় পাগলী হয়েছে। তাহলে আজ আসি?”
“জ্বী জ্বী। তবে কি আমি চায়ের সেটটি আপনার জন্য রাখবো? একেবারে খাঁটি পুরনো জিনিস কিন্তু, ১৫০ বছরের কম বয়স না”।


সুপ্তির মা দুঃখের সাথে মাথা নাড়লেন, “যে দাম বলছেন, তাতে কোন ভাবেই সম্ভব না”।
“আরেকটু না হয় কমালাম, আপনি এত জিনিস নিলেন”।
সুপ্তির মা কিছুক্ষন ভেবে বললেন, “আপনি দিন ১৫ যদি রাখতে পারেন তবে ভালো হয়, এর পর আমি এসে নিয়ে যাবো”।
“ভালো খদ্দের না পেলে রাখবো। আপনি খবর নিয়েন”।


প্রথম দুই তিন দিন সুপ্তির রাতে একা ঘুমুতে একটু ভয় ভয় করছিলো; কিন্তু তার ছোট বোন হচ্ছে পাজির পা ঝাড়া। কি ভেবে যে আব্বু তার নাম সুকন্যা রেখেছে সে আল্লাহ মালুম। একবার যদি শোনে যে সুপ্তির রাতে ঘুমুতে ভয় করছে, ফোন করে করে সবার কাছে খবর পৌঁছে দেবে। তাই সে যে লাইট জ্বালিয়ে ঘুমাচ্ছে, তা কাউকে জানতে দিলো না। দিন তিনেক পরেই সব আগের মত।

অ্যাসাইনমেন্ট আর পরীক্ষার ধাক্কায় সুপ্তির জীবন চলতে লাগলো আগের ধারায়।
২৪শে এপ্রিল সুপ্তির জন্মদিন। ২৩শে এপ্রিল রাতে সে খুবই আনন্দ নিয়ে জেগে থাকে। প্রতিবারই জন্মদিনে রাত ১২টা এক মিনিটে সে বেশ কিছু উপহার পায়। তার মাঝে কিছু উপহার গৎবাঁধা।

তার ভালো মানুষ বাবা একটা খামে শুভ জন্মদিন লিখে কিছু টাকা দেবে, যেটাতে সে বন্ধুদের খাওয়ায়। তার পাজি বোন একটা কার্ডে হ্যাপী বার্থডে লিখেই খালাস। ছোট খালা উপহার আগেই পাঠিয়ে রাখে। প্রতি বছরই সে একটা করে জামা পায়। পাশের বাসার নীনা আন্টির কেক পুরো বিল্ডিং এ হিট।

নীনা আন্টি একটা কেক বানিয়ে আনে। গত বছর নীনা আন্টির ৪ বছরের ছেলে কৌশিক একটা ললিপপ দিয়েছিল। যেটা দেয়ার আগে আবার সে খানিকক্ষন খেয়েছে। এবছর কি করবে কে জানে! তবে তার আম্মুর দেয়া উপহার সবসময়ই ব্যতিক্রম। কোনবারের সাথে কোন বারের টা মিল থাকে না।

এই তো দুই বছর আগে সে পেয়েছিলো রবীন্দ্র রচনাবলীর সেট, গত বছর আম্মু তার জন্য কিনে এনেছিল মুক্তার চমৎকার একটা সেট। পার্টিতে সে প্রায়ই সেটা পড়ে। এবছর কি পাবে তা নিয়ে সে খুবই উত্তেজিত। শুয়ে শুয়ে সে ঘুমের ভান করতে লাগলো। ১২টা ১ বাজার সাথে সাথে সবাই হ্যাপী বার্থডে টু সুপ্তি বলতে বলতে রুমে ঢুকে পড়লো।

সুপ্তি ভান করলো যে সে একেবারে আকাশ থেকে পড়েছে। ডাইনিং রুমের টেবিলের উপরে নীনা আন্টির কেক রাখা। চারপাশে মোমবাতি সাজানো। মোবাইলে টানা ভাইব্রেশন হচ্ছে, মেসেজ আসার জন্য। আনন্দে সুপ্তির চোখে জল এলো।

কেক কাটা পর্ব শেষ করেই সবাই ঘুমানোর জন্য দে ছুট। আম্মু এসে সুপ্তির কপালে চুমু দিয়ে তার উপহারটি বিছানায় রেখে গেলো। সবাই চলে গেলে পরে গভীর রাতে সুপ্তি তার উপহারগুলো খুলতে বসলো। তার বোনের কার্ডটির মাঝে এবার বান্দরের ছবি। দাঁত বের করে বান্দরটি হ্যাপী বার্থডে জানাচ্ছে।

সুখের বিষয় এবার কৌশিক কোন উপহার ছাড়াই এসেছে। ছোট খালার জামাটিও মন্দ না। আব্বুর দেয়া টাকা গুলি ব্যাগে ভরে সুপ্তি আগ্রহ ভরে আম্মুর দেয়া উপহার খুললো।
উপহার খুলে সুপ্তি খানিকক্ষন হতভম্ব হয়ে বসে রইলো। এরপর আবার নতুন করে চোখে জল আসা শুরু হলো।

যে আয়নাটি দেখে সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো ওই পোড়ো বাড়িতে, আয়নাটি তার আম্মু তার জন্য নিয়ে এসেছে। মা দের চোখে কি কিছুই এড়ায় না? সুপ্তি উঠে তার ওয়ার্ডরোবের পাশের দেয়াল থেকে ক্যালেন্ডারটি সরিয়ে আয়নাটা লাগায়। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে সে আবার মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ে। চারপাশের বর্ডারে কি সূক্ষ্ণ কারুকাজ। কাঠের মাঝে লাল আর কালো রঙ করা।

উপরের ময়ূরের লেজ দুইটি কি দিয়ে বানানো যে এত বছর পরেও এতটুকু রঙ নষ্ট হয়নি? আর চোখ গুলি কি রুবী? সুপ্তির চেহারা তার নিজের কাছে বিশেষ সুবিধার কখনোই মনে হয় না। কিন্তু এখন সে নিজেকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো। আয়নায় কি সুন্দরই না তাকে লাগছে। একটা লাল টিপ এনে কপালে পড়লো। রূপকথার রাজকন্যা যেন।

আনন্দ দিয়ে সুপ্তি ঘুমাতে গেলো। কিন্তু ঘুম কেন যেন খুব ছাড়া ছাড়া হলো। শেষ রাতের দিকে তার ঘুমের মাঝেই মনে হতে লাগলো কেউ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।



দুই
পরের দিন বাসায় বিকেলে হৈ হৈ করতে করতে চৈতী, সুমন আর তুলি আসলো। সুপ্তির আম্মু মানুষ কে খাওয়াতে পারলেই খুশী।

৬/৭ পদের নাস্তা বানিয়ে ফেললেন তখনই। আয়না দেখে সবাই থ। চৈতী তো পারলে নিয়েই যায়। কয়শ বছরের পুরনো জিনিস, কে এটা বানিয়েছে, কেই বা ব্যবহার করতো- এসব নিয়ে ব্যাপক আড্ডাবাজী। সুমন বরাবরই কল্পনার রঙ ছড়াতে ভালোবাসে।

তার ধারণা, আয়নাটা অভিশপ্ত। সবার রক্ত চুষে নেয়। একারণেই ময়ূরগুলোর চোখ লাল। নতুবা কে কবে শুনেছে ময়ূরের চোখ লাল। সবার হো হো অট্টহাসিতে তার মতবাদ চাপা পড়লো।

কিন্তু সুপ্তি বিশেষ খুশী হতে পারলো না। বন্ধুরা যখন ডাইনিং রুমে খেতে বসেছে, আর সে এসেছে তুলির মোবাইলটা তার ঘর থেকে নিতে; আবার তার সেই অনুভূতি ফিরে ফিরে এলো। কেউ তাকে দেখছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেংচি দিলো সুপ্তি। নাহ, এটা তার মনের ভুলই হবে।


সবাই চলে গেলে রাতের খাওয়া সেরে সুপ্তি নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করলো। ঘুমুতে যাবার আগে সে আবার আয়নার সামনে দাঁড়ালো। আয়নাটা যেন তাকে আবিষ্ট করে ফেলছে। ঘড়ির আওয়াজে চমকে গেলে সে দেখলো ১টা বেজে গেছে। মানে সে প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।

এত সময় ধরে আয়নায় সে কি দেখছে? হঠাৎ তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি জাগলো। মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটা বইতে সে পড়েছে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ১৭শ সালের ডাইনী ব্লাডি মেরীকে ডাকলে সে আসে। অবশ্য প্রতিবার ৪৫ বার করে ডাকতে হবে অনেক দিন ধরে। সে আয়নার দিকে তাকিয়ে বললো, “ব্লাডি মেরী, ব্লাডি মেরী, ব্লাডি মেরী”। নিঃশ্বাস বন্ধ করে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো।

কিছুই হলো না। নিজের নির্বুদ্ধিতায় নিজেই হেসে ফেললো। কি বোকার মত সে গল্পের বই এর কথায় মেরী না কাকে ডাকাডাকি করছে। সবুজ রঙের ডিম লাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। আবার ঘুমের মাঝে সেই অস্বস্তিকর অনুভূতি।

কেউ অবশ্যই তাকে দেখছে।
রাত তিনটার দিকে ঘুম ভেঙে গেলো। সারা ঘরে কেমন যেন শীতল একটা ভাব। বৈশাখ মাসের এই বিশ্রী গরমে এরকম ঠান্ডা ভাব কি করে হলো? বৃষ্টি নাকি বাইরে? পরদা সরালো সুপ্তি। নাহ, বাইরে সব শুকনো, বাতাস পর্যন্ত নেই।

গাছের পাতাগুলিও চুপ চাপ, সবাই ঘুমে বিভোর। হঠাৎ মনে হলো কেউ যেন বিছানার মাথার কাছ দিয়ে সরে গেলো। ঝট করে ঘাড় ঘোরালো সুপ্তি। শিরদাঁড়া বেয়ে ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত নামলো। নাক কুঁচকে গেলো তার।

কেমন যেন একটা গন্ধ; বিশ্রী পচা গন্ধ। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো কপালে। এসব কি হচ্ছে? তার জানামতে বাসায় কোন ইঁদুর নেই, তেলাপোকা অবশ্য আছে। তেলাপোকা মরলে এরকম গন্ধ কখনো হয়না। বিছানা থেকে লাফিয়ে নামলো সুপ্তি।

উদ্দেশ্য আয়নার পাশের সুইচবোর্ডে টিউব লাইটের সুইচ অন করবে। আয়নার কাছাকাছি গিয়ে সে কেমন যেন আওয়াজ শুনতে পেলো। কেউ গুন গুন করে কোন গান গাচ্ছে, না কবিতা পড়ছে। ধীর লয়ে নীচু সুরে কেউ গুন গুন করছে। একটু গোঙগাচ্ছেও যেন।

আয়নার দিকে তাকাবে না তাকাবে না করেও সুপ্তি তাকিয়ে ফেললো।
নাহ, আয়নায় তাকেই দেখা যাচ্ছে। ওই তো সে, ফুল আঁকা টি শার্ট পড়া। সবুজ ডিম আলোতে নিজেকে দেখতে একটু অন্যরকম লাগছে, কিন্তু এটা তারই প্রতিবিম্ব। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হাত বাড়ালো সুইচের দিকে।

আয়নার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলো সুপ্তি। আয়নার সুপ্তি এখনো তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে; হাত দুইটা পাশে রাখা। কিন্তু সে তো বাম হাত উপরে তুলেছে সুইচ অন করার জন্য। আতংকে চিৎকার দিয়ে সে পিছনে সরে এলো। আয়নার সুপ্তি এখনো তার দিকে তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ আয়নার সুপ্তি হাত বাড়িয়ে দিল, যেন সুপ্তিকে ছুঁতে চায়। দুই হাতে মুখ ঢেকে আকাশচূর্ণ করা চিৎকার করে উঠলো সুপ্তি। আতংকে থর থর করে কাঁপছে। বাইরে তার আম্মু আব্বু দরজা ধাক্কাচ্ছে। সুকন্যার গলাও যেন শোনা যাচ্ছে।

সুপ্তি মুখ থেকে হাত সরিয়ে দেখলো আয়নায় এখনো তাকে দেখা যাচ্ছে। হাত নাড়ালে আয়নার হাতও নড়ছে। কোনমতে আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলতেই তার আম্মু ঝাঁপিয়ে পড়লো।
“কি? কি হয়েছে রে মা? সর্বনাশ, এত ঘেমে গেছিস কেন?”
“জানি না আম্মু”। বলে সুপ্তি একেবারে শুয়ে পড়লো তার মার কোলে।


১৫ মিনিট পর লেবুর সরবত খেয়ে মাথা মুছে সে মোটামোটি সুস্থির হলো। তার বাবা মার ধারনা সে কোন দুঃস্বপ্ন দেখেছে। এখন এই আলোকিত রুমে এত প্রিয় মানুষের মাঝে সুপ্তির নিজেরই লজ্জ্বা করতে লাগলো। তার কোন সন্দেহ নেই যে মাঝ রাত্তিরে ঘুম ভাঙার জন্য এবং বেশী সাইকো থ্রীলার দেখার ফলাফল হচ্ছে এটা। ফিচলে সুকন্যা ঘোষনা দিলো যে রাত্রে গুরু ভোজন হবার কারণে পেট গরম হওয়ায় সুপ্তি উলটা পালটা স্বপ্ন দেখছে।

ইদানিং সে নারায়ন গঙ্গোপাধ্যায়ের ভক্ত হয়েছে। কথায় কথায় টেনিদার উক্তি উদ্ধৃতি করে সবার মাথা ধরায়। সুকন্যাকে ভেংচি দিয়ে সুপ্তি আবার ঘুমুতে চলে গেলো, তবে এবার আম্মুও সাথে এলেন। আবার কি স্বপ্ন দেখে কোন ঠিক নাই।
পরের দিন দুপুরে খাবার টেবিলে রাত্রের কাহিনী নিয়ে আলোচনা হলো।

আসলে ঘটনা টা কি? সুপ্তি দুঃস্বপ্ন বলে এড়িয়ে গেলো। এখন আবার সুকন্যাকে টিজ করার কোন সুযোগ দেয়ার মানে হয় না। তবে সে নিজেই চিন্তিত, আসলেই কি দুঃস্বপ্ন ছিলো? সবকিছু এত বাস্তব মনে হচ্ছিল—নাহ সুপ্তি এ নিয়ে আর ভাবতে চায় না। বিকেলে তুলি আর সুমনের সাথে সুমনের গুরুর গিটার বাজানো শুনতে যাওয়ার কথা, সে সেটা নিয়েই ভাববে।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হবার সাথে সাথে সুপ্তির আবার অস্বস্তি হতে থাকে।

আজ রাতে কি হবে কে জানে। আজ সে দরজা না লাগিয়ে শুয়ে পড়ে। ডাইনিং এর লাইট সারা রাত্রি জ্বালানো থাকে, তাতে করে তার রুমেও আলো পৌঁছায়। ওই ভৌতিক সবুজ আলোর চাইতে সাদা আলো যথেষ্ট স্বস্তিদায়ক। রাত গভীর হতে থাকে, কিন্তু সুপ্তির আর ঘুম আসে না।

চাপা অস্বস্তিতে সে জেগে থাকে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানেনা। হঠাৎ তার আবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। সারা ঘরে গুন গুন একটা আওয়াজ ছড়িয়ে পড়েছে। সুপ্তি উঠে বসে।

সাথে সাথে সব চুপ। তার ভয় ভয় করতে থাকে। ঘড়ির দিকে তাকে দেখলো, আড়াইটা বাজে। ঘরটা আবার কেমন যেন শীতল, যেন এসি চালানো হয়েছে। সাথে সেই গন্ধ।

সুপ্তি নাক কুঁচকে বসে থাকে। আবার আম্মুকে ডাকার একটা ইচ্ছে জেগে উঠে। অনেক কষ্টে নিজেকে বার কয়েক গালি দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করতেই আবার সেই গুন গুন আওয়াজ। এবার একটু জোরে।

তীক্ষ্ণ স্বরে কে যেন একটানা মন্ত্র পাঠ করে চলেছে অত্যন্ত দ্রুত লয়ে। সুপ্তি লাফিয়ে নামে বিছানা থেকে। কিন্তু একটা অমোঘ আকর্ষন তাকে টেনে আয়নার দিকে নিয়ে চলে। কোন এক অজানা শক্তি তাকে বাধ্য করে আয়নার দিকে তাকাতে। না এবার আয়নায় তাকেই দেখা যাচ্ছে, ভীত মুখে তাকিয়ে আছে।

চোখ বন্ধ করে সুপ্তি। এবার চোখ খুলতেই সে ভয়ানক ভাবে চমকে যায়। আয়নায় এ কার মুখ? চিৎকার দেবার জন্য মুখ খোলে সে, কিন্তু আয়নার চোখটির ব্যথিত ভাব দেখে থমকে যায়। অপূর্ব এক চেহারা। তবে অনেক শুকনো।

ঘন কালো চুল, বাতাসে আস্তে আস্তে দুলছে। খাড়া নাক, উন্নত ললাট, যেন এক গ্রীক দেবতা। তবে সবচেয়ে মায়াভরা তার চোখ, তার মাঝে যেন সাগরের গভীরতা। ছেলেটি ব্যথিত চোখে সুপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে। মায়াভরা বিষন্ন সেই চোখ অগ্রাহ্য করা সুপ্তির পক্ষে অসম্ভব।

সুপ্তি ভুলে যায় সে কোথায় আছে, তার কাছে মনে হয় এটাই বাস্তব। আয়নার মাঝে মানুষ দেখা যাবে, এটাই স্বাভাবিক। সে চাপা কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“তুমি কে?”
ছেলেটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপরে বলে, “আমি ইভান”।
দৃপ্ত এবং ভরাট কিন্তু ভীষন আপন করা কন্ঠ।


“তুমি আয়নার মাঝে কেন? তুমিই কি কাল রাতে এসেছিলে?”
“হ্যাঁ, আমি তোমাকে ডাকার চেষ্টা করছিলাম”।
“তুমি আয়নায় কেন? তোমার পরিচয় কি?”
আর কোন কথা না বলে আয়নার মাঝে ছবি মিলিয়ে যায়। লাইট জ্বালিয়ে সুপ্তি অনেক করে দেখে, নাহ, আয়না আবার স্বাভাবিক একটা আয়না হয়ে গেছে। লাইট নিভিয়ে সুপ্তি অনেক বার বলে, “ইভান, ইভান, শুনতে পাচ্ছ?” আয়না নিশ্চুপ থাকে, অন্ধকারে শুধু ময়ূরের চোখগুলো ঝিকমিকিয়ে ওঠে।
পরের দিন সারাটা ক্ষণ সুপ্তি ভার্সিটিতে অস্থির হয়ে থাকে।

কখন সে বাড়ি যাবে, কখন রাত হবে। তার অস্থিরতা দেখে চৈতী বললো, “কি রে প্রেমে পড়েছিস নাকি কারো? এত ছট ফট কেন?” সুপ্তি না শোনার ভান করলো। ইভান দেখতে যেন রুশ দেশের রূপকথার ইভানের মত। সে কি কখনো ভেবেছিল, তার ঘরের আয়নায় কোন এক রাজপুত্র এসে দেখা দেবে?
রাত ১২টা বাজতে সুপ্তি তাড়াতাড়ি লাইট নিভিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। আজ রাতে সে ঘুমাবে না।

রাত দুইটার দিকে হঠাৎ ঘরে ধীর গতিতে শীতল হাওয়া বইতে থাকে, সাথে সেই গন্ধ। এত সুন্দর দেখতে ইভান, কিন্তু এই পচা গন্ধ কেন আসে তবে? সুপ্তি তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে যায়। ইভানের মুখে স্মিত হাসি। ইভান ভীষন রকম ফ্যাকাসে।
“কেমন আছ সুপ্তি?”
“ভালো।

তুমি?”
ইভানের মুখ বিষন্ন হয়ে যায়। “আয়নার মাঝে আর কেমন থাকবো?”
“তুমি আয়নায় কেন? কি হয়েছে?”
ইভান বিষন্ন কন্ঠে জবাব দেয়, “আমি কিছুই জানি না। আমি শুধু এক সকালে উঠে দেখতে পাই আমি আমার ঘরের আয়নার মাঝে বন্দি হয়ে গেছি। তারপর থেকে এখানেই আছি। কতবার কতজন কে ডাকার চেষ্টা করেছি, কেউ শোনেনি।

১০০ বছর পর আজ তুমি শুনলে”।
১০০ বছর! সুপ্তির গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
“তোমার তাহলে বয়স কত?”
ইভান হাসে। “৩০০ বছর আগে তো ২৩ ছিল, এখন তোমাদের হিসেবে নিশ্চই ৩২৩, কিন্তু আমার হিসেবে ২৩”।
“১০০ বছর পর আমি ডাক শুনলাম, আগে কে শুনেছিল?” সুপ্তি নিজের কন্ঠের আবেগ লক্ষ্য করে নিজেই অবাক হয়।


ইভান উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠে।
“সুপ্তি, আমার অনেক কষ্ট, অনেক কষ্ট”।
সুপ্তির বুকে আবেগের বান ডাকে। তার ইচ্ছে হতে থাকে গ্রীক দেবতার মত দেখতে ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দেয়।


“তুমি কি আমার হাতে হাত রাখবে সুপ্তি?”- করুণ ভাবে ইভান জিজ্ঞেস করে।
সুপ্তি হাত বাড়িয়ে দেয়। আয়নায় সে ইভানের হাতের উপর হাত রাখে। বরফের মত ঠান্ডা। হাত যেন বেশীক্ষন রাখা যায় না।

সে সরিয়ে নিতে চায়, কিন্তু অবাক হয়ে দেখে সে হাত সরাতে পারছে না। ইভানের চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠে সে। ইভানের চোখে এখন জান্তব উল্লাস। ভীষন লোভে চোখ ঝক ঝক করছে। সুপ্তি ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠে।

সাথে সাথে ইভান আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে ছবি মিলিয়ে যায়।

সুপ্তি তারপরো পরের রাতের জন্য অপেক্ষা করে। আবার ইভান আসে, হাতে হাত রেখে তারা গল্প করে। ইভান চলে যায়।

ইভান দিনে দিনে আরো সুন্দর হয়। ফ্যাকাশে গালে গোলাপী ছোপ লাগে। মাত্র ৩ দিনেই সুপ্তির স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। কিছুতেই সে কোন শক্তি পায় না। চোখের কোণে কালি।

তার মা ব্যস্ত হয়।
“কি হয়েছে রে সুপ্তি? তুই দেখতে এমন হচ্ছিস কেন? রাতে ঘুমাস না?”
সুপ্তি দুর্বল কন্ঠে প্রতিবাদ করে। “কই মা, ঠিকই তো আছি”।



তিন
পরের দিন ক্লাসে দ্বিতীয় পিরিয়ডেই সুপ্তি মাথা ঘুরে পড়ে যায়। তাড়াতাড়ি তার বন্ধুরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে আসে।

খবর পেয়ে তার আম্মু আব্বু আর সুকন্যা দৌড়ে যায়। ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে অবাক হয়ে যায়। কোন রক্তপাতের ইতিহাস নেই, কিন্তু কি ভীষন রকম রক্তশূন্যতা। রক্তের রিপোর্টে দেখা যায় হিমোগ্লোবিনের লেভেল কমে ৪গ্রাম/ডিএল এ এসেছে। যেখানে তার থাকার কথা নিদেন পক্ষে ১৩।

ডাক্তার বলে এখনি রক্ত দিতে হবে। আম্মুর সাথে রক্তের গ্রুপে তার মিল আছে। বন্ধুরা দৌড়ে আরো দুই ব্যাগ জোগাড় করলো। সুপ্তির আম্মু ক্রমাগত কাঁদতে থাকে, কি অসুখ ডাক্তার তখন কিছুই বলতে পারছে না। এরকম হলে নাকি ক্যান্সারের সম্ভাবনা দেখা যায়।

আম্মুর অফিসের কলিগের ফুফাতো ভাইএর ছেলের তো তাই হলো। রাত বাড়ার সাথে সাথেই সুপ্তি অস্থির হয়ে যায় বাসায় যাবার জন্য। ডাক্তারের কড়া নির্দেশ, রক্ত না দিয়ে বাসায় যাওয়া যাবে না। আম্মু আব্বুও কোন রিস্ক নেবেন না। কিন্তু ইভানের যে আসার সময় হয়ে যাচ্ছে।

সারাটা রাত সুপ্তির অস্থিরতার সাথে কাটে। পরের দিনই সে কান্নাকাটি করে হাসপাতালে থেকে সন্ধায় বাসায় ফিরে আসে। সে কথা দেয় যে রক্ত নিতে সে কালই আবার আসবে। রাতে আম্মু সাথেই থাকতে চায়, কিন্তু সুপ্তি মানা করে। রাত ২টা বাজতেই সে আয়নার সামনে দাঁড়ায়।

কিন্তু ইভান কই?
সুপ্তি ইভান কে অনেক ডাকে। অনেকবার করে ক্ষমা চায়, বার বার করে তার অসুস্থতার কথা বলে। কিন্তু ইভান তো আসে না। কাঁদতে কাঁদতে সুপ্তি ঘুমিয়ে পড়ে। রাত সাড়ে তিনটার দিকে তীব্র অস্বস্তির সাথে তার ঘুম ভাঙ্গে।

ঘরে বিকট গন্ধ। এত ঠান্ডা যে সুপ্তি কেঁপে কেঁপে উঠে। গন্ধে সুপ্তির বমি চলে আসতে থাকে। অনেক কষ্টে নাকে হাত চাপা দিয়ে সুপ্তি আয়নার সামনে আসে। ভিতরে আবছা একটা ছায়া।

সুপ্তি ডাকে, “ইভান?”
ছায়ামূর্তি ঘুরে তাকায়। সুপ্তি আতংকে স্তব্ধ হয়ে যায়। এ কে? কি ভীষন চেহারার এক বুড়ী। সাদা শনের মত চুল, চোখ দুটো ধক ধক করে যেন জ্বলছে, কি তীব্র জিঘাংসা তার মাঝে। চামড়া শত শত বছরের পুরনো চামড়ার মত ঝুলে পড়েছে।

লাল জিহবা মাঝে মাঝে সাপের মত লকলক করছে। খলখল করে বিশ্রীভাবে হেসে উঠলো বুড়ী। সুপ্তির বোধবুদ্ধি সব লোপ পায়। তার পা কে যেন পাঁচ মণ পাথর দিয়ে আটকে রেখেছে; কন্ঠস্বর হয়েছে রুদ্ধ। সে শুধু ভীত শশকের মত চেয়ে রইলো।

আবার হেসে উঠলো বুড়ী। অশ্রাব্য এক গালি দিয়ে বললো্‌, “হাত বাড়া সামনে”।
সুপ্তি তীব্র আতংকে মাথা নাড়লো। বুড়ী চিৎকার দিলো, “হাত বাড়া বলছি”।
সুপ্তির ডান হাত তার আয়ত্তের বাইরে।

সে প্রাণপণ চেষ্টা করেও তার হাতকে আটকাতে পারলো না, হাত আয়না স্পর্শ করলো।
ভীষণ অট্টহাসিতে ঘর ভরে গেলো। এমন জান্তব ভয়ংকর গা শিউরানো হাসির যে পৃথিবীতে অস্তিত্ত আছে সুপ্তি তাই জানে না। এর জন্ম এ পৃথিবীতে না, অন্য কোথাও। অন্য কোন জগতে।

পচা মাংসের তীব্র গন্ধ সইতে না পেরে সুপ্তি বমি করে ফেললো ঘরের মাঝেই। বুড়ি খল খল করে হাসতে হাসতে বললো,
“ইভান কে পেয়েছিস তুই? তোর প্রাণের ইভান? আমিই তোর ইভান। ১০০ বছর পর আজ আমি মুক্তি পেয়েছি। আমি, আজিনাহা! আহ, কি আনন্দ!”
সুপ্তির মাথা কাজ করে না। সে মেঝেতে বসে থর থর করে কাঁপতে থাকে।


“আজ থেকে আমি তোর মাঝেই থাকবো। তুই রাতে যখনই ঘুমাবি, আমি তোর মাঝ থেকে জেগে উঠবো। ১০০ বছর আমি কোন রক্তের স্বাদ পাইনি। আজ আমার রক্ত চাই, অনেক অনেক রক্ত”।
সুপ্তি জ্ঞান হারানোর আগ মূহুর্তে অনুভব করতে পারে, একটা শীতল ছায়া তার মাঝে ঢুকে যাচ্ছে।


সকালে জ্ঞান ফিরে সে দেখতে পায়, আম্মু তাকে নিয়ে আবার হাসপাতালে চলে এসেছে। তবে সে অনেক সুস্থ বোধ করছে। ডাক্তাররা রিপোর্ট দেখে অবাক। মাত্র ৩ ব্যাগ রক্ত পেয়ে হিমোগ্লোবিন লেভেল বেড়ে ১৬তে ওঠা এক কথায় অসম্ভব। বাংলাদেশের রিপোর্টের অবস্থা দেখে ডাক্তাররা ভীষন রাগারাগি করতে লাগলেন।

এই রিপোর্ট অবশ্যই ভুল। কিন্তু চোখও তো স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আগের দিন যে মেয়ের চোখ একেবারে কাগজের মত সাদা ছিল, তার তো এখন একদম স্বাভাবিক চোখ। রিপোর্ট নিয়ে আব্বু আম্মুর মাথা ব্যথা নেই। তাদের মেয়ে সুস্থ, তাতেই তারা খুশী।

কিন্তু সুপ্তির মাথা এখনো কাজ করছে না। তার সাথে এসব কি হচ্ছে? বাসায় ফিরে সুপ্তি আয়নার দিকে তাকায়। এ যেন একদম স্বাভাবিক আয়না। তার মাঝে কি বুড়ীটা ঢুকে পড়েছে? কই? তার তো একদম স্বাভাবিক লাগছে, যেন কিছুই হয়নি। আর ইভান? ইভানকে কি বুড়ী আয়নায় বন্দি করে রেখেছে? ইভানকে ছাড়া সে বাঁচবে না।


রাত বাড়ার সাথে সাথে সুপ্তি অস্বস্তিতে ভুগতে থাকে। কি যেন তার মাঝে জেগে উঠতে চাইছে। ভীষন ঘুমে তার দুই চোখ জড়িয়ে আসছে। রাত ১২টা বাজতেই সুপ্তি গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। সারাটা রাত সুপ্তি ভয়ংকর ভয়ংকর সব দুঃস্বপ্ন দেখে।

সে যেন হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। তার মুখ দিয়ে ভক ভক করে বিশ্রী মাংস পচা গন্ধ বেরুচ্ছে। সে রক্তের স্বাদ পেতে থাকে। সে রক্তে যেন মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। কি বিশ্রী ভাবেই না সে হাসছে।

চিৎকার দিচ্ছে, জান্তব উল্লাসে সে যেন ফেটে পড়ছে।
খুব ভোরে তার ঘুম ভাঙ্গে। সারা শরীরে কালসিটে পড়ে গেছে, ভীষন ব্যথা। নিজের দিকে তাকিয়ে তার মাথা ঘুরে ওঠে। টি শার্ট রক্তে মাখা মাখি।

বাথরুমে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠে সে, মুখ হাত সবই রক্তে রঞ্জিত। এবং সে জানে অবশ্যই এই রক্ত মানুষের রক্ত। কাঁদতে কাঁদতে সে গোসল করতে থাকে। সে এখন পিশাচীনী। এক ভয়ংকর পিশাচ তার মাঝে ঢুকে পড়েছে।

সে যখনই ঘুমাবে, পিশাচ জেগে উঠবে। এখন সে কি করবে?
আম্মু দরজা ধাক্কাতে থাকে, “এই সুপ্তি, তোর রুমে নিশ্চই ইঁদুর মরেছে রে, এত বাজে গন্ধ কেন? আজই রুম ফিনাইল দিয়ে পরিস্কার করাবো বুয়াকে দিয়ে। আগে চল বাইরে যাই”।
সুপ্তি বলে উঠে, “আমি কোথাও যাবো না আম্মু”।
আম্মু ধমকে উঠে, “কথা বাড়াবি না।

কত কষ্টে তোর বাবার কাছ থেকে টাকা নিলাম, আর বলিস বাইরে যাবি না?”
সুপ্তি রেডি হয়ে ডাইনিং এ আসতেই শুনলো বুয়া আম্মুর সাথে কথা বলছে উত্তেজিত ভাবে। কয়েক গলি পরেই তার বস্তি। সেখানে নাকি আজকে একটা অদ্ভুত লাশ পাওয়া গেছে। কেউ লাশের গলায় কামড় দিয়ে ধমনী ছিড়ে সব রক্ত শুষে নিয়েছে। পুলিশ কোন কিনারাই করতে পারছে না।

সুপ্তি ভয়ে থর থর করে কাঁপতে থাকে। এটা অবশ্যই ডাইনী আজিনাহার কাজ। আম্মু তার অবস্থা দেখে বুয়াকে ধমকায়, “যাও তোমার কাজ করো। আমার মেয়েকে ভয় দেখিও না”।
আম্মুর সাথে সুপ্তি বেরোয়।

আজ থেকে সে আর ঘুমাবে না। রাতে যত কষ্টই হোক সে ঘুমাবে না। ডাইনীটাকে সে জেগে উঠতে দেবে না। সে জিজ্ঞেস করে, “আম্মু কোথায় যাচ্ছি?”
আম্মু লাজুক ভাবে বললো, “চায়ের সেটটা খুবই পছন্দ হয়েছে বুঝলি। দেখি ওই বাড়ির চৌকিদার যদি এখনো সেটা বিক্রি না করে থাকে, তবে নিয়েই আসি”।


আবার সেই অভিশপ্ত বাড়ি; যেখান থেকে আয়না এসেছে। সুপ্তি আতঙ্কে ফুঁপিয়ে ওঠে, “না না আম্মু, ঐ বাড়িতে যাবো না”।
আম্মু অনুনয় করে, “লক্ষী মা, তুই বাইরে থাকিস, আমি যাব আর নিয়ে আসবো”।
বাড়িটি আগের মতই আছে, ১৫ দিনে কোন পরিবর্তনই হয় নি; তবে সাবেকী আমলের বৈঠক খানার আসবাবপত্র অনেক কমেছে। ভালোই বিক্রি হয়েছে মনে হয়।

তাদের দেখেই চৌকিদার বলে উঠলো,
“আমি জানতাম, আপনারা আসবেন। তাই চায়ের সেট তুলে রেখেছি”।
চৌকিদার তীব্র দৃষ্টিতে সুপ্তির দিকে তাকালো। সুপ্তির মনে হলো, উনি সব দেখতে পাচ্ছেন। সব কিছু জেনে যাচ্ছেন।

ভয়ে কুঁকড়ে গেলো সে ওই অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে। আম্মু চায়ের সেট দামাদামি করে কিনে ফেললেন। সুপ্তি বেরিয়ে যাবে, তখন বুড়ো মানুষটি তার সামনে এসে দাঁড়ালো।
“তুমি তোমার একটা জিনিস ফেলে গেছো। আমি জানতাম তুমি তা নিতে আসবে”।


সুপ্তি অবাক হয়ে দেখলো, তার হাতে সেই ডায়েরী।
“এটা…… এটা আমার নয়”। ঢোক গিললো সে।
মানুষটি কোন কথা না বলে ডায়েরী বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আম্মু বাইরে থেকে তাড়া দিচ্ছেন।

সুপ্তি দেখলো বুড়ো মানুষটির চোখে সহৃদয়তার ছোঁয়া। সুপ্তি হাত বাড়িয়ে ডায়রীটি নিলো। মানুষটি বললো,
“ভালো থেকো। আমারো তোমার মত একটি মেয়ে আছে”।



চার
সুপ্তি বাসায় ফিরেই ডায়েরী খুললো।

১০০ বছরের পুরনো ডায়েরী, কিন্তু সে তুলনায় অবস্থা যথেষ্ট ভালো। পাতা গুলি হলদেটে, কিছু কিছু জায়গায় কালি ছড়িয়ে গেছে; কিন্তু বেশ কিছু লাইন পড়া যায়। ডায়েরীর কিছু পাতা মাঝ থেকে নাই হয়ে গিয়েছে। ডায়েরীর প্রথম পাতায় লেখা, “আমার জীবন নামা”। নীচে লেখিকার নাম দেয়া; মালবিকা রায়।

১০০ বছর আগে এই মেয়েটিও হাসতো, খেলতো, ডায়েরী লিখতো, আজ সে কোথায়? প্রথম দিকে শুধু ঘর কন্নার গল্প। আজ তার বান্ধবী এসেছে, কাল বাবা ঘোড়া্র গাড়িতে চড়ে বেড়াতে নিয়ে যাবে বলেছে। পড়তে পড়তে টের পেলো, সে বাবা মায়ের অতি আদরের কিশোরী কন্যার লেখা পড়ছে। ডায়েরীর মাঝা মাঝি একটি পৃষ্ঠা পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। একটি লাইন অতি কষ্টে পড়া যায়,
“আজ বাবা আমাকে চমৎকার একটি আয়না আনিয়া দিয়াছেন।

শ্মশান ঘাটের বিখ্যাত তান্ত্রিক বাবাকে উহা দিয়াছেন”।
সুপ্তির গা শিউরে উঠলো। এর পরের পাতা গুলি সবই অল্পবিস্তর পানিতে ভেজা; কালি ছড়িয়েছে। এর পর পাতায় পাতায় যা পড়া গেলো সবই আয়নার গল্প। একটা লাইন পড়ে চমকে উঠলো সুপ্তি,
‘আয়নায় আমার জন্য বাবা রাজপুত্র পাঠাইয়াছেন’।


থর থর করে ভেতর টা কেঁপে উঠলো সুপ্তির। মালবিকাও তার মত রাজপুত্র দেখেছিল। তবে তার রাজপুত্রের নাম কুমার বীরেন্দ্র; ইভান নয়। সুপ্তি বুঝলো, ইভান যথেষ্ট আধুনিক নাম। যুগে যুগে ডাইনী রাজপুত্রের নাম বদলায়।

ইভান নামে কেউ নেই, ইভান একটা মায়া। সুপ্তি ফুঁপিয়ে উঠলো। ইভানের বেশ ধরে ডাইনী তার রক্ত নিয়ে হয়েছে শক্তিশালী। সে প্রতারিত; যেমনটি হয়েছিল বেচারী মালবিকা। সুপ্তি কান্না সামলাতে সামলাতে পড়ে চললো।

এর পর শুধুই ভালোবাসার গল্প; শুধুই রাজপুত্রের গল্প। সুপ্তির দুই গাল বেয়ে পানি ঝরতে লাগলো।
বেশ কয়টি পৃষ্ঠা ঝরে গেছে। এর পরের পাতায় দুই তিনটা লাইন কোনক্রমে পড়া যায়। তাতে লেখা,
“আমার রাজপুত্রকে ডাইনী ধরিয়া লইয়া গিয়াছে।

ডাইনী আমার মাঝে বসবাস করিতেছে। হায় ভগবান, আমি কি করিব?”
পরের পৃষ্ঠাগুলো মর্মান্তিক। ডাইনী রুপী মালবিকা নিজের বাবাসহ আরো অনেককে হত্যা করে রক্ত খেয়েছে, পুরো এলাকা জুড়ে ছড়িয়েছে এক অজানা আতঙ্ক। তীব্র অনুশোচনায় মালবিকা পাগল প্রায়। সে ঘুমায় না, ঘুমাতে চায় না।

কিন্তু তারপরো ঘুমিয়ে পড়ে।
সুপ্তি থর থর করে কাঁপতে থাকে। যদি আজিনাহা আজ রাতে তার আম্মু আব্বুকে মারে? অথবা সুকন্যাকে? না
সুপ্তি রান্নাঘরে গিয়ে যত কাগজের প্যাকেট পেলো সব নিয়ে তার রুমে জড়ো করলো। ছোট একটা নড়বড়ে কাঠের টুল ছিল, তাও নিয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।