বাংলায় কথা বলি,বাংলায় লিখন লিখি, বাংলায় চিন্তা করি, বাংলায় স্বপ্ন দেখি। আমার অস্তিত্ব জুড়ে বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ।
উত্তরণের দিন।
আজ সকাল থেকেই মনটা বড় উদাস আবেদ আলীর। তাল বেতাল নানান ভাবনা এসে বার বার ভর করছে তার মনে।
একটা তুচ্ছ বিষয় নিয়ে এখন ভাবছে সে। বিষয়টা তুচ্ছ মনে হলেও তার কাছে মনে হচ্ছে বিরাট একটি ব্যাপার।
বিষয়টি আসলেই খুব সামান্য। তাদের বাড়ির সামনে আজ থেকে কয়েক বছর আগেও ছিল বিশাল ফাঁকা এক মাঠ। এখন সেখানে পরপর অনেকগুলো ঘর ওঠেছে।
বাড়ির পর বাড়ি। কোন কোন বাড়ির আবার দেয়াল পাকা। বারান্দার সামনে বসার ব্যবস্থা। রং দিয়ে নানা রকম নকসা করা। দেখতে ভাল লাগে।
সারা দিন মানুষের হই হল্লা। ছোট ছোট বাচ্চাদের কান্নাকাকটি। নিরিবিলি পরিবেশটা কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আগের দিনের সেই পরিবেশ আর খুঁজে পায় না আবেদ আলী। অথচ আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে নতুন চর দেখে এখানে জায়গা কিনে বউ-বাচচা নিয়ে সংসার গড়েছিল আবেদ আলী।
সেই সময় সাঝবেলা হলেও কেমন যেন ভয় ভয় লাগত। কেরোসিনের কুপি বাতি জ্বালিয়ে কোন রকমে ভাত-টাত খেয়ে দে’ ঘুম। মাঝে মাঝে শেয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক শোনা যেত। ভোর রাতে অনেক দূরের জয়পাগড়া বাজারের মসজিদ থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসত। ব্যাটারী চালিত একটা মাইক আছে সেখানে।
আশে-পাশের দু’চার গ্রামের ঘুমন্ত মানুষদেরকে ডেকে জাগিয়ে তুলত আজানের সুর।
নতুন চর মানে নতুন মাটি। নতুন ফসল। নতুন জীবন। চারি দিকে ফসলের মৌ মৌ গন্ধ।
ফসলের সাথে বসবাস করতে করতে কেটে গেল চল্লিশটি বছর। যৌবন কালে এই চরে এসে ঘর বেধে আজ বুড়ো হয়ে অবাক হয়ে পৃথিবীকে দেখছে সে। মনে আছেঃ আে পাশের কোন গ্রামে রেডিও ছিল না। রেডিও শুনতে যেতে হত অনেক দূরে—বাজার যেখানে সেই জয়পাড়ায়। জয়পাড়ার বেশ কয়েকটি দোকানে তখন রেডিও ছিল।
অনেক দূরের মানুষ এসে রেডিও শুনত। গণেশ সাহার দোকানের রেডিওটা ছিল ৩ ব্যান্ডের। বিবিসি বাংলার অনুষ্ঠান শুনা যেত তাতে।
মনে আছে ১৯৭১ সালের ( এখানে বাংলা সালটা দিতে পারলে বেশী ভাল হবে)। সন্ধ্যায় গণেশের দোকানের সামনে সে যে কি ভিড়।
ঢাকায় শেখ সাহেব কি এক বিরাট সমাবেশ করেছেন। তাতে নাকি তিনি এক জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়েছেন। সেই খবর শোনার জন্য সবাই্ ভিড় করছে। সন্ধ্যায় সাড়ে সাতটায় এক বিশেষ খবর শোনা গেল। শেখ সাহেবের কন্ঠস্বরও শোনা গেল।
বজ্রকণ্ঠে তিনি বলছেনঃ “এবারের সংগ্র্মা আমাদের মুক্তির সংগ্রাম – এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। সমবেত জনতা যে অস্থির হয়ে উঠেছে। তাদের সম্মিলিত গর্জন ভেসে আসেছিল ইথারের।
আবেদ আলীর বন্ধু ফখরুদ্দিন স্থানীয় হাইস্কুলের মাস্টার। স্কুলটি ভাল।
অনেক ছাত্রছাত্রী। ২০ বছর মাস্টারী করে তারপর এমপিও পেয়েছেন ফখরুদ্দিন মাস্টার। আবেদ আলীর বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
ঃ ও মাস্টার, কই য্ওা। বাড়িতে আস।
বিরাট আলাপ আছে তোমার সাথে।
মাস্টার বয়সে তার চেয়ে সামান্য ছোটই হবে। মাস্টারকে তার কাছে খুব জ্ঞানী মনে হয়। দেশ বিদেশের অনেক খবর তার কাছে পাওয়া যায়। ইতিহাস, ধর্ম এই সব বিষয়েও তার অনেক জানাশোনা ।
তার সাথে কথা বললে আবদ আলীর খুব ভাল লাগে।
ঃ এখন আসতে পারব না ভাই। স্কুলে যাচ্ছি। পরীা চলছে। সন্ধ্যায় আসব।
তখন শুনব তোমার কথা।
সন্ধ্যা বেলায় মাস্টার ঠিকই এসে হাজির। উঠানে খেজুর পাতার পাটি বিছিয়ে বসেন তারা। আবেদ আলীর স্ত্রী আলেফা বিবি তাদের কনিষ্ঠ সন্তান ফজলুও আছে।
ঃ একটা বিষয় নিয়ে খুব চিন্তায় আছি মাস্টার।
আমাদের আশে পাশের ফাকা জাযগা তো সব ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতো মানুষ এলো কোথা থেকে?
ঃ আবেদ ভাই, তুমি তো দেখি কোন খবরই রাখ না। বাংলাদেশে মানুষ বাড়ছে বানের পানির মতো হু হু করে। অথচ আমাদের দেশটা তো অনেক ছোট্ট। পাশের দেশ ইন্ডিয়া-- সেটাকে ভাঙ্গলে বাংলাদেশের মতো ৫০টা দেশ হতে পারে।
এই ছোট দেশে কত বেশী মানুষ। এখনো সেখানে হাজার হাজার একর জমি অনবাদী। আর আমাদের তো জমি নেই বললেই চলে।
ঃ তোমার এই কথাটি অতি খাটি। দিনে দিনে জমি কমছে।
মানুষ আগামীতে চাষ করবে কোথায়? খাবে কি?
ঃ তোমারে একটা কথা বলি। কোরান-হাদিসের কথা। হজরত আদম (আঃ) যখন পৃথিবীতে এলেন তিনি তো দারণ অবাক। এতো বড় দুনিয়া আর এতো জমি। এ সব জমি চাষ করবে কে? আর এখন মানুষের জমি নেই।
হাজার হাজার মানুষ ভূমিহীন। জমি নেই অথচ কৃষক। এক টুকরা জমির জন্য মারামারি- এমন কি খুন খারাবী পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে।
বলে মাস্টার থামেন। আবেদ আলী চুপ করে থাকেন।
একটা বিষয় তার মাথায ঢুকে না। এই যে জমি জমা কমে যাচ্ছে তারপরও তো মানুষের খাবার সংকট আর আগের মতো নেই। বাজারে গেলে ঠিকই খাবার পাওয়া যাচ্ছে। যদিও বেশীর ভাগ জিনিসেই আজকাল বড় বেশী ভেজাল। খাটি জিনিস আজ-কাল আর কিনতে পাওয়া যায় না।
বর্তমান জমানায় মানুষ গুলো বড্ড বেশী শয়তানী শিখে গেছে।
ঃ আচ্ছ মাস্টার, মানুষ এতো টাকা কোথায় পায় বলতে পার।
ঃ আছে আছে। টাকার উৎস আছে। এখন তো কিছু মানুষ আছে ভাল।
কিছু আছে খারাপ। ভাল মানুষ যারা আছে তারা দেশে তেমন কোন কাজকর্ম পায় না। কেউ চলে যায় আরব দেশে। যারা একটু চালাক-চতুর তারা যায় ইউরোপ। সেখানে বেশীর ভাগই কামলা খাটে।
গাধার মতো খাটুনী। ওই সব দেশে কামলা খাটলেও অনেক টাকা মজুরী দেয়। সেই টাকা তারা জমিয়ে দেশে পাঠায়। তাই তো বাজারে জিনিসপত্রের মেলা দাম হলেও হুরহুর করে সব বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
ঃ যারা বিদেশে যারা যায় তারা না হয় গাধার খাটুনী খেটে টাকা আনে।
কিন্তু যারা দেশে থাকে তাদের অনেককেই তো দেখি খুব টাকার মালিক। তারা টাকা পায় কই?
ঃ যারা দেশে থেকে টাকা কামায় তারা করে রাজনীতি। বর্তমান সময়ের সব চেয়ে বড় ব্যবসা হলো রাজনীতি। এমন একটা সময় ছিল যখন ভদ্রলোক রাজনীতি করত মানুষকে সেবা করার জন্য। এখন সব চেয়ে টাউট যারা তারাই রাজনীতি করে টাকা কামানোর জন্য।
ঃ তোমার এই জটিল কথাটি বুঝললাম না মাস্টার।
ঃ বুঝিয়ে দিলেই তুমি বুঝবে। তোমার মাথা ভাল। তুমি পড়াশোনাটা না ছাড়লে এখন কলেজের মাস্টার থাকতে। ঠিক আছে ।
আজ তো অনেক রাত হলো। আরেকদিন না হয় বলব।
মাস্টার চলে যায়। আবেদ আলী আর তার পরিবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আবেদ আলী স্বপ্ন দেখে।
অজানা রাজ্যে হারিয়ে যায় সে।
পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমি জিরাত ভাগ হয়ে গেলে আগামীর মানুষগুলো কি ভাবে চলবে। জমি না থাকলে মানুষের খাবার আসবে কই থেকে। পেটের চাহিদা না মিটলে পৃথিবীর সবই অর্থহীন মনে হবে।
আজ-কাল বিল-ঝিলে একটুকরো জায়গা মানুষ কিনছে লাখ লাখ টাকা খরচ করে।
তারপর সেই জমিতে বালি ফেলে উচু করছে। সেইখানে বানাচ্ছে ঘর। ফসল ফলানোর চিন্তা এখন কেউ করে না। আগে চাই থাকার ঘর। চাল-ডাল তো বাজারে কিনতে পাওয়া যায়।
থাকার ঘর পাওয়া যায় না। হোটেল যদিওবা আছে তা ব্যয়বহুল। বাড়ির চাহিদা কি আর হোটেলে মেটাতে পারবে?
শেষ রাতে আবেদ আলী এক ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে। দেখে তার বাড়িটি একটি বিরাট নদীর মাঝে। সব কিছু টুকরা টুকরা হয়ে যাচ্ছে।
এক সময় ঘরগুলোও মূল ভিটে থেকে আলাদা হয়ে ভেসে গেল। আবেদ আলী হারিয়ে যাচ্ছে। সে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। ঘামছে সে।
টেনশন কাটানোর ভাল উপায় হচ্ছে মস্তিস্ককে বিশ্রাম দেয়া। এই কাজটা । ভাল হয় আরামসে একটা ঘুম দিতে পারলে। বড় একটা ঘুম থেকে উঠলে শরীরের সব টেনশন দূর হয়ে যাবে। ঘুমের চেয়ে ভাল কোন চিকিৎসা নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।