আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পানের পাচালি

একজন ভীরু মানুষ...

এক মহিলা এক সাধুবাবার কাছে গেলেন তার সমস্যা নিয়েঃ

মহিলা: বাবা, আমার স্বামী ঘরে এসেই আমাকে মারধোর শুরু করে দেয়

সাধু বাবা অনেক ভেবে চিন্তে মহিলাকে এক বাটা ভর্তি পান পড়া দিলেন আর বললেন, সে যখনই বাসায় আসবে তখনই এই “পান পড়াটা” তোর মুখে পুরে চাবাতে থাকবি !
.
.
পাঁচ দিন পর
.
.
মহিলা: বাবাজী আপনি মহান, পান পড়া খাবার পর এত ফায়দা হয়েছে যে সে এখন আমাকে মারধোর করে না বরং ভালবেসে রোজ গাদিগাদি পান কিনে আনে।
সাধু বাবা: মাগো, এটা পান পড়ার ফল না, এটা তোর মুখ বন্ধ রাখার ফল।

‘পান’ জিনিসটাই এমন যা আমাদের বেশ কিছু আরামদায়ক অনুভূতির উদ্রেক করে, তা সেটা মুখেই হোক আর কানে। কিন্তু বহুমুখী গুণ সমৃদ্ধ এই পান আমাদের সমাজের কিছু কিছু অংশে অছূত খাদ্য, যা শুধু অশিক্ষিত নিম্নশ্রেণীর মানুষদের মানায়। পানের প্রতি আমার এক বিশেষ দূর্বলতা আছে, যা অনেকের কাছেই অস্বাভাবিক ও অগ্রহণযোগ্য।

আমি অবসরে পান খেতে ভালবাসি, কথাটা অদ্ভুত হলেও সত্য এবং ভালবাসার কারণটিও যথা সময়ে জানাবো। এমন খুব কম এলাকায় আছে যেখানে আমি বেশ কিছুটা সময় কাটিয়েছি আর সেই এলাকার সবচেয়ে ভাল পান দোকানির সাথে আমার পরিচয় নেই আর সেই পানপ্রীতি থেকেই আজ আমি পানের পাচালি লিখব।


পানের ইংরেজী শব্দ Betel Leaf যা পর্তূগীজ শব্দ Bétele থেকে এসেছে যা কিনা আবার মালাইলাম শব্দ Vettila(ভেট্টিলা)’র ভাঙ্গাচোরা রুপ। আর বাংলা অভিধানে ‘পান’ শব্দের অর্থ তাম্বূল, মশলা-সহযোগে চিবানো হয় এমন ঝাঁঝালো পাতাবিশেষ যা এসেছে সংস্কৃত শব্দ ‘পর্ণা’ থেকে; আর সংস্কৃতে পর্ণা শব্দের অর্থ পাখির পালকের মতো সুন্দর পাতা। প্রধানত পান-কে এশিয়া বা আরো ভালো করে বললে দক্ষিণ এশিয়ার নিজস্ব জিনিস বলা যায়।

তবে অন্যসব বিখ্যাত জিনিসের মতই পানের জন্ম আর ব্যবহারের ইতিহাস নিয়ে আছে নানা মুনির নানা মত। আধুনিক আর্কিওলজির মতে খ্রীষ্টপূর্ব ৫০৪ শতাব্দীতে পালি ভাষার এক পঞ্জিকাতেও পানের রসবন্দনা করা হয়েছে। মার্কো পোলো ১৩’শ শতাব্দীতে এশিয়ার উৎসব ঘিরে পান ও সুপারির ব্যবহারের কথা বলেছেন। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, চায়না –তে পান বেশ সুপরিচিত। তবে ভারতবর্ষের রাজা-বাদশাদের পানপ্রীতিতো সব কিছুকে ছাড়িয়ে এক ধাপ এগিয়ে।

তার একটা ছোট্ট উদাহরণ এই যে, মমতাজ মহল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আসল মা (!) কিনা সে নিয়ে সন্দেহ থাকলেও তিনি সন্দেহাতীতভাবে মুঘল সম্রাজে পানের ব্রান্ড অ্যাম্বাস্যাডার ছিলেন । পানের সবচেয়ে সুন্দরী রিপ্রেজেন্টেটিভ বোধহয় ‘সোনাভান’ খ্যাত বাংলা সংগীতের রুপকথা তুল্য অপরূপা সুকন্ঠী এক নারী; কথিত আছে তার ত্বক এতটাই কোমল ছিল যে যখন তিনি পান খেতেন তখন তার গলায় পানের রসের আবির দেখা যেত।
পৃথিবীতে ১০০টির বেশি জাতের পান শনাক্ত করা হয়েছে । আমাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের পানের জাত রয়েছে। এ জাত এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন নামে পরিচিত।

এ জাতগুলোয় পাতার আকার, আকৃতি, বর্ণ, স্বাদ, গন্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন দিক থেকে পার্থক্য বিদ্যমান। অবশ্য একই জাতের পান বিভিন্ন আবহাওয়ায় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হতে পারে। অপেক্ষাকৃত অনুকূল আবহাওয়ায় পান পাতার আকার বড় হয়, পাতা নরম হয় এবং ঝাঁজযুক্ত হয়ে থাকে। পান যেমন রসযুক্ত একটা খাদ্য এর নাম গুলোও তেমনি রসস্থ, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় উৎপন্ন উল্লেখযোগ্য কিছু পানের জাত হলোঃ
চালতা গোটা : বরিশাল অঞ্চলে এ জাতের ব্যাপক চাষ হয়। এটি জলাবদ্ধতা ও রোগবালাই সহনশীল।

পানের আকার বড়, ডিম্বাকৃতি, পাতলা, শীর্ষভাগ সুচালো, সবুজ বর্ণ, পাতার ভেতরের দিকটা মসৃণ, বোঁটা ছোট এবং পাতা কিছুটা ঝাঁজাল। আমার ভালো লাগেনি এই পানটা, বাজেই বলা যায়।
মহানলি : পানের এ জাতটি বরিশালে অনেক জনপ্রিয়। পাতা কিছুটা লম্বা, বোঁটা বড়, বর্ণ গাঢ় সবুজ এবং ঝাঁজ কম।
চেরফুলি : এটিও বরিশাল অঞ্চলের একটি উল্লেখযোগ্য জাত।

পাতা বড় ও পাতলা, ডিম্বাকৃতি, পাতার শীর্ষ সুচালো, ভেতরের পৃষ্ঠ মসৃণ, বোঁটা খাটো এবং স্বাদ ঝাঁজাল। বিশাল সাইজের পান এটা, দেখলে অবাক হতেই পারেন।
মিঠা পান : এ জাতটি প্রধানত চট্টগ্রাম ও মহেশখালী অঞ্চলে হয়। এটির স্বাদ খুবই ভালো বলে বাজারে এর খুব চাহিদা আছে। একবার এই পান খাইলে পানের প্রেমে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় বহুগুণ।


সাচি পান : এ জাতটি মহেশখালী অঞ্চলে অতি জনপ্রিয়। এ পানে বিশেষ স্বাদ ও সুগন্ধ বিদ্যমান বলে মানুষের কাছে এর বিশেষ চাহিদা রয়েছে। পাকিস্তানে এ পান বেশি রফতানি হতো। এ জাতের পান তোলার পর বেশি সময় সংরক্ষণ করা যায়। আমার পছন্দের তালিকায় বিশেষস্থানে আছে।


গাছ পান : উখিয়া, টেকনাফ এবং সিলেটের সমতল ভূমিতে এবং পাহাড়ের ঢালে এ পানের চাষ হয়ে থাকে। বিভিন্ন গাছে উঠিয়ে দিলেও ভালো ফলন হয় বলে এরূপ নামকরণ হয়েছে। এ পানের স্বাদ বেশ ঝাঁজাল। এর নাম আমি দিয়েছি ছাগু পান, চিবাইলে কাঁঠাল পাতার মত লাগে।

বাংলা পান : এ জাতটি রাজশাহী অঞ্চলের একটি উল্লেখযোগ্য জাত।

এ অঞ্চলের শতকরা ৯০ ভাগ এলাকায় এ জাতের চাষ করা হয়। নামের মতই ভালো জিনিস।
মিষ্টি পান : যশোরের বিভিন্ন এলাকায় এ পান জন্মে। এ পানে ঝাঁজ একেবারেই নেই। খুব কম পাওয়া যায়, তবে পাইলে অবশ্যই স্বাদ গ্রহণ বাঞ্ছনীয়, আজকাল আমাদের রাজশাহী অঞ্চলেও হয়।


ভাবনা : যশোরের কালীগঞ্জ এলাকায় প্রচুর চাষ হয়। খাইনি কখনো।
ভোলা পান : ভোলায় চাষ হয়। খুব একটা বলার মতো কিছু নাই।
ঝাল পান : যশোর অঞ্চলে চাষ করা হয়।

খাইনি কখনো।
ভাওলা : ময়মনসিংহ এলাকায় চাষ হয়ে থাকে এ পান। এটাও খাইনি কখনো।
রংপুরী পান : রংপুর অঞ্চলে এ জাতের চাষ হয়। এই পানটা বেশিষ্ট্যহীন ম্যারম্যারে টাইপের একটা পান।


সন্তোষি : নবাবগঞ্জ এলাকায় চাষ হয়ে থাকে। হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চাপাচাপি করার পর অবাক হয়ে দেখবেন কাঁচা পাতা কেমন গুড়োগুড়ো হয়ে গেছে।
পানের জাত বেজাত সংক্রান্ত জ্ঞানদান এখানেই শেষ।


পান আমাদের দেশের সমাজ সংস্কৃতির সাথে ভীষণভাবে জড়িত। সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে সে হোক মুসলিম বা হিন্দু বিয়ে, হোক পান-চিনি বা শুভদৃষ্টি পান লাগবেই।

অতিথি সৎকারে পান বাঞ্ছনীয়, অনেক অস্বাভাবিক কেতাদুরস্ত মানুষকেও দাওয়াত খেয়ে ‘আরে পানের খিলি কোথায়’ বলতে শুনেছি। রংপুর অঞ্চলের কোন বাড়িতে গেলে আপনি তাদের কাছে কতটুকু সন্মান পাবার যোগ্য তা টের পাবেন পান সুপারির বহর দেখে। অনেক ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান-এ পানের গুরুত্ব অপরিসীম বিশেষত বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মে। আমার পর্যবেক্ষণ বলে সব অঞ্চলেই একটা বিখ্যাত চা আর সাথে নাম করা পানের দোকান থাকে। এদের কেউ কেউ আবার বংশ পরমপরায় পান বানিয়ে বিখ্যাত।

অনেকেই পান ও সিগারেট কে সমপর্যায়ের ভাবেন, কিন্তু একটু ভাবুন তো সিগারেটের মতো দূর্গদ্ধযুক্ত, অন্যের বিরক্ত উৎপাদনকারী, সরাসরি অন্যের ক্ষতিকারী একটা বস্তু সুগন্ধযুক্ত রস সৃষ্টিকারী একটা রসিক বস্তুর ভাই ব্যারাদার হতে পারে।

এবার আসি আমি কেন পান খাই সে কথায়। আমার পান খাওয়া নিয়ে নানাজনের নানান বক্তব্য আছে, পানের উপকারিতা অপকারিতা নানান দিক আছে সেসব হটিয়ে শুধু নিজের কথাটাই বলবো এখন। সত্যি কথা বলতে আমি আমার মতো করে একটু সময় পেতে পান খায়, সমাজের অসহ্য একটা অংশকে বুড়ো আঙ্গুল দেখাতে পান খাই। সারাটা দিন কাটায় অসহ্য মেকি একটা কর্পোরেট কারাগারে যেখানে অসহ্য বাজে ধরনের কিছু মানুষ তাদের নোংরা মনের খায়েশগুলো চরিতার্থ করার জন্য সবকিছু করে, দলভারি করতে আমাকেও টানতে চাই তাদের দলে, সেই নোংরা মানুষগুলোর থেকে দূরে বহুদূরে থাকতে ইচ্ছে করে কিন্তু পেটের দায়ে পারিনা তাই তাদের তথা কথিত সভ্য সমাজে গর্হিত পান খাওয়াকে নিজের বিদ্রোহের নীরব অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছি।

অফিস থেকে বের হয়ে একটা পান কিনে যখন মুখে দেই তখন অ্যাবসার্ড থিয়েটারের জু’ষ্টোরির কথা মনে পড়ে, বুদ্ধদেব গুহের মাধুকরির কথা মনে পড়ে তারপর ঐ কর্পোরেট পিশাকচের মুখগুলো ভেবে যখন পানের পিক ফেলি তখন ভীষণ শান্তি শান্তি অনুভব করি নিজের ভেতরে আর সাথে পানের রসের জাদুকরি গুণটা তো আছেই।

নিজের প্যাঁচাল শেষে পানের প্যাচালি শেষ করবো পানের গুণাবলি দিয়ে। পান একপ্রকার চর্ব্য গোত্রের খাবার। একে চিবাতে হয় আর চিবানোর পরে যে রস পাওয়া যায় তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সুপেয় হয়ে থাকে, তাই পান খাওয়া না বলে পানকে পান করা হয় বলাটাই শ্রেয়। পান –এর সাথে তামাক জাতীয় দ্রব্য মিশ্রিত হলে তা অন্যসব তামাকজাত দ্রব্যের মতই ক্ষতিকর কিন্তু তামাকবিহীন পানের গুণের-ও কিন্তু অভাব নেই।

পানে আছে ২১ টি পুষ্টিগুণ, যার ভেতর প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি ও সি বিদ্যমান। পানের ঔষধি গুণ রয়েছে। পানে আছে ক্যালসিয়াম ও ক্লোরফিল, যা হাড় এবং দাঁতের জন্য খুবই উপকারী। পান পাতায় প্রয়োজনীয় তেল অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিপ্রোটোজুয়ান এবং অ্যান্টিফানজাল গুণাগুণ বিদ্যমান আছে। পান পাতার রস হজমে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

স্নায়ুবিক দুর্বলতা দূর করতে পারে। এক্ষেত্রে পান পাতার রস এক চা চামচ মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খেলে টনিকের মতো কাজ করে। ক্ষতস্থানে কয়েকটি পানের রস দিয়ে পানপাতা দিয়ে বেঁধে রাখলে দুই দিনের মধ্যে উপশম হয়। পান শরীরের বলবর্ধক ও উত্তেজক হিসেবে কাজ করে থাকে। তবে পান খেতে হবে পানের মত করে।

সব কিছুর মত পান খাবারও একটা নিয়ম আছে। পানের অপর এক বাংলা নাম সপ্তশির কারণ পান পাতায় ৭টা শিরা থাকে, পান বানানোর সময় পানের মধ্যশিরটা বাদ দিতে হয় নতুবা পানে ঝালভাব আসে আর ঠিক আগার ছুঁচালো অংশটি বাদ দিতে হয় নতুবা পানের আসল রঙটা আসে না (পরীক্ষিত)। এবার পান খাবার সময় প্রথম পিকটা অতি অবশ্যই ফেলে দিতে হবে; কথিত আছে প্রথম পিক বিষ দ্বিতীয় পিক মধু আর তৃতীয় পিক অমৃত। নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে পান খেলে পানের উপকারিতা আশা করতেই পারেন।





অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.