আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৌলবাদের ইতিহাস

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।

মৌলবাদ বাংলাদেশের ইতিহাসের বাইরে অবস্থান নিয়েছে। এই অবস্থানের সঙ্গে বাংলাদেশ যে রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া থেকে উৎসারিত এবং ধনতান্ত্রিক ঔপনিবেশিক সব উন্নয়নের ফল, তার সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশ ব্রিটিশ আমল থেকে এবং পাকিস্তান আমল থেকে একটি বিশেষ ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ফর্ম তৈরি করেছে। এই ফর্মটি ব্রিটিশ (এবং ইউরোপিয়ান) কলোনির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে এবং একই সঙ্গে একটি জাতির ডি-কলোনাইজিং প্রক্রিয়ার ইতিহাস স্পষ্ট করেছে।

সেজন্য বাংলাদেশের ইতিহাস ব্রিটিশ আমল এবং পাকিস্তান আমল থেকে ঔপনিবেশিকতার ফাউন্ডেশনাল টেকসই। এই ইতিহাসের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়েছে ডিপেনডেনসি তত্ত্ব, নব্য-ঔপনিবেশিকতার ক্রিটিক, রাষ্ট্র গঠনের সমস্যা, বিভিন্ন অঞ্চলের নিয়তি এবং বিভিন্ন অঞ্চলভুক্ত ধর্মের প্রভাব। এভাবেই ইউরোপিয়ান আধুনিকতার মধ্যে বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে।
মৌলবাদ এই সবকিছু প্রত্যাখ্যান করেছে; বাংলাদেশের ইতিহাসকে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের রাষ্ট্র গঠনের লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত করেছে এবং একই সঙ্গে মধ্য এশিয়ার মুসলমানদের জাতীয়তাবাদী লড়াইয়ের অন্তর্গত করেছে। সেজন্য এই দুই ইতিহাস গঠন ও রাষ্ট্র গঠন পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে।

এই অবস্থানের দরুন মৌলবাদ বাংলাদেশের নি-এলিট ইতিহাসের উৎসারণ, কৃষক আন্দোলনের, ইতিহাস, স্থানীয় ইতিহাস, শ্রেণী ও কলোনাইজেশনের জটিলতা, নারীবাদী ইতিহাস এবং নারীবাদী আন্দোলন তাদের ইতিহাস থেকে বাদ দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ইতিহাসের পোস্ট-কলোনিয়াল স্ট্যাটাস বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী এন্টি-কলোনিয়াল লড়াই থেকে উদ্ভূত, যেখানে একত্র ও মিশ্রিত মডার্নিটি ও নন-মডার্নিটির বিভিন্ন উপাদান।
মৌলবাদ এ সব বিভিন্ন উপাদান থেকে একটি উপাদান গ্রহণ করেছে। সেটি হচ্ছে ধর্ম, একটি এথনিক জাতিগোষ্ঠীর ক্রিয়াকলাপ : মুসলমান। এভাবে রাষ্ট্র গঠনের আখ্যানে একটি ধর্ম ও একটি জাতিকে বড় করেছে মৌলবাদ।

তার লড়াই আধুনিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, আধুনিক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে, বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির বিরুদ্ধে। এই লড়াইয়ের একদিকে আছে প্রবল জাতীয়তাবাদী মডার্র্নিটি, অন্যদিকে আছে ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদী আখ্যান। মৌলবাদ সচেষ্ট এই ইসলামী সাম্রাজ্যবাদী আখ্যানের ভেতরে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক ফর্ম এবং ভিন্নতাভিত্তিক এথনিক এক্সক্লুসিভিজম ঢুকিয়ে দিতে, নাগরিকত্বের মধ্যে প্রোথিত সমতার কনসেপ্ট উধাও করে দিতে।
মডার্নিটি ও রাষ্ট্র গঠনের অবস্থান থেকে ইসলামিক ঐতিহ্য ও সেক্টারিয়ানিজমের দূরত্ব অনেক দূর। মৌলবাদের ন্যারোটিভ কাঠামো এবং জাতীয়তাবাদের ন্যারোটিভ কাঠামো একেবারে ভিন্ন।

তার দরুন মৌলবাদ অন্য সমাজ গ্রুপ, অন্য ধর্মজ গ্রুপকে অনবরত সম্পর্কের মাধ্যমে অধস্তন করেছে, যুক্তিপূর্ব এবং আদিম স্ট্যাটাসকে ঠেলে দিয়েছে, মডার্নিটির এজেন্ট থেকে বহিষ্কার করেছে। আমরা যখন কৃষকদের লড়াই, নারীবাদী ইতিহাস কিংবা নন-এলিট সাংস্কৃতিক ফর্মের কথা বলি, তখন মৌলবাদীরা আল্লাহর আইন কিংবা বেহেশতি সওগাত কিংবা মানুষের তৈরি আইনের নিকৃষ্টতা প্রমাণে সচেষ্ট হয়ে ওঠে।
অধস্তনতার ভিত্তি সাম্প্রতিক মৌলবাদের মধ্যে ক্রিয়াশীল প্রবলতার ধারণা। এই ধারণা হচ্ছে ক্ষমতার সম্পর্ক। সেজন্য মৌলবাদের মধ্যে একটা সশস্ত্রতার এ্যাসার্সশন আছে।

সে কারণে সশস্ত্রতা চেতনার মধ্যে ছড়িয়ে যায়। যেমন পুরুষের এ্যাসার্সশন এবং নারীদের অধস্তনতা। এই অধস্তনতা ডিসকার্সিভ সম্পর্কের মধ্যে ক্রিয়াশীল। মৌলবাদের মধ্যে পুরুষ ও নারীবিরোধী টার্ম; মাওলানা ও মুসল্লিবিরোধী টার্ম, ধর্মজ এলিট ও অনুসারীবিরোধী টার্ম। এভাবে উন্মোচিত ক্ষমতার সাম্পর্কিত দিক।

ক্ষমতা ও ক্ষমতার সম্পর্ক বাদ দিয়ে মৌলবাদী মতাদর্শের কাছে পৌঁছানো যায় না।
বাংলাদেশের মৌলবাদ ইসলামের দূরবর্তী অঞ্চল, এই অঞ্চলটি ধারাবাহিকভাবে ইসলামিক ধর্মজ সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হয়েছে : সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবেও কলোনি হিসেবে। বাংলাদেশ ও অন্য ইসলামিক দেশসমূহের সম্পর্কের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ উন্মোচিত করেছে ধনতান্ত্রিক কলোনিয়াল অব-উন্নয়ন। আবার রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ার দিক থেকে বাংলাদেশে উন্মোচিত হয়েছে অভ্যন্তরীণ কলোনিয়ালিজমের ধারা : মৌলবাদ এই ধারার মধ্যে সমাজ গঠন ও রাষ্ট্র গঠনের অভ্যন্তরীণ কলোনিয়ালিজমকে শক্তিশালী করেছে। মৌলবাদ সমাজ গঠন ও রাষ্ট্র গঠনের দিক থেকে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার ও মধ্য এশিয়ার রাজনীতির মধ্যে লুপ্ত করার চেষ্টা করেছে।

এই চেষ্টা থেকে উদ্ভূত হয়েছে হিন্দু ভারতের সঙ্গে মুসলমান বাংলাদেশের সম্পর্ক, বৌদ্ধ মিয়ানমারের সঙ্গে মুসলমান বাংলাদেশের সম্পর্ক। মৌলবাদ এসব সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক সঙ্গে ধনতান্ত্রিক কলোনিয়ালিজম ব্যবহার করেছে।
রাষ্ট্র দখলের ইতিহাস প্রণয়ন করে চলেছে জামায়াত, হেফাজত ও বিএনপি; এই প্রণয়নের বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছে অন্যধারা : থম্পসন ও হবসথমের নিজের থেকে ইতিহাস তৈরির ধারা, এক পক্ষে হিস্ট্রি ওয়ার্কশপের মধ্যে জার্নাল এবং অন্য পক্ষে ফরাসীদের প্রাত্যহিক ও স্থানিক ইতিহাস তৈরির ধারা মৌলবাদের বিরুদ্ধে একাডেমিক ও ইনটেলেকচুয়াল লড়াই করে চলেছে। মৌলবাদীদের রাষ্ট্র দখলের ইতিহাসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ইতিহাস নির্মিত হচ্ছে। এ সব ইতিহাস হচ্ছে নারী মুক্তির ইতিহাস, কৃষক মুক্তির ইতিহাস, শ্রমিক মুক্তির ইতিহাস, আদিবাসীদের মুক্তির ইতিহাস।

এ সব ইতিহাস মৌলবাদীদের ইতিহাস নির্মাণকে পরাভূত করেছে এবং একই সঙ্গে বিভিন্ন মুক্তির ইতিহাসকে শক্তিশালী করছে। আমাদের যাত্রা মানব মুক্তির দিকে। লেখক: শিক্ষাবিদ ও গবেষক

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.