আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মৌলবাদের মূলকথা এবং বাংলাদেশের পরিণতি

যুদ্ধংদেহী ধর্মপ্রীতির নাম ধর্মীয় মৌলবাদ। এ মৌলবাদ ধর্মনানুসারীদেরকে ঠেলে দেয় আদর্শিক সংঘাতের দিকে। পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলোর লালনপালনকারীদের মধ্যে মৌলবাদের সুস্পষ্ট অস্তিত্ব বিদ্যমান। সব ধর্মের মৌলবাদীরা আধ্যাত্মিকভাবে সংগ্রামী চেতনায় সদা-সর্বদা প্রস্তুত। এজন্য ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসীদের সাথে মৌলবাদীদের দ্বন্ধ চিরন্তন।

মৌলবাদীরা আদর্শগত সংগ্রামকে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির লড়াই বলে ভাবে। কথিত অশুভ শক্তির কাছে নিজেদের অস্তিত্ব জোরদার করার প্রয়াশ প্রতিনিয়ত তাদেরকে তাড়িত করে চলে। ফলে প্রায়শ তারা সমাজের মূলধারা থেকে বেরিয়ে এসে বিকল্প চেতনার উদ্ভব ঘটায়। মৌলবাদী চেতনায় বিশ্বসীগণের জন্য তারা নতুন মতবাদের সূচনা করে থাকে যাতে তুলে ধরা হয় মৌলবাদী কর্মপরিকল্পনা। তারা ধর্মীয় কেচ্ছাকাহিনী বা পৌরাণিক কাহিনীকে স্রষ্টার কর্ম বলে প্রতিষ্ষ্ঠত করতে তৎপর থাকে।

এই উদ্দেশ্যে জটিল সব কল্পকাহিনীকে সর্বজনোপযোগী আদর্শ হিসেবে গড়ে তুলতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। এসব মতাদর্শ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হলে তারা সংক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। শুরু হয় প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও জঙ্গি তৎপরতা। উল্লিখিত কথাগুলো সকল ধর্মের মৌলবাদীদের বেলায় প্রযোজ্য। তবে ইসলামী মৌলবাদে উগ্রতা অধিক।

ইসলাম ধর্মের উদারনৈতিক-মানবিক ধারার বিপরীতে গড়ে ওঠা পশ্চাৎমুখী জঙ্গিবাদী মৌলবাদ সংকীর্ণ স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের স্বপ্নে বিভোর থাকে। ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে মৌলবাদীদের অনেকেই জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত থাকে। কেউ কেউ কিলিং স্কোয়ার্ডের সদস্যপদ লাভ করে। আবার কেউ কেউ তথাকথিত মুক্তির পথে সুউসাইড বোমারু হতে দ্বিধাবোধ করে না। তাদের বিশ্বাস, সহিংস জেহাদ করা তাদের ঈমানি দায়িত্ব এবং এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহিদ হলে তারা জান্নাতবাসী হতে পারবে।

যাই হোক, বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদ সাম্প্রতিককালে চণ্ডরূপ ধারণ করেছে। মৌলবাদীরা সুসংগঠিত হয়ে সসস্ত্র জঙ্গি কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বোমা বিস্ফোরণ, সংখ্যালঘুদের নির্যাতন, বিধর্মীদের উপাসনালয় ভাঙা, কুপিয়ে বা রগ কেটে হত্যা, গুপ্তহত্যা প্রভৃতি অপরাধ সংগঠিত করে যাচ্ছে। ধর্মকে বর্ম হিসেবে ব্যবহারকারী ধর্মভিত্তিক রাজনীতি যতদিন নিষিদ্ধ না হবে ততদিন এ জঙ্গি তৎপরতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে ধর্মবাদী কোনো রাজনৈতিক দল আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে নাশকতামূলক কার্যক্রম তেমন অব্যাহত রাখতে পারে না। জে.এম.বি, হরকাতুল জেহাদ এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

বাঙলায় মৌলবাদের উত্থানের ইতিহাস দীর্ঘকালের। চল্লিশের দশকে তা সাংগঠনিক রূপ ধারণ করে। মুক্তিযুদ্ধকালে তা বিশেষভাবে সংগঠিত হয়ে স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা রাখে। মৌলবাদ ত্বরাণ্বিত হয়েছে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বিলম্বিতকরণ এবং এ দেশের রাজনীতিতে তাদের পুনর্বাসন এজন্য প্রধানত দায়ী।

তবে এ কথাও সত্য যে গণকল্যাণমুখী অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রিয় অবকাঠামো সৃষ্টির ব্যর্থতা থেকে মৌলবাদ পুষ্ট। তাছাড়া ডানপন্থী রাজনৈতিক দলের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে মৌলবাদী শক্তি বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। অবশ্য ভোটের রাজনীতির চালে বামঘেঁষা মধ্যপন্থী রাজনৈতিক দলও পরোক্ষভাবে দায়ী। তা না হলে জামায়াতের মতো উগ্র মৌলবাদী একটা দল ইতোমধ্যে নিষিদ্ধ হয়ে যেতো। হেফাজতে ইসলাম দেশটাকে হাজার বছর পিছিয়ে দেওয়ার দাবিদাওয়া নিয়ে রাজধানীতে মহাসমাবেশ করার অনুমতি পেতো না।

সমাবেশের নামে হেফাজত উগ্র জঙ্গিত্বের যে রূপ দেখিয়েছে তা আমাদের সকলেরই জানা। কঠোর পদক্ষেপে সেদিন তাদের দমন না করা গেলে বোঝা যেতো কি ক্ষতি তারা করতে পারে একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের। মৌলবাদ ত্বরাণ্বিতকরণে প্রধান বিরোধী দল তো নৈতিক-রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েই যাচ্ছে। সরকারি দলও যদি ভোট খোয়াবার আশংকায় জামাত-হেফাজতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ না করে তাহলে ধীরে ধীরে বাংলাদেশ একটি মৌলবাদী রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ধর্মের বর্মে ঢেকে (তথাকথিত) জাতীয়তাবাদী দলের ঘাড়ে পাড়া দিয়ে মৌলবাদীরাই একদিন ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়ে যাবে।

এখনই উপযুক্ত সময়, জামায়াতসহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার, জঙ্গিত্বে প্রতিরোধ গড়ে তোলার; মৌলবাদের রাহুগ্রাস থেকে দেশটাকে বাঁচাবার। এজন্য একনিষ্ঠ সহায়তা লাগবে সরকারের। তবে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে প্রগতিশীলদের, দায়বদ্ধ শিল্পীসাহিত্যিকদের, মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবিদের, অগ্রসর তরুণসমাজের, মুক্তিকামী জনতার। নইলে শুধু রাষ্ট্রক্ষমতাই নয় শিল্পসাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য এমন কি জীবনযাপনপ্রণালী সবকিছুই মৌলবাদীদের অধিকারে যাবে। হান্নান কল্লোল ১২ মে ২০১৩ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.