আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আত্মহনন চিন্তা থেকে আত্মমর্যাদায়

জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে শাহিনূর বেগম একসময় আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। আজ তিনি জীবনকে, বেঁচে থাকাকে উপভোগ করছেন।
শাহিনূর একসময় একা, সঙ্গীহীন ছিলেন। আজ তাঁর চারপাশে অনেক সুখী মুখ। কারণ, বরগুনার আমতলী উপজেলার আড়পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের ঘোপখালী গ্রামের এই নারী এখন এলাকার দুস্থ নারীদের ভরসার প্রতীক।

কেবল নিজের গ্রাম নয়, আশপাশেও ছড়িয়ে পড়ছে তাঁর সাফল্যগাথা।
২৮ বছর বয়সী এই নারী জৈব সার তৈরি করেন কেঁচো দিয়ে। সামাজিক নানা প্রতিকূলতা জয় করে নিজে স্বাবলম্বী হয়েছেন, অন্যদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়েছেন।
সিডর-আইলায় ভেসে যাওয়া বাঁধ মেরামত না হওয়ায় লোনাপানি ঢুকে চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল আমতলী এলাকা। জৈব সার তৈরি করে হতাশ কৃষকদের মনে নতুন আশার সঞ্চার করেন শাহিনূর।


পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি-বনায়ন বিভাগের প্রধান আলমগীর কবির বলেন, জৈব সার ব্যবহারে লবণাক্ততার মাত্রা হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ফলন বাড়ে ১০ থেকে ৩৫ গুণ।
ঘোপখালী গ্রামের আবদুল লতিফ মাস্টারের দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে ছোট শাহিনূরের ইচ্ছা ছিল অনেক দূর পর্যন্ত পড়াশোনা করার। কিন্তু পরিবারের ইচ্ছায় অষ্টম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায়ই ২০০০ সালে তাঁকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বর পাশের গ্রামের প্রবাসী যুবক।

পরিবারের ইচ্ছার মূল্য দিয়ে তিনি স্বামীর সংসারে যান। দেড় বছরের মাথায় সংসারে আসে এক কন্যাসন্তান। সুখেই দিন কাটছিল, কিন্তু তা বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। তাঁর স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। জীবনটা নিরর্থক মনে হয়।

ক্ষোভে-অভিমানে আত্মহননের সিদ্ধান্ত নেন শাহিনূর। কিন্তু ছোট্ট মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তা পারেননি। শাহিনূর একদিন সবার অগোচরে মেয়েকে নিয়ে এক কাপড়ে চলে আসেন বাবার বাড়ি। বাবার বাড়িতে এসেও স্বস্তি মেলেনি তাঁর। কত দিন বাবা-মায়ের মুখাপেক্ষী থাকবেন—এ ভাবনায় বিষিয়ে ওঠে মন।

নিজের ও মেয়ের অনিশ্চিৎ ভবিষ্যতের কথা ভেবে দিন-রাত শুধু চোখের জলে ভাসেন।
এভাবে বছর খানেক চলার পর স্থির করেন, যে করেই হোক নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। পড়াশোনা করার সময় পাওয়া উপবৃত্তির কিছু টাকা তিনি মায়ের কাছে জমা রেখেছিলেন। এ টাকায় ১০টি হাঁস কিনে শুরু করেন ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম। বছর ঘুরতেই আয় শুরু হয়।

এ অর্থ দিয়ে পরের বছর তিনটি ছাগল কেনেন এবং বাড়ির পরিত্যক্ত জমিতে শুরু করেন সবজির চাষ। তিন-চার বছর এসব করে হাতে আসে হাজার বিশেক টাকা। এ টাকায় ৩০ শতক জমি বন্ধক নিয়ে শুরু করেন সবজির চাষ। কিন্তু ফলন ভালো না হওয়ায় লোকসানে পড়েন। হতাশ হন, কিন্তু দমে যাননি শাহিনূর।


২০১২ সালের শুরুর দিকে শাহিনূর তাঁর চাচার পরামর্শে ‘সংগ্রাম’ নামের স্থানীয় একটি বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে কেঁচো দিয়ে জৈব সার তৈরির প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণের পর সংস্থা থেকে বিনা মূল্যে চারটি রিং স্লাব ও আট হাজার কেঁচো পান। সকাল-বিকেল মাঠে ঘুরে গোবর সংগ্রহ করে রিংগুলো ভরিয়ে তোলার কাজ শুরু করেন। গোবর সংগ্রহ শেষে স্লাবের ভেতর কেঁচো ছাড়েন। তিন মাস পর চারটি স্লাব থেকে প্রায় ৩০০ কেজি সার পান।

সঙ্গে পান কয়েক হাজার কেঁচোর বাচ্চা। সার বিক্রি হয় তিন হাজার টাকায়। কেঁচো বিক্রি করে পান আরও আট হাজার টাকা।
বন্ধক নেওয়া জমিতে এই সার দিয়ে আবার শুরু করেন সবজির চাষ। এবার সাফল্য আসে।

লাউয়ের ডগাগুলো মোটা, লকলকে আর ঘন সবুজ হয়ে ওঠে। দুধসাদা ফুলে ছেয়ে যায় মাচা। শিম, বরবটি, করলা, মরিচ, টমেটো, ক্ষীরার গাছগুলোও লাল-নীল-হলুদ-বেগুনি ফুলে ভরে ওঠে। ঝাঁক বেঁধে আসতে থাকে ফলন। এরপর আর পেছনে ফিরতে হয়নি তাঁকে।


সার উৎপাদন ও সবজি আবাদ করে গত দুই বছরে দুই লাখ টাকা দিয়ে ৩০ শতক জমি কিনে সেখানে দেড় লাখ টাকায় দোতলা টিনের ঘর করেছেন। এ বছর ৬৪ হাজার টাকায় আরও ১৫ শতক জমি এবং ৩৫ হাজার টাকায় কিনেছেন দুটি গাভি। প্রতিদিন গড়ে আয় করছেন প্রায় এক হাজার টাকা।
শাহিনূরের মেয়ে রুবী এখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে। শাহিনূর বলেন, ‘আমার ইচ্ছা, এলাকার নারীরা নিজের পায়ে দাঁড়াক।

এটা পারলে তারা ঘরে-বাইরে সম্মান পাবে। ’
শাহিনূর সম্পর্কে আরপাঙ্গাশিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘একজন নারী তাঁর চেষ্টা ও শ্রম দিয়ে নিজের ভাগ্য বদলাতে পারেন, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ’
শাহিনূরে আলোকিত গ্রাম: আমতলী উপজেলা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে ঘোপখালী গ্রাম। পাকা ও মেঠো পথ পার হয়ে শাহিনূরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির আঙিনায় দোচালা কুঁড়েঘরে আটটি স্লাবে সার তৈরির সরঞ্জাম রাখা। সেখানে বেশ কয়েকজন নারীকে কেঁচো সার তৈরির পদ্ধতি দেখাচ্ছেন।


এঁদের মধ্যে নাজমা বেগম নামের একজন বলেন, ‘আগে শুধু স্বামীর রোজগারে সংসার চলত, এহন মোরা সংসারে টাকা দিতে পারি বইল্লা মনটা ভালো লাগে। ’
বাড়ি থেকে বের হয়ে একটু পুবে এগোতেই আরেক সফল নারীর খোঁজ পাই। নাম মিঠু রানী (৪০)। তিনিও শোনালেন তাঁর দুঃখ, সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প। বলতে গিয়ে একসময় গলা ধরে এল তাঁর।

ছলছল চোখে জানালেন, ১০ বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসন্তান মিঠু রানী আশ্রয় নেন বাবার বাড়িতে। স্বামী-সংসার-সন্তান ও সম্বলহীন এক কঠিন জীবনে কেবল উপেক্ষাই মিলেছে তাঁর। হতাশা, একাকিত্ব আর উপেক্ষিত জীবনে যখন আর কূল ছিল না, তখন শাহিনূর তাঁর পাশে দাঁড়ান। শাহিনূরের পরামর্শে বছর দেড়েক আগে তিনিও কেঁচো সার তৈরি শুরু করেন। দুই শতক জমিতে করেন পানের বরজ ও সবজির চাষ।

সেটা এখন দশ শতকে ঠেকেছে। এ বছর পান, সবজি ও সার বিক্রি করে আয় করেছেন দেড় লাখ টাকার মতো। এখন মিঠু রানীর ধ্যান-জ্ঞান এই খেত-খামার।
একইভাবে ফাহিমা, সাজেদা, তাসলিমা, জয়ফুল বিবি, ফারহানাসহ অনেক নারীর সাফল্যের গল্প যেন ফুরাতে চায় না। শাহিনূরের সাফল্যগাথা ছড়িয়ে পড়েছে পাশের খোন্তকাটা, বালিয়াতলী, পূর্ব তারিকাটা, পাতাকাটা, চাকামাইয়া, হুমা, বাহেলাবুনিয়া গ্রামে।

 

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।