আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অবসর জীবনে ঘুচুক একাকিত্বের ক্লেশ

পেশাজীবন মানুষের অন্যতম আত্মবিশ্বাসের জায়গা। জীবনের একটা দীর্ঘ সময় চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে কাটিয়ে কর্মজীবন থেকে অবসর নিলে হঠাত্ করেই যেন এক সীমাহীন শূন্যতা এসে ভর করে। এক প্রতিষ্ঠানে একসঙ্গে কাজ করা দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরাও যেন দূরে সরে যান। সন্তান-সন্ততিসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রাটাও যেন পালটে যায় হঠাত্ করেই। প্রতিদিনের চেনা রুটিনটা হয়ে যায় অচেনা।

অভ্যাসের সহচর মানুষ হঠাত্ করেই দীর্ঘদিনের অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসতে গিয়ে হোঁচট খান। তাই অবসরের পরে মানুষের মনোজগতে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়া অস্বাভাবিক নয়।
অবসরে মনোজগতে পরিবর্তন
‘আব্বু যেদিন অবসরে গেলেন সেদিন আমাদের বাসার সবার খুব মন খারাপ ছিল। অফিস থেকে ফিরে কলিগদের দেওয়া উপহারগুলো আমাদের দেখিয়ে ভীষণ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। বেশ কিছুদিন মন খারাপ করে রেখেছিলেন।

আমরা ভাইবোনরাই আব্বুকে আগলে রেখেছি তখন। আব্বুর মন ভালো করার জন্য রীতিমতো প্রতিযোগিতা হতো। আব্বুও তাই মন খারাপ করে থাকতে পারেননি বেশি দিন। ’ এভাবেই বাবার অবসরে যাওয়ার দিনটির কথা স্মরণ করেন কলেজশিক্ষক তাহমিনা হক।

কর্মব্যস্ত জীবন থেকে এক নিমেষে অফুরন্ত অবসর অনেকেই মেনে নিতে পারেন না।

তাই মন খারাপের পাশাপাশি মেজাজও হয়ে যেতে পারে খিটখিটে। এমনটিই হয়েছে সদ্য অবসরে যাওয়া স্কুলশিক্ষক আনিস আহমেদের (ছদ্মনাম) ক্ষেত্রে। তাঁর মেয়ে সাদিয়া আহমেদ বলেন, ‘বাবা অবসরে যাওয়ার পর থেকে অনেক বেশি খিটখিটে হয়ে গেছেন। এটা এখানে কেন, ওটা ওখানে কেন, এই কাজ এভাবে কেন করলে, ওভাবে কেন করলে না ইত্যাদি নানা খুঁটিনাটি বিষয়ে সব সময় বকাঝকা করতে থাকেন। এমনকি আম্মুর সঙ্গেও খিটমিট করতে থাকেন।

অনেকেই অবসরটাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেন না, কেউ কেউ নিজেকে কর্তৃত্বহীন ভাবতে শুরু করেন, যার প্রভাব মনোজগতে পড়ে বলেই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিত্সা মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনোবিজ্ঞানী ও সাইকোথেরাপিস্ট ড. মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘অবসরে যাওয়ার পর অনেকেই নিজেকে অকেজো মনে করেন, অবচেতন মনে কেউ কেউ নিরাপত্তাহীনতায়ও ভোগেন, ফলে তাঁদের অনেকেই বিশেষ করে পুরুষদের মধ্যে ঘরের দিকে খেয়াল করার প্রবণতা তৈরি হয়। নানা ভুল-ত্রুটি খুঁজে বের করতে শুরু করেন। অনেকে অসুস্থও হয়ে যান। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে অবসরটাকে জীবনের একটা অংশ হিসেবে সহজভাবে গ্রহণ করা।

তবে মায়েদের ক্ষেত্রে জটিলতা কিছুটা কম। কেননা, চাকরিজীবী মায়েদের কর্মক্ষেত্র এবং সংসার সব খানেই সমান উপস্থিতি রাখতে হয় সারাজীবন ধরেই। তাই অবসরের কারণে তাঁদের মনোজগতে খুব বেশি পরিবর্তন আসে না বলে মনে করেন ড. মাহমুদুর রহমান।

কাছের মানুষদের করণীয়

‘বাবা অবসরে গেছেন, তাঁর মেজাজ ইদানীং খুব খারাপ থাকে; তাই তাঁকে এড়িয়ে চলি’ কিংবা ‘মা এত বেশি ভুল ধরেন আজকাল। আগে মা একেবারেই এমন ছিলেন না।

’ মা-বাবার এমন পরিবর্তনে সন্তানেরা অনেকেই বিরক্ত হয়ে থাকে। বিরক্তির মাত্রা মাঝেমধ্যে এত বেশি হয় যে স্বাভাবিক সম্পর্কে চির ধরে। এ ক্ষেত্রে সন্তানদের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি সঙ্গীর একান্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতায় সহজেই অবসরকে আনন্দদায়ক করে ফেলা সম্ভব।

কর্মজীবী মা-বাবারা এমনিতেই সন্তানদের খুব বেশি সময় দিতে পারেন না।

ফলে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব সৃষ্টি হতেই পারে। অবসরে যাওয়া এই দূরত্ব ঘোচানোর, সেই অপূর্ণতা দূর করার একটা সুযোগ হতে পারে। দীর্ঘদিনের অভ্যস্ত কর্মব্যস্ত জীবনযাপন থেকে বের হয়ে এসে মা-বাবার মধ্যে একাকিত্ব, অনিশ্চয়তা প্রভৃতি তৈরি হতে পারে, তাই সন্তানদের উচিত এই সময়টাতে তাঁদের বেশি বেশি সময় দেওয়া।

অবসরে যাওয়া স্বামীর খিটমিট আচরণগুলোকে মনে পুষে রেখে অভিমান করে দূরে সরে যাওয়া নয়, বরং স্ত্রী যদি এ সময়ে তাঁকে মমতার হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নেন—তাহলে অনেকটাই সহজ হতে পারবেন তিনি। একইভাবে অবসরে যাওয়া স্ত্রীর বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে স্বামীকে।

স্বামীর উচিত এসময়ে স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করে, পুরোনো দিনের সুন্দর স্মৃতিগুলো রোমন্থন করে মন ভালো রাখার চেষ্টা করা। অবসরে যাওয়া স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে এমনটাই বললেন মনোবিজ্ঞানী মাহমুদুর রহমান।

তাঁর পরামর্শ হচ্ছে, ‘অবসরে মন-মেজাজ খারাপ না করে আপনজনদের সঙ্গে বাইরে ঘুরতে যাওয়া যেতে পারে, একসঙ্গে বসে সিনেমা দেখা, খাবার খাওয়া, গল্প করা যেতে পারে। মোট কথা পরিবার-পরিজনের সঙ্গে শেয়ারিংটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ’

নেতিবাচক ভাবনা হয়

অবসর জীবনচক্রের একটি স্বাভাবিক অধ্যায়।

এই বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে দেখা উচিত নয়। মনোবিজ্ঞানী মাহমুদুর মনে করেন, চাকরির ব্যস্ততার জন্য অনেক ছোট ইচ্ছা অপূর্ণ থাকে সময়ের অভাবে, তাই অবসরের অফুরন্ত সময় সেসব অপূর্ণতা দূর করতে কাজে লাগানো যেতে পারে। চাইলে নিজেকে নানা সাংস্কৃতিক কিংবা কল্যাণমূলক কাজের সাথে সংযুক্ত করা যেতে পারে। এতে করে নিজেকেও সময় দেওয়া হবে, পরিবার ও সমাজকেও সময় দেওয়া হবে।

কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নেওয়া মানেই অকর্মণ্য হয়ে যাওয়া নয়।

এটি জীবনের এক নতুন অধ্যায় তাই একে সহজভাবে গ্রহণ করা প্রয়োজন। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করতে পারেন পরিবারের কাছের মানুষরাই, বিশেষ করে সন্তানেরা। সন্তানের মনঃকষ্টে মা-বাবা যেমন উত্কণ্ঠিত হয়ে পড়েন, সন্তানকে নানা সমস্যা থেকে আগলে আগলে রাখেন, তেমনি তাঁদেরও উচিত অবসরের এই সময়টাতে বাবা-মাকে সঙ্গ দেওয়া। তাঁরা যেন কোনোভাবেই নিজেকে একা ও অকর্মণ্য ভাবতে না পারেন সেদিকে খেয়াল রাখা সন্তানের একান্ত কর্তব্য। আপনজনদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও বন্ধুত্বপূর্ণ বোঝাপড়া থাকলে অবসর হবে অপরিসীম আনন্দের।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।