আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধূর্ত নগরীতে বিমূড় একজন

৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের গরমে এর চেয়ে দ্রুত গতিতে চলা যায়না । সেই চেষ্টাও করা উচিত নয় । তবুও ছেলেমানুষী ভঙ্গিতে দৌড়ের নামে প্রায় ছুটে যাবার কাজটা করতে মন্দ লাগেনা সীমার । কিছুক্ষণ আগে ভেবে দেখেছে বহুদিন হলো কোন ধরণের ছেলেমানুষী করেনি । অতঃপর মনঃস্থির করলো এই অনড় জীবনযাপনে কিছু সময়ের জন্য ইতি টেনে দিলে খারাপ হয়না ।



কাজটা করতে গিয়ে হাতে ধরে থাকা তীব্র গরমে নিমেষেই গলে যাওয়া আইসক্রিমের রসে গাঢ় সবুজ সালোয়ার মাখামাখি হয়ে যায় তার । সেই মিশ্রণে শরীরের বিশেষ স্পর্শকাতর কোন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের উদ্ভাসিত হবার কোন সম্ভাবনা নেই । তবু পশ্চাৎদেশের ভাঁজ উন্মুক্ত করে দেয় এমন জায়গায় প্যান্টের ঝুল নেমে স্থির হয়ে থাকে আর সাথে বদরঙ্গা টি শার্ট পরিহিত জনা তিনেক স্বআরোপিত আধুনিক ছেলে সীমার শরীরের দিকে আগ্রহ ভরে চেয়ে থাকে ।

সীমা আইসক্রিমটা শেষ করে নিজের সাদা রঙের প্রায় জীর্ণ হয়ে যাওয়া পার্সটা খুলে দেখে । আরেকবার চেক করে নেয় পার্সে খুচরো পয়সা কেমন আছে ।

দেখতে দেখতে হাতের ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে , সেই কারণে পার্সটা কাত হয়ে গেলে দুইটা পাঁচ টাকার এবং তিনটি দুই টাকার কয়েন গড়িয়ে গড়িয়ে সদ্য পাট্টা দিয়ে ঢালাই করা পীচের রাস্তায় পড়ে যায় । সীমা নিজের শরীর সামলেই নিচু হয়ে সেগুলো কুড়িয়ে নেয় । রাস্তাটায় এখনো কালো কালো পীচের গন্ধ পাওয়া যায় । তার উপর দিয়ে চলাচল করা কোন মানুষেরই অত সময় নেই এই ঘ্রাণ শুঁকে দেখবার ।

বেশ দূরে একটা পত্রিকা কেনাবেঁচার স্ট্যান্ডে জনা পনেরো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে এই গরমের মাঝেও ।

কেউই মাথার উপর কিছু দেয়নি । এই কাঠফাঁটা গরমেও কি তারা প্রত্যেকে সীমার মতো করে প্রাণ খুঁজে পায় ? মাত্রই ফর্সা দেখতে , সোনালী ফ্রেমের চশমায় নিজের চোখ জোড়াকে আবছা রেখে দেওয়া এক মধ্যবয়সী একটা বাংলা দৈনিক পত্রিকা হাতে তুলে নিলো ।

দৃশ্যটা দেখে সীমার মনে পড়লো প্রায় সাড়ে সাত মাস পর আজকে সকালে তার চোখের সামনে পত্রিকা এসে পড়ে গিয়েছিলো । কিঞ্চিত আগ্রহ নিয়ে পত্রিকাটি বাম হাতে তুলে নেওয়ার পরে সর্বত্র চোখ বুলিয়েছিলো । যেই কয়েকটি খবর পড়ে বিরক্ত হয়ে গিয়েছে সেগুলো হলো এইঃ

প্রধানমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন সম্প্রতি মালিবাগে সংঘটিত হওয়া ডাক্তার দম্পতিদের নৃশংস হত্যাকান্ডের খুনীদের গ্রেফতার করে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা হবে ।



লোকসানের কারণে বগুড়ায় প্রধান সড়কের উপরে দুধ ফেলে দিয়ে দুধ উৎপাদকদের আহাজারি । স্থানীয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততা । ঘটনায় অর্থমন্ত্রীর ভাষ্য দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণই স্থিতিশীল আছে , আসছে অর্থবছরে জিডিপি দাঁড়াবে আনুমানিক ছয় দশমিক দুইতে ।

উত্তরায় চলচ্চিত্র নায়িকা তাসনিমের শ্যুটিং দেখতে সেখানে উপচে পড়া ভীড় । নায়িক এই দৃশ্যে অভিভূত ।

জানিয়েছেন সারা জীবনেও এই ঘটনাটি ভুলবেন না ।

ডেমরায় পয়সার অভাবে সাত বছরের বাচ্চার হাত কেটে নিয়ে তাকে ভিক্ষা করাতে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে পাষণ্ড বাবা – মা । ঘটনাটি জানাজানি হবার পর সেই এলাকায় একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে । আগামী কয়েকদিন ঘটনাটি নিয়ে ফলো আপ ছাপাবার নিশ্চয়তা দিয়েছেন স্থানীয় প্রতিবেদক ।

এইসব আলবাল জিনিস নিয়ে ভাবতে ভাবতে সাতাশ বছর আট মাস আঠারো দিনের সীমা বিশ্বাস মৌচাকের উদ্দেশ্যে রিকশায় চাপে ।

হালকা নীল রঙের চেক লুঙ্গি পরিহিত রিকশাওয়ালা এই ভয়াবহ উত্তপ্ত আবহাওয়ায় একটু পর পর হালকা লাল গামছায় নিজের সমগ্র মুখ মোছে আর রিকশার প্যাডেলে চাপ দিতে থাকে । তার রিকশার সাথে আরেকটি অসতর্ক কমবয়সী রিকশাওয়ালা নিজের রিকশা লাগিয়ে দেয় । সীমার রিকশার রিকশাওয়ালা প্রায় নিজের ছেলের বয়সী সেই চালককে চুতমারানীর পুত বলার সাথে সাথে তার মায়ের সাথে সহবাসের ইচ্ছা প্রকাশ করতে সে দ্বিতীয়বার চিন্তা করেনা ।

রিটায়ার্ড সংস্কৃতিমনা স্কুলমাস্টারের মেয়ে সীমা বিশ্বাসের মধ্যবিত্তীয় অভিরুচিতে এইসব গালাগাল আদপেই কোন আঘাত করেনা । এইসব অভিরুচি সীমা ঘরে রেখেই বেরোয় ।

তার দর্শন তার গোল মুখের আদুরে মায়ের স্বভাবের মতোই সহজ । সে কিংবা তার ঘরের কোন মানুষ মরে যাবার পরে সৎকার করতে গেলে আপাদমস্তক এই মুসলমানের দেশে বল হরিবল হরিবল বললেই এই অসভ্য সমাজ ভ্রু কুঁচকাবে নিশ্চিত । এরকম একটা নিকৃষ্ট জনপদে জীবনের প্রতি পদে পদে আবার অভিরুচির ন্যাকামো কিসের ? কোথাও কোন বালও ছেঁড়া যায়না ।

এই দৃঢ়চেতা সীমা বিশ্বাসই কেবল জীবনের একটি জায়গায় ধাক্কা খেয়ে গেছে । সেই ধাক্কার কাছে আরেকবার নির্লজ্জের মতো নিজেকে চিনে নিতে সে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের এই প্রখর সূর্যের আলোতে ভরা তপ্ত দুপুরে রিকশায় করে মৌচাক যাচ্ছে অলস ভঙ্গিতে ।

সেই ব্যতিব্যস্ত জায়গাটিতে যখন এসে পৌঁছালো তখন কুলকুল করে তার রিকশাওয়ালা ঘামতে লাগলো । চারপাশের হালহকিকত দেখে কি বুঝলো সেই জানে । ফিসফিস স্বরে সীমাকে বলতে আরম্ভ করলো “ আফা , পারলে তাড়াতাড়ি এইহান থেইকা চইলা যাইয়েন , আইজ এইহানে গন্ডগোল লাগবো । ভালা ঠেকতাছেনা চাইরপাশ । “

রিকশাওয়ালা কথাগুলো বলতে বলতেই মধ্যবাড্ডাগামী একটা বাসের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে খানখান হয়ে গেলো ।

হঠাৎ অতিব্যস্ত এই রাস্তার মানুষগুলো দ্বিগবিদিক ছুটতে শুরু করলো । পার্সে গোটা গোটা অক্ষরে দেড় পৃষ্ঠার একটি চিঠি নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূড় সীমা দ্রুতই নিরাপদ একটি জায়গায় সরে আসলো । রাস্তার ঘটনাপ্রবাহের দিকে চোখে রাখতে রাখতে ভেঙ্গে যাওয়া কাঁচের বাসটি থেকে মাত্র সাড়ে নয় গজ দূরত্বে একজনকে দেখলো হাতে মোটা একটি লাঠি নিয়ে আরো কয়েকটি বাস ভাঙ্গবার নির্দেশ দিতে ।

সেই একজনের মোটা মোটা ভ্রু , রেগে গেলে তার চোখজোড়া বড্ড রুঢ় মতো দেখায় । সীমা কতোবার বলেছে তাকে সেই চাহনী দেখলেই তার গা শিরশির করে তবু সে কান দেয়নি ।

সাড়ে ছয়শো টাকার প্রায় জীর্ণ হয়ে যাওয়া পার্সটিতে দেড় পৃষ্ঠার চিঠিটি গাঢ় আবেগ নিয়ে সীমা লিখেছে এই মারমুখী যুবকের উদ্দেশ্যেই । কিন্তু চিঠির প্রাপকের এই রুদ্রমূর্তি সে এতোদিন যাবত ধরতে পারলোনা । এবারে সীমার কাছে সব ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে আসে । বিথী তবে দিন এগারো আগে তাকে সত্যি কথাই বলেছিলো । ছেলেটা তবে সোহাগই ছিলো ।

ইডেন কলেজের কিছু পাশের এক মেসে জনৈকা সুতন্বী যুবতীর কোমর ধরে ..................

সেই সময়তেই হঠাৎ সীমার সারা শরীরে প্রবল কাঁপুনী দেয় । সে দৌড়ে সামনের রেস্টুরেন্টের ওয়াশরুমে ছুটে গিয়ে হড়হড় করতে করতে আরো মুষড়ে পড়ে । এটা অতি অবশ্যই এক্সএক্স এক্সহোয়াই ক্রমোজমের খেলার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি । সীমা ঘৃণা , ক্ষোভ উভয়ের মিশ্রণে সেই দেড় পৃষ্ঠার চিঠিটি কুচি কুচি করে ছিঁড়ে বেসিনের মুখের ভেতর দিয়ে ফেলে দিতে যায় । টুকরো কাগজগুলো বেসিনের মুখের সাথে আটকে থাকে ।

পানি ছিটালেও বেসিনের মুখের ভেতর দিয়ে ঢোকেনা ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.