আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বসন্ত, আহা, বসন্ত নিষ্ফল {{গল্প}}

এই সময়ে আমার এইখানে থাকার কোন কথা নেই। তবু কথামত সবসময় যে সেই জায়গায় থাকতে হবে তারও কোন কথা নেই! সন্ধ্যা, ঘড়ির কাটা সাটা ছোঁয়ার আগে মুয়াজ্জিনের অনুমতিপ্রার্থী । আমি ভিকারুন্নিয়াসার সামনে ঘুরাঘুরি করছি! পকেটের অবস্থা সুবিধার না। বিশ টাকা থাকার কথা, কিন্তু হাত দিলে এমনও হতে পারে যে দেখা গেল টাকাটা নেই। বিচিত্র না, ভয়ে হাত দিচ্ছি না ।

মনে মনে ধরে নেয়া যাক টাকাটা জায়গামতই আছে। একটু আগে ৭৫ টাকা ছিল, রাস্তার পাশে ওজন মাপার যন্ত্র নিয়ে বসে থাকা এক পিচ্চি প্রায় ধরে বলে ফেলল ,ভাই ওজন মাপবেন?!
আমি বললাম,আজ কি তোর ইনকাম কম নাকি? পা ছাড়!
-আইজকা না খালি অহন বাজার মন্দা, লোকজন ওজন মাপতে চায় না।
দুপুরে খাইছিস?
এতক্ষণ চোখে চোখে চেয়ে কথা বলছিল। এই প্রশ্নের উত্তরে কিছু না বলে চোখ নামিয়ে নিল! কত আর বয়স হবে? যতটুকু বয়স হোলে চোখের মনি থেকে শৈশবের কালো মুছে গিয়ে ধুসর হতে থাকে তার থেকেও কম। আমি পরপর তিনবার ওজন মাপলাম! ঘটনা তেমন কিছু না, যন্ত্রের উপর উঠি আবার নামি, তারপর বলি আরেকবার মাপত, শরিরের যত্ন আত্তি করা দরকার।

গুরুজন বলে গেছেন, স্বাস্থই সকল সুখের মুল! অথচ তিনবারেই পিচ্চি প্রথমবারের থেকে ২০০ গ্রাম করে ওজন কমিয়ে বলতে লাগল! আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ব্যাটা তুই সংখ্যা চিনিস তো? প্রতিবার কি মুহূর্তের মাঝেই আমার ওজন দুইশ গ্রাম করে কমছে?! সে বল্ল,পত্যেকবার যন্রের উপরে উঠার পরথেকে আপনার পকেট থেকে ৫ টাকা কইরা কইমা যাইতাছে তো ওজন ও কমতাছে! ট্যাকা আলা মানুষের ওজন থাকে, ট্যাকা ছাড়া মানুষের ওজন নাই! এই পাঁচ ছয় বছরের পিচ্চির মুখে এই কথা শুনার পর আমার যে অবস্থা হল তাকে বাংলায় বলে “তব্দা” যাওয়া। পিচ্চি বলে কি! ঘটনার সত্যতা পরীক্ষার জন্য আমি চতুর্থবারের মত ওজন মাপক যন্ত্রের উপর উঠলাম, কাটার উত্থান পতন অতি মনোযোগের সাথে দেখছি! এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে কাটাটা ঠিক আগের ওজনের ২০০ গ্রাম নিচেই স্থির হল!! আমি মেজাজ খারাপ করে বললাম, আবার মাপ! তারপরমিনমিন করে বললাম, কোথাও কোন গোলমাল হচ্ছে! কিন্তু গোলমালটা কোথায়?? কাঙ্খিতভাবেই ওজন আরও ২০০ গ্রাম কমে গেল! নিজের ওজন আর কমাতেইচ্ছা হল না,পাচবারে পুরো ১ কেজি নেমে গেছে! ভয় হল, এইভাবে ওজন নামতে থাকলে একটু পরে আমাকেও যন্ত্র নিয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়তে হবে!
আমি পিচ্চিরে বললাম, নাম কি তোর?
-বাদশা ।
আয় বাদশা তোরে আখের রস খাওয়াই! তোর ব্রেইন শার্প! গ্লুকোজ হল ব্রেনের খাবার বুঝলি! গ্লুকোজ খেলে আরও শার্প হবে!

পিচ্চি পরপর দু গ্লাস আখের রস মেরে দিল ঢোকঢোক করে,আমি এক গ্লাস! ব্যাস গুনাপাতিক হারে পকেট থেকে টাকা কমে গেল! স্মভবত ওজনও, মাপার সাহস করলাম না আর! আমি বাদশার কাঁধে হাত রেখে বল্লা, আচ্ছা বলতো, টাকা ছাড়া আর এমন কি কোন আছে যা মানুষের ওজন বাড়াইতে পারে?
সে দুই পাটি দাঁত বিকশিত করে হেসে বলল, হেইডা তো আমি জানি না! তয় আপনে কিন্তু ভাইজান মানুষ ভালা! ভালা মাইনসের এত ওজন থাকে না!! আপনে একদম টেনশন নিয়েন না!

আমি টেনশন নিচ্ছি না! পকেতে বিশ টাকা নিয়ে টেনশন করা যায় না! রাস্তার ওপাশের স্কুলের গেট খুলে এমন একজনকে হেঁটে আসতে দেখছি এদিকে হাসিমুখে তারপরে আর টেনশন করার কোন মানেও হয় না। সে কোন না কোন সমাধান বের করবেই সকল সমস্যার! সে স্বৈরশাসকে একনায়েকের মত আমার সামনে দাড়িয়ে বলল, কি! বাইরের পানিতে এইসব খেতে কতবার নিষেধ করেছি! তুই জানিস ঢাকার পানির কি অবস্থা! আর এখানে দাঁড়িয়ে আখের রস!! কাল ই তো জন্ডিস বাঁধিয়ে বিছানায় পড়ে থাকবি!
আমি ওকে হাতধরে টেনে নিয়ে হাটতে হাটতে বললাম, চুম্বন যদি না ভেজায় কণ্ঠতল, আখের রস ই যে অভাগার সম্বল!
-একটা থাপ্পর খাবি!
পাঁপড় এ লবন দিস একটু! বিট লবন ছাড়া পাঁপড় জমে না তেমন!
এবার সে রেগেমেগে বলল, এসব সস্তা প্রেমের সংলাপ আমাকে বলবি না! আমি তোর প্রেমিকা না, প্রেমিকা পর্যায়েরও কেউ না যে ভবিষ্যতে প্রেমিকা হতে পারে।
আমি গম্ভীর হয়ে বল্লা,আচ্ছা, একটা দামি সংলাপ বলি?! তোর সমুদ্রেরা সমুদ্রের থেকেও সুন্দর! এত কালো চোখ মনে হয় শৈশবের ঘুম থেকেই জাগিস নি, আমি একটু আগেই একটা শিশুর কালো চোখের সাথে আখের রস খাচ্ছিলাম।

বাদশা, তোর চোখ ঠিক অমন শিশুদের মত কালো!
ভ্রু কুঁচকে নিশু জানতে চাইল, বাদশা?! বাদশা কে?!
একটা পিচ্চি। ওজন মাপে। আয় তোকে দেখাই বলে হাত ধরে প্রায় টেনে অকে নিয়ে জোরসে আবার উল্টোদিকে হাঁটা দিলাম। নিশু উফ করে উথল, আহ! ব্যাথা লাগে, এত জোরে চাপ দিস কেন?!!
বাদশার ওজন মাপক দোকানের কাছে এসে নিশুকে যন্ত্রের উপর তুলে দিয়ে আমি বাদশার জায়গায় বসে গিয়ে বললাম, আমি তিনবার তোর ওজন মাপবো! তুই আমাকে ৫ টাকা করে দিবি! দেখবি প্রতিবারে তোর ওজন ২০০ গ্রাম করে কমছে!
-আহ, কি হচ্ছে এসব?!!
আরেহ, দেখি না, খুবই মজার ব্যাপার!
আমি নিশুর প্রথমবার ওজন মেপে পাচ টাকার জন্য হাত পাতলাম! নিশু বলল, টাকা কি এখনি দিতে হবে?
হুম!
-পাচতাকা ভাংতি নেই, ধর পাঁচশ টাকার নোট! বলে আমার হাতে পাঁচশ টাকা গুজে দিল! তারপর দ্বিতিয়বার যন্ত্রে উঠল! আমি অবাক হয়ে দেখলাম ওজন কমেনি মোটেই! তবু ক্রিত্তিম চিৎকার মেরে বললাম, ৫০ গ্রাম!! নিশু এতটা বোকা নয়, সে বলল,মোটেই ৫০ গ্রাম কমেনি, আরও বেড়েছে মনে হচ্ছে! তারপর ৫০০ টাকার আরেকটা নোট গুঁজে দিয়ে বলল, আবাড় মাপ! এব্বাড় দেখবি ১০০ গ্রাম বেড়েছে! আমি বাদশার মাথায় চাটি মেরে বললাম, কিরে ব্যাটা, আপামনিরে তোর সূত্র প্রমান দেখা! তোর থিওরি তো ফেল মারল! বাদশা মিনমিন করে বলল, রাজকন্যাদের মত ধনী মাইনষের বেলায় হইব না! ট্যকা পয়সা নিয়া যাগর বেরেইনে হজ্ঞলখন টেনশন লাইগাই আছে তাগর হইব!
নিশু বলল, একটা রিকশা ডেকে তো, এবার আমাকে যেতে হবে। মার শরীরটা ভালো নেই, তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে ।



নিশু চলে গেল। আমি বড় করে নিঃশ্বাস নিলাম। পঞ্চ ইন্দ্রিয় যোগে পাচবার ওজন মাপা হয়ে গেছে। নিশুকে দেখার পর থেকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বড় জ্বালাচ্ছে,সাগরের কথাটা আমি ওকে মিথ্যে বলিনি, সত্যিই বলেছিলাম। ওকে দেখলেই বুকের ভেতর কোথায় জানি সাগর জেগে উঠে, ঢেউ খেলে যায়, ফোঁস ফোঁস করে, আমি টের পাই।

বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ওদের সাথে পাল্লা দেই। তারপর আবার ষষঠ বারের মত বাদশার যন্ত্রে দাড়াই! বললাম, দেখত আমার ওজন কত!
বাদশার যন্ত্রের কাটা উঠছে! উঠছে তো উঠছেই! আমার ভয় হল আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে নাকি! আমি জোরে জোরে দম নিচ্ছি, আমার সমস্ত শরীর মন হয়ে গেছে! মনের ওজন কী যন্ত্রে ধরে??

সেদিন চৈত্র মাস, বসন্তের এখনও কিছুটা বাকি। পলাশ ফুল ফুটেছে, ভীষণ লাল। বাসের জন্য যাত্রীরা দাঁড়িয়ে আছে। এই শহরের রাজপথেও আজকে সাপের খেলা দেখাচ্ছে! আমি ঘোরের মাঝে হাঁটছি! দুটো চারটা রিকশা বেল দিতে দিতে চলে যাচ্ছিল।

রিকসার বেলগুলোতে শুধু একই সুর বাজছে। উহ বসন্ত , আহ বসন্ত! একঘেয়ে সুর, কিন্তু বিরক্তি আসে না। একঘেয়েমিটাই সৌন্দর্য! ভ্যাঁপসা গরম চারদিকে । স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর জমেছে কোথায় যেন, মাইকের শব্দ আসছে । কবি পড়ছেন, অশ্রু যদি না ভেজায় আঁখি যুগল, বসন্ত আহা বসন্ত নিষ্ফল! গতরাতে নিশুর মা মারা গেছেন।

আমি হাঁটছি নিশুর বাড়ির দিকে। নিশুকে সান্তনা দিতে হবে, বুকের কাছে মাথাটা চেপে ধরে থাকতে হবে। আমি পারবো তো? কি বলে সান্তনা দেব ভেবে পাচ্ছি না। মাথা হাতড়ে চলেছি ভেতরে ভেতরে। ভীষণ ফাঁকা লাগছে মাথাটা ।

বর্ণেরা বর্ণান্ধ, শব্দেরা স্তব্ধ! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।