আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাহাড়ের কোলে বিদ্যার আলো

চারদিকে পাহাড় আর পাহাড়। সবুজের অবারিত বিস্তৃতি। মাঝখানে একটি পাকা ভবন, যেখানে উঠোনময় একদল শিশু-কিশোরের ছুটাছুটি। গায়ে নীল-সাদার পোশাক। একটু পর ঘণ্টা বাজতেই সুশৃঙ্খলভাবে সবাই ঢুকে পড়ল ভবনে।

এরপর সমস্বরে ভেসে আসছে অ-তে অজগর ওই আসছে তেড়ে, আ-তে আমটি আমি খাব পেড়ে...।
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে বাইপাস সড়ক ধরে পূর্ব দিকে জেলা কারাগারের পাশে গেলে চোখে পড়ে উত্তরণ গৃহায়ণ মডেল বিদ্যালয়ের এই দৃশ্য।
পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে বসবাসরত সুবিধাবঞ্চিত ছিন্নমূল ছেলেমেয়েদের বিদ্যালয় এটি, যেখানে শিক্ষার্থীদের স্কুলব্যাগ, পোশাক ও খাতা-কলম বিদ্যালয় থেকেই বিনা মূল্যে সরবরাহ করা হয়। স্থানীয় লোকজনের ভাষায় ‘গরিবের স্কুল’।
শুরুর কথা: জেলার ঐতিহ্যবাহী দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কক্সবাজার সরকারি বালক ও বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক এম সিরাজুল ইসলাম শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নিয়ে কাজ করছেন বায়তুশ শরফ কমপ্লেক্সের মহাপরিচালক হিসেবে।

সমাজসেবামূলক নানা কাজে ওই পাহাড়ি এলাকায় তাঁর যাতায়াত অনেক আগে থেকেই। দেখলেন, পাহাড়ে বসবাসরত শিশুরা বিদ্যালয়ে যায় না। কারণ, এসব পাহাড়ের আশপাশে চার-পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো বিদ্যালয় নেই। পাহাড়ে কাঠ কেটে কিংবা জমিতে কাজ করে বেড়ে উঠছিল শিশুরা। বিষয়টি নাড়া দেয় সিরাজুল ইসলামকে।

উদ্যোগ নিলেন শিশুদের শিক্ষার আলোয় আনার। অর্থ জুগিয়ে পাশে দাঁড়াল উত্তরণ গৃহয়াণ সমবায় সমিতি। অবশেষে ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে ১০ জন ছাত্রছাত্রী নিয়ে শুরু হলো প্রথম শ্রেণীর পাঠদান। সেই শুরু। এখন বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণী পর্যন্ত চালু হয়েছে।

বর্তমানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৬৯৭। এর মধ্যে প্রাথমিকের ছাত্রছাত্রী ৩২১ জন। রয়েছেন ১৪ জন শিক্ষক।
উত্তরণ গৃহায়ণ সমবায় সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী জানান, প্রায় ১০০ একর জমি নিয়ে দেশের বৃহৎ এই আবাসন প্রকল্প। এর সদস্য সংখ্যা এক হাজার ৫০; যদিও এখানে এখনো বসতি শুরু হয়নি।

স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয় ১ দশমিক ৬৮ একর জমিতে।
আমির, রুবিদের চোখে স্বপ্ন: বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ছাত্র আমির হোসেন জানায়, তিন কিলোমিটার দূরে বাদশাঘোনা এলাকা থেকে পাহাড়-জঙ্গল পেরিয়ে বিদ্যালয়ে আসে সে। আগে জঙ্গল থেকে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করত। আমির বলে, ‘এখন পড়ালেখা করে মানুষের মতো মানুষ হতে চাই। আমার বাবা দিনমজুরি করেও আমাকে পড়ালেখা করাচ্ছে।

আরও বড় হয়ে একটি চাকরি করে সংসারের হাল ধরতে চাই। ’
দশম শ্রেণীর ছাত্রী রুবি আকতারও আসে দেড় কিলোমিটার দূরের পশ্চিম লারপাড়া গ্রাম থেকে। বাবা রফিকুল আলম দিনমজুর। রুবি বলে, ‘নয় বছর ধরে আমি এই স্কুলে পড়ছি। আমার ছোট চার বোনও পড়ে।

বই রাখার ব্যাগ, স্কুলের পোশাক-খাতা-কলম—সবই বিদ্যালয় থেকে বিনা মূল্যে পাচ্ছি। এ জন্য আমরা সিরাজ স্যারের (এম সিরাজুল ইসলাম) কাছে কৃতজ্ঞ। ’
বাদশাঘোনা এলকার বাসিন্দা দিনমজুর কামাল আহমদ (৪৫) বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। পাহাড়ি জমিতে কাঁচা ঘরবাড়ি তৈরি করে কোনো রকম বেঁচে আছি। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করার মতো সামর্থ্য কারও নেই।

উত্তরণ স্কুলটি না হলে আমাদের ছেলেমেয়েরা অন্ধকারে থাকত। ’
উত্তরণ গৃহায়ণ মডেল বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নাছির উদ্দিন বলেন, এ বছর বাণিজ্য বিভাগ দিয়ে দশম শ্রেণী চালু করা হয়েছে। আগামী বছর বিজ্ঞান বিভাগও চালু করা হবে।
হবে বিশ্ববিদ্যালয়ও!: বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকার সুবিধাবঞ্চিত ছিন্নমূল ছেলেমেয়েদের মানুষ করার উদ্দেশ্য নিয়ে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছি। এখন বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

পাশাপাশি খরচও বাড়ছে। বিদ্যালয়ের ১৪ জন শিক্ষকের বিপরীতে প্রতি মাসে সমিতিকে প্রায় এক লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়। তা ছাড়া প্রায় ৭০০ শিক্ষার্থীর পোশাক, ব্যাগ ও খাতা-কলমের বিপরীতে আরও টাকা খরচ হচ্ছে। তার পরও আমরা চাই, ছিন্নমূল ছেলেমেয়েরা শিক্ষিত হোক। এই বিদ্যালয়ে ২০১৫ সাল থেকে কলেজের পাঠদান শুরু করব।

এরপর এখানে প্রতিষ্ঠা করা হবে “কক্সবাজার বিশ্ববিদ্যালয়”। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১০ একর জমি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ’

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।