আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিলেত: পাখির চোখে দেখা- পনেরো

মার্চ ১৫, '১৪ ইং

ম্যাকের চাকরি ছাড়ার পরে একটা লোকাল রেষ্টুরেন্টে কিছুদিন কাজ করেছি। অল্পদিন করার পরেই বুঝতে পারলাম , এধরনের কাজ যারা কাঁচা টাকা বানিয়ে নেবার জন্য এই দেশে এসেছে শুধু তাদেরই জন্যে উপযুক্ত। আমার মত যারা পড়াশোনা করতে এসেছে তাদের জন্যে নয়। মনে মনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম নতুন একটা উপযুক্ত কাজের জন্যে। কাজ জুটলো।

আমার এখনকার কাজের জায়গা- একটা মানি ট্রান্সফার শপ। নামে রিয়া মানি ট্রান্সফার হলেও কাজে কর্মে জগাখিচুড়ি। ছোট্ট দোকানটা-কাজ কিন্তু অনেক- একাধারে সাইবার ক্যাফে, পার্সেল সার্ভিস, ম্যান এন্ড ভ্যান, ডেলিভারি ও রিমুভাল, প্রিন্টিং , ফটোকপি, কম্পিউটার আনুসঙ্গিক মায় ল্যাপটপ , মোবাইল মেরামতি পর্যন্ত আছে। এককথায় অল- ইন- ওয়ান, সর্বেসর্বা। আর টাকা পাঠানোর ধান্দার কথা তো প্রথমেই লিখেছি।




দোকানটার মালিক শ্রীলঙ্কান। নানা ব্যবসা করতে করতে টাকা বানিয়ে পাহাড় করেছে। মানুষ প্রথমে অর্থ উপার্জন করে বেঁচে থাকার জন্যে। পরে এক পর্যায়ে টাকাই মানুষের বেঁচে থাকার কারন হয়ে যায়। মালিকটির কাজ কর্ম দেখলে আমার তাই মনে হয়।

সারাদিন অর্থের পিছে অনর্থক ছুটে চলা এক মানুষ। যখন হাতে টাকা আছে তখনই সুখ, যেই টাকা নিয়ে আমরা যেতে পারবো না শেষমেষ। তো মালিক মি: রিচার্ড সারাক্ষন খালি ধান্দায় থাকে কিভাবে ,আরো কি কি উপায়ে টাকা করা যা। সেই হেতু এখন যা লাভ হয়েছে তা হল,তার সবকিছুতে সে আর সময় দিতে পারছে না। দোকানের কার্ডের মধ্যে অনেক কিছু লেখা , লোকে যখন তাকে দরকারে খোঁজ করে তখন তাকে আর পাওয়া যায় না।



যেহেতু মালিক সর্বক্ষণ ব্যস্ত বাইরে বাইরে, দোকানটাতে আমার কাজের দিন গুলোতে তাই আমিই বস , আমিই আবার কর্মচারী-একাই একশো যাকে বলে। কারন দোকানে তিনদিন আমি বসি , বাকি চারদিন আরেকটি শ্রীলঙ্কান মহিলা। আর কেউ নেই । কোন দরকারে একদিন একজন না আসলে সেইমত অন্যজনের সাথে আমরা দিন পাল্টে নিই।


এখানে-বিলেতে আসার পরে আমার যাদের সাথে পরিচয় -বন্ধুত্ব তারা মূলত নেপালী, ভারতীয় বা পাকিস্তানি।

ভিয়েতনামী, ইথিওপিয়ান, মালয়েশিয়ানও আছে , অল্প সংখ্যক। কিন্তু লঙ্কানদের সাথে মোলাকাত হয়নি তেমন। এইবার মাসকয়েকের কাজের সুবাদে আমাদের অন্যতম প্রতিবেশী জাতিটির সাথেও পরিচয় হয়ে গেল। এদের অনেক কিছুই দেখলাম আমাদেরই মতো, খাবারদাবারে- ভাত, তরকারীতে, এমনকি বেগুন ,সাজনা পর্যন্ত খায়। পুরুষেরা এমনকি লুঙ্গিও পরে! এদের ছেলেদের মুখে একটা তাগড়াই গোঁফ থাকাটা মনে হয় ম্যান্ডেটরী! প্রায় সবার মুখে দেখি শোভা পাচ্ছে।



ক্রেতারা মূলত শ্রীলঙ্কান তামিল , কিছু আছে ভারতের তামিল নাড়ুর। কথা তামিলে। ফোনে তো বটেই, গাত্রবর্ণের কারনে সোজা দোকানে ঢুকেও তামিলে শুরু করে, ভাবে আমিও ওদেরই একজন। বাকিরা ভাবে আমি ইন্ডিয়ান। তারপর বিনীত ভাবে ওদের ভুলটা শুধরে দিই।

তখন একটু লাজুক হেসে ভাঙা ভাঙা ইংরেজীতে কথা চালায়। ভাঙা ভাঙা বললাম, কারন বেশীর ভাগ এখানে পলিটিকাল অ্যাসাইলামে এসেছে, ব- হু আগে , কিন্ত ইংরেজীর অবস্থা এত দিনেও মোটেই সুবিধের না। মহিলাদের তো নয়ই , পুরুষগুলোরও বেশীর ভাগের অবস্থাই শোচনীয়। ভাবি মহিলাদের নাহয় সম্পদশালী সক্ষম স্বামী থাকলে বাইরে কাজ না করলেও চলতে পারে , পুরুষগুলো এদেশে এই ভাষাজ্ঞান নিয়ে কাজ কর্ম করে খাচ্ছে কিভাবে?!

একটা কথা ঠিক যে -আমার দেখা এশিয়ানদের মধ্যে ভারতীয়দের ইংরেজী তুলনামূলকভাবে আশ্চর্য শুদ্ধ ও সুন্দর। তামিল ভারতীয় যারা আসে মেয়ে-পুরুষ নির্বিশেষে কথাটা এদের বেলাও খাটে।

যথেষ্ট দরিদ্র ও পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীর বোঝা নিয়ে ভারত যে এতো এগিয়ে দ্রুত পরাশক্তি হয়ে যাবার রাস্তায় - এর একটা বড় কারনও নিশ্চয়ই এটাই। যতই গাল দেই না কেন, ইংরেজী ভালো করে জানতে পারাটা এখন নি:শ্বাস নিতে পারার মতোই জরুরী, যদি আমরা সত্যিই পৃথিবীতে এগিয়ে যাওয়া জাতিগুলোর সাথে নাম লেখাতে চাই।


তামিলদের যে রক্তক্ষয়ী ইতিহাস তার সাথে আমার পরিচয় ভাসা ভাসা, পত্রিকার পাতায়। এখানে এসে আরো কিছু বেশী জানতে পারলাম। এক কাস্টমার আমাকে মোবাইলে কিছু রক্তাক্ত ভিডিও দেখালো।

যুদ্ধ এখন শেষ , কিন্তু ওদের মনের ক্ষত একই রকম আছে। বাইরের আঘাত দেখা যায় , মনেরটা না। কিন্তু ভেতরেরটা বাইরের চেয়েও অনেক অনেক গভীর। ঠিক আমাদেরটার মতোই- পাকিস্তানীদের প্রতি। এক ক্রেতা প্রশ্ন করেছিল- আমাদের তো অনেক বিভক্তি, তোমাদের তো ধর্মও এক ছিল , তারপরেও এরকম যুদ্ধ হলো কেন?

ধর্মে নামে এক হলেও তার শিক্ষাগুলোকে যখন মানুষ মনে রাখে না, তখন ধর্মের আর দোষ কি?পাকিরা মনে করতো তারা গৌরবর্ণ, সুন্দর লম্বাচওড়া -আশরাফ আর আমরা বাঙালিরা কালো বেটেখাটো কুৎসিত -আতরাফ শ্রেনীর ।

একই বিষয় যদিও হয়ত ধর্মের নামে না, সিংহল, তামিল সংঘর্ষেও খাটে- নিজেই ভালো, উঁচু শ্রেনীর আর সব নিচু , খারাপ। শান্তির ধর্ম ইসলামের সঠিক অনুসরন মানুষের জীবনকে যেমন সুন্দর করতে পারে,তার বিকৃত অনুসরন জীবনকে তেমনই অভিশপ্ত করে তোলে- একথা না মুসলিমরা তখন শিখেছি আর না এখন। বানরের কলা নিয়ে কামড়াকামড়িতে মাঝখান থেকে মোড়ল শেয়ালেরই লাভ।

কিন্তু এসব পুরনো কথা , সবাই-ই জানেন। যদিও মানেন খুব কম।

তামিলদের কথা জেনে আমার নতুন যা লাগলো তা হচ্ছে আমরা কতটাই না আত্নকেন্দ্রিক । ঘরের কাছে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে। এখনও আশেপাশের কত দেশে কত রক্ত , কত অশ্রু। কিন্তু আমরা আক্ষরিকভাবেই ভাবেই পাশের ঘরে কে আছে , কেমন আছে তার কোন খবরই রাখি না, পাশের দেশ তো দূরের কথা। আমি , আমরা যখন সিনেপ্লেক্সে নতুন আসা মুভিটা নিয়ে গল্প করছি, তখনও পাশের দেশের একটি মানুষ জীবনের দাবিটা নিয়ে লড়ছে! তবুও জীবন ত এমনই তাই না? দ্য শো মাস্ট গো অন....

আমার নতুন কাজটাতে বেতন খু-ব- ই কম।

তাও আপাতত আপদকালীন কাজ হিসেবে খপ করে লুফে নিয়েছি। ভাবটা ছিল এমন, একটা জব তো আছে, এখন অবসর সময়ে ভালো একটা কাজের জন্য আবেদন করতে থাকবো। কাজ পাওয়া এখানে কারো কারো জন্যে খুব সোজা, কিন্তু বেশীর ভাগেরই লটারীর মতো। টিকেট কিনতে কিনতে যদি হঠাৎ নম্বর উঠে পড়ে! বাংলাদেশের মত এখানেও অভিজ্ঞতার জয়জয়কার। আর আনকোরা নতুন কেউ তা পাবে কোথ্থেকে ? এজন্য নানা ফন্দি ফিকির আছে।

বানিয়ে বানিয়ে লিখে একটা দোকানের ঠিকানা দেয় মানুষজন। ফোন নম্বরটা থাকে বন্ধুবান্ধবের, ফোন সাধারনত কেউ করে না, যদি যাচাই করতেও চায়, বন্ধু ফোন ধরে ভুয়া চাকরির ''সত্যতা'' প্রমান করে দেয়। তাও কাজ পাওয়াটা যথেষ্ট কষ্টকর। সুপারিশ থাকলে ভিন্নকথা। আমার তিন তিন জন বন্ধু শ দুই আবেদনের পরে কাজ পেয়েছে।

অবাক কান্ড! প্যাথেটিক ব্যাপারটা হল, এদের মধ্যে দুজনই কাজ পেল তখন ,যখন পাঠ চুকিয়ে দেশে ফেরার সময় প্রায় হয়ে এসেছে!

যাই হোক, আমি কাজ শুরুর সময়ে যা ভেবেছিলাম তা আর করা হলো কই? চাকরির গোলকধাঁধায় আটকে গেছি। সপ্তাহে ত্রিশ ঘন্টা কাজ আরও আছে ফার্মের কাজটাও। তারপরে ক্লাস তো আছেই। এরপর আর সময় কোথায়? দেখা হলেই চাচা ধমক দেন , তোমার এইসব হাবিজাবি চাকরী ছেড়ে একটা ভালো জবের জন্য এপ্লাই কর, সব আলসেমীর তো একটা লিমিট থাকতে হয়...কতদিন কাটিয়ে দিলে, ভালোমত চেষ্টা করলে না, নাহলে এতদিনে ঠিক জুটে যেতো....।

আমি আর কি বলি?

সময় নেই ।

আমার এখন অলস সময়েরও বড়ই অভাব....।


এখন আমার নতুন চাকরীর অভিজ্ঞতা একটু শেয়ার করি। কাজে বহুরূপী হলেও নামে যখন রিয়া মানি ট্রান্সফার, তখন কাগজে কলমে ওটাই বোধহয় আসল কাজ হিসেবে লেখা যায়। সকালের প্রথম কাজ শ্রীলঙ্কান ও ভারতীয় হালনাগাদ বিনিময় রেটটা জেনে নিয়ে বাইরের সাইনবোর্ড ও দোকানের স্টিকি কাগজটাতে তিনটা কপি বের করে লাগিয়ে দেয়া । এই দুই দেশই শুধু আলাদা ভাবে বের করার কারন হলো, আমাদের দোকানে মূলত এই দুই দেশী আরো বিশেষভাবে বললে, তামিল লোকজনই আসে বেশী, যেহেতু মালিক ঐ ভাষী।

আমরা যেমন বাঙালি দোকানে যেতে বেশী পছন্দ করি -ঐরকমই।

তো এর পরে ঝাড়পোছ শেষে দোকানে বসে থাকা, আক্ষরিক অর্থেই। বেশীর ভাগ সময়েই দোকানের লোক তেমন আসে না।

একসময় ব্যাংকে কাজ করেছি. প্রবেশনারী সিনিয়র অফিসারের গালভরা পোষ্টে আমার শুরুটা হয়েছিল ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে। আরও অনেকেরই হয়।

তো সেখানে অনেক ধরনের কাজের মধ্যে একটা ছিল যাদের আত্নীয়স্বজন বিদেশ থেকে টাকা পাঠায় তাদের ফরম পূরণ , আমাদের তথ্যভান্ডারে থাকা নামধাম টাকার পরিমান, সাংকেতিক নম্বর মিলিয়ে দেখা, তারপরে সিলছাপ্পর মেরে ক্যাশে টাকা তোলানোর জন্যে অনুমোদন দিয়ে দেয়া। এখানে আমার কাজটা পুরো উল্টাপিঠের। এখান থেকে লোকজন তাদের দেশে টাকা পাঠায়, তাই এদেরকে পাঠানোর পরে পিন নম্বর দিই। টিক মেরে মেরে দেখিয়ে দেই কোন তথ্যগুলো তাদের অপর পাশের প্রিয়জনদেরকে জানিয়ে দিতে হবে। মজাই লাগে , একই মুদ্রার দুই দিক ভাগ্যক্রমে কেমন দেখা হয়ে গেল!

দোকানের ব্যস্ততা কখনোই খুব একটা বেশী থাকে না।

তাই জীবনে প্রথমবারের মত এই কাজ করতে করতে আমি আমার দেশের ড্রাইভারদের দু্ঃখ বেশ বুঝতে পেরেছি! কেন বললাম? !

দেশী চালক ভাইদের কাজটা কেমন? সকালে সাহেব, বেগমকে অফিসে নামিয়ে দেন, বাচ্চাগুলোকে যার যার স্কুলকলেজে। কাজ শেষে বিকেলে - সন্ধ্যায় বাড়িতে নিয়ে আসা। জ্যামে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয়,যাওয়া আসা দুই সময়ের মাঝামাঝিতেও। যারা ক্ষেপ খাটেন তাদের কথা অবশ্যি আলাদা। অনেক ড্রাইভারকে দেখেছি ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়িতে বসে ঘুমাচ্ছেন।

গানটান শুনছেন। যাই করেন গতিবিধি সেই গাড়িকে ঘিরে । ওটা ছেড়ে আশে পাশে যাওয়ার জো নেই। আমারও একদম তাই। চেয়ার ছেড়ে , দোকান ছেড়ে দশ এগারো ঘন্টা নড়বার উপায় নেই।



দোকানে লোক জন খুব কম আসে, আগেই বলেছি। কিন্তু দোকান আগলে সেই একখান গদিমোড়া চেয়ারে সারাদিন ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা যে কত ক্লান্তিকর তা বাইরের কাউকে বোঝানো অসম্ভব।


দোকানে নিজেকেই সব দেখতে হয় সত্যি- কিন্তু শুরুতে যখন শুনেছিলাম একাই এই দোকান ম্যানেজ করতে হবে , বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। মালিক তখন কিছুদিন ছিল কাজ কর্ম দেখিয়ে দেবার জন্যে। তার মূল লাভের ব্যবসা ম্যান এন ভ্যান সার্ভিস।

কী একটা কারনে মি: রিচার্ডের ড্রাইভিং লাইসেন্স স্থগিত ছিল - ছ মাসের জন্যে। যখন আমি কাজে ঢুকেছি তখন আর সপ্তাহ দুয়েক বাকি নিষেধের মেয়াদ শেষ হতে। ঐ কদিন একটু কাজ বুঝেছি তার কাছে থেকে । কোন কারনে ঐ লোক দোকানের বাইরে বের হলে ভয় লাগত, ক্রেতার কাজ নিয়ে যদি কোন সমস্যায় পড়ি ? এখন মালিক লাইসেন্স ফিরে পেয়েছে, দোকানে সপ্তাহে দুসপ্তায় একবারে দেখি কি দেখি না। একাই সামলাতে অভ্যাস হয়ে গেছে , সে থাকলেই বরং সঙ্কোচ হয়।

কোন একটা পড়া সাহিত্যের ধার করা ভাষায় জুৎসই লাইনটা পড়েছিলাম, ''সময় ও অভ্যাসের এমনই মহিমা। ''


এ প্রসঙ্গে আবার ব্যাংকের কথা বলি। প্রথম প্রথম যখন কাজ করতাম , এক সিনিয়র আপু কাজ বোঝাতেন। কোন সমস্যা হলেই চিন্তা নেই, আপু তো আছেনই । একবার এজিএম- এ ওনার দ্বায়িত্ব পড়লো।

আমাকে একাই ঐ দিন কাজ দেখতে হবে-এই অবস্থা। কি যে টেনশন! দিনশেষে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। এরপর কতবার কত কারনে একা একাই কাজ করতে হয়েছে- শেষের দিকে উনি না থাকলেই বরং স্বস্তি লাগতো, কেননা আমাদের বসার জায়গাটা ছিল বেশ আটসাট, কম্পিউটারও একটা , দুজনের চেয়ে একজনে আরাম করে বসে শান্তিমতো কাজ করতে পারতাম !

আমার কাজ সপ্তাহে তিনদিন। বাকি কয়দিন যে মহিলাটি দেখেন তার প্রসঙ্গে আলাদা করে কিছু না লিখে পারছি না- অন্যরকম একটা মানুষ। মহিলার নাম দেবী।

শ্রীলঙ্কান তামিল। মালিকের বন্ধুস্থানীয় পরিচিত। তার মধ্যে মায়া ও মাতৃ ভাব দুই-ই প্রবল। মায়ের মমতায় তিনি দোকান দেখেন। আমার জন্যে মাঝে সাঝে খাবার নিয়ে আসেন ঘরে রান্না হলে, সুন্দর করে বক্সে আটানো কয়েক পদের তরকারী , সাথে সরু সরু চালের ধবধবে ফুলের মত ঝরঝরে সাদা ভাত ।

এমনকি খেতে খেতে চাটনীরও আভাস পেলাম। একবার বোম্বাই সাইজের সিঙ্গারা চপ জাতীয় খাবার নিয়ে হাজির। দোকানের অবশ্যি। শুধু যে আমার জন্যেই তা না, মালিক যদি আসে তার জন্যেও আরেক পোটলা ভরা। দোকানের কাজগুলো এমন ভাবে দেখেন যেন নিজেরই দোকান।



অথচ অবাক ব্যাপার হলো দুমাসের উপর হলো কাজ করছেন এখানে, এখনও একটা পেন্সও বেতন দেয় নি তাকে বস। হতে পারে যে তার টাকার এই মুহূর্তে দরকার নেই। নিজের স্বামী আছে ,সংসার আছে, আমার মত কাজ থেকে প্রাপ্তি তাঁর মাসটা কাটানোর পেছনে জ্বালানি জোগায় না, তারপরেও অবাক লাগে। মালিকই বা কেমন আর কেমন তার শ্রমিক কর্মচারী!অথচ মালিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকউন্টে তো টাকারও কোন অভাব নেই । আশ্চর্য!

মাসের পরে মাস বেতন বিহীন থেকে যাবার পরেও দেবীর তা নিয়ে দেখলাম কোন মাথাব্যাথা নেই ।

মাসকয়েক আগে যখন এসেছি তখনও তার কাজে যেমন মনোযোগ , আগ্রহ ছিল , এখনও তাই আছে। কম্পিউটারে আমার নিজের যে খুব বেশী জ্ঞান তা নয়, তাঁর আরও কম। তবু কাস্টমারের কোন সমস্যায় একঘন্টা ধরে হলেও সমাধানের চেষ্টা শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যান। পুঁজিবাদী ঘোর বৈষয়িক সমাজে এখনো খোদ লন্ডনে এরকম মানুষ টিকে আছে, কি অবাক একটা ব্যাপার!

তামিলে আক্কা মানে বড় আপু বা বোন, আন্না মানে ভাইয়া , বড় ভাই।
দেবী আক্কার কাছ থেকে কিছু দু-একঅক্ষর তামিল শিখেছি।

মহিলাটি চমৎকার হলেও একটা মাত্র সমস্যা, ইংরেজীটা বড়ই শোচনীয়। তার সাথে কথা চালানো এক মারাত্নক কষ্টদায়ক ব্যাপার। কিছুদিন দোকানে তার থেকেও শুরুতে শুরুতে কাজ শিখতাম, দেখা যেত -উনি যা বলছেন আমি তা বুঝিনা। আবার আমি যা বলছি উনিও তা বুঝতে পারছেন না -এমন অবস্থা!


এরই মাঝে একদিন উনি আমাকে প্রস্তাব দিলেন , আমার সাথে ফোনে নিয়মিত ঘন্টাখানেক করে কথা বলে বলে উনার ইংরেজীটা গড়সড় করবেন। সাধু প্রস্তাব সন্দেহ নেই কিন্তু আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম।

একে তো যে দিন কাজ থাকে না ঐ দিন ক্যাম্পাসেই পড়া নিয়ে কাটে তারপর আছে অন্য ফার্মের কাজটা। তারচেয়ে বড়-আসল কথা হলো তাঁর সাথে কথা বলে বলে ইংরেজী শিখানোটা বিশাল দুঃসাহসের ব্যাপার, সামনাসমানি কথা চালালোই যথেষ্ট কষ্টকর আর ফোনে তো কথাই নেই । পারতপক্ষে আমি এই কারনেই মূলত ম্যাসেজ পাঠিয়ে কাজ সারার চেষ্টা করি ,তাতে বোঝার ব্যাপারে কোন অস্পষ্টতা থাকে না।

তো ফিরে আসি কাজের কথায়-এখন কাজ মোটামোটি শেখার পরে নিজেই দোকান খুলি বন্ধ করি। এ এক মজার নতুন অভিজ্ঞতা আমার জন্যে।

মাথার উপরে সদা তটস্থ করে রাখার মত একজন বস ফিগার নেই। এক আলাদা ক্ষমতা ও স্বাধীনতা আছে এর। কিন্তু সমস্যাও কম না। বস হবার সুবিধা ও অসুবিধা দুটা দিকই এখন বেশ বুঝতে পারছি। দোকানে ক্রেতা যথেষ্ট কম।

আয়রোজগারও। তা বলে ভাড়া তো আর তা নয়। তাই ওটা তুলতে গিয়ে ফটোকপি প্রিন্ট এইসবের দর যথেষ্ট চড়া। লোকজন এসব নিয়ে আমাকে শোনায় , অভিযোগ করে। আমি নাচার।

তারপর আছে মালিকের ল্যাপটপ , ফোন এইসব মেরামতির কারবার। শুরুতে যখন কিছুদিন লাইসেন্স বিহীন বসে ছিল, তখন আমি তাকে কিছু কিছু কাজ করতে দেখেছি। আমার ভূমিকা ছিল মাঝে সাঝে স্ক্রু খুলে , ভেতরটাতে কিছু জমেটমে আছে কিনা ক্লিনার ব্রাশ ইত্যাদি দিয়ে পরিষ্কার করা। কোন যন্ত্রাংশ নষ্ট হলে তার কথামতো ই-বেতে মডেল খুঁজে অর্ডার দেয়া। তাতে মেরামতে আমার যৎসামান্য বিদ্যা হয়েছে ঠিকই কিন্তু এ দিয়ে লোকজনের দামি জিনিসগুলো ঠিক করে দেয়ার দ্বায়িত্ব নেয়া সম্ভব নয়।



মি: রিচার্ড এখন লাইসেন্স ফিরে পেয়ে রাজ্যের জমা পড়া এসব কাজের দিকে এখন আর মন দেয় না। টাকালোভী ব্যবসায়ীদের অবস্থা হচ্ছে খাদ্যলোভী পেটুকের মতো। খেতে পারুক না পারুক , সব পাতে নেয়া চাই-ই। তখন তো ছিলই , এখনও সুযোগ পেলে এসব কাজ হাতে নেয়- সরাসরি সশরীরে দোকানে থাকতে পারে না বলে ফোনের মাধ্যমে। তার মূল ব্যবসা ভ্যান নিয়েই সে মহাব্যস্ত দোকানে আসবে কখন?সমস্যা বাধে তখনই যখন সে এই মেরামতির কাজগুলো জমাতেই থাকে।

কিছু নিজে পারবে না বলে অন্য মোবাইলের দোকানটাতে দিয়ে দেয় কিন্তু কম্পিউটারের ব্যাপারে তো তা করার উপায় নেই। লোকজন ঘুরে ঘুরে আসে , চোখ লাল করে জানতে চায় এখনও ঠিক করা হলো না কেন? সামনে তো মালিককে পায় না তাই আমাদেরকেই এসব বিরক্তির ঝাল স্বাদ হজম করতে হয়। চিন্তা করুন তো অবস্থাটা! লোকে তিতিবিরক্ত হয়ে জিনিস ফিরিয়ে নিতে চায়-তারো উপায় নেই। রিচার্ড ফোনে বলে, আগামীকালকেই ঠিক করে রাখবে। কত আগামীকাল পার হয়ে যায় , একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটে চলে......।




কাজ করতে গিয়ে কিছু মজার মজার লোকজনদের দেখাও পাই। একজন রোমানিয়ান লোক আসে- প্রায়ই। এক অক্ষরও মনে হয় ইংরেজী জানে না । দোকান বন্ধ হয় সাড়ে আটটা নটার দিকে , শেষ ঘন্টাগুলোতে নিয়মিতভাবে তার আগমন ঘটে। দেখা গেল আধঘন্টা নেট ব্যবহার করেছে, হাতের ইশারা দিয়ে বোঝায় আবার সে আসবে আরেক দফা ব্যবহার করতে।

তখন দেখা যায় দোকান বন্ধ হবার সময় ঘনিয়ে আসছে- মিনতি করে মোবাইলে ঘড়ির ছবি বের করে হাত দিয়ে কাঁটা দেখিয়ে বোঝায় আর আধঘন্টা , অন্ততপক্ষে পনেরটা মিনিট তাকে ব্যবহার করতে দেয়া হোক!

একদিন বেশ আনন্দ পেলাম তার কর্মকান্ড দেখে । ইংরেজী তো বিশেষ জানে না। সেদিন আট মার্চ, নারী দিবস। ফেসবুক ওপেন করেছে, তাতে ওর ভাষার লেখা আমার কাছে সাংকেতিক ভাষার চেয়ে কোন অংশে কম না। কিন্তু ছবির ভাষা সার্বজনীন।

নারীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে আঁকানো একটা ছবি দেখিয়ে বারে বারে আমাকে ডাকতে লাগলো। ইঙ্গিতে বুঝলাম আমাকে সে নারী দিবসের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে!

এই যে এতক্ষণ বসে থাকতে হয় , কিভাবে সময় কাটাই? পেপারটা পড়ি আগাগোড়া। অনলাইনে গড়ে দুটা তিনটা বই শেষ করি প্রতিদিন । প্রথম ধরেছি আমার অন্যতম প্রিয় জাদুগরী লেখক হুমায়ুন আহমেদের বই। এসব পড়ার সূত্রেও অনেক মজার ব্যাপার ঘটে।



একদিন এরকমই পেপার পড়ছি নেটে, একজন ক্রেতার অবাক প্রশ্ন ,ইউ নো বেঙ্গলী?
পরিচয় হয়ে অবাক আনন্দে আবিষ্কার করলাম প্রশ্নকারীও বাঙালি। এরকম ব্যাপার বার কয়েক হয়েছে। এই চাকরিতে ঢোকার আগে বাংলাদেশীরা যে এই অঞ্চলে আছে তেমন করে টের পাইনি। এখন মাঝে মাঝেই বাঙালিদের দেখা পাই দোকানে। এরকম একজনের সাথে দেখা -ভার্সিটির শিক্ষক।

অনেক দিন ধরে এদেশে আছেন , এখন দুবাইতে কাজ নিয়ে চলে যাবেন। অনেক ভালো বেতনের ভালো চাকরি। এই সংক্রান্ত কাগজপত্র স্ক্যান করাতে এসেছেন। আনন্দের আতিশয্য আভা তার চোখে মুখে ফুটে বেরুচ্ছিলো। আমাদের দেশের মানবেতর জীবন যাপন করা প্রবাসী ভাইবোনদেরদের ছবিই সাধারন ভাবে চোখে পড়ে।

এরকম একজন বিদেশ বিভূঁইয়ে সফল বঙ্গসন্তানের ঝলমলে মুখটা দেখে তাই একটু বেশীই ভালো লাগলো। নিয়মের বাইরে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম!


আমার দোকানটা একগাদা কাজ করানোর জন্যে আছে বটে। কিন্তু খুবই অপেশাদার। পার্সেলের কাজ বেশ আগে থেকে ছিল, কঠোর মনিটর করার ব্যবস্থা না থাকায় হারানো যাওয়ার ঘটনাও ছিল। এখন চালু হয়েছে বাক্সের গায়ে নম্বর দেয়ার প্রথা।

নানা রকমের কাজ একসাথে শিখেছি এখানে। এর মাঝে বিশেষ করে পাউন্ড পাঠানোর ব্যবস্থাটা আমার কাছে যথেষ্ট ঝুঁকির মনে হয়- একজন এমপ্লয়ির দিক থেকে। একগাদা পাউন্ড নিয়ে যখের মত পাহারা দিতে হয়। দোকানটা ভেতরের দিকে, ক্যামেরাও নেই । কোন নূন্যতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই।

মার্কেটটার বেশীর ভাগ দোকান আমাদেরটার আগে বন্ধ হয়ে যায়। কারো পক্ষে টাকাকড়ি ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাওয়া কঠিন হতে পারে- অসম্ভব মোটেই নয়।

আমার কাজের মূল ব্যাপারটা আসলে পরিশ্রম না, বিশ্বস্ততা। আর সব মানবিক গুণাবলীর মতোই ওটার দামও বোধ হয় আজকাল আর তেমন নেই। তাই পুরো দোকানটার এত দ্বায়িত্ব নিতে হলেও পারিশ্রমিক অকল্পনীয় কম।

অন্যজনের কথাতো আগেই বলেছি। দুমাসের উপর হয়ে গেছে- দেয়ার নাম নেই। বেশীর ভাগ ব্যবসায়ীদের- সবাই না, চক্ষলজ্জ্বাও মনে হয় কম থাকে। মাস গড়িয়ে যায় , তাও পেমেন্ট দেয়ার নামগন্ধ নেই। অথচ চাকরি নেবার সময় আমার সাথে কথা হয়েছিল সাপ্তাহিক পারিশ্রমিকের।

যত দোষই থাকুক আগের কাজটায় অন্তত এ ব্যাপারে মালিকপক্ষ নিয়মিত ছিল। এখানেই দেখলাম ব্যাতিক্রম। একে তো ঘন্টাপ্রতি অবিশ্বাস্য কম রেট , কিভাবে কোনটার খরচ সামলাবো সেই চিন্তায় অস্থির থাকতে হয়। তারপরে সামান্য কটা পাউন্ডের জন্য ঘোরাতেই থাকে, ঘোরাতেই থাকে...। একবার তো অবস্থা এমন হল- অ্যাকাউন্টে দেখলাম মাত্র একুশ পাউন্ডের মত আছে।

তখন মাসের সবে শুরু। কত রকমের খরচ। পরীক্ষার ফি দেবারও সময় চলে এসেছে। ঐ লোকের হাত থেকে কিছুতেই টাকা গলানো যাচ্ছে না। টেনশানে মাথা খারাপ হবার জোগাড় ।

নতুন এখন আর বলা যায় না আমাকে, পারিশ্রমিক আদায় করতে এই কান্ড প্রতিবারের সাধারন ঘটনাতে পরিণত হয়েছে।

সামনে কাড়িকাড়ি টাকা, সব মানি ট্রান্সফারের- দুহাতে আগলাই বসে বসে, আর নিজের খরচগুলো কিভাবে মিটাবো এই চিন্তায় মাথায় যন্ত্রণা হতে থাকে। নিজেকে গাড়ির ড্রাইভার নয়, এটিএমের সামনে বসে থাকা অতন্দ্র প্রহরী গার্ডের মত মনে হয়, একই অভিন্ন অনুভূতি! একই চাকরীর সুবাদে কত যে অভিজ্ঞতা হলো! ''সমুদ্রের লোনা পানি চারিদিকে, তৃষ্ণা মেটাবার মত একবিন্দু নেই কোথাও..। '' কবিসাহিত্যিকেরা নেহাত ভুল কথা বলেন না, আমাদের মতো মানুষদের জন্যেই সম্ভবত কথাটার সৃষ্টি, বড়ই খাঁটি একটা কথা.., সন্দেহ নেই তাতে...।

রেজওয়ানা আলী তনিমা
এপ্রিল ১০,'১৪ ইং ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.