আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলা সাহিত্যের সৃজনশীল গদ্যশিল্পী, কবি ও শিক্ষাবিদ অমিয় চক্রবর্তীর ১১৩তম জন্মবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা


রবীন্দ্রোত্তর যুগের আধুনিক বাংলা কবিতার শীর্ষস্থানীয় বাঙালি সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ অমিয় চক্রবর্তী। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বিশেষ ঘনিষ্ঠ অনুজ কবি। এক সময় রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যসচিব হিসেবে তাঁর প্রজন্মের অন্য সব কবির তুলনায় তিনি রবিন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে ছিলেন সবচেয়ে বেশি। আধুনিক বাংলা কবিতার কবি বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ ও বিষ্ণু দে’র সঙ্গে কবি অমিয় চক্রবর্তীর নাম অবিনাশী বন্ধন ও সমসাময়িকতার বিস্ময়ে জড়িয়ে আছে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "খসড়া" রবীন্দ্রপ্রভাব বর্জিত আধুনিকতার অনন্য বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত।

অমিয় চক্রবর্তী ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিন দশক যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়ার্ড, বস্টন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক প্রাচ্য ধর্ম ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। এদিক থেকে এক বিশ্ব নাগরিক মননের অধিকারী তিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মাটির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল সব সময় অবিচ্ছেদ্য। আজ এই বরেণ্য কবি ও শিক্ষাবিদের ১১৩তম জন্মদিন। ১৯০১ সালের আজকের দিনে তিনি পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে জন্মগ্রহণ করেন।

জন্মদিনে কবির প্রতি আমাদের ফুলেল শুভেচ্ছা।


অমিয় চক্রবর্তী ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ১০ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের হুগলিতে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তী। তাঁর পিতার নাম দ্বিজেমচন্দ্র চক্রবর্তী এবং মাতা অনিন্দিতা দেবী। পিতা দ্বিজেমচন্দ্র চক্রবর্তী আসামে গৌরীপুরএস্টেটের দেওয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং তাঁর মা অনিন্দিতা দেবী ছিলেন সাহিত্যিক।

যিনি "বঙ্গনারী" ছদ্মনামে প্রবন্ধ-বিন্ধ প্রকাশ করতেন। অনিন্দিতা দেবী সংস্কৃতে পারদর্শী ছিলেন বলেই চার সন্তানকে সংস্কৃত শিখিয়েছিলেন নিজেই। গৌরীপুরের সংস্কৃত টোল থেকে প্রখ্যাত পণ্ডিতকে তিনি নিযুক্ত করেছিলেন কালিদাস, ভবভূতি, ভারবি প্রমুখের রচনা পাঠের সুবিধার্থে। এভাবেই অমিয় চক্রবর্তী শৈশবেই ব্যাকরণে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। শৈশবে যে সব স্কুলে অমিয় চক্রবর্তী অধ্যয়ন করেছেন সেগুলো হলো গৌরীপুরের প্রতাপচন্দ্র ইনিট্টটিউশান ও কলকাতার হেয়ার স্কুল।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে হাজারিবাগে আইরিশ মিশনের সেন্ট্ কোলাম্বাস কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন, বটানিতে বি.এ. ডিগ্রী লাভ করেন। কিন্তু ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ থেকেই বিশ্বভারতীর কাজে কর্মে জড়িয়ে পড়লেন ঘনিষ্ঠভাবে। ফলে ইণ্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়ার যে আশৈশব স্বপ্ন তাঁর ছিল তা’ এক নিমেষে উবে গেল। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সুযোগ হলো সংর্কীণ। তিনি এম. এ. পরীক্ষা দিলেন বটে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র হিসেবে নয়, পাটনায় প্রাইভেট ছাত্র হিসেবে।

শেষাবধি ১৯২৬ সালে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. ডিগ্রী লাভ করেন।

(১৯৩০ সালে জার্মানীতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে অমিয় চক্রবর্তী)
১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য-সচিব হিসেবে যোগ দেন। এজন্য ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে স্থায়ীভাবে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন অমিয় চক্রবর্তী। সাহিত্য সচিবের দায়িত্ব ছাড়াও পরে অবশ্য বিশ্বভারতীর সকল প্রকার কাজেই অমিয় চক্রবর্তীকে জড়িয়ে পড়তে হলো ; বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ও রথীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতে। পরের বছর রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগেই তাঁর বিয়ে হয় ড্যানিশ কন্যা হিয়োর্ডিস এর সঙ্গে।

রবীন্দ্রনাথ বিদেশিনী নববধুর নাম দিয়েছিলেন হৈমন্তী। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে বার্মিংহামে থাকাকালীন সময়ে তাদের একটি কন্যা সেমন্তী(ভট্ট্রাচার্য)-এর জন্ম হয়। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব হিসেবে কাজ করেন অমিয় চক্রবর্তী।

((অমিয় চক্রবর্তী ও কবি বুদ্ধদেব বসু)
এর পর উচ্চশিক্ষার্থে তিনি ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলিয়ল কলেজের ছাত্র হিসেবে ১৯৩৪-৩৭ পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পান। ১৯৩৭ সালে তিনি ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডির কবিতা নিয়ে অভিসন্দর্ভ রচনা করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে ডি.ফিল. ডিগ্রী লাভ করেন।

তার গবেষণার বিষয় ছিল: The dynasts and the post war poetry : a study in modern ideas. কর্মজীবনে অমিয় চক্রবর্তী ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত হাওয়ার্ড, বস্টন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক প্রাচ্য ধর্ম ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। সেই সময় তিনি আলবার্ট আইনস্টাইন, কবি ইয়েটস, রবার্ট ফ্রস্ট, আলবার্ট সোয়ইটজর, বোরিস পাস্তেরনাক, পাবলো কাসালস প্রভৃতি বিখ্যাত মনিষীর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর প্রথমদিককার কবিতা রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থাকলেও তিনি অচিরেই স্বকীয়তা অর্জ্জন করেন। ছন্দ, শব্দ চয়ন, শব্দ ব্যবহারের ধাঁচ, পংক্তি গঠনের কায়দা সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন বাঙালী কবিদের মধ্যে অনন্যসাধারণ। কঠিন সংস্কৃত শব্দও তাঁর কবিতায় প্রবেশ করেছে অনায়াস অধিকারে।

তাঁর কবিতায় জাগ্রত চৈতন্যের সঙ্গে সঙ্গে অবচেতনার প্রক্ষেপ পলিলক্ষিত হয়। সৃজনশীল গদ্যশিল্পী ও কবি অমিয় চক্রবর্তীর উল্লেখ যোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছেঃ ১। এক মুঠো, ২। মাটির দেয়াল, ৩। অভিজ্ঞানবসন্ত, ৪।

পারাপার, ৫। পালাবদল, ৬। পুষ্পিত ইমেজ, ৭। অমরাবতী, ৮। ঘরে ফেরার দিন ও ৯।

অনিঃমেষ। তাঁর পারাপার ও পালাবদল কাব্যের পটভূমি চার মহাদেশ পরিব্যাপ্ত। তাঁর গদ্যগ্রন্থগুলো হচ্ছেঃ ১। চলো যাই, ২। সাম্প্রতিক, ৩।

পুরবাসী এবং ৪। পথ অন্তহীন।

(অমিয় চক্রবর্তী নেহরুর কাছ থেকে দেশিকোত্তম উপাধি নিচ্ছেন)
বাংলা কবিতায় আধুনিকতার পথিকৃত ও পঞ্চপাণ্ডবদের অন্যতম কবি অমিয় চক্রবর্তী সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৬০ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার, ১৯৭০ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কার, দেশিকোত্তম ও ভারতীয় ন্যাশনাল একাডেমী পুরস্কার সহ বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৬ সালের ১২ জুন মৃত্যুবরণ করেন এই বরেণ্য শিক্ষাবিদ ও কবি। আজ তাঁর ১১৩তম বার্ষিকী।

কবি অমিয় চক্রবর্তীর জন্মবার্ষিকীতে আমাদের ফুলেল শুভেচ্ছা।
 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।