আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধোঁয়া কিংবা সঙ্গ-নিঃসঙ্গতার গল্প

লিখতে গিয়েই নিজেকে খুঁজে পাই কম্বলটা গলা পর্যন্ত টেনে- খাটের স্ট্যান্ডের সাথে বালিশে হেলান দিয়ে; আধশোয়া অবস্থায়ঃ ইউজিন ও’নীলের লেখা,”ডিজায়ার আন্ডার দ্যা এলমস” নাটকটি পড়ার চেষ্টা করছি। ইংরেজীতে জ্ঞান আমার এমনিতেই খুব কম, তাতে নাটকটি আবার আঞ্চলিক ইংরেজীতে লেখা! যে শব্দ গুলোর অর্থ উদ্ধার করতে পারছিনা, সেগুলো বোঝার জন্য বার বার অভিধানের পাতা উল্টাতে হচ্ছে। এ যে কি যন্ত্রনা-ভূক্তভোগী ছাড়া কেউ ভাল বুঝে উঠতে পারবেনা। বিরক্তিতে মাঝে মাঝে ইচ্ছে হচ্ছে মাথার সমস্ত চুল টেনে-টেনে উঠিয়ে ফেলি। চুল ছেড়ার ইচ্ছেটা অনেক কষ্টে দমন করে-বার বার উঠে বসে অভিধানের পাতা উল্টাতে উল্টাতে; কিছুটা বুঝে, অধিকাংশ না বুঝে ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকি।

হঠাৎ করেই খেয়াল করি, বইয়ের অক্ষর গুলো আর ছোটটি নেই আস্তে আস্তে বড় হতে শুরু করেছে; এভাবেই একসময় তারা পেয়ে যায় দানবাকৃতি। ভয়ে আমার কলিজা জবাই করা মুরগীর মত লাফাতে শুরু করে। রক্তের একটি অবশ স্রোত পায়ের পাতা লক্ষ্য করে নামতে থাকে; বইটি হাত থেকে নিচে পরে যায়। কানে ভেসে আসে একটানা বিরামহীন গোঙ্গানির শব্দ, তাকিয়ে দেখি ঘরের সব আসবাবপত্র একেকটি বিরাট বিরাট একচোখা দানবে পরিণত হয়েছে। তারা গোঙাতে গোঙাতে, আমাকে গ্রাস করতে আসছে দল বেঁধে।

আমি কম্বলটাকে মাথা পর্যন্ত টেনে নিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকি, কাঁপুনির মাত্রা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর, দরজায় মৃদু টোকার শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। আমি কিছুটা আশ্বস্ত হই, ভাটার পানির মত ভয় নেমে যেতে থাকে ধীরে। এরকম মৃদু টোকা দেওয়ার ক্ষমতা কেবল মানুষেরই আছে; কোন দানবের নয়। দরজা খুলে দেখি উজ্জ্বল হাসিতে মুখটা ভরিয়ে দিয়ে নিবির দাঁড়িয়ে আছে।

মুষলধারে বৃষ্টিতে কোন চাতক পাখি গাছের ডালে বসে, তার হা করা মুখটি অনেকক্ষণ উঁচিয়ে ধরে রাখার পর, একফোটা পানি মুখে এসে পড়লে যে অনুভূতি হয়; ওকে দেখে আমার মনে সে সেরকম একটি অনুভূতির জন্ম নিল। আমি অনেকদিন ধরে পাইনি মানুষের মনের স্পর্শ, কারো হৃদয়ের উত্তাপ করিনি অনুভব-কেউ তার মনের দুটি কথা শুনানোর জন্য আসেনি কাছে এবং কারো প্রতি খুলে দিতে পারিনি আমার জং ধরা বুকের অর্গল। একের পর এক বইয়ের পাতা উল্টে যাওয়া, চিন্তার অগোছালো সুতার সাথে বিরামহীন সংগ্রাম, হতাশার মাজা পুকুরে ডুবে থাকা আর নিজের সাথেই নিজের অর্থহীন অব্যক্ত কথা বলা শুধু! বন্ধু-বান্ধবের একটা জগত আর সবার মত আমারও ছিল একসময়। কোন আভাস না দিয়েই হঠাৎ বইতে শুরু করে পরিবর্তনের হাওয়া, আস্তে আস্তে সবাই চাকরীতে ঢুকতে শুরু করে-বিভিন্ন বেতনে হরেকরকম পদমর্যাদায়। তারপর থেকে বাদ্য বাজিয়ে, বাজি পুড়িয়ে শুরু হল সাদা-শ্যামল পরীদের আগমন।

একেকটি আলাদা-আলাদা জগত তৈরী হল সবার-সে জগত ব্যাক্তিগত কামনা-বাসনার, লাভ-লোকসানের, আকাংখা-ভোগের। এখন ওরা সবাই আলাদা স্বপ্ন দেখে, অন্যরকম ভাবনা ভাবে, ভিন্ন রাস্তায় একাকী হাঁটে। অথচ আমরা কতদিন কত অভিন্ন স্বপ্নের জাল বুনেছি, অসংখ্য সম্মিলিত রাস্তার পরিকল্পনা করেছি রচনা। ওদের মুখ যত চেনা ছিল আজকাল তার চেয়ে বেশী অচেনা মনে হয়। ভিন্ন কোন গ্রহ থেকে ওরা এসে যেন ডেরা বেঁধেছে এই মাটির পৃথিবীতে।

আমি পারিনি ওদের মত সমাজের অন্ধ গহ্বরে নিজেকে সেঁধিয়ে দিতে। তাই আজ আমি নিতান্তই অসামাজিক! রাষ্ট্র, এনজিও ও বহুজাতিক কোম্পানীর নিকট নিজেকে বিক্রী এবং মিডিয়ার দালালী করতে রাজী হইনি বলে চাকরী করা হয়ে উঠেনি। বিয়ে প্রথাকে অস্বীকার করি বলে কোন যৌবনবতী ললনাকে বানাতে পারিনি আমার যৌনদাসী। আর একটি কচি রমনীর দাসীগিরির বেতন দেওয়ার ক্ষমতাও যে আমার নেই! ভবঘুরে বলে পরিচিতি আমার অনেক দিনের যদিও এখন আর আক্ষরিক অর্থে ভবঘুরে নই; কারন এখন আমি আর আগের মত মাটির পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াই না। যদিও অগোছালো চিন্তার রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়ে অনেক সময় ব্যয় করে থাকি-সেই অর্থে ভবঘুরে বলা যেতে পারে অবশ্য।

আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটির নাম অর্ণব। কত দিন, কত রাত, কত বিকেল, কত সন্ধ্যা, কত সকাল যে একসাথে কেটেছে আমাদের হিসেব করতে গেলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। মনে কোন কষ্ট পেলে, হৃদয়ে কোন সুখানুভূতি হলে, মাথায় নতুন কোন চিন্তা এলে, কবিতার কোন পংক্তি অনেক বেশী ভাল লেগে গেলে; ওকেই প্রথম বলতে হত। যতক্ষণ না আমি ওর কাছে প্রকাশ করতে পারছি-অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতাম। ওর কাছে বলতে পারলেই কষ্ট গুলো দমকা হাওয়ায় উড়ে যেত, সুখানুভূতি গুলো আরো গভীর ও প্রশস্ত হয়ে সাগরের বিস্তার লাভ করত; দুজন একসাথে বসে নতুন চিন্তাটিকে পরিকল্পনার ছকে বেঁধে ফেলতাম।

আর ও কবিতার মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝতনা; ভাল লাগা পংক্তিগুলো শুনে, আমার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত। ওর ফ্যাল-ফ্যালে চোখ দুটো দেখেই পংক্তিগুলো আনন্দে ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে সুদূর নীলিমায় উড়ে যেত। কত রাত যে আমি ভাবতে ভাবতে, কবিতা পড়তে পড়তে, হঠাৎ করে ওর কাছে চলে এসেছি! সপ্তাহ খানেক আগে সন্ধার সময় বিষণ্ণ মনে, ওদের বাড়ীর পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। গোধূলী আলোয় ওর মা আমাকে দেখতে পেয়ে ডেকে নিয়ে বলে, অর্ণব আজকে বাড়ীতে এসেছে, দেখা করে যাও। আমি প্রায় দৌড়ে ওদের ঘরে ঢুকে যাই।

দরজার কাছেই দেখা হয়ে যায় ওর তরুনী ভার্যার সাথে। মেয়েটি আমাকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করেঃ কেমন আছেন? জবাবে আমি শুধু বলিঃ ভাল, আপনি? মেয়েটি এই মাত্র গোসল সেরে এসেছে। ভেজা, স্নিগ্ধ কালো চুলগুলো শুভ্র পিঠে ছড়ানো; টপ টপ করে পানির ফোটা ঝরে পড়ছে। গভীর-কালো, বিশাল-বিশাল চোখ দুটো যেন প্রস্ফুটিত কালো গোলাপের মত পাপড়ি মেলে আছে; পেন্সিলের মত সুক্ষ গাঢ় লাল ঠোঁট দুটো মৃদু মৃদু নড়ছে। নিচের ছড়ানো ঠোঁটের বা-পাশের তিলটিকে মনে হচ্ছে সুদূর অসীমে একটি কালো বিন্দু, আর নাকটিকে যেন কোন এক অখ্যাত শিল্পী তার সমস্ত সৌন্দর্যবোধ দিয়ে অপরূপ ভঙ্গিমায় গড়েই চলেছে, আর অনন্ত কাল ধরে যেন চলতে থাকবে গড়ার কাজ।

অর্ণব খাটে বসে হিন্দী সিরিয়াল দেখছিলো। আমাকে দেখা মাত্রই হাত ধরে নিয়ে এসে খাটের উপর বসিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করেঃ হেই তোর খবর কিরে, দেখাই পাওয়া যায়না-কি করছিস আজকাল? বলার ভাবে আন্তরিকতা আনার চেষ্টা করলেও ওর কন্ঠ স্বর জুড়ে ছিলো সাইবেরিয়ার শীতলতা, চোখ দুটো ছিলো প্রচন্ড রকমে ভয় পাওয়া, যেন আমাকে দেখামাত্র নয় নম্বর মহা বিপদ সংকেত পেয়েছে। আমার বিহ্বলতা কর্পূরের মত হাওয়ার উড়ে যেতে থাকে। যদি কোন এক ক্ষনিকে আমার, শুন্য দুটি উদাস চোখের সাথে ওর কামিনীর কামার্ত-ভরা চক্ষু যুগলের মিলন হয়ে যায়! এই ভেবেই ওর হৃদয়ে আমার প্রতি বিরক্তি, ভয়, আর ঈর্ষার জলোচ্ছ্বাস বয়ে যাচ্ছে। যেখানে হৃদয়ের উষ্ণতা বহে না, সেখানে তো আর বসে থাকা যায় না।

আমি মৃতবত উঠে দাঁড়াই, বিরান দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলিঃ চলিরে আজকে, আমার অনেক কাজ জমে আছে, এখনি না সারলেই নয়। অর্ণব ছদ্ম আবেগে, চোখে কৌতুহলের ভাষা ফুটিয়ে তুলে বলেঃ এক্ষুনি চলে যাবি? বস, গল্প গুজব করি, রাতের খাবার সেরে তারপরে যাস। ওর মুখ থেকে চোখ নামাতে দেখি, কাঁপা কাঁপা চেনা হাতটি আমার দিকে বাড়িয়ে ধরেছে। হাতটি কি আমার আসলেও চেনা! এখনতো ভীষণ অচেনা মনে হচ্ছে। চেনা-অচেনার কি আছে কোন সীমারেখা? আমি কোন কথা না বলে, কাঁপা হাতটির কম্পন পুরোপুরি থামিয়ে দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াই।

মেয়েটি এখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাথাটা সামান্য একটু হেলে ধরে তোয়ালে দিয়ে চুল ঝাড়ছে। তার কাঁচা তনুটি বামদিকে একটু কাত হয়ে আছে। রাশি রাশি ছড়ানো চুলের মাঝ দিয়ে টল-টলে চোখ দুটি মেলে ধরে তরঙ্গায়িত নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করেঃ চললেন নাকি’? মেয়েটির হৃদয় উৎসারিত কথার স্রোত এঁকে বেঁকে প্রবাহিত হচ্ছে। টিপাইমুখের মুখের মত বাঁধ দিয়ে রুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়নি। আমি জবাব দিতে গিয়ে দেখি, শক্তিশালী ভারত আমার কন্ঠের উপর ফারাক্কা বাঁধ বসিয়ে দিয়েছে।

শত অলিগলি খুঁজেও একফোঁটা কথাও নিঃসৃত হতে পারলনা। আমি হেলতে দুলতে বিভিন্ন রকম হোঁচট খেয়ে চলতে থাকি বাড়ীর দিকে। এ অবিশ্রান্ত পথ চলা আমার, জানিনা কোথায় আমার ঘর-বাড়ি। বুকের ভেতরে প্রচন্ড একটা হেচকা টান অনুভব করলাম; অতি যত্নে রক্ষিত বুকের মাঝখানের সুক্ষ তন্তুটি ছিড়ে গেল যেন! মাঝে মাঝে, প্রতিমুহূর্তে পরিবির্তিত হয়ে যাওয়া নতুন আমির সাথে, এই পুরাতন আমি সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করি; কিন্তু নতুন আমি, পুরাতন আমির কোন আহ্বানেই সারা দেয় না। সে কত কাকুতি-মিনতি করে কত কিছুর লোভ দেখায়, কত বিলাসের দিকে ডাকে কিন্তু কোন লাভ হয়না।

নতুন আমি প্রচন্ড ভয়াবহ গতিতে, সমস্ত বাধা-বিঘ্ন, জড়তা, সমাজ-সংস্কার, নৈতিকতাকে দু-পায়ে দলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পুরাতন আমিকে ছেড়ে চলে যায় শত সহস্র মাইল দূরে। তার আর দেখা পাওয়া যায়না, শুধু আলোর হাতছানি দেখতে পাওয়া যায় হঠাৎ হঠাৎ । আর এই পুরাতন আমি পড়ে থাকি নিশ্চল-স্থবির অন্ধকারে মধ্যে। নড়াচড়ার একটু ক্ষমতাও নেই, যেন পরে আছি হাজার ধরে! অতীতের বিরানভুমিতে বিচরণ করতে করতে এবং নুড়ি পাথর মাড়াতে মাড়াতে হঠাৎ করে দিয়াশলাই থেকে কাঠি বের করার শব্দ শুনে বাস্তবতার শীতল মরুভুমিতে ফিরে আসি।

তাকিয়ে দেখি, আমার সারা রাত্রির জন্য রেখে দেয়া একমাত্র সিগারেটটি নিবিরের মুখে ধরা। বুকটা ধক করে উঠে, মুখের সমস্ত জল যায় শুকিয়ে! আমি কেবল বলতে যাচ্ছি সিগারেটটা একটু পরে জ্বালা। কিন্তু দেখি ওর নাক–মুখ দিয়ে বলক-বলক ধোঁয়া বেরুচ্ছে। আমি ধপাস করে খাটের কিনারে বসে পড়ি। সিগারেট কেনা বাবদ, দোকানে প্রায় পাঁচশ টাকা বাকি পড়ে আছে।

আমি যখন নিকোটিনের অভাবে কুচকে যাওয়া মুখ নিয়ে দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াই; দোকানদার আমাকে দেখামাত্র তার ছোট-ছোট দেবে যাওয়া চোখ দুটিকে টেলিভিশনের পর্দায় নিবদ্ধ করে ফেলে বা অন্য খদ্দেরদের সাথে ভীষণ ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। ডাকতে ডাকতে হয়রান হয়ে যাই, আমার মৃদু ডাক কোনমতেই উনার কর্ণ কুহরে প্রবেশ করতে চায়না। মনে হয় যেন আটলান্টিকের ওপাড় থেকে ডাকছি! অনেকক্ষণ ডাকা-ডাকি করার পর নিতান্ত বাধ্য হয়ে আমার দিকে তাকায়, নিকোটিন কাতর চোখ দুটো দেখে উনার সম্ভবত একটু দয়া হয়। নিতান্ত অনিচ্ছায় প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে আমার দিকে ছুড়ে দেয়। সাথে সাথে ছুড়ে মারে একটা ইঙ্গিত, বাকীর টাকা শোধ না করলে আর পাওয়া যাবেনা, মনে থাকে যেন।

তারপরও আমি বিষণ্ণ মুখে দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াই প্রত্যেক দিন কয়েকবার করে। আজকে রাত্রেও এভাবে দুটি সিগারেট চেয়ে নিয়ে এসেছিলাম। একটি তিন কিস্তিতে শেষ করার পর এই সিগারেটটিই অবশিষ্ট ছিল। মনে করেছিলাম এটিকে চার কিস্তিতে শেষ করব। কিন্তু এভাবে যে এক চুমুকে সবটুকু ধোঁয়া শেষ হয়ে যাবে সেটা কে ভেবেছিলো! সিগারেট শেষ হোক কিন্তু তার বদলে যে একজন জলজ্যান্ত, সজীব মানুষ পাওয়া গেল; যে অন্তত বাংলা উপন্যাসের কোন বিমূর্ত চরিত্র নয়! নিবির আমার চেয়ে বছর চারেকের ছোট হলেও, ওর সাথে আমার বন্ধুর মতই সম্পর্ক।

কিন্তু তাই বলে তো আর সিগারেট কিনে আনতে বলতে পারিনা, প্রেস্টিজে বাঁধে। আর এই নির্জন-নিসঙ্গ, বরফের মত ঠান্ডা রাত্রে আমাকে যে সঙ্গ দিতে এসেছে তাই যথেষ্ট। আমার বুকের ভেতরে জমে থাকা বিভিন্ন ধরনের অনুভূতি, অসঙ্গতি, ক্ষোভ স্রোতের মত বের হয়ে ওর চোখে- মুখে, কানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে থাকে; ও কথা বলার কোন সুযোগই পায়না। আমি তো কথা বলেই যাচ্ছি, আর ওদিকে শরীরের ভেতর নিকোটিনের অভাব ভয়াবহ ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। মনে হয় কথা বলার সাথে নিকোটিনের চাহিদা বাড়ার গাণিতিক সম্পর্ক আছে, কিন্তু আজকে যেন জ্যামিতিক হারে বেড়ে যাচ্ছে।

এস্ট্রের মধ্যে ফেলে দেয়া সিগারেটের শেষ অংশ গুলো আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতে শুরু করে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় সমস্বরে বলে উঠেঃ আমাদেরকে পুড়ে নিঃশেষ করে তোমার নিকোটিনের চাহিদা তুমি পূরণ কর। দুই- তিন দিন ধরে মৃত্যু-যন্ত্রণায় ছটফট করছি। আমাদের শরীরে অবশিষ্ট তামাকটুকুর কারনে আমরা মারা যেতে পারছিনা। আমাদেরকে পোড়াও, নিঃশেষ কর; হাওয়ায় বিলীন হয়ে আমরা নির্বান লাভ করি।

মুশকিল হল, নিবির জেগে থাকা অবস্থায় তো ওদের কাতর অনুরোধে আমি সারা দিতে পারিনা। শুধু নিবির কেন, কোন সমবয়স্ক অন্তরঙ্গ বন্ধুর সামনেও না, যদিও এরকম কেউ আর অবশিষ্ট নেই। হয়তো ও ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ওদের আহ্বানে আমি সাড়া দিতে পারব। কিন্তু ও ঘুমালে তো একেবারে সারা রাত্রির জন্য ঘুমাবে, তখন যদি আবার বইয়ের অক্ষর, চেয়ার –টেবিল, আসবাবপত্র গুলো দানব হয়ে আমাকে গ্রাস করতে আসে! তখনতো আবার ওকে জাগিয়ে তুলতে হবে। বিরক্ত হয়ে হয়তো তক্ষুণি চলে যাবে বা আর কখনও আসবেনা আমার কাছে! কিন্তু এখন কি করি? নিকোটিনের চাহিদা উত্তোরত্তর বেড়েই চলেছে, আমার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।

সিগারেটের শেষ অংশগুলোর মধুর আহ্বানে সাড়া না দিয়ে আর পারছিনা। কিন্তু আমার কথার ঢেউও তোড়ে বেরিয়ে আসছে বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের মত। ও ঘুমিয়ে গেলে কথাগুলো কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটাও ভেবে পাচ্ছিনা। তখন সম্ভবত আশেপাশের সমস্ত ঘুমন্ত মানুষকে ডেকে তুলতে হবে কথা আমার শোনানোর জন্য। আহা-- --- আবার যদি এরকম হত আমি বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি ,আর একটার পর একটা সিগারেট পুড়িয়ে চলছি।

আমার কথা শুনে কেউ আমোদিত হচ্ছে, অনেকেই বিরক্ত হচ্ছে, দুই-একজন মাঝেখানে থামিয়ে দিয়ে নিজে কথা বলার চেষ্টা করছে। ওদের হৃদয়ের মধ্যে আমার হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি পাচ্ছি দেখতে, আমার কথা ওদের মনের মধ্যে লাভা স্রোতের মত বয়ে যাচ্ছে। আর আমি আকাশের দিকে রোয়া রোয়া ধোঁয়া উঠাচ্ছি। কি পরম শান্তি যে পেতাম, হৃদয়টা ভরে যেত! নাহ-------- আর ভাবতে পারছিনা! নিবির থেকে থেকে হাই—উঠাচ্ছে, ঘুম এলো বলে। ওর ঘুমিয়ে পড়াটাই মনে হচ্ছে ভালো হবে।

তখন এস্ট্রে খুঁজে, মোটামুটি তামাক আছে এরকম একটা শেষ অংশ বের করে; তাতে আগুন ধরিয়ে, ঠোটের মধ্যে আগুনের তীব্র আচ সহ্য করতে করতে, অনেক কষ্টে টেনে টুনে ধোঁয়া বের করে উপরের দিকে উদগীরণ করতে করতে, সেই উড়ন্ত ধোয়ার মধ্যে মানুষের জীবন্ত মুখ কল্পনা করে নিকোটিন এবং সঙ্গ দুটোরই চাহিদা একসাথে পূরণ করার চেষ্টা করতে পারব। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।