আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গরিবের দেশে উত্তরাধিকারের রাজনীতি-এ এ জাফর ইকবাল

আমার পোস্ট গুলো পড়ার অনুরোধ রইলো রাজার ছেলে রাজা হবে এটাই ছিল গরিব মানুষের শাসন ব্যবস্থার অতীত। বাদ সেধেছে গণতন্ত্র এসে। এখন সুযোগ মতো সোচ্চার গণতন্ত্র প্রত্যাশীরা, শাসক হিসেবে জনপ্রতিনিধিদেরই প্রাধান্য বেশি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে গণমানুষের স্বাধিকার নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে উন্নয়নকামী দেশগুলোতে যে অবিসংবাদিত নেতৃত্ব গণদেবতার মতো দেশ শাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করে, তারাই পরবর্তীতে প্রকারান্তে উত্তরাধিকারীদের প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে। এ চেষ্টা ভালো কী মন্দ সেটা পরের কথা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে জনমত যাচাইয়ের অনিবার্য বিষয়টি সামান্যও প্রাধান্য পায় না এ প্রক্রিয়ায়।

এতে ক্ষেত্রবিশেষে সময়ের ব্যবধানে জন্ম নেয় জনবিক্ষোভ। ভারতে গান্ধী নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বাধীনতার। ব্রিটিশরা তাকে ফকির বলত। সেই মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী তার পুত্রকে রাজনীতিতে আসার পথ তৈরি করে দেননি। মহাত্মা গান্ধীর এ দূরদর্শী উদ্যোগের কারণে কংগ্রেস ভারতের সবচেয়ে বড় দল হিসেবে এখনও টিকে আছে।

গান্ধীর পর দলের প্রধান নেতা মতিলাল নেহেরুর সুযোগ্য পুত্র জওহরলাল নেহেরু হাল ধরেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের। লক্ষণীয় বিষয় হলো, আইন ব্যবসায়ী মতিলাল নেহেরু জওহরলালকে তৈরি করেছিলেন রাজনীতি করার জন্যই। তার উপযুক্ততা মেনে নিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। পরবর্তীতে জওহরলাল নেহেরু রাজনৈতিক উত্তরাধিকার তৈরি করেন ইন্দিরা গান্ধীকে। এই তৈরি প্রক্রিয়ায় ইন্দিরা শুধু স্বদেশ সংশ্রব নয় একই সঙ্গে নিজেকে তৈরি করেছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠে পড়াশোনা করে।

তারপরও জওহরলাল নেহেরুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে কংগ্রেসের সভানেত্রী তিনি হতে পারেননি কিংবা প্রধানমন্ত্রীও না। তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। নিজেকে জাতীয় রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সময় নিতে হয়েছে। অকাল মৃত্যু হয় ইন্দিরা গান্ধীর। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর তার একমাত্র জীবিত পুত্র রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণে বাধ্য হন।

বাধ্য হন কংগ্রেসের দায়িত্ব নিতেও। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, মা ও নানার উত্তরসূরি হিসেবে রাজনীতিতে তাদের শূন্য আসন পূরণে যে যোগ্যতা ও মানসিকতা ধারণ করা উচিত ছিল শুরুতে তা ছিল অনুপস্থিত। শূন্য আসন তাকে প্রধানমন্ত্রী হতে বাধ্য করেছে। এক্ষত্রে যে বিষয়টি লক্ষণীয় তাহলো রাজীব গান্ধী যখন ক্ষমতা নেন তখন দলের নেতৃত্ব ছিল নানা দ্বন্দ্বে সংক্রমিত। বংশের দোহাই এখানে রাজীব গান্ধীকে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা লাভের।

রাজীব গান্ধী যখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন ঠিক তখন বিশাল ভারতে কংগ্রেসের কোন বিকল্প ছিল না। শুধু কি তাই, কেন্দ্রীয়ভাবে পুরো ভারতে নিয়ন্ত্রণ রাখতে গেলে রাজীবের কোন বিকল্প ছিল না। হঠাৎ মারা গেলেন রাজীব গান্ধী। রাজনীতিতে আসতে হলো সোনিয়াকে। যে শূন্যতাকে অবলম্বন করে রাজীবকে কংগ্রেসের হাল ধরতে হয়েছিল ঠিক একই ধরনের আরেকটি শূন্যতায় সোনিয়াকে কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিতে হয়।

তিনি লোকসভার নির্বাচন করেন এবং নির্বাচনে জয়ীও হন। পরবর্তীতে সোনিয়া বিদেশিনি বলে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হলে, তিনি প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণ না করে দলের প্রধান হিসেবে সরকার নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, দলের প্রধান হয়ে সরকার প্রধানের ওপর প্রভাব খাটানোর মাধ্যমে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার যে কৌশল সোনিয়া গ্রহণ করেছেন তা উত্তরাধিকারের রাজনীতির একটি ভিন্ন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। তিনি প্রমাণ করেছেন, সরকার নিয়ন্ত্রণ করে দল, আর সংগঠিত থাকবে জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে। সোনিয়ার পরে কি আসবে রাহুল? এ নিয়ে সোনিয়া মুখ খোলেননি বরং বলেছেন রাহুল নিজেই ঠিক করবে ভবিষ্যতে সে কি করবে।

তবে রাহুলের রাজনৈতিক গতিবিধি এ কথাই প্রমাণ করছে যে, জনস্বার্থকে উপেক্ষা করে তিনি সরকারপ্রধান হওয়ার উদ্যোগ নেবেন না। তবে দলের প্রধান হওয়ার জন্য সাংগঠনিক কাজকর্ম একেবারেই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের নেহেরু পরিবারের উত্তরাধিকারের এ ধারাবাহিকতা দেখে অকপটে বলা যায়, দল না চাইলে এমন সুযোগ কেউ কখনো নেয়নি, যাতে করে সরকারপ্রধান হয়ে দেশ চালানোর উপযুক্ততা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে এ প্রবাহকে অনেকেই অনুকরণীয় মনে করেন। কিন্তু তারপরও সরকারপ্রধান হওয়ার কৌশলটি যদি জননন্দিত না হয় তাহলে দেশের জনগণের ভাগ্যে দুর্দশা অনিবার্য।

প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাকিস্তান। লারকানার জমিদার শাহনাজ ভুট্টো সম্পদশালী ব্যক্তি ছিলেন এবং রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোকে তৈরি করতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানের পরবর্তী শাসক হিসেবে। বোম্বেতে রাজনীতি আরম্ভ করেছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে নেতৃত্ব গ্রহণের অপকৌশল এবং ক্ষমতা আরোহণের জন্য প্রতিহিংসাপরায়ণ হওয়ার সবচেয়ে অধিক দাম্ভিকতা তাকে শাসক বানিয়েছে বটে, জননন্দিত হওয়ার প্রয়োজনীয় অনুভূতিগুলোকে হত্যা করেছে।

শাহনাজ ভুট্টো যেমন জুলফিকার আলী ভুট্টোকে তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন ঠিক একই কায়দায় ভুট্টো তার পরবর্তী উত্তরাধিকারী হিসেবে বেনজিরকে তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুর পর উপযুক্ত পরিবেশ পায়নি বেনজির, তার বাবা সঠিকভাবে গণতন্ত্রের চর্চা করেননি বলে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি যে নিরাপদ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে তা থেকে বেনজির ছিলেন বঞ্চিত। এ কারণেই অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে রাজনীতির ময়দানে দাঁড়িয়ে। এখন ভুট্টো পরিরবারের ডামি নেতা হিসেবে দেশের কর্ণধার হয়েছেন আসিফ আলী জারদারি।

আর ভুট্টোর পিপলস পার্টি অপেক্ষা করছে বিলাওয়াল ভুট্টোর জন্য। উত্তরাধিকারী প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ভুট্টো গণতন্ত্রের সুষমবিকাশে যত্নবান ছিলেন না। এ কারণে যথেষ্ট যোগ্যতা থাকার পরও অসময়ে জান দিতে হয়েছে বেনজিরকে এবং আগামী প্রজন্মে বিলাওয়ালের অবস্থান কি হবে তা নিশ্চিত করে বলার কোন উপায় নেই। ভারত ও পাকিস্তান। দক্ষিণ এশিয়ার এ দুটি দেশে পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছিল একদিন আগে।

উভয় দেশই উত্তরাধিকারের রাজনীতির চর্চা করছে। ভারতের উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে যতটা সাফল্য এসেছে পাকিস্তানে ব্যর্থতা এসেছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এরও কতগুলো কারণ আছে। উন্নয়নকামী দরিদ্র দেশগুলোতে সরকার এবং দল যদি একই ব্যক্তির হাতে একক পরিচালনায় কেন্দ্রীভূত থাকে তাহলে সরকার টিকলেও দল টিকে না। কারণ সরকারের জবাবদিহিতা থাকে না দলের কাছে।

সরকারকে দল সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করতে না পারলে স্বাভাবিকভাবেই জনস্বার্থ উপেক্ষিত হয়। জনমত যাচাইয়ে ব্যারোমিটার হচ্ছে দল আর দলের নৈতিকতা সবসময়ই সরকারের কর্মকা-ে প্রভাব বিস্তার করার কথা। এটি যখন সঠিকভাবে হয় না তখন সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে যার হাতে পরবর্তীতে নেতৃত্ব যাবে, তাকে জনগণের অভিভাবকত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে জনমত গঠন করা, সংগঠিত জনমতকে কাজে লাগানো এবং আবেগতাড়িত জনমতকে জনস্বার্থের সঙ্গে সম্পৃক্ত রাখার পরবর্তী উত্তরাধিকারীদের রাজনীতি করার মৌলিক উপাদান। এটি ব্যর্থ হলে প্রতিবিপ্লব আসতে বাধ্য।

আলবেনিয়ার আনোয়ার হুজ্জা অবিসংবাদিত নেতা। পূর্ব ইউরোপে তার মতো বিশাল মাপের রাষ্ট্রনায়ক অদ্যাবধি জন্মায়নি। কিন্তু এখন আলবেনিয়া থেকে তাকে মুছে ফেলার প্রতিযোগিতা চলছে। কেন ঘটল এমন ঘটনা? রাজনৈতিক দর্শন যা আনোয়ার হুজ্জা উপহার দিতে পারতেন তার পরবর্তী প্রজন্মকে, তা তিনি দিয়ে যাননি। যে কারণে সে দেশে ভেস্তে গেছে সমাজতন্ত্র, আর জন্ম নেয়নি কোন রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী।

অথচ আনোয়ার হুজ্জার জন্য এটা ছিল অত্যন্ত সহজ এবং তখনকার নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ। প্রসঙ্গত এখানেই বলা হলো উন্নয়নকামী গণতান্ত্রিক দেশে উত্তরাধিকারের রাজনীতি জন্ম নেয় সেই গণদেবতার ছায়া থেকে। যে গণদেবতার ছায়ার নিচে বিকল্পের চিত্র অনুপস্থিত থাকে। সঙ্গতকারণেই অনেকে বলেন গণতান্ত্রিক রাজনীতির অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতৃত্ব যদি তার রাজনৈতিক সংগঠনের সঠিকভাবে প্রতিফলিত না হয় তাহলে উত্তরাধিকারের রাজনীতি সময়ের ব্যবধানে ব্যর্থ হতে বাধ্য। শ্রীলঙ্কায় টেকেনি উত্তরাধিকারের রাজনীতি।

দুটি পৃথক পর্যায়ে উত্তরাধিকারের রাজনীতির প্রসার ও বিস্তার লাভ করে। এর একটি হলো যে কোন গণদেবতার অসময়ে হঠাৎ করে অপমৃত্যু ঘটলে তার পরবর্তী প্রজন্মকে দিয়ে রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করা হয়। এক্ষেত্রে মানসিক প্রস্তুতি এবং সামাজিক সহযোগিতা দুটিরই প্রয়োজন হয় নতুন নায়কের। বংশের ধারাবাহিকতায় রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী সৃষ্টির আরেকটি দর্শন হচ্ছে শাসক জনগণের ন্যায় ও ন্যায্যতাকে মূল্যায়ন না করে বংশপরম্পরায় দেশ শাসন করা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এখন এটাই হচ্ছে।

যদিও বা মধ্যপ্রাচ্যের অনেক শাসক জনকল্যাণকর কাজ করতে গিয়ে মরুভূমিকে মরুদ্যান বানিয়ে তার জনকল্যাণের মানসিকতা প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে তৃতীয় শক্তি তাদের স্বার্থে ছলছুঁতোয় জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে শাসন ব্যবস্থায় জনস্বার্থ অনুপস্থিত। এ ঘটনাটি ঘটেছে ইরাকে ও লিবিয়ায়। আত্মাহুতি দিতে হয়েছে সাদ্দাম এবং গাদ্দাফিকে। সঙ্গতকারণেই গণতন্ত্রের মুখোশধারী কল্যাণকর কাজে লিপ্ত নৃপতিরাও তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নকামী দেশগুলোতে যোগ্য উত্তরাধিকারী মনোনয়ন করতে পারেনি।

উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে বাংলাদেশকে নিয়েও এখন অনেকে ভাবছে। বঙ্গবন্ধু এবং তার সহকর্মীরা ঘাতকের হাতে অসময়ে নিহত হওয়ার পর দলীয় রজনীতির শূন্যতা পূরণে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আসতে হয়েছে। তিনি সমালোচনার ঊধর্ে্ব নন। তবে তারপর কি হবে তা বিশ্লেষণের অগ্রিম কোষ্ঠী এখন সবার কাছেই অজ্ঞাত। অন্যদিকে প্রধান বিরোধীদল বিএনপির নেতৃত্বে থাকা বেগম জিয়া অতি দ্রুত সুযোগ তৈরির চেষ্টা করেছেন তার পুত্র তারেক রহমানকে প্রতিষ্ঠায়।

খালেদার পর তারেক এ কথা প্রকাশ্যে কেউ বলেনি বটে কিন্তু তারেক রহমানের ৪৮তম জন্মদিন পালনের ঘটা দেখে বোঝা যাচ্ছে জিয়াউর রহমানের জন্মদিন কেউ না খুঁজলেও বিএনপি যারা করে তাদের যদি আগামীতে বিএনপি করতে হয় তাহলে খালেদার বিকল্প হিসেবে তারেককেই মেনে নিতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যোগ্যতার ব্যারোমিটার এবং দক্ষতার মাপকাঠিতে তারেকের বর্তমান অবস্থা ভবিষ্যতের জন্য মসৃন দিকনির্দেশনা দেয় কিনা। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরাধিকারের রাজনীতি গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় কোন কোন ক্ষেত্রে সুশাসন দিতে পারে না। অতীতের সে ধারাবাহিকতা যদি আগামীতেও অব্যাহত থাকে তাহলে উত্তরাধিকারের রাজনীতিতে বিপর্যয় অনিবার্য। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।