আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র - কে কার সুঁই-সুতো ??

প্রথা বিরোধী যোদ্ধা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে সমালোচিত রাষ্ট্র। পুঁজিবাদী স্বার্থের প্রয়োজনে এরা একে অন্যকে ব্যবহার করে আসছে বহুদিন ধরেই । আর এই দুর্গন্ধ সহ্য করে যাচ্ছে সারা বিশ্ব । তাঁদের এই দুর্গন্ধের উৎস বের করতে গিয়ে আমেরিকার আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক জন মেয়ারশেইমার ও অধ্যাপক স্টিফেন ওয়াল্ট বলেছেন "ইসরায়েল লবির প্রতিদ্বন্দিহীন ক্ষমতা" যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিষয়ক নীতিমালাকে মিথ্যে করে দিয়েছে। তারা উভয়েই ইসরায়েলের উপনিবেশ বিস্তারে এবং লেবানন ও গাজায় ইসরায়েলের হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের যে সমর্থন, তার ঘোর সমালোচক।

এসব হামলার শিকার ও ক্ষতিগ্রস্ত বহু মানুষের উপর দারুণ প্রভাব ফেলেছে এ অধ্যাপকদ্বয়ের বহুল প্রচারিত প্রবন্ধ "দ্য ইসরায়েল লবি"("The Israel Lobby")। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে(lrb.co.uk) দ্য লন্ডন রিভিউ অফ বুকস(the London review of Books) এ এবং পরবর্তীতে ২১টি দেশে এটি পরিবর্ধিত বই আকারে প্রকাশিত হয়। তাদের প্রবন্ধে উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মধ্যেকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিষয়ক গূরুত্বপূর্ণ সব তথ্য। কিন্তু এরপরেও তাদের মূলতত্ত্ব বাস্তবতাকে অনুসরণ করে না। আসল সত্য হল এই, ইসরায়েলের বিশাল অস্তিত্বের মূল কারণ যুক্তরাষ্ট্র।

মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকান কর্তৃত্ব এবং একইসাথে অন্যায় ও অগ্রহণযোগ্য পরিস্থিতিকে সহনশীল করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের চলমান যে অভিযান, তার পেছনে ইসরায়েলের রয়েছে অপরিহার্য ভূমিকা। ইসরায়েলের প্রতি অপেক্ষাকৃত কম সমালোচনাহীন সমর্থন প্রদান করে "আমেরিকার স্বার্থকে" আরও ভালভাবে রক্ষা করা হবে, এই বক্তব্য রেখে মেয়ারশেইম এবং ওয়াল্ট- যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কে সত্যিকার অর্থে বিরোধীতা করেননি। যুক্তরাষ্ট্র একটি মনোপোলি পুঁজিবাদি রাষ্ট্র যার সম্পদ এবং ক্ষমতা অনস্বীকার্যভাবে শোষণ ও অত্যাচারের একটি বৈশ্বিক শাসনতন্ত্রের সাথে যুক্ত। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের চরিত্র নিয়েও তারা কোন আলোচনা করেননি। দক্ষিণ আফ্রিকায় বিদ্যমান জাতিবিদ্বেষ পূর্ণ সরকার যেমন সমর্থনযোগ্য নয়, ঠিক তেমনি ইসরায়েলের অস্তিত্বও কোন অংশে সমর্থনযোগ্য নয়।

এ কারণে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার সম্পর্ক নিয়ে তাদের যে সমালোচনা সেটি যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শুধুমাত্র আশাপ্রদ চিন্তা বলেই মনে হয়। এ বিষয়টি বিপদজনক বিশেষত এমন একটি সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র উভয় দিকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক দিকে ইসরায়েলের অস্তিত্ব ও আগ্রাসন কে টিকিয়ে রাখতে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদান করে যাচ্ছে আবার অন্যদিকে আফ্রিকা, ফিলিস্তিন সহ আরব জনগণের কাছে মিত্র হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক উৎকর্ষতা সত্ত্বেও এ দুই বুদ্ধিজীবী- বুদ্ধিবৃত্তিক বয়কটের শিকার হয়েছেন বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে। এটি একটি লজ্জাজনক বিষয় যে, অসংখ্য লেখক ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব রয়েছেন যারা ইসরায়েলের যে কোন সমালোচনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েন, তারা মেয়ারশেইমার ও ওয়াল্ট এর গায়ে সেমিটিসম বিরোধী তকমা এঁটে তাদের থামিয়ে দেবার প্রয়াস চালিয়েছেন।

বিশ্বের সাধারণ মানুষ ও যুক্তরাষ্ট্রের নিজেদের ভেতরে যে ধারণা সেটির সাথে তাদের যুক্তিতর্কের মিল রয়েছে। আর তা হল এই যে, বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্য ও এর বাইরে সঙ্ঘটিত যুক্তরাষ্ট্রের অপরাধগুলো এমন একটি প্রক্রিয়া যেটি মূলতঃ অন্য কোন ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না, সেটি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে "ইহুদী গোষ্ঠীগুলো" দ্বারা। স্টিফেন মেহার গত বছর এপ্রিলে মেয়ারশেইম ও ওয়াল্টকে জবাবটি লেখেন । স্টিফেন মেহার নিজেকে এমেরিকান ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিসের একজন গ্রাজুয়েট হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি ওয়েস্ট ব্যাংক এ বসবাস করেন।

মেহার তার ব্লগ rationalmanifesto. blogspot. com ও electronicintifada. org এ বিষয়টি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন । ইসরায়েলের বহু সমালোচক ইসরায়েলি দখলদারিত্ব, ঔপনিবেশিকতা এবং দখলকৃত ওয়েস্ট ব্যাংক এ চালিত শুদ্ধি অভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সহযোগীতা প্রদানের পেছনে "ইসরায়েল লবি" কে দায়ী করে থাকেন। এই সহযোগীতা বর্তমান সময় পর্যন্ত চলছে। ইসরায়েলি সরকার দখলকৃত পূর্ব জেরুসালেম এ ১,৬০০ বসতি স্থাপন করার ঘোষণা দিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে অসম্মান প্রদর্শন করে ,যে সময় তিনি সে দেশ সফরে গিয়েছিলেন। জো বাইডেনের সফর চলাকালে পূর্ব জেরুজালেমে নতুন বসতি স্থাপনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করায় ইসরায়েলের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ছিল যুক্তরাষ্ট্র।

এ সিদ্ধান্ত বাতিল করতে গত বছর ইসরায়েলের ওপর নানামুখী চাপ তৈরি করেছিল দেশটি। ঐ সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন নিজে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে টেলিফোন করে রাগ ঝাড়েন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার একজন জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা অভিযোগ করেন, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রকে 'অপমানিত' করেছে। ঐ সময়টিতে মার্কিন বিশেষ দূতের পূর্বনির্ধারিত ইসরায়েল সফর বাতিল করেছে ওয়াশিংটন। মিত্র দেশ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এমন তীব্র প্রতিক্রিয়াকে 'অস্বাভাবিক' হিসেবেই দেখছিলেন কূটনীতি বিশেষজ্ঞরা।

ইসরায়েলি কূটনীতিকরা পর্যন্ত বলছিলেন, গত ৩৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে সংকটজনক অবস্থায় পড়েছে দু'দেশের সম্পর্ক। ঐ সময়টীতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ইসরায়েল প্রশ্নে আবার নিজেদের স্বাভাবিক অবস্থানেই ফিরে আসে যুক্তরাষ্ট্র। কড়া ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশকারী হিলারিও সুর নরম করেছেন। তিনি বলেছেন, 'ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গভীর ও নিখুঁত সম্পর্ক রয়েছে। আমরা ইসরায়েলের নিরাপত্তার ব্যাপারে বরাবরের মতোই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

' হোয়াইট হাউসের মুখপাত্রও একই সুরে বলেছেন, দুই সহযোগী দেশের মধ্যে স্বাভাবিক মতানৈক্যের কারণে এ উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের এ পরিবর্তন ও উত্তেজনা প্রশমনের প্রচেষ্টাকে খুব স্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ইসরায়েলপন্থীদের চাপেই ওবামা প্রশাসন তাদের কঠোর অবস্থান থেকে সরে এসেছে। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, মার্কিন কংগ্রেসের ২৫ জনেরও বেশি সদস্য ইসরায়েলের প্রতি নমনীয় হওয়ার জন্য ওবামা প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানায়। বিরোধী রিপাবলিকান পার্টির হুইপ এরিক ক্যান্টোর বলেন, 'ছোটখাটো একটি বিষয় নিয়ে ইসরায়েলের মতো মিত্র দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এমন আচরণ কাম্য নয়।

' মার্কিন কংগ্রেসে ইসরায়েলের অনেক কট্টর সমর্থক রয়েছে। ধারণা করা হয়, ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক না করলে ওবামাকে অভ্যন্তরীণ চাপে ফেলার হুমকি দিয়েছেন এসব সদস্য। মার্কিন কংগ্রেস সদস্য ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ইসরায়েলি লবি গ্রুপগুলোও সক্রিয় হয়ে। ওয়াশিংটনের লবি গ্রুপ আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক এফেয়ার্স (এআইপিএসি) ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে মার্কিন প্রশাসনের সাম্প্রতিক মন্তব্যে 'গভীর উদ্বেগ' প্রকাশ করেছে। ইসরায়েলপন্থী মার্কিন ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকরাও দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে যুক্তরাষ্ট্রের এ ইসরায়েলপন্থীদের ব্যবহারের ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিলেন নেতানিয়াহু। মার্কিন চাপের মুখে নির্বিকার থেকে তিনি ঘোষণা দেন, 'যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কিছুদিনের মধ্যেই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কারণ আমরা জানি কিভাবে এমন পরিস্থিতি সামলাতে হয়। ধীরেসুস্থে ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গেই আমরা তা করব। ' বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নিজদের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন বলেই মার্কিন প্রশাসনের অবাধ্য হতে দ্বিধা করে না।

এ কারণেই হিলারির কঠোর হুঁশিয়ারির পরও নেতানিয়াহু পূর্ব জেরুজালেমে বসতি স্থাপন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিতে পারেন। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলি ইশাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি উল্টো ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, 'ইসরায়েল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং যা খুশি তা-ই করার অধিকার আমাদের আছে। ' এ ঘটনার পর সংঘাত সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও এই দুই রাষ্ট্রের মিত্রতা ও সহযোগীতা বর্তমান সময় পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ রয়েছে। হোয়াইট হাউজের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের তথাকথিত নিন্দা জ্ঞাপন সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এটি পরিস্কার করে দিয়েছে যে ইসরায়েলের প্রতি এর সমালোচনা পুরোপুরি সাংকেতিক হয়েই থাকবে। তবে আমরা দেখতে পাই যে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে লবি তত্ত্বে কোন ব্যাখ্যা নেই।

স্টিফেন ওয়াল্ট ও জন মেয়ারশেইমের "ইসরায়েল লবি" থিসিসের উপর বছর কয়েকপর নোয়াম চমস্কি, স্টিফেন জুনস, ওয়াল্টার রাসেল মিড ও আরো অনেকের সমালোচনা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ইসরায়েল লবির উপর মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির প্রভাবকেই এর মূলবিষয় বলে আসছেন ইসরায়েলের অনেক কট্টর সমালোচক। ইসরায়েল লবি বিষয়ক বিতর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের ভেতরকার গতবছর কূটনৈতিক দ্বন্দ্বকে সামনে রেখে, লবি তত্বের ভেতরকার ত্রুটিগুলো পুনর্মূল্যায়ন এবং সেই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের আচরণকে এর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার প্রেক্ষাপটে আরোপ করা প্রয়োজন যা সত্যিকার অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে মূল নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। বিশ্বে "লবির" ব্যাপক দুর্নীতির প্রভাবমুক্ত অঞ্চলগুলোতে বিদ্যমান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিমালার সাথে মধ্যপ্রাচ্যে এর পররাষ্ট্রনীতির কোন তফাৎ নেই। ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধিত সমর্থনের বিষয়টিকে মূলতঃ মধ্যপ্রাচ্যের যে বিশেষ একটি কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে তার প্রতি এক ধরনের যৌক্তিক সাড়া হিসেবে দেখা যেতে পারে।

কারণ এটি বিশ্বের শক্তি উৎপাদনকারি প্রধান অঞ্চল। ইসরায়েলকে একটি "সমুদ্রতীরদূরবর্তী ইউ এস সামরিক ঘাঁটি "(নোয়াম চমস্কির ভাষায়) হিসেবে গড়ে তুলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যান্য শক্তি উৎপাদনকারী অঞ্চলে এর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হবে, কেননা শক্তি সম্পদগুলো বৈশ্বিক ক্ষমতার একটি প্রধান চালিকাশক্তি। দেখা যায় যে, যারা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিমালার পেছনে লবিকে দায়ি করে থাকে, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত আগ্রহ এবং এর অগ্রগতি সাধনে ইসরায়েলের প্রধান ভূমিকাটি বুঝতে তারা ভুল করে থাকেন। ভৌগলিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্ক "ইসরায়েল লবি" থিসিসটির একটি প্রধান দাবী এই যে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি গঠনের পেছনে রয়েছে এই "লবি"। যদি যুক্তিটি সত্যি হয় তাহলে এর সমর্থনকারীদের দেখাতে হবে যে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিমালায় কোন গুণগত স্বতন্ত্রতা রয়েছে কিনা।

সতর্ক বিশ্লেষণে লক্ষ্য করা যায় যে, লবি সৃষ্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ক্ষতি এবং "জাতীয় স্বার্থ", এ দুই এর মাঝে কোন ভেদ নেই। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি এর অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা "জাতীয় স্বার্থ" কে চালনা করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল চালিকাশক্তি। সারা বিশ্বে বহু দেশ রয়েছে যারা ওয়াশিংটনের প্রতি একইভাবে তাদের আনুগত্য প্রদর্শন করে থাকে। তারা তাদের নিজস্ব এলাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রস্তুত করে চলেছে। ওয়াশিংটনের স্বার্থ রক্ষার্থে যাবতীয় তাদের অপরাধকে প্রকাশ্যে সমর্থন প্রদান ও আন্তর্জাতিক নিন্দার মুখে তাদের রক্ষা করা হয়।

উদাহরণস্বরূপ, ফিরে দেখা যেতে পারে পূর্ব তিমুরে ৩০ বছর ধরে ইন্দোনেশিয়ার আক্রমণ ও দখলের নারকীয় ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের বিষয়টি। শুধু ধর্ষণ ও অনাহার কে সেখানে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ক্ষান্ত দেওয়া হয়নি, একইসাথে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ কে হত্যা করে, যে দেশের জনসংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৫০ হাজার। এসব নৃশংসতায় পূর্ণ সমর্থন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র বোমায় ব্যবহৃত পেট্রোল নেপাম(napalm) ও রাসায়নিক বিভিন্ন অস্ত্র সরবরাহ করে যা ইন্দোনেশিয়ার সামরিক বাহিনী যাচাই বাছাই না করেই ব্যবহার করে। এই বাহিনীকে সম্পূর্ণ রূপে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

বিল ক্লিনটন এ কারণে বলেছিলেন, “সুহার্তো ছিলেন আমাদের লোক”। ইন্দোনেশিয়ায় আক্রমণের সময় জাতিসঙ্ঘে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রাষ্ট্রদূত ড্যানিয়েল প্যাট্রিক ময়নিহান(Daniel Patrick Moynihan) পরবরর্তীতে লিখেছিলেন, পূর্ব তিমুরে নিষ্ঠুর হত্যালীলা বন্ধে জাতিসংঘের যে কোন পদক্ষেপই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর অকার্যকর প্রমাণ করতে চেয়েছিল এবং এ লক্ষ্যটি তিনি “উল্লেখযোগ্য সফলতার” সাথে পালন করেন। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের এই সমর্থন কোন “ইন্দোনেশিয় লবির” প্রভাবে ঘটেনি। বরং পরিকল্পনাকারীরা ১৯৫৮ সালে ইন্দোনেশিয়াকে কৌশলগত দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অঞ্চলের মাঝে একটি বলে চিহ্নিত করেন। এর কারণ এটি তেলসমৃদ্ধ একটি দেশ এবং ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনকারি হিসেবে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

কোন কোন স্থানে যেমন ল্যাটিন আমেরিকায় যেখানে গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, এল সালভাদর এর মত যুক্তরাষ্ট্রের খদ্দের রাষ্ট্রগুলো বছরের পর বছর মানবাধিকার দাবী করে আসা নিরস্ত্র কৃষকদের হত্যা করেছে, তাদের জন্য জনগণের "সফল বিরোধিতা" একটি হুমকিস্বরূপ। অর্থাৎ, একটি দেশ ইউ এস এর নির্দেশের বিরোধিতা করলে যদি যুক্তরাষ্ট্র তা সহ্য করে তবে তা এর কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে ওঠাকে শক্তিশালী করবে। বিশ্বজুড়ে এই জাতীয় চিন্তাধারার প্রাতিষ্ঠানিকিকরণ ঘটিয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র যা মূলতঃ আরম্ভ হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আধুনিক সাম্রাজ্যবাদী যুগের শুরু থেকে। যুদ্ধের প্রথম থেকেই এটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে এর পরবর্তী ফলাফল হবে বিশ্ব নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান এবং এ কারণে পররাষ্ট্র দপ্তর ও পররাষ্ট্র কাউন্সিল যুদ্ধ পরবর্তী যথাযথ একটি বিন্যাস সৃষ্টির পরিকল্পনা হাতে নেয় যেখানে যুক্তরাষ্ট্র হবে প্রশ্নাতীত ক্ষমতার অধিকারী। এই উদ্দেশ্য সাধনে প্রধান যে পরিকল্পনাটি সামনে রাখা হয় তা হল তার মধ্যে রয়েছে বিশ্বের শক্তি সম্পদগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, বিশেষ করে সৌদি আরবের উপর, যে দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে “ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার সামগ্রী” বলে উল্লেখ করা হয়।

ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের জার(czar) হ্যারল্ড ইকেস(Harold Ickes) এর পরামর্শ মোতাবেক বিশ্বের তেলের মজুদের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারাই হচ্ছে “যুদ্ধ পরবর্তী” রাজনৈতিক ব্যবস্থার চাবিকাঠি। যেহেতু বিশ্বের শিল্প অধ্যূষিত পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে সচল রাখতে কম মূল্যে শক্তির বৃহৎ যোগান অপরিহার্য। এর অর্থ এই দাঁড়ায় যে, মধ্যপ্রাচ্যের তথা বৃহত্তর সউদির তেলের মজুদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইউরোপ, জাপান ও বিশ্বের একটি বড় অংশের অর্থনীতির ভিত্তি যার উপর দাঁড়িয়ে আছে তা চলে আসবে হাতে। এ যুক্তির সপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনাকারি জর্জ কেনান(George Kennan) জানান, এতে করে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে চলে আসবে “ভেটো ক্ষমতা”। বিনিউ ব্রেজেজিনস্কি(Zbigniew Brzezinski) সাম্প্রতিককালে “প্রশ্নবিদ্ধ ক্ষমতা” নিয়ে আলোচনা করেন, যা যুক্তরাষ্ট্র ভোগ করছে বিশ্বের শক্তি সম্পদগুলোর উপর একচ্ছত্র অধিকারের ফলে।

সুতরাং দেখা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে কোন “সফল বিরোধ” কিংবা স্বাধীন উন্নয়নের ভয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভীত নয়। এসকল বিষয় ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের দুশ্চিন্তায় আরেকটি ভিন্ন মাত্রা রয়েছে আর তা হল এই যে, যদি বিরোধীপক্ষ তেল সম্পদের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের সামনে হুমকিস্বরূপ দাঁড়ায়, তবে যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক ক্ষমতার একটি প্রধান উৎস হুমকির সম্মুখীন হয়। নিক্সন প্রশাসনের সময়কালে ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর পরাজয় ও কৌশলগত স্বার্থরক্ষার তাগিদে মধ্যপ্রাচ্যে সরাসরি হস্তক্ষেপের ফলশ্রুতিতে বিপ্লবপূর্ব ইরানে (যে দেশটি আমেরিকার আঞ্চলিক প্রতিনিধির ভূমিকা পালন করেছিল) সামরিক বাহিনীর সাহায্য আকাশচুম্বী হয়। ১৯৭৬ সালে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, “ইরানের মত অন্য কোন দেশের মানবাধিকারের তালিকা এমন নিকৃষ্ট নয়”। এ প্রতিবেদনটি উপেক্ষা করা হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা বেড়েই চলে।

কারণ এই সমর্থন প্রদানের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ আরও গতিশীল হয়ে উঠে, এর পিছনে কোন “ইরান লবি” অস্তিত্বশীল ছিল না। কৌশলগত বিষয়ের উপর নজর রেখে যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য নিপীড়ক ও প্রতিক্রিয়াশীল সরকারকে সহযোগিতা প্রদান করে, যার মধ্যে রয়েছে সাদ্দাম হোসেন এর জঘন্যতম বর্বরতা। কুর্দিদের বিরুদ্ধে আনফাল গণহত্যাকাণ্ডের সময়কালে ইরাকি বাহিনী যুক্তরাষ্ট্র সরবরাহকৃত রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে প্রায় ১ লক্ষ সাধারণ কুর্দিশকে হত্যা করে এবং ইরাকি কুর্দিস্তানের ৮০ শতাংশ গ্রাম ধ্বংস করে দেয়। এসকল নৃশংসতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিন্দা রুখতে যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা সচেষ্ট। এ বিষয়ে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন যে, বড় বড় যৌথ প্রতিষ্ঠান ও অভিজাত শাসক শ্রেনী নির্ধারিত “জাতীয় স্বার্থ” রক্ষাকারী সকল অপরাধমুলক কর্মকাণ্ডে সমর্থন দেয়া এবং আন্তর্জাতিক সমালোচনাকে প্রতিহত করার চেষ্টা ব্যতিক্রম কোন বিষয় নয়, বরং এটিই নিয়ম।

এটি কাকতালীয় কোন বিষয় নয় যে, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্ক ঘনীভূত হয় ইসরায়েল কর্তৃক ১৯৬৭ সালে গামাল আব্দেল নাসের এর স্বাধীন জাতীয়তাবাদী সরকারের পতনের পর। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের প্রধান প্রতিপক্ষের পতন ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব থেকে সৌদি আরব আরব উপদ্বীপের প্রকৃত ক্ষমতাধারীদের আড়ালে রেখে একটি “আরব ফাসাদ” (Arab Façade) হিসেবে চমৎকারভাবে কাজ করে এসেছে মুলতঃ বৃটিশ ঔপনিবেশিক পরিভাষা লাভের উদ্দেশ্যে। “সমগ্র অঞ্চলকে সৌদি রাজপরিবারের ক্ষমতার বিরুদ্ধে দাঁড় করানো”, এই জাতীয়তাবাদী স্লোগানের মাধ্যমে নাসের যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার প্রতি যে হুমকি দিয়েছিলেন তা ছিল মারাত্মক। জবাবে পররাষ্ট্র দপ্তর জানায়, আরব জাতীয়তাবাদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত ছিল “ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন প্রদান ”।

কারণ ইসরায়েল ছিল এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র নির্ভরযোগ্য সমর্থক বাহিনী। ইসরায়েল কর্তৃক নাসের এর সরকারের পতন ও অবমাননার ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ছিল বড় রকমের আশীর্বাদ। এর ফলে ইসরায়েলের সাথে একটি জোরদার মৈত্রী গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় ওয়াশিংটনের কাছে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য খদ্দেরদের চাইতে ইসরায়েলকে অনেক বেশি পরিমাণে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের পিছনে কারণ হিসেবে রয়েছে ইসরায়েলের এই বিশেষ আঞ্চলিক গুরুত্ব। ইসরায়েলকে যে কোন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করার ক্ষমতা সরবরাহের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত শৃংখলাকে টিকিয়ে রাখাই যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক কৌশলের কেন্দ্রবিন্দু।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ইসরায়েল একটি নির্ভযোগ্য মিত্র - ইসরায়েলি সরকারের পতনের কোন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সুতরাং পশ্চিমাবিরোধী ইসলামি মৌলবাদী অথবা স্বাধীন জাতীয়তাবাদীদের হাতে অস্ত্র চলে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই, যা ঘটেছিল ইরানে ১৯৭৯ সালে। বর্তমানে ইউরোপে ক্রমবর্ধমান স্বাধীনতা ও সেই সাথে ভারত ও চীনের ক্ষুধার্ত অর্থনীতি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রমহ্রাসমান শক্তি সম্পদের চাহিদা বৃদ্ধি পায় । ফলে যা কিছু অবশিষ্ট রয়েছে তার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করাই এখন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এশিয়া আফ্রিকা রিভিউ(Asia-Africa Review) এর ২০০৯ এর সেপ্টেম্বর সংখ্যায় মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রাক্তন বিশেষ দূত সান বিগান(Sun Bigan) লিখেছিলেন, “ যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই বিশ্বের তেল সরবরাহের উৎসটি নিজের অধীনে রাখার প্রয়াস চালিয়েছে”।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, যেহেতু ওয়াশিংটন সন্দেহাতীত ভাবে ইরাকি তেল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চালাবে সেহেতু চীনকে শক্তির মজুদ খুঁজতে অন্য কোন অঞ্চলের প্রতি নজর ফেরাতে হবে। বিগান বিশেষভাবে জোর দিয়ে লিখেছেন, “ইরানের রয়েছে প্রচুর শক্তি সম্পদ ও এর তেল গ্যাসের মজুদ বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং এসবই রয়েছে ইরানের নিজের নিয়ন্ত্রণে । সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ইসরায়েলের কৌশলগত গুরুত্ব উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হিসেবে আংশিকভাবে বলা যেতে পারে ইরানের স্বাধীনতার বিষয়টি, বিশেষত ১৯৭৯ সালে ইরানের শাহ এর যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত নিষ্ঠুর একনায়কত্বের উৎখাতের পর থেকে এটি গুরুত্ব পেয়ে আসছে। শাহ এর প্রস্থানের ফলে এ অঞ্চলটিকে এককভাবে দমন করার জন্য রইল ইসরায়েল। যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে ঐক্যমত পোষণ করে সৌদি আরবের বিশাল তেলের সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে রাখার দায়িত্ব নিশ্চিত করেছে ইসরায়েল।

যুক্তরাষ্ট্রের নীতিমালায় ইসরায়েলের ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে লক্ষ্য করা যায় যখন ক্লিনটনের সময়কালে যখন যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক কৌশল “দ্বৈত হটাও নীতি” তে পরিবর্তিত হয় এবং ইরাক ও ইরান উভয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়ায় ইসরায়েল। ক্রমাগত উন্নত প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে ইরানের পক্ষে বিপুল ক্ষমতাসম্পন্ন ধ্বংসাত্মক অস্ত্র উৎপাদনে সমর্থ হওয়া সম্ভব, ২০১০ এর ফেব্রুয়ারির কোয়াড্রেনিয়াল ডিফেন্স রিভিউ(Quadrennial Defense Review) তে যেগুলোকে “এন্টি একসেস ওয়েপনস”(anti access weapons) বলে উল্লেখ করা হয়। এর ফলে বিশ্বের যে কোন অঞ্চলে ইচ্ছেমত যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা প্রতিহত হবে। এটি ইরানের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ওয়াশিংটনের সামনে একটি অত্যন্ত কঠিন পরীক্ষা। ইরানের তেলের উপর নিয়ন্ত্রণ লাভের অভিপ্রায় ও একটি সার্বভৌম জাতীয়তাবাদের ঘাঁটি নস্যাৎ করার লক্ষ্যে এই বিরোধের উত্থান ঘটেছে।

এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ইসরায়েলকে সমর্থন প্রদানের বিষয়টি কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। “ইসরায়েল লবি” ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ লবি’ সংক্রান্ত হাইপোথিসিসটি যদি গ্রহণ করা হয়, তাহলে এটি বলা যেতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল, এ দুই দেশের স্বার্থে কোন বিভাজন ঘটলে যুক্তরাষ্ট্রকে এর “জাতীয় স্বার্থের” বিপরীতে গিয়ে ইসরায়েলের ইচ্ছার প্রতিই নজর দিতে হবে। তারপরও লবি বিতর্কের সমর্থনকারীদের দাবী অনুযায়ী, যদি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিমালা এর জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী হত তবে এটাই প্রমাণিত হত যে নীতিমালা ব্যর্থ ছিল। প্রশ্ন জাগতে পারে- কার জন্য ব্যর্থ ? যুক্তরাষ্ট্রের অভিজাত শ্রেণীর জন্য নয়, যারা প্রতিপক্ষের আন্দোলনকে সাফল্যের সাথে নস্যাৎ করে বিশ্বের শক্তি সম্পদের প্রধান উৎসগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে নিয়েছে। প্রতিরক্ষা এবং অবশ্যই এনার্জি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এই নীতিমালা ব্যর্থ নয়।

বাস্তবিক অর্থে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি ও অন্যান্য অঞ্চলের নীতি একই। শুধু তাই নয়, এটি লাভজনক ও কৌশলগত দিক থেকে সফল। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না, যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন বিষয়ক নীতিমালায় দখলদারিত্ব সমাপ্তির কোন লক্ষ্য নেই ও ফিলিস্তিনিদের অধীকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের লক্ষ্যও এতে অনুপস্থিত- বস্তুত এসব প্রতিরোধ করাই এ নীতিমালার মূল উদ্দেশ্য। ২০০২ সালে ইসরায়েল কর্তৃক সংঘটিত “অপারেশন ডিফেনসিভ শিল্ড”(Operation Defensive Shield)এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের ও তাদের যুক্তরাষ্ট্র মদদপুষ্ট সরকারকে বেশ ভালোভাবে শাস্তি দেওয়া হয় । ক্যাম্প ডেভিড প্রশ্নে তাদের আপোষহীন অবস্থানের কারণে।

ইতোমধ্যে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ যে সময়টিতে ইসরায়েলের “সাবকন্ট্রাক্টর”(subcontractor) ও সহযোগী(collaborator)হিসেবে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে চালিত পূর্বের সকল প্রতিরোধ দমন করে আসছিল। ইসরায়েলের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্লোমো বেন আমির (Shlomo Ben Ami) ভাষ্যমতে প্রাক্তন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল শ্যারন সুপরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনি প্রতিষ্ঠানসমূহের ধ্বংস সাধন করেন। যার ফলে সেগুলো পুনরায় নির্মাণের সুযোগ তৈরী হয়। এতে করে সেদেশের উপর আরও বেশি মাত্রায় যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। উপনিবেশ স্থাপন ও দখলদারিত্বের ফলে ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে মূল্যবান ভূমি ও পানি সম্পদ ইসরায়েলের দখলে চলে যায়।

এর ফলে প্রভাবশালী সমাজ হিসেবে ইসরায়েলের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় যাতে করে প্রতিবেশী কোন রাষ্ট্র এর উপর চাপ প্রয়োগ করতে না পারে। ইসরায়েলের ক্ষমতা বিস্তারের প্রক্রিয়াকে একটি “শান্তি প্রক্রিয়ার”(peace process) লেবাস চাপিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করছে এই আশায় যে, সময় যত অতিবাহিত হবে ফিলিস্তিনিরা তত বেশি নিজেদের সম্পদ ও অধিকার সমর্পণ করবে। এ মূহুর্তে প্রাথমিকভাবে যা করণীয় তা হল বিশ্বের সামনে তুলে ধরা যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এবং এই মহৎ লক্ষ্যের যারা বিরোধীতা করে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সময়ে ওবামা প্রশাসন তেল সম্পদ আয়ত্তে আনার জন্য, আরব ও আফ্রিকা কেন্দ্রিক দীর্ঘদিনের নীলপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য মিসর, তিউনিসিয়া, ইয়ামেন, সিরিয়া প্রভৃতি দেশে চলমান আন্দোলন ও লিবিয়া যুদ্ধে, সি আই এ ও মসাদ এজেন্ট ঢুকিয়ে দিয়ে দেশগুলোতে নিজেদের পুতুল সরকার বসানোর পরিকল্পনা করছে। এর জন্য ইসরায়েলকে সাথে নিয়ে ওই অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চালানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, সম্প্রতি গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সচিব রবার্ট গেটস ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এহুদ বারাক এর সাথে একটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে বসেন।

গত দুই বছরে তাদের ভিতর বহুবার বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে তারা চলমান মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির পটপরিবর্তনের বিশেষত লিবিয়া কেন্দ্রিক যুদ্ধের মুখে ওবামা প্রশাসন কর্তৃক ইসরায়েলকে নিরাপত্তা প্রদানের প্রতিশ্রুতি বিষয়ে আলোচনা করেন। কারণ তিউনিসিয়ায় সফল গণ-আন্দোলনের মুখে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন প্রেসিডেন্ট জয়নুল আবেদিন বেন আলী। মিসরে প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের পতন । বিক্ষোভ দানা বেঁধেছে আশপাশের আরও কয়েকটি দেশে।

আরব বিশ্বের এই পট পরিবর্তন বা সংস্কার প্রক্রিয়া যে পথে হচ্ছে তা যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র ইসরায়েলের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা। তিউনিসিয়া-মিসরের পাশাপাশি পর্যবেক্ষকেরা তিক্ষ্ণ নজর রাখছেন মার্কিন মিত্র সৌদি আরব, ইয়েমেন ও জর্ডানের ওপর। এর মধ্যে মিসর ছাড়া জর্ডানই একমাত্র আরব দেশ যার সঙ্গে ইসরায়েলের শান্তি চুক্তি আছে। রক্ষণশীল বিশ্লেষক ড্যানিয়েল প্লেতকা বলেন, ওই অঞ্চলের চলমান গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যদি যা করার তা না করে শুধু কথা বলেই চলে এবং আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে না পারে তাহলে ওই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব হ্রাস পাবে। প্রথম প্রথম মোবারকের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি কিছু না বললেও পরে পতনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিয়েছে ।

অথচ তিনি তাদের দীর্ঘদিনের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র এবং ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রক্রিয়ার অন্যতম সহযোগী। মিসরে যদি কোনো পক্ষ ক্ষমতায় আসে তাহলে দেশটি তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে পারে বলে যে কথা উঠেছে তা নিয়ে মুখ খুলেছেন মিসরের অন্যতম বিরোধী নেতা মোহাম্মদ এল বারাদি। মোহাম্মদ এল বারাদি বলেছেন, ‘মিসরে গণতন্ত্র কায়েম হলে দেশটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলবিরোধী হয়ে উঠতে পারে বলে যে কথা বলা হচ্ছে তা নিতান্তই অমূলক ও কাল্পনিক। ’ বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইসলামপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুডের উত্থানের ভয় দেখিয়ে মোবারক পশ্চিমাদের সমর্থন আদায় করে আরও ক্ষমতায় টিকে থাকতে চেয়েছেন। কার্নেগি ফাউন্ডেশনের মারিনা ওত্তাওয়ে বলেন, ‘মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় আসতে পারে এবং এই পরিবর্তনের ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের অবনতি হতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে।

তবে দুই বিষয়ে এই উদ্বেগ অতিরঞ্জিত। কারন আরব বা লিবিয়ার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার ফসল । ’ মারিনা আরও বলেন, ‘এই উদ্বেগের কারণে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে মোবারকের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি। ’ কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের লেসলি গেলব জানিয়েছেন, মুসলিম ব্রাদারহুড মার্কিন নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। লেসলি গেলব আরও বলেন, ‘সংগঠনটির সমর্থক হামাস বা অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ সুয়েজ খাল এলাকার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং মিসর-ইসরায়েল চুক্তির বিরোধিতা করতে পারে।

’ লেসলি গেলব আরও বলেন, ‘এসব ছাড়াও ওই অঞ্চলে এবং সারা বিশ্বে সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচেষ্টাকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে মুসলিম ব্রাদারহুড। এ ছাড়া ভারতের কাছে ইসরায়েলের ক্রমাগত অস্ত্র ও প্রযুক্তি বিক্রির মূল উদ্দেশ্য পাকিস্তান ও চীনকে চাপের মুখে রাখা । যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে সবসময় নীরব ভূমিকা পালন করে আসছে । যদিও এটি সত্যি যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলিদের অপরাধের বিষয়ে বিশ্ব জুড়ে জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়ছে, কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যবর্তী স্থানে একটি শক্তিশালী ও নির্ভরযোগ্য মিত্রকে ধরে রাখতে পারা কৌশলগত দিক থেকে একটি বড় ধরনের অর্জন, যার তুলনায় এই ক্ষোভ কিছুই নয়। কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণাধীন ফিলিস্তিনের কর্তৃপক্ষের যে সংবিধান রয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্রকে এর লক্ষ্য পূরণে এবং আরও কার্যকর উপায়ে দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে সবরকমের প্রতিরোধ দমন করতে সাহায্য করছে, কেননা জেনারেল কেইথ ডেটন সরাসরি ফিলিস্তিনি নিরাপত্তা বাহিনী্র তত্ত্বাবধানে রয়েছেন।

একইভাবে গাজার বাইরে ইসরায়েলি সৈন্যদের পুনরায় বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার ফলে ওয়েস্ট ব্যাংক দখলের সুবর্ণ সুযোগ পেলেন শ্যারন যাকে আন্তর্জাতিকভাবে একজন “মহান শান্তিকামী দূত” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ইসরায়ে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.