আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পোড়া মুখ: পুড়ছে হৃদয়

সাধারণ একজন পোড়া মুখ: পুড়ছে হৃদয় তারিক আল আজিজ আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। মানসপটে ভেসে উঠছে অসংখ্য পোড়া মুখ। ভাবছি, কত বড় পাষাণ আমি? কী করে করছি ‘লাঞ্চ’, ‘ডিনার’? চোখে পানি জমছে, আলতো করে মুছে ফেলছি। ‘ঘিঞ্জি’ ঢাকায় এত মানুষ, কেউ না কেউ আমার কান্না দেখে ফেলবে। কী করব বলুন? কান্নাই সার! ভাবতে পারেন, এতগুলো লাশ! লাশের মিছিল! আচ্ছা কতজন মারা গেছে? শতাধিক তো জানি।

সরকার তরফে জেনেছি ১১১। তাই কি? কেউ কেউ সংখ্যা বাড়াচ্ছেন- ১১৮, ১২০, ১২৬..। আসলে সংখ্যাটা কত? মনে হচ্ছে সত্য সংখ্যাটা পাহাড় সমান উঁচু। গণমাধ্যমে কোন প্রতিবেদককে দেখলামনা যে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা, আগুন লাগা অবস্থায় কারখানার অবস্থা, কতজন নামতে পেরেছে.. সব মিলিয়ে বলছেন সংখ্যাটা এত বা এত’র পাশাপাশি। অনেকেই হয়তো পুড়ে গেছেন হাড়গোড় শুদ্ধ।

তারা তো হিসেবের বাইরে। পরিজনরা তাদের খুঁজবেন, যতদিন বেঁচে থাকবেন। আমরা দু’দিন বাদে আর কাঁদবো না, ভুলে যাব। কী জানেন, ভাবতে গেলে আতঙ্কে আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ধরুন, আমাকে বলা হলো আগুনে পুড়তে থাকা মানুষের অবস্থা নিয়ে একটা চিত্রনাট্য লিখতে।

কী লিখব? কী দাঁড়াবে ‘ডিটেইল’? ধোঁয়াচ্ছন্ন মুখ, দম নিতে পারছে না, নিজের হাতে বোনা কাপড়গুলো জ্বলছে, চিৎকার..! আরেকটু পর? পত্রিকায় পড়লাম, স্ত্রী প্রিয়তমকে ফোন করে বলেছেন, অমুক চিহ্ন দেখে আমার লাশ চিনে নিও। উফ! আর পারছি না। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে খানিকটা সময় কাঁদলাম। কান্না, এটুকুই। যিনি প্রিয়তমা হারিয়েছেন, যে বাবা তাঁর মেয়ে হারিয়েছেন, তারা জীবনভর কাঁদবেন।

তাদের অশ্রু শুকিয়ে যাবে। হৃদয়ের ক্ষতে লাগানোর জন্য কোন মলম নেই। পরিবারগুলোকে এক লাখ টাকা করে দেবার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। প্রিয় মানুষের আগুনে গলা শরীরের দাম! এরপরও অনেকে হয়তো নাশকতার ভিন্ন ভিন্ন চিত্র হাজির করবেন। কী করে এই ইস্যু কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা যায়! লোপামুদ্রা’র গান অনেকেই শোনেন।

ওই যে গানটা- ‘পাখিরা সব কোথায় গেছে চলে? ফিরবে নাকি মানুষ পোড়া বন্ধ হলে। ’ আমারো মনে হয় উড়ে চলে যাই কোথাও। এ যে সহ্য হবার নয়। মানুষ কতটা স্বার্থপর হলে এতগুলো জীবন যাবার পরও সম্পদের ক্ষতির কথা ভাবতে পারে? কী করে পারে? আমাদের দেশের কিছু ব্যবসায়ীরা পারেন। অনায়াসে তারা নিজের সম্পদ চুরি হবার ভয়ে গেট আটকে দিতে পারেন।

বড় বড় তালা ঝুলিয়ে দিতে পারেন। কচি মেয়েগুলো আগুনে ঝলসে যাবার পরও কিছু ব্যবসায়ী হিসাব কষতে পারেন কত টাকা ক্ষতি হলো! ছোটকালে পড়েছি ‘আপনাকে বড় বলে বড় সে নয়’। আরো জেনেছি ‘বড় বড় গাছ বড়ত্বের পরিচয় দেয় নীচ দিকে নুয়ে গিয়ে’। বিজেএমইএ’র কি এতটুকু দায় নেই? এই সংগঠন সংশ্লিষ্ট অনেককে গণমাধ্যমে এই অবস্থায়ও যখন নিজেদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে দেখছি, তখন সত্যি ঘৃণায় গা রি রি করে উঠছে। কালও দেখলাম একজন খতিয়ান টানছেন কী করে তারা আরো অনেক মানুষকে পুড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছেন।

কত বড় বড় ব্যবসায়ীদের সংগঠন! আচ্ছা, বড় ব্যবসায়ীরা কি বড় মানুষ হন না? কতকিছুই ঘটে, আমরা নিরুদ্বিগ্ন। আমরা জাতটাই কি আসলে স্বার্থপর? তা হবে কেন? ঝড়-জলোচ্ছাস তো আমরা একসাথে মুকাবেলা করি। একের বিপদে অন্যে এগিয়ে যাই। এতগুলো মানুষ পুড়ে যাওয়ার পর সরকার শোক ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এতবড় দুর্ঘটনার পরও অনেকের উদ্বেগের কমতি ঠিক চোখে পরছে।

গণমাধ্যম দেখছি মানুষকে শোকের সাগরে ভাসাতে তৎপর। কিন্তু আসল জায়গায় তারা নেই। কেন তারা অনুসন্ধিৎসু হয়ে ঠিক ঠিক কারণগুলো খুঁজে বের করতে পারছেন না? একজন মেয়ে রিপোর্টারের অবস্থা দেখে অবাক হলাম। এ বিষয়ে ‘এক্সপার্ট’ সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছেন তিনি। চেহারায় গ্লামার ঠিকরে পড়ছিলো।

কী আর বলব? নিমতলি, বউবাজার দেখেছি। একই ঘটনা আবার দেখলাম আশুলিয়ার গার্মেন্টে। একইদিন চট্রগ্রাম বহদ্দারহাটেও ফ্লাইওভার দুর্ঘটনা ঘটেছে। আগেও একবার একই ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনা ঘটেছিলো। শুক্রবারের দিন হওয়ায় সেবারে তেমন ক্ষতি হয়নি।

এবারে ১৭ প্রাণহানি। পুকুরের তলদেশে ‘গার্ডার’ চাপা আরো লাশ থাকতে পারে। আগেরবার কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বলা বাহুল্য, আগের অনেক অনেকবারেও কোন পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়নি। যা হয়েছে তা ‘আইওয়াশ’।

আমরা জনগনও ভুলে গেছি। আবার মেতে উঠেছি হাসি-ঠাট্রায়। ওই যে, বাঙ্গালি হাসতে জানে! আমরা সুখি জাত! শতাধিক মানুষের মৃত্যুতে আমার বেশি কিছু চাইবার নেই। অনেকেই দেখছি যেমন ছিলেন তেমনই আছেন। নিজের কাজে আগে যেমন ছিলেন তেমনই ডুবে আছেন।

এবার মনে হয় নিজেদের হৃদয়ের খোঁজ করার সময় হয়েছে। আমাদের হৃদয় আছে কীনা, নেড়েচেড়ে দেখা দরকার। কিছু না, শুধু একটু দুঃখ অনুভব করি। পারলে দু ফোটা চোখের জল ফেলি। হয়তো মানুষ হবার দিকে একটু এগিয়ে যেতে পারবো।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।