আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-অর্ধেক পরিপূর্ণ জীবন।

মাঝে মাঝে বৃষ্টি দেখে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে জাগে... ভেতর ভেতর যাই পুড়ে যাই, কেউ জানেনা আমার আগে... সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে আমার পরিচয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে! না, সুনীল সম্ভবত কখনো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাননি। তারপরও তার সাথে আমার পরিচয় সেখানেই। ভর্তি হয়েছিলাম চবিতে। একবছর ছিলাম। শাহ আমানত হলের বর্ধিত (এক্সটেনশন) অংশের ছোট্ট এক রুমে থাকি তখন।

সম্ভবত টিন শেড একতলা ভবন। ভবনের এই অংশটা খুব মজার! মূল ভবন থেকে আলাদা ছোট ছোট অনেকগুলো সারিবদ্ধ রুম। একতলা। অনেকটা ইংরেজী ‘U’ আকৃতির। মাঝখানের জায়গাটুকুতে একচিলতে সবুজ ঘাস।

কিছু নাম না জানা ফুল। কিন্তু একতলা এই বর্ধিত অংশে আসতে হলে দীর্ঘসময় আপনাকে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে! অনেকগুলো সিঁড়ি! কারন, এই বর্ধিত অংশটি আসলে বড় এক টিলার উপর অবস্থিত। যারা গিয়েছেন, তারা জানেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জুড়েই অজস্র পাহাড় আর টিলা। সেই টিলার একটির উপরেই এই বর্ধিত অংশ। আমার রুমের পেছনদিকের জানালার বাইরেই ঘন জঙ্গল।

গাছ, লতাপাতা। কিছু লতাপাতা আবার বেপরোয়া হয়ে কখনো সখনো জানালা দিয়ে রুমের ভেতরও ঢুকে পড়ে। আমি তখন সাপের ভয়ে অস্থির। এখানে সেখানে সাপ দেখা যায়। বিষাক্ত পাহাড়ি সাপ! আমি টেলিভিশনে সাপ দেখলেই ভয়ে অস্থির হয়ে যাই, গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে যায়! সেই আমি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিজ উদ্যোগে রুমের চারপাশে কার্বলিক এসিড ছড়িয়ে দেয়ার খবরেও বিন্দুমাত্র আশ্বস্ত হইনা।

বরং সন্ধ্যার পরে রুমে কেউ না থাকলে টেলিভিশন রুমে গিয়ে বসে থাকি। রুমমেট কেউ না আসা পর্যন্ত রুমে ফিরিনা। রোজার মাস। জোহরের নামাজ পরে এসে সবাই মিলে রুমে বসে আছি। আমার এক রুমমেট, সম্ভবত রাসেল (দীর্ঘদিন একসাথে ছিলাম, অথচ আজ নামও ভুলে গেছি!) নাম, মেরিন সায়েন্স বা এরকম কিছুতে পড়ে।

হঠাত দেখি ওর টেবিলে একটি বই। বিশাল মোটা। তখন পর্যন্ত মোটা বই দেখলে আর পড়ার আগ্রহ থাকেনা! কিন্তু বইটা হাতে নিলাম নামের কারণে। বইয়ের নাম ‘প্রথম আলো’। প্রথম আলো নামের বইয়ের প্রতি আগ্রহ থাকার পেছনে ছোট্ট ঘটনা আছে।

চবিতে শিবিরের প্রভাব সম্পর্কে আশা করি সকলেই কম বেশী জানেন। সেসময় বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায়। সুতরাং, শিবির তখন অন্ততপক্ষে, চবিতে মাটিতে পফ ফেলে হাটেনা। হাঁটে মাটির কয়েক হাত উপর দিয়ে! বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা বিশেষ কিছু পত্রিকা ছাড়া পড়তে পাইনা। দিনের বেলা ক্লাশ আওয়ারে টেলিভিশন রুম বন্ধ থাকে! আরও নানান রকম ঝামেলা।

তো সেই সময়ে সম্ভবত দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় চবি’র শিবির নিয়ে কোন রিপোর্ট হয়েছে। সুতরাং জনকণ্ঠ, সংবাদসহ আরও কিছু পত্রিকার সাথে হলের পেপার রুমে প্রথম আলোও নিষিদ্ধ। আমার একটা সমস্যা আছে। প্রথম আলো মিথ্যা লিখুক, সত্য লিখুক। খারাপ লিখুক ভালো লিখুক।

এই পত্রিকা ছাড়া যদি দেশের বাকী সবগুলা পত্রিকাও পড়ে ফেলি, তারপরও মনে হয়, আজ বুঝি পত্রিকাই পড়া হয় নাই। সকাল থেকেই ভেতর ভেতর ছটফট লাগে। তো হলের এক বড় ভাইকে বললাম যে আমি রুমে প্রথম আলো রাখলে কোন সমস্যা হবে কিনা! উনি বললেন, কি সমস্যা? তোমার টাকায় তুমি রাখবা! আমি প্রথম আলো রাখা শুরু করলাম। দেখি আশে পাশের রুমের প্রায় সবাই তখন আমার রুমে পেপার পড়তে আসা শুরু করেছে। তো এই নিয়ে আমার রুমের শিবিরের এক বড় ভাই ভীষণ ক্ষেপে গেলেন।

কিন্তু ব্যাক্তিগতভাবে আমাকে পছন্দ করায় কিছু বলতে পারছিলেন না। দিনে দিনে বিষয়টা সম্ভবত ওনার সহ্যসীমার বাইরে চলে যাচ্ছিল। সোমবারের এক সকাল। তখন প্রথম আলোয় সোমবার রস+আলো ছিলনা, ছিলো ‘আলপিন’। আলপিনের শেষ পাতায় সুমন্ত আসলাম ‘বাউণ্ডুলে’ নামে একটা বিভাগ লিখতেন।

অসাধারন সেই বিভাগ, সেই লেখা! তো সেই সকালে তার এমন এক লেখা পড়ে আমি আমার মুগ্ধতা কিছুতেই কাটাতে পারছিলাম না । রুমে যে আসছে তাকেই লেখাটা পড়ে শোনাচ্ছি। রুমমেট বড় ভাই আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। আমার হাত থেকে আলপিন খানা নিয়ে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিলেন। এবং সেদিন থেকে হলে নিষিদ্ধ হোল প্রথম আলো।

সেই আমি হঠাত যখন আমার রুমেই কারো টেবিলে প্রথম আলো নামের ইয়া মোটা সাইজের বই দেখলাম, কৌতূহলী না হয়ে পারলাম না! বইখানা হাতে নিলাম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বই। এই ইয়ামাহা সাইজের বই হাতে নেয়ার সময় সেটি পড়ার যদি বিন্দুমাত্র আগ্রহও থেকে থাকে, তা পুরোপুরি উবে গেলো সেই বইয়ে লেখা ‘প্রথম খণ্ড’ শব্দটি দেখে! তার মানে, এই বই বই নয়, আরো বই আছে!! প্রবল বিরক্তি এবং বিতৃষ্ণা নিয়ে আমি সেই বই খুললাম। ভাবলাম, দেখি ব্যাটা কি লিখেছে! প্রথম পাতা উলটালাম, দ্বিতীয় পাতা উলটালাম, তৃতীয় পাতা উলটালাম। উল্টাতেই থাকলাম।

একসময় আজান হোল, আজানের শব্দে আমি চমকে উঠলাম। বাইরে অন্ধকার! আরিহ! ইফতারের সময় হয়ে গেল নাকি! আমার রুমমেটরা সব কই! এদের অবশ্য সেদিন বাইরে ইফতার করার কথা! আমি দৌড়ে বাইরে গেলাম! প্রবল শীত, চারদিকে ঘন কুয়াশা! অন্ধকার! সেই অন্ধকারে আমার বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো যে আমার আছর, মাগরিব, ইফতার সব আমি সেই বইয়ের পাতায় পাতায় গিলে ফেলেছি! সেখানে কি নেই! ইতিহাস! কল্পনা! সৃষ্টি, ধ্বংস, জীবন, রাজনীতি, দর্শন... ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম চরীত্ররা। কী নেই, কে নেই। কিন্তু আমি তন্ময় হয়েছিলাম ‘ভরত’ নামে এক ‘কাছুয়া’র গর্ভে জন্ম নেয়া সুনীলের অসম্ভবকে অবলীলায় সম্ভব করে তৈরি করা এক অসামান্য চরীত্রে। এক অভূতপূর্ব সম্মোহনে।

সেই দিন সুনীল আমার মোটা বই ভীতি এমন নির্মমভাবে ভেঙ্গে দিয়েছিলেন যে এরপর থেকে আমি বই পড়তে বসলে কেবল বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো ফুরিয়ে যাচ্ছে কিনা, এই আতংকে অস্থির থাকি! পৃষ্ঠা গুনতে থাকি! রেহ! এই বুঝি বইটা শেষ হয়ে গেল! এরপর রুদ্ধশ্বাসে শুরু হোল সুনীল পাঠ। পরদিন সকালেই পাগলের মত ছুটলাম প্রথম আল’র দ্বিতীয় খণ্ড কিনতে। একে একে গিলতে থাকলাম সুনীল। সুনীলের প্রবন্ধ, সুনীলের কবিতা, সুনীলের গল্প, সুনীলের উপন্যাস! সুনীলের কবিতা ‘কেউ কথা রাখেনি’ বাংলা আধুনিক কবিতার সমার্থক এক নাম। এত জনপ্রিয় কবিতা কি কোন ভাসায় আর আছে! এমন করে কি একজনমে কেউ এক মানব্জীবনের সকল হাহাকার বলে যেতে পেরেছেন! একটা কবিতায়, গুটিকয় শব্দে! নাকি সম্ভব! ‘জোছনাকুমারী’ নামে সুনীলের ছোট্ট এক উপন্যাস আছে।

আমার জানাশোনা যত স্বল্পই হোক, তারপরো বলবো বিশ্ব সাহিত্যের অনেক অনেক বিখ্যাত বই পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু জোছনাকুমারী নামের এই ছোট্ট বইখানার সাথে আমি কিছু মেলাতে পারিনা! একজন মানুষ কি করে পারেন! কিভাবে পারেন!! এই বই পড়ে আমি এক অদ্ভুত ঘোরে পড়েছিলাম। সেই ঘোর আজও কাটেনি! হয়তো কাটবেনা কোনদিন! না কাটুক! সুনীলের আত্মজৈবনিক লেখা ‘অর্ধেক জীবন’ পড়ে কতবার যে সুনীল হতে চেয়েছি, তার ইয়ত্তা নেই! এই বইয়ে সুনীল লিখেছিলেন, কারোপক্ষেই নাকি তার পুরোজীবনের আত্মজীবনী লেখা সম্ভব নয়, লেখা সম্ভব অসম্পূর্ণ জীবনী। অর্ধেক জীবন। এর চেয়ে বড় সত্যি হয়তো নেই, কিন্তু সত্যের ভেতরেও অজস্র সত্য থাকে, সেই সত্য আমরা খুজিনা।

হয়তো কখনো কখনো খুঁজি। আজ যেমন খুঁজছি! সুনীল, কিছু কিছু মানুষের জীবনে যে কখনোই পূর্ণ জীবন বলতে কিছু নেই! হাজার বছর আয়ু পেলেও যে মনে হয়, কেন আর কটা দিন নয়! আরও কত কি পাওয়ার ছিল, দেয়ার ছিল! বড় অসময়ে চলে গেলেন! আবার এও মনে হয়, এমন জীবন যদি অর্ধেক জীবন হয়, ঈশ্বর তবে অর্ধেক জীবন-ই দিন! অর্ধেক পরিপূর্ণ জীবন। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।