আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফ্রিডম অব স্পিছ বা ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন কি সাম্প্রদায়িকতার উস্কানিদাতা?!

যেকোনো ধরনের মত প্রকাশ এবং তার প্রতি সহনশীল আচরণ গনতন্ত্রের মুল চালিকাশক্তি। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া গনতন্ত্র তথা প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যাবস্থা গড়ে তোলা অসম্ভব। আধুনিক বিশ্বের যেকটি দেশ গনতন্ত্র বিকাশে বেশি সোচ্চার তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স অন্যতম। নিজেদের দেশে যাই হোক না কেন গরিব দেশগুলিতে গনতন্ত্র নামের টোটকা বেচা-বিক্রিতে তাদের রয়েছে আশ্চর্য রকম প্রচেষ্টা। একেক দেশের একেক রকমের শাসনতন্ত্র (বা যন্ত্র) থাকতেই পারে সেটা এই লেখার বিষয় না বরং গনতন্ত্রের ধ্বজাধারী দেশগুলি সুকৌশলে মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলে বিশ্ব সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢেলে দিচ্ছে কি না তার একটা চেষ্টা করাই হবে এই লেখার মুল উপজীব্য।

যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রথম সংশোধনের মাধ্যমে ধর্ম প্রচার ও প্রসার, মত প্রকাশ, জমায়েত হওয়া, কোনও বিষয়ে সংক্ষুব্ধ হলে তার পিটিশন দেয়াসহ আরও কিছু বিষয়ে স্বাধীনতা দিয়েছে। এই সংশোধনীটি “বিল অফ রাইটস” নামেও সমধিক পরিচিত। পেপার-পত্রিকা, টেলিভিশন দেখে আর সে দেশের মানুষদের সাথে কথা বললে আপনি নিশ্ছিত হতে পারবেন তারা তাদের নিজেদের ও অন্যদের অধিকার সম্বন্ধেও কতটা সচেতন। আমেরিকান নাগরিক প্যাস্টর টেরি জোন্স ২০১০ সালে ৯/১১ বেদনাদায়ক দিনটিকে সামনে রেখে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরান পোড়ানর ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং ৯/১১’র দিনটিকে তিনি “আন্তর্জাতিক কোরান পড়ানো দিবস” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। ত্রিশ বছরেরও অধিক ইউরোপে ধর্ম প্রচার করে শেষতক ফ্লোরিডার মৌলবাদী গাইন্সভিল/জেইন্সভিল ক্রিস্টিয়ান চার্চে ১৯৯৬ সালে এসে থিতু হন।

তিনি যা করতে চেয়েছিলেন তা মৌলবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। আর তিনি এই হীন কাজটি করার সাহস পেয়েছিলেন ঐ “বিল অফ রাইটস” নামক সাংবিধানিক রক্ষাকবচ থেকে। সেসময় ওবামা সরকার তাকে শুধু অনুরোধ করেছিল ঐ কাজটি তিনি যাতে এড়িয়ে যান! তিনি আদৌ কোনও কোরান পুড়িয়েছিলেন নাকি নিছক বাহবা নেয়ার জন্য এমন কাজ করতে চেয়েছিলেন তা অবশ্য জানা যায়নি। এবার আসা যাক নাকুলা বাসিলির ব্যাপারে। তিনি "Innocence of Muslims" বানিয়ে শুধু যে মুসলিমদের শত্রুতেই পরিনিত হলেন তা নয় সেই সাথে শতাধিক মানুষের মৃত্যুর কারনও হলেন! আমেরিকান মুক্তচিন্তা নামক ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তিনি যে চলচিত্রটি নির্মাণ করলেন তা শুধু ডাহা মিথ্যা না জঘন্য মিথ্যাচার।

আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট “ফ্রিডম অফ এক্সপ্রেশন” এই ধারনাটিকে সমন্নত রাখতে স্বীয় দেশের পতাকা পোড়ানোকেও সমর্থন করে এই কথাটি আমাদের আবার মনে করিয়ে দিলেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি রডহ্যাম ক্লিনটন। বাসিলির এইরূপ মিথ্যাচার আর আমেরিকান গণতন্ত্রের খেয়ালি মনোভাবের কারনে উত্তাল হয়ে উঠে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব। শুধু যে কয়েক ডজন মুসলিমই এতে প্রান হারায় তা নয় লিবিয়ার বেনগাজিতে আমেরিকান রাষ্ট্রদূতও মারা যান। এত কিছুর পরও বাসিলিকে গ্রেফতার করা হয় আগের একটি মামলার জামিনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার জন্য। আর একেই বলে আমেরিকান গণতন্ত্র! লিবিয়া সরকার আমেরিকান রাষ্ট্রদূতের মৃত্যুর জন্য ঠিকই ক্ষমা চেয়েছিল কিন্তু আমারিকার মাটি থেকে পুতি দুর্গন্ধময় চলচিত্রখানা যে শতাধিক মানুষের প্রান কেড়ে নিয়েছে তাতে আমারিকা বরাবরের মতই দুঃখ প্রকাশ করতে অনিহা প্রকাশ করে কারন একটাই ভিন্নমত প্রকাশের অধিকারকে সমন্নত রাখা।

ফরাসি বিপ্লবের হাত ধরে ফ্রেঞ্চরা নির্দয় রাজা বাদশাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছিল, মুক্তবুদ্ধি আর মত প্রকাশের স্বাধীনতা পেয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজিদের হাত থেকে ইহুদী সম্প্রদায়কে রক্ষার ক্ষেত্রে তাদের অবদান ছিল প্রশংসাযোগ্য। কিছুদিন আগেও ইহুদীদের প্রতি যাতে কেউ কটাক্ষ না করে সেই জন্য তারা আইন পর্যন্ত করেছে। আর এই আইনের কারনে ক্রিস্টিয়ান ডিওর এর প্রধান ডিজাইনার জন জিলিয়ানো কোনও মতে জেলে যাওয়া থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন তবে তার ঐ চাকরিটা খোয়াতে হয়েছিল। স্টার ওয়ারস খ্যাত ইহুদী অভিনেত্রী নাতালি পোর্টম্যানত ঘোষনা দিয়েছিলেন যে তিনি আর ঐ ডিজাইনারের সাথে কোনও কাজ করবেন না।

তথাকথিত সেকুলার ফ্রেঞ্চ সমাজে ইহুদী বা তাদের ধর্ম নিয়ে এত টানাটানি হাসির উদ্রেক করে। তবে অনেকেই আবার এরমধ্যে ষড়যন্ত্রের গন্ধও পান। নাকুলা বাসিলির "Innocence of Muslims" মুক্তি পাওয়ার পর আর সব মুসলিমদের মত ৪৭ লাখ ফ্রেঞ্চ মুসলিমও ক্ষুব্ধ হয়েছিল তারা প্যারিসে প্রতিবাদ সমাবেশ করতে চেয়েছিল কিন্তু ফ্রান্সের সেকুলার সরকার তা হতে বাধা দেয়। আর এর রেশ কাটতে না কাটতেই একটি প্রভাবশালী হাস্য রসাত্মক বিষয়ক ম্যাগাজিন “চার্লি হেবডু” মহানবী (সাঃ) এর একটি ব্যাঙ্গাত্তক কার্টুন প্রকাশ করে। একদিকে ইহুদী তোষণ আর অন্যদিকে প্রিডম অব প্রেসের দোহাই দিয়ে অন্য একটি সম্প্রদায়ের মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করার মানে কি? দুই সম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য দুই রকমের ব্যাবস্থা? এটাই কি সেকুলারিজমের মুল মন্ত্র? ইহুদীরা আমাজনে বাস করা অস্তিত্ব সংকটে পরা কোনও নৃগোষ্টি নয় যে তাদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য বন্ধ করতে আইন কানুন তৈরি করতে হবে যেন তাদের সংখ্যা কমে না যায়! আইন যদি করতেই হয় তাইলে তা সবার জন্য সমান হওয়াটা বাঞ্ছনীয় সেটা সেকুলার বা ধর্মভিত্তিক যে রাষ্ট্র ব্যাবস্থাই হোক না কেন! আধুনিক গণতন্ত্রের আঁতুড় ঘর বলে পরিচিত ব্রিটেনের মানবাধিকার চর্চার রেকর্ড মোটেও ভাল নয়।

ব্লেয়ার, গরডন আর হাল আমলের ক্লেগ-কেমেরনের আজব জুটি আমেরিকার বি-টিম লেবাসের কোনও হেরফের করতে পারেনি। ব্লেয়ারের জি হুজুর মার্কা কাজ কারবার ইরাকে মিলিয়ন লোকের মৃত্যুর কারন হয়েছে। তিনি যদি একটু সাহসী হতেন জর্জ বুশ মানুষ মারার মহোৎসবের এত বড় একটা ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে পারতেন না। সাবেক লেবার এম.পি জর্জ গ্যালাওয়ে ব্লেয়ার সরকারের এহেন মানবাধিকার পরিপন্থি কাজের কঠোর সমালোচক ছিলেন। পড়ে তাকে লেবার দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।

গত মার্চের বাই ইলেকশনে ব্রেডফোর্ড আসন থেকে তিনি বিপুল ভোটের ব্যাবধানে জয়ী হন। আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন যে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের ধ্বজাধারী ব্রিটেন ৩০০’র বেশি যুদ্ধাপরাধীর নিরাপদ আস্তানা! হোম অফিসের হিসাব অনুযায়ী ২০১০’র জুলাই থেকে ১১’র ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৮ মাসে মাত্র তিন জন চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধিকে সরকার দেশে ফেরত পাঠাতে পেরেছে। অথচ তারাই বিশ্ব মানবাধিকার নিয়ে বেশি হৈচৈ করে। ৭১’র কুখ্যাত চৌধরী মইনুদ্দিনত এখন রিতিমত একজন ব্রিটিশ নাগরিক। ১৬ জন ব্রিটিশ মুসলিমকে গুয়ানতানামো বে কারাগারের ১৪ শিকের ভিতরে পুরতে ব্রিটিশ সরকার সুচতুরভাবে কাজ করে গেছে।

নিজ দেশের নাগরিকদের নুন্যতম সহযোগিতা করেনি MI5। এই ১৬ জন নিরাপরাধ লোকের মানবাধিকার নিয়ে খেলা ব্রিটেন শেষ পর্যন্ত কোর্টের বাইরে ক্ষতিপূরণ দিয়ে একটা ফয়সালা করেছিল। আজকে দেখলাম ব্রিটিশ কম্পিউটার হ্যাকার গেরি ম্যাককিনন সিআইএ আর নাসার ৯৭টি কম্পিউটার হ্যাক করার পরও তাকে সরকার আমেরিকার হাতে তুলে দিবেনা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে অথচ কিছুদিন আগেই আবু হামজা সহ আরও চারজন মুসলিম ভিন্নমতাবলম্বীকে আমেরিকার হাতে তুলে দিয়েছে আর জুলিয়াস আসাঞ্জত রীতিমত লন্ডনস্থ ইকুয়েডর দূতাবাসে গৃহবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। ঐ ১৬ জনের একজন মোয়াজ্জেম বেগ বলেছিলেন “ব্রিটিশ সরকার আমাদের সাথে মামলায় টিকতে পারবেনা বলেই শুধু টাকা দিয়ে ফয়সালা করেছিল অন্যথায় তারা তা করত না”। তার এই উক্তি প্রমান করে ব্রিটিশ সরকারের কদর্য রুপ।

গ্রেট ব্রিটেন মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের পথে হয়ত কয়েক শতক ধরে হাঁটছে কিন্তু ধর্ম, বর্ণ আর মতের পার্থক্য এখনও সরকারের আচরণে ভিন্নতার কারন হয়ে দেখা দেয়। ফরাসি বিপ্লব আর অনেক সামাজিক ঘাত প্রতিঘাতে প্রসব হয় “Declaration of the Rights of Man and the Citizen”। যার মাধ্যমে ফ্রান্সে সকল নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮১ সালের প্রেস ল’র দ্বারা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। আবার ১৯৯০ সালে গাসত অ্যাক্ট দ্বারা ইহুদী সম্প্রদায়কে রক্ষার ব্যাবস্থা করা হয়।

ফ্রান্সে আপনি যদি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইহুদী নিধনের কথা স্বীকার না করেন তাইলে তা হবে আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ! তেমনি প্রথম সংশোধনের মাধ্যমে আমেরিকার নাগরিকদের জন্য “Bill of Rights” আর অন্যদিকে জার্মানির সংবিধান ৫ম আর্টিকালের মাধ্যমে তার নাগরিকদের যেকোনো কিছু বলার, আর প্রকাশ করার অধিকার দিয়েছে। যুক্তরাজ্য আর সুইজারল্যান্ড আর্টিকাল ১০ আর আর্টিকাল ১৬ এর মাধ্যমে তার নাগরিকদের একই অধিকার দিয়েছে। এভাবে দেখলে দেখা যাবে যে আধুনিক বিশ্বের প্রায় সব সভ্য দেশই তার নাগরিকদের ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে স্বাধীনভাবে বলার, মতপ্রকাশ আর স্বাধীনভাবে চলার অধিকার দিয়েছে। কিন্তু এই অধিকারের কিছু ব্যাতিক্রম রয়েছে, যেমন আপনার স্বাধীনভাবে প্রকাশ করা মত অন্য কাউকে বা তার ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত না করার শর্ত। আর এই ব্যাতিক্রমগুলি বা শর্তগুলি নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।

আমেরিকার নাগরিক “নাকুলা বাসিলি” বা ফ্রান্সের পত্রিকা “চার্লিস হেবডু” যা করল তা উক্ত দেশ সমুহের সংবিধান অনুযায়ী হয়ত আইন সিদ্ধ কিন্তু উক্ত আইনের ব্যাতিক্রমগুলি লক্ষ্য করলে তা সমানভাবে অগ্রহনযোগ্যও বটে। পরিতাপের বিষয় আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রী আর ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী শুধু তার নাগরিকদের অধিকারের কথাই আমাদের শুনালেন কিন্তু ফ্রিডম অব স্পিছ বা ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশনের সেই উল্লেখিত ব্যাতিক্রমগুলির কথা মোটেও উল্লেখ করলেন না বা করেন না?! নিজেদের বিশ্বের সবচেয়ে নিরপেক্ষ দাবি করা দেশ সুইজারল্যান্ড আইন করে মসজিদের লম্বা মিনার তৈরি করা বন্ধ করে দিয়েছে কিন্তু ৩০০ ফুটের অধিক লম্বা ক্যাথিড্রালের চূড়া ধর্ম পালনে সবার সমান অধিকারের আর্টিকেলটি সুইস সরকার নিজেরাই ভুলন্ঠিত করে নিরপেক্ষতার মাথা খেয়েছে। সুনামগঞ্জ, অক্টোবর ১৯, ২০১২ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.