আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটা মন খারাপ করা গল্প…

একেবারে শুরুতেই বলে রাখি, আমি হলাম গ্রামের মানুষ, আঞ্চলিক ভাষায় বলতে গেলে একেবারেই খ্যাত মার্কা একটা ছেলে। লেখাপড়া বা কপাল, যেকোন একটা বা দুটোরই জন্য আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আধুনিক সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে আমি নিতান্তই বেমানান। যাক গে, মন খারাপ করা গল্পটা শুরু করি।

দিনটা ছিল শনিবার। অক্টোবরের ৭ তারিখ। ২০১২। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। আমি আর আমারা মোট ১০ জন মিলে জাভা’র(কম্পিউটার ল্যাঙ্গুয়েজ) উপর একটি কোর্স করার সিন্ধান্ত নিয়েছিলাম তারও প্রায় মাস খানেক আগে।

বাঙ্গালীর ব্যবস্থাপনা মানেই তো অব্যবস্থাপনা। তাই শুরু করতে গিয়ে মাসখানেক দেরী হয়ে গেল। টাকা-পয়সা একটু কম লাগবে, তাই আমরা ধানমন্ডির ‘হলি একাডেমী’(সিটি কলেজের সামনে ওভার ব্রীজ থেকে নেমেই যে গলিটা হাতের ডান দিকে চলে গ্যাছে, সেই গলিতে) নামের একটি কোচিং সেন্টারের ছোট্ট একটি রুম ভাড়া করি। যা হোক, কষ্ট করে হলেও তো কম টাকায় শেখা হয়ে যাবে। ক্লাস শুরু করে দিলাম সেপ্টেম্বরের ৩০ তারিখ থেকে।

অক্টোবরের ৭ তারিখ ছিল আমাদের দ্বিতীয় ক্লাস। জীবনে বোধহয় অনেক বড় একটা ভুল করেছি ল্যাপটপ না কিনে ডেস্কটপ পিসি কিনে। আবার ল্যাপটপ ছাড়া কোর্সের ক্লাস করার উপায়ও নেই। তাই আমার হলের এক কক্ষসঙ্গীর ল্যাপটপ ধার করে নিলাম। লেখাপড়ার জন্য কত আগ্রহ আমার! ক্লাস শেষ হল বিকাল পাঁচটার দিকে।

আমার ব্যাগটা অনেক ভারী। একে তো ল্যাপটপ, তার উপর মাল্টিপ্লাগ,বই-খাতা, কলম……। তাই ব্যাগটাকে ঘাড়ে তুলতে রীতিমত অলসতা চেপে বসল আমার উপর। হঠাৎ, আমার খুব প্রিয় বন্ধু রিফাত ঘাড়ের পেছনে হাত চেপে আমাকে এসে বলল, বাইরে কারা যেন মারছে আমাদের। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার আরেক প্রিয় বন্ধু ধুমকেতুর মত উড়ে এসে বলল, পালা, মারতে আসল।

দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি, দু’তিন জন ছেলে, হাতে বাঁশ নিয়ে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে। একেবারে কোচিং সেন্টারের ভেতর ঢুকে পেড়েছে, আমাদের ক্লাসের ভেতর ঢুকে পড়েছে। হিতাহিত জ্ঞান শূণ্য হয়ে জান বাঁচানোর জন্য দৌড় দিলাম, ক্লাসের বিপরীত দিকের ছোট্ট দরজর উপর দিয়ে আমরা তিনজন লাফিয়ে পড়লাম অপর রুমে ক্লাস নিতে থাকা এক ম্যাডামের উপর। ম্যাডাম সক্রোধে চিৎকার করে উঠলেন, “এ্যাই, ব্যায়াদপ ছেলেরা, কি করছ, আস্তে যাও। ” “ম্যাডাম, আমাদের মারতে আসছে…” হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে পেছন থেকে বলে উঠল কেউ একজন।

মুহূর্তে আমরা তিন জন চলে গেলাম কোচিং সেন্টারের একদম পেছনে। একটা অন্ধকার যায়গায়। লম্বা জালের মত কিছু একটা ছিল। সেটা সরিয়ে খাজকাটা দালানের আড়ালে আমরা লুকিয়ে থাকলাম। আর মনের ভেতর গুণগুণিয়ে উঠতে থাকল খোদা-আল্লাহ্ আর দেব-দেবীদের নামগুলো।

ওরা লাঠি হাতে আমাদের খুঁজতে আসছিল। কিন্তু ম্যাডাম বাঁচিয়ে দিলেন, বললেন, ওদিকে কেউ নেই। তোমরা যাও……। অন্ধকারের আড়ালে অনেকক্ষণ লুকিয়ে থাকলাম। আমার সাথে আরও দু’জন লুকিয়ে আছে।

বাকিদের খবর জানি না। যে দুজন আমার সাথে আছে, ওদের কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ ঝুলছে। আমার ব্যাগটা? হে ঈশ্বর…. ব্যাগটা তো রুমে রেখে দৌড় দিয়েছি। ব্যাগটা যেন থাকে…..। প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর আমরা বেরোলাম।

আমার বন্ধু-বান্ধব সবার চোখে-মুখে বিস্ময় আর আতঙ্ক একসাথে লীলানৃত্য করছে। পা টিপে টিপে এগুলাম সেই ক্লাস রুমটার দিকে, যেখানে আমি ক্লাস করেছিলাম। না, আমার ব্যাগটা আর নেই……………..। ততক্ষণে কোচিং এর গেট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কোচিং সেন্টারের পরিচালক সেই মুহূর্তে ছিলেন না।

তবে কোচিং সেন্টারের লোকেরা আমাদের ই দোষ দেয়া শুরু করলেন। তাদের কথাগুলো ছিল মুটামুটি এরকম, নিশ্চই আপনাদের সাথে ওদের পূর্ব শত্রুতা ছিল। অথবা আপনারা নিশ্চই কিছু করেছিলেন। তা না হলে শুধু শুধু ওরা আপনাদের মারতে আসবে কেন? আমি এবং আমরা তাদের বোঝানোর অনেক চেষ্টা করলাম যে, আমরা তাদের কাউকে চিনি না। কোনদিন দেখি নি।

তাদের সাথে আমাদের কখনও কোনদিন একটি কথাও হয় নি। তারা জবাবে বললেন, “আপনাদের এ কথা বাংলাদেশের কেউ বিশ্বাস করবে না। যাক, আপনারা এখন বের হন। যা হবার তো হয়েছেই, এখন কোচিং সেন্টারের মান-সম্মান নষ্ট করবেন না। ” কোচিং সেন্টারের ভেতরে অনেক খোঁজা খুঁজি করলাম।

আমার ল্যাপটপের ব্যাগটা আর পেলাম না। সবসময়ই যে ছেলেটির সাথে থাকি, তার নাম রাশেদ। ওকে শুধু আমার বন্ধু বললে ভুল হবে। হবে ঠিক কি বলে ডাকলে ঠিক হবে, তা আমি জানি না। রাশেদের ফ্যাকাসে রক্তাভ মুখটি দেখা গেল।

ওর বাম পাশের কান দিয়ে রক্ত পড়ছে। কপাল-ভ্রু-গালদুটো ফুলে গিয়ে, রক্ত জমাট বেঁধে লাল হয়ে আছে। ওকে দেখতে বিশ্রী লাগছে। বুঝতে পারলাম, ওর উপর দিয়ে কি গ্যাছে। স্থানীয় বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে পড়ে জানতে পারলাম, ওরা নাকি ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের ছেলে।

এ ঘটনায় আমাদের কোন সংশ্লিষ্টতা ছিল না - এ কথা মানুষকে বোঝানো যে কতটা কঠিন, তা আমি এতদিনে বুঝে গ্যাছি। আমি নিশ্চিত, আমি আপনাদেরকেও বোঝাতে পারিনি। বোঝাতে পারার কথা না। আমার এক বন্ধু তার ছোট ভাইকে ডাকল। ওর ছোট ভাই স্থানীয় কিছু ছেলেদেরকে ধরে আনল।

ওরাই নাকি গোটা ধানমন্ডি এলাকার মা-বাপ। এক লোক আমাকে জিজ্ঞসা করল ল্যাপটপটা কি আমার ছিল? আমি বললাম, না। আমার বন্ধুর ছিল। সে জানতে চাইল, ল্যাপটপটা আমার হাত থেকে নেওয়া হয়েছে কি না। আমি বললাম, না।

ল্যাপটপটা আমি রুমে রেখে পালিয়ে যাই। এসে দেখি ওটি আর নেই। তাহলে আমি ধরে নিতে পারি না যে ল্যাপটপটা ওরাই নিয়েছে? এমন সহজ স্বীকারোক্তির জন্য আমি বকা খেলাম। হারিয়ে গেলে নাকি সব-সময়ই বলতে হয়, যা হারিয়েছে সেটি আমার ছিল এবং যারা নিয়েছে তারা আমার হাত থেকেই ছিনিয়ে নিয়েছে। শুরুতেই বলেছি, আমি বোকা-সোকা জাতের এক ছেলে।

এত সব কৌশল আসলেই আমার জানা ছিল না। ফিরতে আমাদের অনেক রাত হল। ল্যাপটপটা আর পাওয়া গেল না। খারাপ করা মন আর আহত বন্ধুদের নিয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে এলাম। মন খারাপ করা গল্পটা এখানেই শেষ।

আমার মনে হওয়া দু’টি কথা বলি। আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধানমন্ডি যেতাম। ওখানে আমাদের চেনা-পরিচিত খুব বেশি মানুষ জন ছিল না। তাই হয়ত স্থানীয় ক্যাডাররা এমন করতে সাহস পেয়েছিল। আরও অনেক অসম্ভব কাহিনী মাঝেমাঝেই মনে হয়।

আসলে একটা দূর্ঘটনা ঘটে যাবার পর অনেক যদি-কিন্তু মনের ভেতর ঘোরপাক খেতে থাকে। কিন্তু, আমি জানি, এর কোন কিছুই সত্য নয়। আমার বন্ধু সিফাতের কাছ থেকে শোনা, এ ঘটনার কিছুদিন আগে নাকি ওই একই রাস্তায় কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে চাঁদা না দেওয়ায় চরমভাবে অপমান করে কিছু ছেলে(আমি জানি না ছেলে গুলো এরাই কি না)। সেদিক থেকে আমরা তো ভাগ্যবানই। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে চর-থাপ্পর মারা হয় নির্বিবাদে, সেখানে আমাদের না হয় ধানমন্ডি প্রধান সড়কের পাশের রাস্তায় ১০-১২ জন সন্ত্রাসী দিনের আলোতে সবার সামনে পিটিয়ে, আহত করে, ল্যাপটপ নিয়ে চলে গ্যাছে- এ আর এমন কি।

তাই না? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.