আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘুরতে গিয়েছিলাম ভারত - ৫

আগের পর্বগুলো - ১ , ২ , ৩ , ৪ হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে রওনা দিয়েছিলাম অনেক রাতে। ঘুমানো ছাড়া আর কোন কাজ ছিল না তখন। ঘুম খুব একটা হয়নি। এমনিতেই ট্রেনের দুলুনি, তার উপর এমন জায়গায় সিট পেয়েছিলাম যে লোকজনের হাঁটাচলার শব্দ হয় খুব। যা হোক, ভোরবেলা নেমে এলাম।

এবার ফ্রেশ হবার পালা। আগেই অভিজ্ঞজনদের কাছ থেকে জেনে নিয়েছিলাম যে এখানকার ট্রেনগুলোর বাথরুমে বদনা সংকট হয়। তাই সাথে করে একটা বোতল রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু শিগগিরই টের পেলাম বদনার কাজ বোতল দিয়ে করা একটু মুশকিলই। এই সময় আমাদের উদ্ধার করল আমাদেরই এক বন্ধু।

সে বুদ্ধি করে বাংলাদেশ থেকেই একটা বদনা নিয়ে গিয়েছিল শুধুমাত্র ট্রেনে ব্যবহারের জন্য। সে আমাদের সবার ব্যবহারের জন্যই ঐ বদনা উন্মুক্ত করে দিল। সে যে কি অভাবনীয় দৃশ্য। যখনই কারুর বাথরুমে যাওয়া দরকার হয়, তার কাছে গিয়ে বদনা চেয়ে নেয়। তারপর কাজ শেষে আবার যার জিনিস তাকেই বুঝিয়ে দেয়।

জয়তু বদনা। আমাদের বাবুর্চি ট্রেনেই রান্নার ব্যবস্থা করেছিল। মেনু সেই আগের মতই। শুধু মুরগির তরকারী এবার বাদ পড়ল, দুই বেলাই মাছের ব্যবস্থা। কারণ ভারতে ট্রেনে মাংস রান্না করা নাকি নিষেধ।

আজব নিয়ম। তবে একটা জিনিস খুব ভালো লাগল। প্রতিটা স্টেশনে খাবার পানির ব্যবস্থা আছে। সরকারীভাবেই পানির কল বসানো, সেখানে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া যায় বিনা খরচে। প্রয়োজনমত বোতলে ভরে নিলেই হল।

প্রতিটা স্টেশনে ট্রেন থামলেই আমাদের ছেলেদের কাজ হত সবার বোতল সংগ্রহ করে নেমে যাওয়া। তারপর পানি ভরে ভরে সেগুলো জানালা দিয়ে যার যার কাছে পৌঁছে দেয়া। ওহ, শিকল কাহিনী তো বলাই হল না। এখানে রাতের বেলা লাগেজ পাহাড়া দেয়ার জন্য তো কেউ জেগে বসে থাকবে না, তাই চোরের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য লাগেজগুলো শিকল দিয়ে ট্রেনের সিটের সাথে বেঁধে রাখতে হয়। স্টেশনে শিকল আর তালা নিয়ে ফেরিওয়ালারা ঘুরতেই থাকে।

বেশির ভাগ স্টেশনে ট্রেন দশ-পনের মিনিটের মত করে থামছিল। একটা স্টেশনে গিয়ে প্রায় এক ঘন্টা থেমে ছিল। ঐ ফাঁকে আমাদের কয়েকজন বন্ধু একটু ঘুরতে বেড়িয়ে স্টেশনের পাশেই একটা মন্দিরে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে প্রসাদ বিতরণ চলছে। তারাও সুন্দরমত বেশি করে প্রসাদ নিয়ে এল।

তারপর আমাদের সবাইকে ভাগ করে দিল। প্রসাদ হিসেবে খিচুড়ি দিয়েছিল, তবে মজা হয়নি তেমন, লবণ কম। একজন আবার সবার জন্য আঙ্গুর কিনে আনল, এখানে নাকি অনেক সস্তা। আঙ্গুরগুলো অবশ্য খুবই মিষ্টি ছিল। ভালোই চলছিল ট্রেনযাত্রা।

হঠাৎ করেই এক জায়গায় এসে ট্রেন থেমে গেল। কোন স্টেশন না, বাইরে ধু ধু মাঠ। কেউ একজন বলল এটা টাটানগরের কাছে। সেই যে ট্রেন থামল তো থামল, নট নড়ন চড়ন। কোন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কী হল।

কেউ নিশ্চিত হয়ে কোন খবর দিতে পারল না। শুধু এটুকুই জানলাম যে ট্রেন ছাড়তে দেরী হবে। সেই দেরী পুরো বারো ঘন্টা গড়িয়েছিল। এই বারো ঘন্টায় অস্থির হয়ে উঠলাম আমরা। সবাই দলে দলে ভাগ হয়ে আড্ডা দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ পাচ্ছিলাম না।

তা-ই বা আর কতক্ষণ করা যায়। আমাদের স্যার একেকবার একেক দলের সাথে বসে আড্ডায় যোগ দিচ্ছিলেন। আমাদের দলেও এক সময় এলেন। এই সময় কে যেন স্যারের এক সুপ্ত প্রতিভার খবর দিল। স্যার না কি হাতের রেখা দেখে ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান বলতে পারেন।

খুবই হাস্যকর লাগে আমার এই ব্যাপারটা। যা হোক সবাই চেপে ধরল স্যারকে। স্যারও আগ্রহ নিয়েই একে একে সবার হাত দেখতে থাকলেন আর বলতে থাকলেন। একেকজনের জন্য স্যারের করা মন্তব্য শুনে সব হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে থাকলাম। কারণ স্যারের মন্তব্যের বেশির ভাগই মিলছিল না কারুর সাথে।

আর বেশির ভাগের এক প্রশ্ন, বিয়ে হবে কবে। ছেলেদের মধ্যে একজনের হাত দেখে স্যার বললেন, তুমি খুবই নরম স্বভাবের ছেলে, এত কোমল স্বভাব মেয়েদেরও হয় না। বেচারা লজ্জাই পেয়ে গেল। মোটামুটি সবারটাই দেখা হল। আমি চুপচাপ এক কোণে বসে ছিলাম।

আমার কোনই ইচ্ছা ছিল না এসব হাস্যকর কাজ করার। কিন্তু আমি না চাইলেই কি সবাই ছাড়বে। আমি যে সবার মন্তব্য শুনে শুনে হেসেছি, তার বদলা নিতে হবে না? জোর করে ধরে বসিয়ে দেয়া হল আমাকেও। আমার হাত দেখে স্যার প্রথমেই যেটা বললেন, তুমি ভয়ংকর জেদী, ছেলেরাও এত জেদী হয় না। সবাই এবার জোর গলায় প্রতিবাদ করে উঠল, এটা একেবারেই অসম্ভব কথা।

স্যার বললেন, কিন্তু আমি তো তাই পাচ্ছি, আমি আমার সারা জীবনে এমন হাত আর দেখিনি, জেদী হবার সবগুলো চিহ্ন ওর আছে, সাধারণত একজনের হাতে একটা বা দুইটা পাওয়া যায়, ওর সবগুলো আছে। এক দুষ্টু ছেলে হাত দেখানোর সময় স্যারকে জিজ্ঞেস করল, স্যার দেখুন তো আমার বিদেশ ভ্রমণ আছে কি না। স্যার কিছুক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বললেন, নাহ, তোমার বিদেশ ভ্রমণ নাই। সে বলল, তাহলে আমরা এখন কোথায় ভ্রমণ করছি স্যার? আর এক দুষ্টু স্যারের সামনে হাত মেলে ধরে করুণ চেহারা করে বলল, আমার বিয়ে হবে কবে বলেন না স্যার। স্যার দেখে গবেষণা করে বললেন, তিরিশের আগে না।

সে মিটি মিটি হাসতে থাকল। অন্যরা আর চুপ করে থাকতে না পেরে বলেই দিল, স্যার ও তো বছর খানেক আগেই বিয়ে করে ফেলেছে। স্যার আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না, বোকার মত তাকিয়ে রইলেন। এমন মজা করে করে অনেকটা সময় কাটিয়ে দেয়া গেল। তারপর এক সময় ক্লান্ত হয়ে কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়ল।

ছেলেরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে বসে পড়ল তাস নিয়ে। বারো ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর অবশেষে আমাদের ট্রেন ছাড়ল। আমরা এক সময় পৌঁছালাম আগ্রায়। এখানে উঠলাম হোটেল স্যাভয়-এ। পরের দিন আমরা দেখতে যাব অন্যতম সপ্তাশ্চর্য তাজমহল।

রাতে খাওয়ার পর শুরু হল ব্রিফিং। খুব অদ্ভূত, তাজমহল দেখতে যাওয়ার জন্য আবার ব্রিফিং কিসের? ব্রিফিং-এর কারণ হল ভারতের যে কোন দর্শনীয় স্থানে ঢোকার টিকিটের দামের বৈষম্য, ভারতীয়দের জন্য যেখানে টিকিটের মূল্য দশ রুপি, বিদেশীদের জন্য একশ রুপি। এই বৈষম্য তো আর আমরা মেনে নিতে পারি না, ওদেরকে কেন আমরা এতগুলো রুপি দিয়ে আসব। আমরা দশ রুপিতেই দেখব তাজমহল। তাই আমাদেরকে শিখিয়ে দেয়া হল যাতে আমরা একসাথে সবাই টিকিট না কেটে তিন-চারজন করে গ্রুপ করে নিই।

যাতে কোন একটা গ্রুপ ধরা পড়ে গেলেও পুরো দলবলসহ ধরা না পড়ি। আর আমাদের কোন প্রশ্ন করলে কী জবাব দিব তাও শিখিয়ে দেয়া হল। আমরা হলাম পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী। তারপরও যদি সন্দেহ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর নাম জানতে চায় তো তাও যেন আমরা গড়গড় করে বলে দিতে পারি সেই ট্রেনিং দেয়া হল। আমাকে নিয়ে সবাই একটু সন্দেহে ছিল।

একটু বেশিই বাংলাদেশি মনে হয় আমাকে দেখলে। আমার নিজেরও সন্দেহ একেবারে কম ছিল না। তাই আমি ঠিক করলাম আমি কোন গ্রুপে থাকব না। কারণ আমি যে গ্রুপে থাকব সেই গ্রুপের ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকবে। তার চেয়ে ভালো ধরা পড়লে আমি একা ধরা পড়ব।

তেমন কিছু তো হবে না, একশ রুপি দিয়ে টিকিট কেটেই নিব। যা হোক, কে কী করবে, কী বলবে সব ধরণের জল্পনা-কল্পনা করতে করতে আমরা ঘুমাতে গেলাম। পরের দিন কিভাবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান হয়েছিল তা না হয় আরেকদিন বলি। চলবে.................... ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.