আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একদিন উকিল মুন্সী

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ মনের দুঃখ মনে রইল বুঝলি না রে সোনার চান/ চন্দ্র-সূর্য যত বড় আমার দুঃখ তার সমান। উকিল মুন্সী। ১৯৭৮ সালের অক্টোবর মাসের এক নির্জন কুয়াশাময় ভোরে নেত্রকোনার বেতাই নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালেন উকিল মুন্সী।

নদীটি তাঁর বাড়ির উঠান ঘেঁষে বয়ে চলেছে। বর্ষার পানি সরে যাওয়াতে নদীটিকে এখন বোঝা যায়। বর্ষাকালে নদী আর ফসলের মাঠ একাকার হয়ে যায়। চরাচর ডুবে থাকে দশ হাত পানির তলায় । চারিদিকে থইথই পানি ।

হাওর অঞ্চলের ধারাই এরকম। মানুষ বর্ষায় জলবন্দি জীবন কাটায়। উঁচু মাটির অভাবে কবর পর্যন্ত দেওয়া সম্ভব হয় না। পানিতে লাশ ভাসিয়ে দিতে হয়। হাওরের পানিতে লাশ ভাসে।

হাওরের পানিতে নাইওর-নৌকাও ভাসে। নাইওরী আষাঢ় মাসে বাপের বাড়ি যায়। মাঝিরা গলা ছেড়ে সুনামগঞ্জের উজানধল গ্রামের শাহ আবদুল করিম এর গান গায়: কোন মেস্তরী নাও বানাইছে কেমন দেকা যায় আরে ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খি নাও ... আশ্বিনের ভোরের বাতাস শীত জড়ানো। সেই শীতমাখা বাতাসের ঝাপটায় উকিল মুন্সীর ৯৩ বছরের দীর্ঘ শীর্ণ সামান্য কুঁজো শরীরটি একবার কেঁপে ওঠে। বৃদ্ধের গায়ে একটি ঘিরে রঙের চাদর জড়ানো।

লুঙ্গির রং সাদা। টুপির নীচে ছোট ছোট করে ছাঁটা পাকা চুল। ভুরু দুটিও পাকা। ঈষৎ লম্বাটে মুখে দরবেশের মতন ধ্বধবে পাকা দাড়ি। চামড়া কুঁচকে যাওয়া গায়ের রংটি এককালে উজ্বলই ছিল ।

চোখের মনি ঘোলা। বৃদ্ধ গায়ে ভালোভাবে চাদর জড়িয়ে একবার ডানদিকে তাকালেন। ওদিকটায় করচ বন। বেতাই নদীর পাড় ঘেঁষে অনেক দূর ছড়িয়ে আছে। আলো-আঁধারীতে বাইট্টা করচ গাছগুলি ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ভোরের বাতাসে সে গাছের টক টক গন্ধ ছড়িয়েছে। কী নির্জন ভোর! কান পাতলে শিশির পতনের শব্দও শোনা যায়। পূবালী বাতাসে করচ পাতারা অল্প অল্প কাঁপছিল। আশ্বিন ভোরের কুয়াশা ছড়িয়ে ছিল করচ বনে । শিশিরে ভেজা মোটা মোটা গুঁড়ি ।

ওই দৃশ্যে মনে গান এল আচমকা। সংবাদে কি অঙ্গ জুড়ায় সখি বিনা দরশনে শিশিরে না ভিজে মাটি বিনা বরিষনে। নিজের অজান্তে গুনগুন করে গাইছেন বৃদ্ধ । এমনিতে বৃদ্ধের গলা ভারি চড়া । তাঁর আযান অনেক দূর থেকে শোনা যায়।

কিন্তু এই মুহূর্তে গুনগুন করেই গাইছেন। বৃদ্ধ খেয়াল করলেন ...তাঁর বড় ছেলের মৃত্যুর পর এই প্রথম গান এল মনে ... বৃদ্ধ এই নির্জন সুবেহ সাদিকে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। তাঁর আবদুস সাত্তারের শ্যামলা ভরাট মুখখানি মনে পড়ে। জীবনে এত দুঃখ পাওয়ার পরও এই মুহূর্তে বুকটা কেমন মুচড়ে উঠল। হায়! আমার আবদুস সাত্তার বাঁইচা নাই! ... পূর্বধলার লেটিরকান্দা পাগলা বাড়িতে গানের আসর বসছিল।

তারা আবদুস সাত্তাররে গানের জন্য ডাকছিল। লেটিরকান্দা যাইয়া সে পড়ল জ্বরে। সেই জ্বর আর সারল না। আবদুস সাত্তার- এর কবর বাড়ির উঠানে। বড়ুই গাছের তলায়।

রাতদিন ছেলের কবরের পাশে বসে থাকেন উকিল মুন্সী। আবদুস সাত্তার-এর বড় ছেলের নাম বুলবুল। তেরো বছরের ডাগর চোখের শ্যামলবালকটি বেহালা বাজায়। যদিও বুলবুলের হাত তেমন পাকে নাই। উকিল মুন্সীর বড় আদরের নাতী সে।

বুলবুলকে বাপের কবরের পাশে বসে বেহালা বাজাতে বলেছেন বৃদ্ধ । তাতে ছেলের বউ রহিমার আপত্তি । মুখ ঝামটে বলে, কবরের পাশে বইসা আবার গানবাজনা কীয়ের! বৃদ্ধ শরীয়তও মানেন। তবে গান তাঁর প্রাণ। ... সুনামগঞ্জের উজানধল গ্রামের শাহ আবদুল করিম বয়েসে আমার ছোট।

যে বৎসর আমার বিয়া হইল অর্থাৎ ১৯১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে ... সে বৎসরই ফেব্রুয়ারি মাসে করিমের জন্ম । করিম বয়সে আমার ছোট হইলেও আমার সঙ্গে তাঁর গভীর সখ্য ছিল। করিম একটা গান শোনাইত - গান গাইয়া আমার মনরে বুঝাই মন করে পাগলপারা আর কিছু চাই না আমি গান ছাড়া তয় গান ছাড়া আমার আরও কিছু চাই। ... জীবনভর নামাজ পাঁচ ওয়াক্তই পড়েছেন উকিল মুন্সী। তাহাজ্জুতের নামাজ পড়েন।

মক্তবে পড়ানো আর ইমামতীই তাঁর পেশা। হাওর অঞ্চলে তিনিই এমাত্র ইমাম- যিনি একতারা বাজিয়ে গান করেন। উকিল মুন্সীর পীর বলেছেন, ‘গানবাজনা কর, মুশকিল নাই। তয় খালি একতারা বাজাইয়া গান করবা। আর কিছু না।

’ বুলবুলের বেহালার সুর ঘন হয়ে বাতাসে ছড়ায়। কাল আর ওই সুর ভোরের বাতাসে ছড়াইব না। রহিমা আইজ বাপের বাড়ি চইলা যাইব। হায়, ওর লগে আমার আর দেখা হবে না। কত বৎসর হইল আমি রহিমারে দেখতেছি।

রহিমা শিশুকালে মক্তবে আমার কাছে কায়দা পড়ছিল। তখন কত বয়স হইব তার? বেশি হইলে সাত বছর হইব। রহিমার বাপের বাড়ি খালিয়াজুরি থানার (বর্তমানে উপজেলা) নূরপুরের বোয়ালী গ্রামে। তার স্বামী আর বাঁইচা নাই, শ্বশুরবাড়ির ভিটা খাঁ খাঁ করে। রহিমার সহ্য হয় না।

রহিমা বাপের বাড়ি যাইয়া থাকব ... উকিল মুন্সী আর কী বলবেন। তিনিই তো রহিমার অকাল বৈধব্যের জন্য দায়ি। বড় শখ কইরা বড় ছেলের সঙ্গে রহিমার বিয়া দিসিলেন। সেই রহিমায় অল্প বয়েসে বিধবা হইল। আবদুস সাত্তার বিবাহিত ছিল বইলা বিয়াতে রহিমার বাপে রাজি ছিল না।

রহিমা রে দেইখা মায়া লাগছিল। অন্যায় আবদার না কইরা পারেন নাই ... পাশে তখন আবদুস সাত্তার-এর মা ছিল। বুকে তখন সাহস ছিল। বড় ছেলে আবদুস সাত্তারও উকিল মুন্সির জানের জান। বাপকে বড় ভক্তি শ্রদ্ধা করত সে বাঁইচা থাকতে।

গানের কন্ঠও ছিল বড় চমৎকার। ময়মনসিংহের বাউল সম্মেলনে গোল্ড মেডেলিস্ট। পাকিস্তান আমলের মেট্রিক পাস। বড় ছেলে আবদুস সাত্তার ছিল উকিল মুন্সির গর্বের ধন। বড় কথা হইল আবদুস সাত্তার উকিল মুন্সীর পীরের শানে গান বাঁন্ধছিল ।

সরওয়ারে মদিনা তুমি আল্লাহর ওলি/ কুতুবুল আকতার শাহ পীর বদলে/ নুরে আলামীন জাহাগীর দরবার শরীফ/ রিচি করিলা তরাফ/ ওহে নিরাশার আশা আসিয়া /ভক্তের আশা ... হবিগঞ্জের রিচির মোজাফফর মিয়া উকিল মুন্সির পীর । তিনি ‘সাহেব বাড়ির মোজাফফর আহমেদ’ নামে পরিচিত। মোজাফফর পীরের দরবার শরীফ হবিগঞ্জ শহরের কাছেই । দরবার শরীফটি ‘জাহাগীর দরবার শরীফ’ নামে পরিচিত। চিশতিয়া তরিকার মোজাফফর মিয়া সৈয়দ নাসির উদ্দিনের সিলসিলার উত্তরসূরী।

সৈয়দ নাসির উদ্দিন ছিলেন হযরত শাহজালাল (র)- এর তিনশ ষাট জন শিষ্যের একজন। দরাজকন্ঠে গান গাইতেন বলে উকিলকে বেশি স্নেহ করতেন পীর সাহেব। আর করবেন না কেন? উকিল মাওলানা ভাসানীর মিটিংয়ে গান গেয়েছেন। ভাসানী বুকে জড়ায় ধরছিলেন। তবে পীর সাহেব একবার উকিল মুন্সীর ওপর রাগ করেছিলেন ... একবার পীরের দরগায় ওরছ ছিল।

শরীর খারাপ থাকায় উকিল দরগায় যেতে পারেন নাই। পীর সাহেব রেগে গেলেন। ভক্তদের বললেন-উকিল মুন্সী দরগায় আইলে তারে ভিতরে ঢুকতে দিবা না। তার জন্য ওরছ নষ্ট হইল। এর দিন কয়েক পরে উকিল পীরের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন।

দরবারে ঢোকার আগে গানে টান দিলেন-বন্ধু আমার নিঃদুনিয়ার ধন রে/ তোরে দেখলে জুড়ায় জীবন আমার/ না দেখলে মরণ রে ...। গান শুনে পীর দরবার থেকে বের হয়ে এসে উকিলের হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেলেন। ভক্তরা অনুযোগ করে বলল: আমাদের বললেন তারে যেন দরবারে ঢুকতে না দেই। আর এখন আপনি নিজেই ভাইগা তারে ডেকে আনলেন। পীর সাহেব আর কী বলেন!চুপ করে রইলেন।

এই সব কথা স্মরণ হইলে বৃদ্ধের ছানিপরা চোখে জল আসে ... চারিদিকে আলো ফুটে উঠছিল। করচবনে পাখপাখালির ডাক। আশ্বিনের কুয়াশা সরায়ে জৈনপুরে ভোরের রাঙা আলো ফুটে উঠতে থাকে। ভোরের সে লালচে নরম আলো ছড়ায় বেতাই নদীর উপরে, দুই পাড়ে। নদীটা এইখানে বাঁক নিয়েছে।

বাঁক ছাড়িয়ে হাঁটতে থাকলে কালিবাজার। কালিবাজার থেকে সাত মাইল দূরে মোহনগঞ্জ থানা (বর্তমানে উপজেলা)। প্রায় চল্লিশ বছর হল উকিল মুন্সী জৈনপুর থাকছেন । আহা! জৈনপুরের আকাশে-বাতাসে কী মায়া! সে মায়া মানুষেও ছড়িয়ে আছে। এখানকার সাধারণ খেটে-খাওয়া মাটির মানুষের জন্য গভীর ¯েœহ অনুভব করেন বৃদ্ধ।

গান-পাগল মানুষও তাঁকে শ্রদ্ধাভক্তি করে। মসজিদের ইমাম হয়েও কালিবাজার রামদাসের চায়ের দোকান বসে চা খান। কেউ কিছু মনে করে না ... নিজের অজান্তেই বুক চিরে কেমন যেন দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। উকিলের কী এত দুঃখ? নিজেরে শুধান বৃদ্ধ। বুলবুলের বেহালার একটানা করুণ সুর ভেসে আসে।

পরিচিত সুর ... শুয়াচান পাখি আমার শুয়াচান পাখি/ আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি। ... আবদুস সাত্তার মরণের তিনমাস আগে মরল লাবুশের মা। মৃতা স্ত্রীর শিয়রে বসে গাইলেন শুয়াচান পাখি আমার শুয়াচান পাখি/ আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি। শিষ্য রশিদ উদ্দিন তখন বৃদ্ধ ওস্তাদের পাশে ছিল। সে ওস্তাদকে সান্ত¦না দেওয়ার জন্য ‘শুয়াচান পাখি’ গায়।

বুলবুল এখন সেই সুর বাজাচ্ছে। কাল ভোরে আর বুলবুলের বাজনা শোনা যাইব না। শীতমাখা নদীর বাতাসে ৯৩ বছরের দীর্ঘ শরীরটি কেঁপে ওঠে। ভুলু। বুলবুলের প্রিয় কুত্তাটা করচ বন থেইকা বাহির হইয়া আসে ।

কালা রঙের বড় আকারের কুত্তা। ভুলু রেও কি তারা নিয়া যাইব? না, ভুলু যাইব না। জৈনপুর কী মায়া! এই মায়া ছাড়ন কি সহজ? কিন্তু ... কিন্তু খালিয়াজুরি থানার (বর্তমানে উপজেলা) নূরপুরের বোয়ালী গ্রামটিও তো মায়াজড়ানো । সেই গ্রামেই উকিলের জন্ম (১৮৮৫ সনের ১১ জুন)। ওই বোয়ালী গ্রামেরই মেয়ে রহিমা।

ওই গ্রামেরই মক্তবে রহিমাকে পড়িয়েছেন উকিল মুন্সী। উকিলের বাবার নাম মওলানা গোলাম রসুল আকন্দ। অবস্থা বেশ স্বচ্ছলই ছিল। উকিলের জালালপুরের নানাবাড়িটিও বেশ বিখ্যাত। উকিলের মা ছিলেন জালালপুরের ধলা চৌধুরীর বাড়ির মেয়ে।

শৈশবে মায়ের গভীর স্নেহ-ভালোবাসায় দিন কেটেছে । মওলানা গোলাম রসুল আদরের পুত্রের নাম রেখেছিলেন: আবদুল হক। এক বিচিত্র কারণে সে নাম পরবর্তী সময়ে বদলে যায়। মায়ের ইচ্ছা ছিল ছেলেকে উকিল বানাবেন। শখ করে ছেলের নাম রাখলেন- উকিল।

তাঁকে সবাই ডাকত উকিলের মা। আর ইমামতী করতাম বলে সবাই আমারে মুন্সী বইলা ডাকল। নেত্রকোণার হাওর অঞ্চলে ইমাম সাহেব কে ‘মুন্সী সাহেব’ বইলা ডাকে। এইভাবে আমার নাম হইয়া গেল: ‘উকিল মুন্সী’। ... এই বার আমার দুঃখের কথা কই।

আমার গান শুইনা সবাই জানতে চায় উকিলের কী এত দুঃখ? অল্প বয়েসে আমার আব্বা মইরা গেলেন। মামারা মায়ের আবার বিয়া দিলেন । পরে আমার পৈত্রিক সম্পত্তিও হাতছাড়া হইয়া যায় ... বেতাই নদীর পাড়ে কে যেন গেয়ে উঠল- মনের দুঃখ মনে রইল বুঝলি না রে সোনার চান চন্দ্র-সূর্য যত বড় আমার দুঃখ তার সমান। উকিল মুন্সিী এই নির্জন কুয়াশামাখা ভোরে বেতাই নদীর পাড়ে করচ বনের ধারে দাঁড়িয়ে ম্লান হাসেন। মানুষ এই গান শুইনা ভাবে, উকিলের কী এত দুঃখ? আমি মরলে পরে মানুষ এই গান শুইনা ভাবব উকিলের কী এত দুঃখ ছিল ... ছুটবেলায় আমার সুখের সংসার ভাঙল বইলা আমার এত দুঃখ।

খোদারূপী মায়েরে হারাইয়া এই আমার দুঃখ। মা! মা! তুমি আমারে ছাইড়া চইলা যাইতে পারলা? আশ্বিন ভোরের বাতাসে এক যন্ত্রণাবিদ্ধ হৃদয় হাহাকার উঠে। মায়ের মুখে খোদার দর্শন পাইছিলাম বইলা এই তিরানব্বই বছর বয়েসেও আমার মায়ের মুখখানা একবার দেখতে ইচ্ছা করে। ... মায়ের বিয়ার পর শুরু হইল আমার ভবঘুরে জীবন। মনে গান আইত বইলা আর কন্ঠ সুমিষ্ট ছিল বইলা ঘাটুগানের দলে ভিইড়া যাইতে আমার সমস্যা হইল না।

তারপর ঘরতে ঘুরতে মোহনগঞ্জ থানার জালালপুরে ঠেকল আমার ভবঘুরে নাওখানি । জালালপুরে আমার আব্বার ফুফাত ভাই কাজী আলিম উদ্দিনের বাড়ি। লোকে বলে ‘কাজিবাড়ি’। আমি কাজিবাড়িতে উঠলাম। থাকি।

খাইদাই। আর ঘুইরা বেড়াই। একদিন হইল কী-আল্লাহতালাহ জালালপুরের গ্রামের পথে এক সুন্দরী কইন্যার রূপ ধইরা আমার সামনে আইলেন। ট্যার পাইলাম পায়ের তলায় জমিন কি রকম জানি কাঁপতাছে। আমার অঙ্গও কাঁপতে ছিল।

আমি এ কারে দেখতেছি। এ যে পবিত্র নূরের সৃষ্টি। খোঁজখবর নিয়া জানতে পারলাম কইন্যার নাম: লাবুশের মা। পিতা লবু হোসেন। কৃষি করে।

আমি আমার ইশকের অনুভূতি লইয়া গান বান্ধলাম। ধনু নদীর পশ্চিম পাড়ে সোনার জালালপুর/ সেখানেতে বসত করে উকিলের মনচোর। এই গান লোকমুখে জালালপুরে ছড়ায় যায়। আমার ইশকের কথাও ছড়াইল। কইন্যার বাবা গরিব কৃষক বইলা কাজীবাড়ি লোকেরা ইশকের পথে বাধা হইয়া।

আমি হইলাম কাজীগো আত্মীয়। লবু হোসেন আত্মীয় হইয়া গেলে তারা ছুট হইব না? জালালপুরে আমার থাকা বন্ধ। যাওয়াও বন্ধ। আমি আবার পথে পথে ঘুইরা বেড়াইলাম। শ্যামপুর, পাগলাজোড়া, জৈনপুর গ্রামে পাগলের মতন ঘোরাঘুরি করলাম।

মনে মনে ভাবি আল্লাহতালা আমারে দেখা দিলেন ক্যান? সাকার রূপ ধরলেন ক্যান? দেখা যদি দিলেন ... তাইলে আমারে ধরা দিলেন না ক্যান? কী এই রহস্য? এইসব ভাইবা ভাইবা আমার মনে শান্তি নাই। শান্তি নাই। ‘চিত্তে চিতার অনল জ্বলে। ’ কৃষ্ণ বিহনে রাধা হইল পাগল । আমি পথে পথে পাগলের মতন ঘুইরা বেড়াই আর রাধারমনের গান গাইলাম: আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয় তোমারে না দেখিলে রাধার প্রাণে কেমনে সয় বন্ধু রে ... আমার মনে শান্তি নাই।

শান্তি নাই। আল্লাহর দেখা পাইলাম ... তারে কাছে পাইলাম না। ... শ্যাষে বরান্তর নামে এক গ্রামের মসজিদে ইমামতি শুরু করলাম। রাত্রে আমার ঘুম আসত না। রাত জাইগা গান বান্ধতাম।

ঐদিকে লাবুশের মা গান শুইনা বড় কাতর হইয়া উঠছিল। সে তার বাপরে বুঝাইল। শ্যাষে লাবুশের মার লগে আমার বিয়া হইল। গোপনে বিয়ার আয়োজন তার বাপ লবু হোসেন করল। বিয়ার সন্ধান কাজীবাড়ির কেউই পায় নাই।

তিন একর জমিসহ বসতবাড়ি দিলেন আমার শ্বশুর। আমি খোদারূপী লাবুশের মা রে তন্ন তন্ন কইরা দেখলাম। ছাইনা ছুঁইয়া দেখলাম। ইহার ফলে সৃষ্টিতে খোদা আরও ছড়ায় পড়িলেন। লাবুশের মার কোল জুইড়া এক এক কইরা আবদুস সাত্তার আইল, নুর ইসলাম আইল (এরে আমি পুলিশ মিঞা বইলা ডাকতাম) ।

অয়েশা আক্তার আর রাজিয়া খাতুন নামে দুই কন্যা আইল। ইমামতীই হইল আমার পেশা। কেউ মারা গেলে জানাজা পড়াইতে আমার ডাক পড়ত। আমি মক্তবেও পড়াইতাম। আর আমার সুখের ঘরে মনের আনন্দে আমি গান বান্ধতাম।

নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ আর হবিগঞ্জে আমার বহুত নামডাক হইল। এইদিকে ভারতবর্ষ ভাগ হইয়া পাকিস্তান হইল। ইংরেজরা ভারত ছাইড়া চইলা গেল। পাকিস্তান হওনের তিন বছর পরে একবার হবিগঞ্জ গেছিলাম গানের জলসায়। তখন আমার পীরের সঙ্গে দেখা হইয়া গেল ।

গানের জন্যে তিনি আমারে আলাদা চোখে দেখতেন। আমি হইলাম পীরের পাঁচ খলিফার একজন। জালালপুরে ৪০ বছর ছিলাম। শ্যাষে জৈনপুরের রতন চেয়ারম্যানের সঙ্গে মোহাব্বত হইল। তার টানেই মোহনগঞ্জের জৈনপুরে আইলাম।

সেই লাবুশের মা চইলা গেল ... আবদুস সাত্তারও চইলা গেল ...আজ রহিমাও চইলা যাইব ... উড়িয়া যাইব শুয়াপাখি পড়িয়া রইব ছায়া কীসের দ্বেষ কীসের খেস কীসের মায়াদয়া রে কান্দে হাছন রাজার মন মইনা রে ... হাছন রাজা কথা স্মরণ করে বৃদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে মনে সালাম পাঠায় হাছন রাজার মোকামে ... হালকা রোদ ফুটে উঠেছে। করচবনে পাখির কিচিরমিচির। রহিমা কাল রাত্রেই বলছিল সকালেই চলে যাবে। মজিদ মাঝিরে বইলা রাখছিল।

সকালে সে আইসা ঘাটে নৌকা ভিড়াবে। উকিল মুন্সী ধীরে ধীরে পা ফেলে ঘাটের দিকে হাঁটতে থাকেন। রহিমার ছোট মেয়েটা ভুলু রে জড়িয়ে বসে আসে । ভুলুর দুঃখী চেহারা দেখলে বোঝা যায় জীব জগ]ৎ হইল মায়ার খেলা। ঘাটে একটি ছই নৌকা ভিড়ে আছে।

গলুয়ে মজিদ মাঝি বসে আছে বৈঠা নিয়ে। লগি হাতে ছৈয়ের ওপর শামসু । সে মজিদ মাঝির বড় ছেলে। নৌকায় মালসামানা তোলা হয়েছে। মালসামানা আর কী- ইমামের দরিদ্র ঘর।

রহিমার চার মেয়ে আর দুই ছেলে। তারা নৌকায় উঠে বসেছে। নীল রঙের গেঞ্জি পরা বুলবুল বসেছে একটা ট্রাঙ্কের ওপর । তার হাতে বেহালা। রহিমা এসে দাঁড়ায়।

ওর আজ ওর শাশুড়ির একটা সাদা রঙের শাড়ি পরেছে। যৌবন টলোমলো শরীরে বৃদ্ধার সাদা শাড়ি মানায় না। রহিমার তামাটে রঙের ধারালো মুখখানি থমথম করছিল। আমি মাইয়াটার সর্বনাশ করলাম। কী দরকার ছিল এরে পুত্রবধূ করনের।

কিন্তু আমি কী জানতাম আবদুস সাত্তারে মইরা যাইব? আমি কী জানতাম লাবুশের মার সঙ্গে আমার দেখা হইব? বিয়াও হইব? আমার হাতে কী ঘটনা ঘটাইবার ক্ষমতা আছে? খাালি দেইখা যাওন ছাড়া? রহিমা শ্বশুরকে সালাম করে। উকিল মুন্সী নিস্তেজ কন্ঠে বললেন, দাবি রাইখও না। বাচ্চাদের কষ্ট দিও না। তুমি আর বিয়া কইর না। এই জীবন মাইনা নাও।

তোমার সাথে আমার এই শেষ দেখা। রহিমা কিছু না বলে চুপ করে থাকে। কাঁদছিল সম্ভবত। রহিমা নৌকায় ওঠার পর মজিদ মাঝি নৌকা ছাড়ে। রোদ কেমন ম্লান হয়ে আসে।

ভুলু ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল। নৌকা বেতাই নদীর বাঁকে মিলিয়ে যায়। বৃদ্ধ ঘুরে দাঁড়িয়ে শূন্য ভিটার দিকে হাঁটতে থাকেন। তাঁর পিছনে ভুলু ... রহিমা বোয়ালী গ্রামে বাপের বাড়ি যাওয়ার কয়েকদিন পরই শ্বশুরের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছিলেন। রহিমা অবশ্য বাপের বাড়ি থাকেননি।

বোয়ালী গ্রাম থেকে ফিরে এসে জৈনপুরে শ্বশুরের ভিটায় বাস করছেন। শ্বশুরের কথায় সম্ভবত রহিমা আর বিয়ে করেন নি ... স্বীকার করছি ... নেত্রকোনার বিশিষ্ট মরমী সাধক উকিল মুন্সীর (১৮৮৫/১৯৭৮) জীবন সর্ম্পকে আমার গভীর কৌতূহল ছিল। ব্লগার আবদুল ওয়াহিদ- এর একটি পোস্ট আমার দীর্ঘদিনের সে তৃষ্ণা মেটালো। তাঁকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। এবং তাঁর কাছে ঋণ স্বীকার করে আরও বলি যে ... তাঁর লেখা ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ লেখাটির তথ্যের ওপরই এই লেখাটা দাঁড়িয়ে আছে।

উকিল মুন্সীর জীবন সর্ম্পকে আমি যে সব তথ্য জানত পেরেছি সেসব তথ্য ব্লগারদের জানানোর উদ্দেশ্যেই এই পোস্ট। উল্লেখ্য, আবদুল ওয়াহিদ- এর তথ্য অনুযায়ী ‘শুয়াচান পাখি আমার শুয়াচান পাখি/ আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছ নাকি। ’ ... এই গানটির কিছু অংশ উকিল মুন্সীর শিষ্য রশিদ উদ্দিন এর লেখা। এবং উকিল মুন্সীর মেয়ে রাজিয়া খাতুন এর দাবি অনুযায়ী ওই জনপ্রিয় গানটির উপলক্ষ্য উকিল মুন্সীর স্ত্রী নয়, পীর হবিগঞ্জের মোজাফফর আহমেদ ... Click This Link Click This Link উকিল মুন্সীকে নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন এ প্রকাশিত একটি লেখা। Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.