আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মেধার মন খারাপ!

নিজেকে ভালোবাসি, ভালোবাসি আমার কন্যা মনস্বিতা মেধাকে, ভালোবাসি কবিতা, গান, আর মানুষ, সকালের শিশির, সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি আমার বাংলাদেশকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, এখন গুটিগুটি পায়ে বাড়ছে রাত, আমার ঘর বারান্দায় শুনশান নিরবতা, একটিও পাপড়ি মেলেনি আজ আমার শব্দ গোলাপ, ছোট্ট কঁচি একটা পানপাতা হৃদয় যেখানে জমানো আছে আমার আনন্দের সোনালী মোহর, এই পানপাতা হৃদয় হাসলে আমার ঘরে হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ে সেই মোহর, সে দুয়ারে খিল এঁটে বসে আছে, দু’চোখ ভরা যেখানে থাকে সবসময় রূপালী বিস্ময় সেখানে আজ খরস্রোতা নদী, ওর নাম মনস্বিতা মেধা, ওর বয়স চার বছর দুমাস, একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ও সবে প্লে ক্লাস থেকে নার্সারী ক্লাসে উঠেছে, আমার কন্যা। গত এক বছরে আমি জেনেছি ওর স্কুল খুব পছন্দ, ছুটির দিনেও ও স্কুলে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে। স্কুল থেকে ফিরে নিজে নিজেই হোমওয়ার্ক করতে বসে যায়। স্কুল থেকে ফিরে আজ ওর কান্না থামছে না, কখনও তো এমন হয় না, আজ থেমে থেমে ফুঁসে উঠছে ওর অভিমানী চোখ! ছুটির পর যখন স্কুল থেকে ওকে বুঝে নিলাম তখনও সবকিছু স্বাভাবিক, স্কুলের গেট থেকে একটা বেলুন দিয়ে বানানো হাঁস কিনেছিলাম সেটা দিলাম ওর হাতে, সব সময়ের মতই ও খুশি হলো, ওরা ক্লাস করে তিন তলায়, অন্য দিন ছুটির পর পানির ফ্লাক্স আর ব্যাগ আমার হাতে দিয়েই স্কুলের নীচে ওদের জন্য টাঙানো দোলনার দিকে ছুটে যায়, এ সময় ওর বন্ধুদের সঙ্গে একটা প্রতিযোগীতা চলে কে কার আগে গিয়ে দুটো মাত্র দোলনায় গিয়ে বসতে পারে। আজ ও তেমন কিছুই করলো না, আমার জামা খামচে ধরে আছে, ওর মুখে স্বভাব সুলভ হাসি, আমি বললাম কি হলো? ওর বন্ধুরা সব ছুটে গেছে দোলনার কাছে, ও বললো -মা চলো, বলেই আমার হাত ধরে টেনে স্কুল থেকে বেরিয়ে এলো, অন্য দিন ছুটির পর এটা কিনে দাও ওটা কিনে দাও এমনি ওর অনেক বায়না থাকে, আজ প্রথম বললো - বাসায় চলো, রিক্সায় উঠে বসলাম, অন্যদিনের মতই জানতে চাইলাম কি পড়লে আজ স্কুলে? -আজ স্কুলে একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে, ওর বলার ভঙ্গিতে সব সময় একটা নাটকীয়তা থাকে তাই স্বাভাবিক ভাবেই জানতে চাইলাম -কি ঘটেছে? -মিস আমাকে পানিশমেন্ট দিয়েছে -তুমি কি করেছ? -বলবো না।

আমি ওর মুখের দিকে তাকালাম, ওর চোখ দিয়ে নিরবে জলের ধারা বইছে। -কেন? -বললেতো তুমি বলবে কেন করেছো আমি নরম গলায় বললাম -মাকে বলবে না? -আমি আরাফকে মেরেছি, বলেই ও জোরে কেঁদে ফেললো, -ও না তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কেন ওকে মারলে? -হাত দিয়েতো মারিনি, -হাত দিয়ে মারনি মানে কি? -টিফিনের সময় খালা (আয়া) আমাদেরকে লোইন করে ওয়াসরুমে হ্যান্ডওয়াস করাতে নিয়ে গিয়েছিলো, সুমি মিসের প্লে ক্লাসে নতুন বেবিগুলো কি করছে দেখার জন্য আমি প্লে ক্লাসের দরজাটা একটু ফাঁক করে দেখে দরজাটা ছেড়ে দিলাম দরজাটাতো একটু নষ্ট টাইট তখন আরাফ হাতে ব্যাথা পেয়ে গেলো। আরাফ কখন আমার পিছনে এসেছে আমিতো দেখতে পাইনি। -এর জন্য এভাবে কাঁদতে হবে নাকি, স্কুলেতো এমন একটু হয়ই -মিস আমাকে প্লে রুমে খেলতে যেতে দেয়নি -আরাফ কি হাতে অনেক ব্যাথা পেয়েছে? -মনে হয়, আমি দেখিনি কিন্তু ও অনেক জোরে কেঁদেছে -ঠিক আছে কাঁদতে হবে না, এরপর থেকে সাবধানে থাকবে এমন যেন আর না হয় -না ঠিক নেই, মিস সবাইকে প্লে রুমে খেলতে নিয়ে গিয়ে আমাকে একা ক্লাস রুমে বসিয়ে রেখেছে, আমাকে এমন পানিশমেন্ট দিয়েছে। আমার অনেক কষ্ট লেগেছে, যদি কোনো ভয়ংকর শাকচুন্নি এসে আমাকে নিয়ে যেতো তুমি তোমার বাচ্চাকে কোথায় পেতে? বলে ও ডাক ছেড়ে কাঁদতে শুরু করলো।

আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম -শাকচুন্নিতো গল্প মা, রিয়েল ক্যারেক্টার না, ও কান্না থামিয়ে আমার দিকে তাকালো -মা আমার কান্না মুছে দাও। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে ওর চোখ মুছে দিলাম ও ওর হাতের বেলুনের হাঁসটার দিকে মনোযোগ দিলো -এটা কোথা থেকে কিনেছো? -দেখলে না তোমার স্কুলের সামনে বিক্রি করছে ওখান থেকে -পিংক কিনেছো কেন? ব্লু কিনতে পারতে? -কিনলাম -তুমি ভেবেছো তোমার জানের পিংক পছন্দ তাই? -হ্যাঁ -ওর কাছেতো পার্পেলও ছিলো -হ্যাঁ ওর সাথে এমনি কথা বলতে বলতে বাসায় পৌঁছে যাই। বাসায় পৌঁছে ও ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় চলে যায় ওর সদ্য কেনা টবের চায়না গোলাপের খোঁজ নিতে, আমি ওর জন্য খাবার রেডি করে ওকে ডাকি ও এসে ডাইনিং টেবিলে বসে বলে -আজ একটাও ফুল ফুটলো না কেন মা? -কাল ফুটবে, আমি ওর মুখে খাবার তুলে দিতেই ও মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললো -খাবো না, আমার ভালো লাগছে না -কেন ভালো লাগছে না? -আমাকে মিস সবার সাথে প্লে রুমে খেলতে যেতে দেয়নি, বলেই আবার ওর চোখ ছাপিয়ে কান্না -ইস আবার কেন? হয়েছে আর কাঁদতে হবে না, প্লে রুমে আজ যাওনি কালতো যাবে -না কাল আমি স্কুলেই যাবো না -কেন মা স্কুল কি দোষ করলো? -ফ্রেন্ডসরা আমাকে দুষ্ট ভাবলো না? দুষ্টদেরইতো পানিশমেন্ট হয় -আচ্ছা তুমি আরাফকে ইচ্ছে করে ব্যাথা দাও নি সেটা মিসকে বলনি? -না -বলনি কেন? বললেতো মিস বুঝতো তুমি দুষ্ট না -মিসতো আমার কাছে কিছু জানতে চায়নি। আমি একটু আবাক হই এবার! -মিস তোমার কাছে জানতে চায়নি তুমি কেন আরাফকে ব্যাথা দিয়েছো? -না -ওখানে কি মিস ছিলো? -না, মিস ক্লাসের ভেতরে ছিলো, আরাফ অনেক ব্যাথা পেয়ে জোরে কেঁদেছে না? এবার ওর কষ্টটা আমাকে স্পর্শ করলো, আমি বললাম -থাক কেঁদো না, ওকে কোলে নিয়ে হাঁটলাম কিছুক্ষণ, তারপর ওকে নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে আনলাম, ক্যালিফোর্নিয়া পেস্ট্রি শপে ওর প্রিয় পেষ্ট্রি খাওলাম। ভাবলাম সব ভুলেটুলে গেছে, একটু আগে ওকে ঘুম পাড়াতে নিয়ে গেলাম, চোখ বন্ধ করার আগে ও আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো -মা পানিশড্ হওয়া শেম কথা না বলো? -ওহ! তুমিতো আর ওকে ইচ্ছে করে ব্যাথা দাওনি, এবার ঘুমাও ঘুম থেকে উঠে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে -প্লিজ মরনিংয়ে আমাকে তুমি স্কুলে যেতে বলবে না প্লিজ -ওকে বলবো না, এবার ঘুমাও পাখি, একটু পরেই ও ঘুমিয়ে পড়লো, আমি উঠে এসে এই লেখা লিখছি আর ভাবছি, স্কুলের নামে আমি আমার দু্গ্ধপোষ্য শিশুটিকে একা একা তিনটি ঘন্টার জন্য কার কাছে রেখে আসি? তারা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়েই শাস্তি স্বরূপ অতটুকু একটি ‍শিশুকে ক্লাসরুমে নিঃসঙ্গ বসিয়ে রাখে, একবার ভাবে না, এই অন্যায় শাস্তি একটি শিশুর মনে কেমন বিরূপ প্রতিক্রিয়া করবে।

এই শাস্তিই কি অতটুকু একটা শিশুর জন্য যথাযথ, ওকে কি বুঝিয়ে বলা যেত না যে কাজটা ঠিক হয়নি। যাদের কাছে এই দীর্ঘ সময়ের জন্য রেখে আসি, যারা এতগুলো ছোট ছোট বাচ্চার দায়িত্ব পালন করে তারা কি শিশুর মনস্তত্ত্ব নিয়ে সামান্যতমও ভাবে? বা এই বিষয়ে নূন্যতম ধারণাও কি তারা রাখে? রাখা কি উচিত? আমি সিরিয়াসলি ভাবছি কাল থেকে ওকে আর স্কুলে পাঠাবো কিনা? আমার টনক নড়েছে, কষ্ট হচ্ছে আমার টনক নড়ানোর জন্য আমার কাছে অতটুকু সোনামনিকে কতখানি কান্না কাঁদতে হলো। যে শিশুটি স্কুলে যেতে এত ভালোবাসে সে আজ স্কুলে যেতে চাইছে না! আবার মাঝে মাঝে এও ভাবছি, আমার শিশুটিই কি ওভার রিয়েক্ট করছে, আমি কি আমার শিশুটিকে নিয়ে কোনো মনস্তত্ত্ববিদের শরণাপন্ন হবো। যারা শিশুর মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন তারা কি এই লেখাতেই আমার জন্য কোনো পরামর্শ নিয়ে এগিয়ে আসবেন? এখন আমি ভাবছি আর কষ্ট পাচ্ছি এই ভেবে, আমার অতটুকু বাচ্চা শাস্তি পাওয়ার পরেও স্কুলে কাঁদেনি, কষ্ট বুকে চেপে স্কুল ছুটি না হওয়া পর্যন্ত হেসেই গেছে! ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।