চীনের মসজিদ ১
বৃহষ্পতিবারে ভেন কে যখন জিজ্ঞেস করলাম তাদের এলাকায় মসজিদ আছে কি না, সে প্রথমে আমার প্রশ্নটাই বুঝতে পারল না। অনেক কায়দা কসরত করে তাঁকে বোঝাতে হল মুসলমানরা যেখানে প্রার্থনা করে সেটাকে বলে মসজিদ। সে বিজ্ঞের মত বলল ওহ আই নিউ ট্যট ইট ইস ইন মেক্কা। কোন বুদ্ধিমান মুসলমান এরপর তাকে আর কোন প্রশ্ন করা সমীচীন বোধ করতেন কি না সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। পশ্চিমা প্রচারণায় মুসলমান আর মাসলম্যান প্রায় সমার্থক হয়ে ওঠায় অনেক বুদ্ধিমান বাঙালি মুসলমানই বিদেশিদের সাথে ধর্মীয় আলোচনায় আগ্রহী হন না।
বুদ্ধিমান হিসাবে আমার পরিচিতি নেই। মা আর স্ত্রী তো আমার মত নির্বোধ কস্মিন কালেও দেখেননি। আজ কাল কণ্যাদেরও ধারনা হয়েছে প্রায় সে রকমই। সেই খ্যাতির (!) জোরেই ভেন কে আবার বুঝানোর চেষ্টা করলাম। আমার অধ্যাবসায়ে চমৎকৃত হয়ে ভেন বলল ওকে টেল দ্য স্পেলিং অব মস্ক।
আমার উত্তর শুনে ইন্টারনেটে ডুব দিল সে। কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে তাকাল বিশ্ব জয়ীর ভঙ্গীতে আই গট ইট, ইটস মুসলিম টেম্পল রাইট? মুসলমানদের কাছে মসজিদের পরিভাষা হিসেবে মন্দির কতটা গ্রহনযোগ্য সে বাহাসে না গিয়ে ধন্যবাদ দিলাম ভেনকে। সে আমাকে বলল উই সে কিনঝেন্সি ইন চাইনিজ। সে জন্যেই প্রথমে তোমার কথা বুঝতে পারিনি। হ্যা, একটি মসজিদ আছে মেইলিন রোডে।
- সেটা কত দূরে?
- ইটস ইন এনাদার সিটি। ৩৮ কিলো মিটারস ফ্রম হিয়ার। এবার আমার অবাক হবার পালা,আইয়ুবুরা তাহলে জুমার নামাজ পড়ে কোথায়?
আমার কথার বিন্দু বিসর্গ সে বুঝলো কিনা জানিনা। আমি বললাম আমি কি যেতে পারি সেখানে?
- ইউ ওয়ান্ট টু গো?
- ইয়েস, আই ডু।
- দেন, মে বি আই হ্যাভ টু গো উইথ ইউ
- তোমার যাবার দরকার নেই।
রাস্তা বলে দিও, আমি নিজেই চলে যাবো
- তুমি তো ভাষা জানো না। পথ হারিয়ে ফেলবে।
ভেনের কথা খুব একটা গুরুত্ব দিতে ইচ্ছে করল না। বললাম কি এমন হবে লোক জন কে জিজ্ঞেস করতে করতে ঠিকই ফিরে আসব। প্রথমে কোন উত্তর না দিয়ে মিটি মিট হাসতে লাগল সে।
পরে বলল আমাকে নিলে অসুবিধা কি? অসুবিধা তেমন ছিল না। আমাদের দেশে মসজিদে কখনও অমুসলিমদের যেতে দেখিনি। আর একটা চিন্তাও মনে ঊঁকি ঝুকি দিচ্ছিল। আমি যখন নামাজ পড়ব তখন সে কি করবে? তবে ভেনের জোরাজুরির কাছে হার মানতে হল। শর্ত দিলাম, সে আমার সাথে যেতে পারে তবে যাতায়াতের সম্পূর্ণ খরচ আমার।
ভেন কে বললাম ওখানে আমি নামাজ পড়বো বেলা বারোটার পরে কোন এক সময়। সুতরাং ১০টার পর রওনা দিলেই আমাদের চলবে। ভেন বলল জেনারেল ম্যানেজারের সাথে কথা বলে আমাকে বিকেলে জানিয়ে দেওয়া হবে। যাওয়া হবে কি হবে না ভাবতে ভাবতে ফিরে এলাম হোটেলে।
একটা কথা ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল।
বিভিন্ন দেশের বারো তেরো টা শহরে আমাকে কাজের জন্যে ঘোরা ফেরা করতে হয়েছে, কিন্তু লোংগাং ছাড়া আর কোন মসজিদ বিহিন শহরে থাকিনি। মুসলিম সঙ্খ্যাগরিষ্ঠ শহর বাদ দিলেও মিঊনিখ, নাইরোবি, মোম্বাসা, ব্যাঙ্কক, সিঙ্গাপুর, ফ্রিটাউন, লন্ডন সব জায়গাতেই মসজিদ আছে। আমি আগেই বলেছি আমি খুব ধর্মপ্রাণ নই। তবে বাঙালি মুসলমানের কিছু অভ্যাস আমার অস্থি মজ্জায় । শুক্র বারে পাজামা পাঞ্জাবি পরে মসজিদে যাওয়া তার একটি।
আমি দেশ থেকে পাজামা পাঞ্জাবিও নিয়ে এসেছি জুম্মার নামাজের কথা মনে করে। আর এখন মসজিদই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
বিকেলে ভেনের ফোন পেলাম। অফিসে কাজের তাড়া থাকায় সে যেতে পারবেনা। তবে তার পরিবর্তে আর এক জন যাবে তার নাম কেভিন।
তার কাছে আরও জানাগেল মেইলিন যেতে প্রায় ঘন্টায় খানেক সময় লাগবে। । কেভিনের সাথে আমার আগেই পরিচয় হয়েছিল ডাইজেষ্টার খোলা জোড়ার ক্লাশে। আমি বললাম ঠিক আছে আমরা যদি সাড়ে দশটায় রওনা দেই তাহলেই হবে। ভেন একটু পরে জানালো কেভিন সাড়ে আটটার সময় হোটেলে থকাবে।
সাড়ে আট্টার ব্যপারে আমার একটু আপত্তি ছিল। কারণ জুমার নামাজ বারোটার আগে শুরু হবার কোন সম্ভাবনাই নেই। বেশি আগে পৌছালে কভিন বিরক্ত হতে পারে। ভেন আমার কথা বুঝল বলে মনে হল না।
কেভিন
রুম থেকে বেরুতে ২ মিনিট দেরি হয়েছিল।
লবিতে নেমে দেখি কেভিন উৎকণ্ঠায় সময় কাটাচ্ছে। আমাকে দেখে যেন হাপ ছেড়ে বাঁচলো। কুশল বিনিময়ের পর তার উতকন্ঠার কারন কিছুটা বোঝা গেল। সে বলল - হোয়েন আই ওয়াজ এন্টারিং আই স টু উওমেন উইথ ভেরি স্মল ক্লথ কামিং ফ্রম ইনসাইড দ্য হোটেল।
- বললাম তোমাকে কি এ জন্যেই চিন্তিত দেখাচ্ছে?
- না।
ঠিক তা নয়, তবে ওদের বুঝতে পারছিলাম না আমি ঠিক জায়গায় এসেছি কি না।
- তুমি কাদের দেখেছো আমি জানি না। তবে এই হোটেলের ২ থেকে পাঁচ তলা পর্যন্ত নাইট ক্লাব। সেখানে তো অনেকেই আসতে পারে।
- ইয়েস।
মে -- বি
কেভিন কে আর কোন চিন্তার অবকাশ না দিয়ে বললাম চল এগোই। কেভিন বলল এখান থেকে প্রথমে আমাদের বাসে যেতে হবে মেট্রো স্টেশন প্রযন্ত।
- তার পর কি মেট্রোই?
- না, আমরা ওখানে গিয়ে বাস বদলাব।
বাস স্টপেজ আমাদের হোটেলের পাশেই। নাম পিং জিয়াও স্টপেজ।
পিংডির মেট্রো লাইন এ পর্যন্ত পৌছায় নি। কেভিনের সাথে বাস স্টপেজে পৌছলাম মোটামুটি কনফিউজড অবস্থায়। জানাগেল আমার এ যাত্রার গাইড কেভিনেরও এ মুখো যাত্রা এই প্রথম। তার সাথে আমার পার্থক্য হচ্ছে সে মানুষকে জিজ্ঞেস করতে পারছে। বাস স্টপে ম্যাপ দেখে বাসের নম্বর খুঁজে বের করতে পারছে আর আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝার চেষ্টা করছি সে সঠিক রাস্তায় আছে কি না।
বেশ কিছুক্ষণ পরে জানা গেল আমাদের ৩৭৯ নম্বর বাসে যেতে হবে তবে ৩৭৯ নম্বর বাস ছাড়ে পাশের স্টপেজ থেকে। পাশের স্টপেজটি মাত্র মিটার বিশেক দূরে। যেতে যেতে কেভিন বলল আমি তোমাদের মুক্তি যুদ্ধের কথা জানি। পাকিস্তান তো তোমাদের দেশ থেকে অনেক দূর ঠিক না? মনে হল আমার সাথে যাবার জন্যে কেভিন বাংলাদেশ সম্পর্কে লেখা পড়া করেছে। কেভিন বলল না কাল নয়।
আমি অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশ সম্পর্কে আগ্রহী, আমার আর একটা অগ্রহের বিষয় তুলনামূলক ধর্মতত্ব। আমাদের অফিস সেটা জানে বলেই তোমার সাথে আমাকে পাঠিয়েছে।
- এতটুকু বয়সে ধর্ম নিয়ে পড়াশুনা করতে ভাল লাগে! আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বলল তুমি মুসলমান কেন? তোমার বাবা কি মুসলিম ছিলেন?
কেভিনের সাথে আমার এই প্রথম আলাপ নয়। তাকে আমি চিনি বায়োডাইজেষ্টার খোলা জোড়া শেখার দিন থেকে। সেদিন তাকে দেখেছি এক জন নবীন টেকনিসিয়ান হিসাবে।
কথাবার্তা কাজকর্মে পুক্সিন টেকনোলজির বাইরের কোন বিষয়ে তার আগ্রহ আছে বলে মনে হয়নি। সেদিনের কেভিনের সাথে আজকের কেভিনের অমিল অনেক। বললাম বাবার কথা আসছে কেন?
-আমি তো বাবাকে তেমন ভাবে পাইনি তাই।
কেভিনের সাথে আলাপ করতে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। বাবার কথা তার খুব একটা মনে নেই।
বাবা যখন হারিয়ে যান কেভিনের বয়স তখনও দুই বছর হয়নি। কেভিনের মা ছিলেন এক কয়লা খনির শ্রমিক। বাবা নিখোঁজ হবার পর কায়ক্লেশে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলেন সংসারটা। কেভিনের বয়স যখন চার তখন তিনিও মারা যান খনি দুর্ঘটনায়। এরপরে কেভিনের ঠাঁই হয় দাদা-দাদির সংসারে।
কিছুদিন পর তাকে দত্তক নেয় এক অবস্থাপন্ন দম্পতি। সেখানেই কেভিনের বেড়ে ওঠা। ওই দম্পতির এক মাত্র মেয়েটিকেই সে বোন হিসাবে জানে। পালক বাবার ইচ্ছাতেই তার ইংরেজি সাহিত্য পড়া। কেভিনের ভাষায় পালক বাবার ইচ্ছায় কথাটা আংশিক সত্যি।
উনি ইংরেজির জানালাটি খুলে দিয়েছিলেন মাত্র। কেভিনকে বললাম তোমার পড়ার সাথে কাজের যোগসুত্র তো নেই বললেই চলে। কথাটা সে মেনে নিলেও মনে নিল বলে মনে হল না। বলল ইংরেজিতে আমার মেজর থাকলেও আমি ইকোনমিক্স আর মার্কেটিঙও পড়েছি। কেভিনের বাবার হারিয়ে যাবার বিষয়টি আমাকে কৌতুহলি করে তুলেছিল।
তবে কেভিন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে প্রসঙ্গটি পালটে দিল।
মিনিট দশেক অপেক্ষার পর বাস পাওয়া গেল। বাসে বসার জায়গা খালি নেই। দাড়ানোর জায়গা পাওয়াই মুসকিল। কেভিন বলল আমাদের কে যেতে হবে শেনহুই রোড হয়ে, সুয়াংলং মেট্রোস্টেশনের নিচ থেকে ছড়বে আমাদের বাস।
১২ মিনিটে পৌছলাম শেনহুই রোড। দূরত্ব খুব বেশি নয়, মাঝে ৫টি স্টপে থামার জন্যে সময় বেশি লাগে। শেনহুই রোডের কাছে লোঙ্গাং লাইনের শেষ স্টেশন সুয়ালং। শেঞ্ঝেন মেট্রোর পাঁচটি লাইনের অন্যতম এই লাইনটি ২০০৫ সালে চালু করা হলেও। ২০১০এর ইউনিভারসিয়াডের সময় ব্যপক উন্নতি হয় এই লাইনের।
৩২ কিমি থেকে বাড়িয়ে লাইনের দৈরঘ ৪২.৫ করা হয়। প্রতিদিন ৩০টি স্টেশনের লক্ষাধিক যাত্রী যাতায়াত করে এই লাইনে। গল্প করতে করতে বাস এসে গেল। মেইলিনের বাস মোটামুটি ফাকা পাওয়া গেল। কেভিন বলল আর একটু সকালে ভীড় বেশি থাকে।
অনেকেই মেইলিন থেকে অফিস করে লোঙ্গাঙ্গে। গাছ পালায় ছাওয়া ছোট্ট শহর মেইলিন। আমরা যখন পৌছলাম সূর্য তখনও পুরোপুরি মাথার ওপর ওঠেনি। কেভিন কে বললাম এই জন্যেই আমি আরও পরে রওনা দিতে চেয়েছিলাম। নামাজের এখনও বেশ দেরি।
কেভিনের সরল উত্তর আমরা কেবল মেইলিনে এসেছি। এখনও তোমার মসজিদে পৌছাই নি। মোবাইলের গিপিএস থেকে মসজিদের লোকেশন খুঁজে বের করল কেভিন। বেশি দূর হাটতে হল না। বাস স্টপের কাছেই মসজিদ।
তবে ইন্টারনেটে মসজিদের যে ছবি দেখেছিলাম, এক মাত্র রাস্তার পাশের তোরণ ছাড়া আর কোন কিছুর সাথে তার মিল নেই। বিশাল একটা বারান্দাওলা ঘর। বাইরে একচালা টিনের ছাউনির মত। পূর্ব দিকে ঘরের চাল ঘেষে দাঁড়িয়ে দুটি মিনার। (অসমাপ্ত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।