আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেইলী রোড থেকে সেগুনবাগিচা :মঞ্চ নাটকের নুতন দিগন্ত

প্রত্যাশা করি কুসঙ্গের চেয়ে সৎ সঙ্গ এক সময়ের নাটকপাড়া খ্যাত বেইলীরোড এখন ফাস্টফুড পাড়া হিসেবেই বিবর্তণ ঘটেছে। মহিলা সমিতি আর গাইড হাউস মিলনায়তনে যারা একসময় নাটক দেখতে যেতেন একটু ফুরসত পেলেই ,তারা এখন এর কোনো হদিসই পাবেন না এই দুটি মিলনায়তনের। মহিলা সমিতি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে ইতিমধ্যেই,আর গাইড হাউস সংস্কারের অযুহাতে বেশ কয়েক বছর ধরেই বন্ধ। এখন আর নেই কোন প্রাণচাঞ্চল্যেভরা নাট্যকর্মীদের আনাগোনা। নেই কোন একজন তারা মিয়া কিংবা সাবেরের চায়ের দোকানের সামনে জড়ো হওয়া নাট্যকর্মীদের জম্পেশ আড্ডা দেয়ার ভীড়।

নেই কোন তাদের নানা চুলচেরা বিশ্লেষনের বাক্যুদ্ধ। আছে এখন ভোজন রোসিকদের রসনা তৃপ্তকরার দীপ্ত অঙ্গীকার। আছে সারিবদ্ধ জৌলুসেভরা ইমারতা। আছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত দোকানগুলোর আলোর ঝল্কানি। এতো আছের ভীড়ে শুধু আলোর স্বপ্ন দেখানো মানুষগুলোই চুপিসারে বিদায় নিয়েছে মধ্য প্রান্তর থেকে।

কিন্তু স্বপ্ন দেখানো ব্রতী হওয়া মানুষগুলো কী থেমে থাকতে পারে!এক প্রান্তর থেকে অন্য প্রান্তরে যাদের নিরন্তর ছুটে চলা তারা থেমে থাকতে পারেনি। লক্ষে অবিচল বিশ্বাসে অটল আলোকিত মানুষগুলো ঠিকই আলো দেখানোর নুতন গন্তব্যে পৌঁছেছে। এবার তারা শিল্পকলার মূলভুখন্ডে সীমান্তে গেড়েছে। যা তাঁদের দীর্ঘ দিনের লালীত স্বপ্ন ছিল। সরকার আসে সরকার যায়।

আশ্বাস আসে বিশ্বাস জাগায়,এবার আধুনিক মঞ্চ হবেই। কিন্তু আশ্বাসের দোলাচালে ক্রমাগত স্বপ্নগুলো ভেসে বেড়ায়। বিশ্বাসের গায়ে আঁচড় লাগে। স্বপ্নসারথিরা পরস্পরের মুখামুখি হয় ,প্রশ্ন করে স্বপ্ন পুরণ হবে তো! শংকা নিয়ে প্রহর কাটে। আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ,যেটির জন্য এতকাল পথচলা।

বেইলী রোড থেকে সেগুনবাগিচা। পরিবর্তণ হয় ঠিকানার। বেইলী রোডের ভাঙ্গাচোরা মঞ্চের হাজার রজনীর স্মৃতি আঁকড়ে নিয়ে ছুটে আসে নুতন গন্তব্যে। রাষ্ট্রযন্ত্রের শিল্পকলার পীঠ্যস্থান ‘শিল্পকলা একাডেমী’ই হয় তাদের নব্য জয়যাত্রা। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে ,এবার হলতো- অন্তত একটি আধুনিক নাট্যমঞ্চ।

ফিরে দেখা স্বাধীনতাত্তোরকাল থেকে মঞ্চ নাটকের গোড়াপত্তন হলেও মুলত সত্তর দশক থেকে দর্শনীর বিনিময়ে নাট্যচর্চা শুরু হয়। সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশে সাংস্কৃতির অঙ্গনে বিরাজিত বিভিন্ন সংকট দূর করা এবং গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে তাঁদের সদা বলিষ্ঠ উচ্চারণ সর্বজণপ্রশংসিত হয় সেই সময় থেকেই। বাংলাদেশ মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তাতে রাষ্ট্র বা কোন সরকারের ভূমিকা নেই। সব কিছু সম্ভব হয়েছে নাট্যজনদের কঠোর পরিশ্রম ও গভীর আতœপ্রত্যয়ের ফলে। মানুষের ভেতর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা ছিল অসামান্য,অদ্বিতীয় ।

একইভাবে নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তাঁদের জোড়ালো ভূমিকাও কারো অজানা নয়। অথচ বরাবরই এই মাধ্যমটি উপেক্ষিত থেকেছে রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে। তবুও যুদ্ধ করেছে আপন গতিতে এই উচুমানের শিল্পের বিকাশ ঘটাবে বলে। বেইলীরোডের জরাজীর্ণ মঞ্চে যেমন ওঠে এসেছে শোষণ বঞ্চনার কথা। বলতে চেয়েছে সমাজের নানা অনিয়মের এপিট-ওপিট।

তেমনি নির্মল আনন্দ দিয়ে জীবনকে অর্থবহ করে তোলারও ছিল এক অপূরূপ প্রচেষ্টা। এত কিছুর পরও কারও যেন মাথা ব্যাথাই ছিল না এর বেহাল দশা থেকে টেনে তোলার। বছরের পর বছর সভা সেমিনার র‌্যালী-কথা একটাই আমাদের একটা আধুনিক মঞ্চ দাও । আমরা আমাদের এই শিল্পকে আর্ন্তজাতিক আঙ্গিনায় নিয়ে যাবো। অবশেষে দিন বদলের হাওয়া লেগেছে এর গাঁয়।

রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকাতায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রথম একটা আধুনিক মঞ্চ নির্মাণ করে স্বপ্ন সারথিদের মুখে এক টুকরো হাসি এনে দিয়েছে। কিন্তু আকাশের কালো মেঘ যেন কাটতেই চায় না। আধুনিক মঞ্চতো হলো, এবার আগের মতো দর্শক পাবোতো! নাট্যজনদের সন্দিহান জিজ্ঞেসা। এই সংসয়ের যুক্তি ছিল এই বলে, গত প্রায় চার যুগ ধরে নাট্যচর্চা হয়েছে বেইলী রোড কেন্দ্রীক। ভাঙ্গাচোরা মিলনায়তনে বসেই বছরের পর বছর নাটক উপভোগ করেছে।

এমন অনেক দর্শক আছে যারা মিলনায়তনের চত্বরে প্রতিদিন এসেছে শুধু নাটক দেখতেই নয় ,শিল্পের আঙ্গিনায় মেলবন্ধন ঘটাতেও। সেসব আগুন্তকের প্রাঞ্জল উপস্থিতির কারণে নাটকপাড়া সবসময় সরব থাকতো। আবার এখান থেকে রাজধানীর যেকোন স্থানে যাতায়েতও খুব বেশী বেগ পেতে হয়নি। তাই বেইলী রোডস্থ কোথাও যদি আধুনিক মঞ্চটা হতো তাহলে খুব ভালো হতো বলে কেউ কেউ অকাট্য যুক্তি দাড় করাতো। আবার কেউ কেউ বলতো শিল্পের যেমন কোন সীমা রেখা নেই তেমনি এর কোন নির্দিষ্ট গন্ডিও নেই।

শিল্পের চাষ যেখানেই হবে সেখানেই ফলন হবে। এমন ভাবনা থেকেই বেইলীরোডের যুগ অবসান ঘটিয়ে সেগুনবাগিচার শিল্পকলার যুগের শুরু। তবে আশার কথা এই যে শিল্পকলা জমে ওঠছে। নাট্যজনদের আশংকার কালোমেঘও কাটতে শুরু করেছে। দর্শক আসছে।

বাড়ছে শিল্পমুখী আড্ডা। যেমনটি ছিল বেইলী রোডকে ঘিরে। এখানে জীর্ণকায় তারা মিয়া কিংবা সাবেরের চায়ের স্টল নেই,আছে ঝকঝকে সাজানো গোছানো ‘কফি হাউস’। এই কফি হাউসের জনপ্রিয়তা তারা মিয়া কিংবা সাবেরদেরকে ডিঙ্গিয়েছে কিনা তার হিসেব পাওয়া না গেলেও ইতিমধ্যে কফি হাউসের পরিচিতি ব্যাপকতা লাভ করেছে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।