ছোট বেলা থেকেই পশু পাখির প্রতি আমার অনেক আগ্রহ ছিল। তো ক্লাশ সেভেনে উঠার পর মাথায় ভূত চাপলো খরগোশ পুষবো। নানি বাড়ি যাওয়ার পথে প্রায়ই রাস্তার ধারে খরগোশ চোখে পড়ত। আর ওগুলি দেখে আমারও খরগোশ পোষার শখ জাগলো। কিন্তু আমার খরগোশ পোষার পথে একমাত্র বাঁধা হয়ে দাঁড়ালো আমার আম্মু।
আম্মু পশু পাখি একদম সহ্য করতে পাড়ত না।
কিন্তু বয়সটাই তখন ভয় জয় করার। আম্মুকে উপেক্ষা করে একদিন বিকালে আমি দুটো খরগোশ নিয়ে হাজির। আম্মুর মার খেলেও খরগোশ কেনার উত্তেজনার কাছে সেটা কিছুই না। খরগোশ দুটোর একটা একদম ধবধবে সাদা আর লাল টকটকে চোখ।
অন্য খরগোশটা তার তুলনায় একদম সাধারন, খয়েরী আর সাদার মিশ্রণ।
সারাদিন খরগোশ নিয়ে পড়ে থাকি, খাওয়া দাওয়া পড়ালেখা বাদ দিয়ে। সুগার মিল কলোনি তে থাকতাম বলে খবরটা ছড়িয়ে পরতে বেশী সময় লাগে নি। পিচ্চি পোলাপাইনের ভীড় সারাদিন লেগেই থাকতো।
এরকম একদিন এক পিচ্চি আসছে খরগোশ দেখতে।
আমি খয়েরী খরগোশটা খাঁচা থেকে বের করে বাগানে রেখে আসতে যাচ্ছিলাম। আর এরই মধ্যে পিচ্চিটা সাদা খরগোশটা বের করতে লেগে কাঠের ঢাকনা খরগোশটার উপরে ফেলে দিল। আমি এসে দেখি খরগোশটা শরীর মোচড়াচ্ছে আর কেমন জানি শব্দ করছে। খুবই অসহায়ের মত খরগোশটার মৃত্যু দেখলাম। আমি যে দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম খরগোশটার দিকে, ঠিক একই দৃষ্টিতে খরগোশটার সঙ্গীও তাকিয়ে ছিল।
দুটো খরগোশের কষ্টই যেন আমি অনুভব করছিলাম।
সঙ্গী হারানোর পর খরগোশটা কেমন জানি উদাস হয়ে গেল। খরগোশটাকে আর কখনও খাঁচায় রাখিনি। আমার রুমেই থাকতো। খরগোশটার অবস্থা দেখে আম্মুও আর কিছু বলেনি।
একা একা থাকতো বলে এক সময় খরগোশটার নাম হয়ে গেল ‘ইক্কু’ । আমার খরগোশ ‘ইক্কু’।
ইক্কু ধীরে ধীরে আমাদের ডাকে সারা দিতে লাগলো । এক সময় সে আমাদের পরিবারের অংশ হয়ে পড়ল। ইক্কু বলে ডাক দেওয়া মাত্র যেখানেই থাক ছোট ছোট লাফ দিয়ে সেখানে হাজির হয়ে যেত।
খরগোশের সৌন্দ্যর্য যে খরগোশ পোষেনি সে কখনই পুরোপুরি জানতে পারবে না। গরমের দুপুরে ইক্কু যখন খাটের পাশে চার পা ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে থাকতো, তখনকার সৌন্দর্য আসলেই বর্ণনা করার মত নয়। তারপর ছিল তার লাফিয়ে লাফিয়ে চলা। আসলেই মুগ্ধ হওয়ার মত। আর স্টোর রুমে ঢুকে তরকারি চুরি করা, আর ধরা পড়ে অপরাধীর মত মুখ।
আসলেই দেখার মত। আমি তো আগে থেকেই ছিলাম, বাসার সবাইও তখন ইক্কুতে মুগ্ধ হয়ে ছিল। সবাই খোঁজখবর রাখতো ইক্কুর। খাওয়ার সময় ইক্কু টেবিলের চার পাশেই ঘুর ঘুর করত। আমরাও খেতে খেতে খাবার নিচে ফেলতাম ইক্কুর জন্য।
সবচেয়ে অবাক করা বিষয় ছিল, যে সবচেয়ে বেশী ইক্কুকে অপছন্দ করত তার সাথেই ইক্কুর ভাব ছিল সবচেয়ে বেশী।
আম্মু আর ইক্কুকে বেশীর ভাগ সময়ই একসাথে দেখা যেত। আম্মু তরকারি কাঁটার সময় ইক্কু পাশে বসে থাকতো আর উপরি হিসেবে প্রায় প্রায়ই কিছুনা কিছু পেত। আমি না থাকলে আম্মুর পেছন পেছন ঘুরে বেড়াতো সারাদিন। কিছু সময় আম্মুর চোখের আড়াল হলেই আম্মু ইক্কু ইক্কু করে ডাক দিয়ে ডেকে আনত কাছে।
আপু আর ছোট ভাইয়ের ও প্রিয় ছিল ইক্কু। বলতে গেলে আমাদের পুরো পরিবারই অন্যরকম এক ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল।
ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষার সময় আব্বু বলল, পরীক্ষার সময়টা ইক্কুকে যেখান থেকে এনেছ সেখানে রেখে আস। পরীক্ষার পরে আবার নিয়ে এসো। আমিও কি মনে করে জানি রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।
আব্বু যখন ইক্কুকে রেখে আসার জন্য খাঁচায় ঢুকালো, ইক্কুর অবাক হওয়াটা আজও চোখে ভাসে। ওকে নিয়ে যাওয়ার সময় ওর চোখের আকুতি আমি আজও ভুলতে পারি নি।
হ্যাঁ, পরীক্ষা শেষ হলে ওকে আনতে গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু ও আর আসেনি । হয়তো আমার উপর অভিমান করেই।
ওর নিঃস্বার্থ ভালবাসার প্রতিদান যে দিতে পারিনি। পাঠিয়ে দিয়েছিলাম সম্পূর্ণ অচেনা এক জায়গায়।
ওকে রেখে আসার পরের দিনই ফুড পয়জনিং হয়ে মারা যায় ‘ইক্কু’। ওর খালি খাঁচাটা আমার চোখে পড়েছিল । কেমন জানি উপহাস করছিল আমাকে ।
আমি আর বেশীক্ষণ থাকতে পারিনি ওখানে। অপরাধীর মত পালিয়ে এসেছিলাম।
আজ সাত বছরের উপরে হল ও নেই। তবুও মাঝে মাঝে ভুল করে ইক্কু বলে ডাকি। মনে হয় এখনি হয়তো টেবিলের নিচ থেকে মাথা বের করে তাকিয়ে থাকবে আমার দিকে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে যায় বুক থেকে অজান্তেই।
এমনি কোন এক দিনে ও চলে গিয়েছিল।
-Zawad Amin- ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।