আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অপ্রত্যাশিত প্রত্যাশা

রাত তখন প্রায় দুটো। শহরের রাস্তা দিয়ে দুএকটা ব্যস্ত গাড়ি চলছে। রাস্তার কুকুরগুলো মাঝে মাঝে ডাক দিয়ে উঠছে। ঘুমন্ত শহরে সে শব্দ বিকট শোনা যায়। একলা ‘প্রশান্তি’ বাড়ির ছেলেটি পড়াশুনায় মগ্ন।

আশিক বুয়েটের ছাত্র। দিনে লোডশেডিং তাছাড়াও ব্যস্ত শহরের কলকাকলিতে পড়ায় মন বসে না। তাই রাত জেগেই সে পড়ে। আশিকদের বাড়ি থেকে সোজা সামনে একটা বাড়ি আছে। বিদেশী স্টাইলের খুব সুন্দর বাড়ি।

দেখে কাররই পলক পড়বে না। বাড়ির নামটাও ইংরেজি ‘‘Fabricated house’’. বাড়ির চতুর্দিক কাচ দিয়ে ঘেরা। উঁচু প্রাচীর। ৩-৪ জন গার্ড। বলতে গেলে একেবারেই নিরাপদ।

মাঝে মাঝে আশিক এই জানালার কাছে আসে ঐ বাড়িটা দেখার জন্য। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে বাড়িটা দেখে। লাল, সবুজ, নীল বাতিতে রাত্রিবেলা বাড়িটার সৌন্দর্য আরসব বাড়ি থেকে আলাদা হয়ে যায়। পড়তে পড়তে হঠাৎ আশিকের চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। যে বাড়িতে এত নিরাপত্তা সেই বাড়িতেই দুজন আলখাল্লা পড়া লোক দেখা যাচ্ছে ! একজন খাটো একজন বেশ লম্বা।

তারা প্রাচীর টপকে ভিতরে ঢুকেছে। আশিক পড়া থামিয়ে জানালা ঘেষে দাড়াল। পর্দাটা একটু তুলে দিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে দিল। লোকদুটি কিছুক্ষণ দাড়িয়ে কিযেন সব বলছে। হাতে থাকা ব্যাগ থেকে কিসব বের করে জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ল ঘরে।

আশিকরাই শুধু এ জানালা দেখতে পায়। আর কিছু দেখা গেলনা। এই সময় আশিকের মনে হচ্ছে একটা Telescop থাকলে ভাল হত। সকালের সিগ্ধ আলোটা এসে পড়ল আশিকের চোখে। ধড়ফড় করে উঠতে গিয়ে দেখল তার মাথাটা গ্রিলে ঠেকানো।

‘আশিক, আশিক !’ আশিকের মা মায়া চৌধুরী দরজায় দাড়িয়ে ছেলেকে ডাকছেন। মায়ের গলার এমন আওয়াজ সে কখনও শোনেনি। তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিল। ‘শুনেছিস খবর ?’ বিশ্বয় ভরা চোখ নিয়ে মা ঘরে ঢুকলেন। হাইতুলতে তুলতে সে দরজা দিয়ে একবার উঁকি দিয়ে দেখল বাবা সামাদ চৌধুরী বেশ চিহ্নিত।

মা তখনও হাঁপাচ্ছেন আর ঘামছেন। আশিকও হতভম্ভ হয়ে গেল। ‘কি? ব্যাপার কি মা?’ ‘আর কি ব্যাপার হবে বল। কাল রাতে....’ এতটুকু বলেই মা থেমে গেলেন। কোন কথা বেড় হচ্ছেনা তার।

নিজেকে সামলে নিয়ে আবার তিনি শুরু করলেনÑ ‘কাল রাতে, সামনের বাড়িটা আছেনাÑ তার মালিক রফিক সাহেব খুন হয়েছেন। ’ ‘খুন!’ আরেকটু কাছে এসে বসল আশিক। ‘হ্যারে খুন। সকালে আমাদের কাজের মেয়েটা পানি আনতে গিয়েছিল ওই শুনে এসেছে। পরে তো আমরাও গিয়ে দেখি লোকে ভরে গেছে বাড়ি।

উহ্ কি বিভৎসভাবে কেটেছে রে আশিক। দেখলেই রক্ত হীন হয়ে যায়। ’ কথাগুলো শুনে সে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে সত্যিই অনেক লোক। পুলিশ, সাংবাদিক এরাও উপস্থিত। ধীরে ধীরে আশিকের মনে হতে লাগল রাতের ঘটনা।

ঐ আলখাল্লা পড়া লোকদুটো। আশিক কিছুক্ষণ স্থির হয়ে তাকিয়ে থেকে মাকে বললÑ ‘আমি দেকেছি মা। ’ ‘কি দেখেছিস?’ ‘দুটো লোককে ঐ বাড়িতে ঢুকতে দেখেছি। তারপর....’ ‘কি বলছিস তুই?’ ‘রাত্রিবেলা যখন আমি পড়ছিলাম। তখন দেখেছি।

তারপর আর কিছু মনে নেই। ’ মিসেস চৌধুরী আশিকের মুখ চেপে ধরলেন। ফিসফিসিয়ে বললেনÑ ‘খবরদার আশিক। খুনের মামলা। কেউ যেন জানতেও না পারে কথাটি।

পুলিশ, টুলিশের ব্যাপার। আমরা কিছু জানিওনা, দেখিওনি। ’ ‘কিন্তু মা আমি তো দেখেছি। ’ ‘কেউ কি সেটা জানে? নিজেকে ঢোল পিটিয়ে বেড়ানোর দরকার কি? আমরা কারও শত্র হতে চাইনা। ’ আশিক ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।

নাস্তার টেবিলে সবাই নাস্তা করছে। হঠাৎ কাজের মেয়েটা হন্ত দন্ত হয়ে এল। ‘খালাম্মা একখান গাট নাইকা। কোনহানে গেছে কেউ কইবার পারে না। বাড়িতেই ব্যাটা নাই।

’ ‘সে কিরে গার্ড নেই। তাহলে বুঝেছি সেই খুন করে পালিয়েছে। আজকালকার কাছের লোকেরা না। ’ কথাটা বলেই মিসেস চৌধুরী কাজের মেয়ে ফুলির দিকে তাকালেন। ফুলি মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইল।

মি. চৌধুরী একবার মুখ তুললেন কিন্তু কিছু বললেন না। রফিক সাহেবের বাড়ি লোকে লোকারণ্য। লাশটা পুলিশি হেফাজতে রাখা হয়েছে। রফিক সাহেবের তিন ছেলে। বড় ছেলে রাজীব হাসান বিবাহিত একটা ছোট চেলে আছে।

বউসহ তিনি বাবার বাড়িতেই থাকেন। মেজো রাকিব হাসানও বিাহিত। তিনি বউসহ রংপুরে থাকেন। দুজনেই চাকুরীজীবি। আর সব ছোট ছেলে রাহাত হাসান লন্ডনে থাকে।

সে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। আজ ৬Ñ৭ বছর হল সে ওখানে। একবারের জন্যও দেশে আসেনি। আর রয়েছেন রফিক সাহেবের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। স্বামী বিয়োগে কারও সাথে কথা বলছেন না।

চোখ দিয়ে শুধু পানি ফেলছেন। রাজীব সাহেবের স্ত্রী সারা আর ছেলে সায়মন মিসেস রফিকের পাশে বসে আছেন। রাজীব সাহেব পুলিশের সাথে কথা বলছেন। ‘মা আপনি সকাল থেকে নাখাওয়া। কিছু এনে দিই?’ বড় বউয়ের কথাতে না সূচক মাথা নাড়েন মিসেস রফিক।

ধীরে ধীরে বাড়ি ফাঁকা হয়ে গেল। রাজীব সাহেব মায়ের ঘরে এলেন। ‘ওদের দু’ভাইকে খবর দিয়েছিস?’ ‘হ্যাঁ দিয়েছি। ’ বলেই রাজীব সাহেব কাঁদতে লাগলেন। মায়ের আওয়াজও জোড়ে হয়ে গেল।

ছোট্ট সায়মন কিছু না বুঝেই দাদীর গলা জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। বাইরে গাড়ির শব্দে রাজীব সাহেব ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন। একটা পুলিশ জীপ এসে দাড়িয়েছে বাড়ির সামনে। ‘আমি এ এলাকার নতুন ইন্সপেক্টর। সুহাস চৌধুরী।

পুলিশ হাতটা বাড়িয়ে দিলেন রাজীব সাহেবের দিকে। ‘আমি রাজীব হাসান। রফিক হাসানের বড় ছেলে। ’ ‘রফিক সাহেব আর আমার বাবা একই সাথে পড়াশুনা করেছেন। পরশু এখানে জয়েন করেছি।

বাবার বন্ধুর এলাকা শুনে তার সাথে দেখা করার ইচ্ছা ছিল। বাবার মুখে আপনার বাবার অনেক গল্প শুনেছি। কিন্তু তার আগেই....’ ‘আসুন, ভেতরে আসুন। ’ ভেতরে ঢুকতেই আরেকটা গাড়ির শব্দ। রাকিব হাসান এসেছেন।

সাথে স্ত্রী প্রবা। ভাইকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন তিনি। তাকে স্বান্তনা দিয়ে ঘরে নিয়ে গেলেন। ‘বসুন আপনি। ’ সোফায় সুহাস চৌধুরীকে বসিয়ে দিয়ে তাদেরকে ঘরে নিয়ে গেলেন।

ইন্সপেক্টর সোফা ছেড়ে উঠে হাতে গ্লোবস পড়ে এটা ওটা নেড়ে দেখছেন। এতক্ষণে কাজের লোক চা নিয়ে এসছে। টেবিলে নাস্তা রেখে বেশ কিছুক্ষণ ইন্সপেক্টরকে দেখলেন তিনি। ইতস্তত করলেন ইন্সপেক্টর, রাজীব সাহেব ঘরে ঢুকলেন। ‘নিন খান।

করিম চাচা তুমি মেজোকে একটু পাঠিয়ে দিও। ’ কাজের লোকটি চলে গেল। সুহাসও এসে বসলেন সোফায়। গ্লোবস খুলে চা হাতে নিলেন। ‘সে কি, আগেই চা খাচ্ছেন?’ ‘আসলে নাস্তা করতে ভাল লাগছেনা।

’ কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন দুজনে। সুহাস চৌধুরীর চায়ে চুমুক দেওয়ার আওয়াজ শুধু শোনা যাচ্ছে। ‘আপনার ছোট ভাই কখন আসবেন। ’ ‘এইতো সন্ধ্যাবেলা। ’ ‘লন্ডন থেকে এত দ্রুত !’ ‘আসলে ঐ রাত্রেই ওকে ফোন করেছি।

’ ‘তো ওনি রাত্রিতেই রওয়ানা দিলেন?’ ‘এক্সাক্টলি। ’ ‘আচ্ছা তবে উঠি। ও হ্যাঁ সন্ধ্যাবেলায় একবার আসতে পারি। আরেকটা কথা, ঐ কাজের লোকটা.....। ’ ‘কোন কাজের লোক?’ ‘কিযেন বললেন? ও মনে পড়েছে করিম চাচা।

’ ‘করিম চাচা ! উনি আমাদের জন্মেরও আগে থেকেই এখানে থাকেন। ’ খুবই বিশ্বস্ত। ’ ‘ভাল। এই বিশ্বাসটাই তো মানুষকে ধ্বংস করে। ’ ‘মানে?’ ‘কিছু না চলি।

’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন রাজীব সাহেব। সেদিকে একপলক দেখে মুচকি হেসে দিলেন ইন্সপেক্টর। চোখে সানগ্লাস পড়ে জীপ নিয়ে বেড়িয়ে গেলেন। * ‘মা তুমি বুঝতে পারছনা। ওনাকে এই ইনফমেশনটা দেওয়া খুবই জরুরী।

‘কিসের জরুরী?’ ছেলেকে ধমক দিয়ে উঠলেন মিসেস চৌধুরী। তিনি কিছুতেই চাচ্ছেন না ছেলে ওদের বাড়ির খুনের মামলার সাথে জড়িয়ে যাক। কিন্তু আশিকও নাছোড় বান্দার মত বারবার বোঝাতে চেষ্টা করছে। তা তিনি কানেই তুলছেন না। ‘মা, আমি বড় হয়েছি।

ভালমন্দ অন্ততপক্ষে বুঝতে পারি। আজ ওনাদের বিপদ মা। ’ আশিক তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগল। কান্না জড়ানো চোখে মিসেস চৌধুরী মুখ তুললেন। ‘বিপদ জন্যই তো বলছি বাবা।

আমি তোকে হারাতে চাইনা। এতকষ্টে তোকে পৃথিবীতে এনেছি খুইয়ে ফেলার জন্য নয়। ’ ‘মা .........। ’ কথাটা বলে আশিকেরও চোখ ছলছল করে উঠল। মাকে আরও জড়িয়ে ধরল।

মাও আশিককে কাছে টেনে হু হু করে কাঁদতে লাগলেন। ‘আজকের পত্রিকাটা পড়েছো?’ মি. চৌধুরী হাতে একটা খবরের কাগজ নিয়ে আসলেন। হাত বাড়িয়ে কাগজটা নিল আশিক। মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন। একদম প্রথম পাতাতেই।

জোড়ে জোড়ে পড়ল আশিক। ‘থানা থেকে কনস্টেবল উধাও !’ মানে কি বাবা? ‘মানে আর কি হবে। নতুন অফিসারটা আসার পর থেকে একের পর এক ঘটনা ঘটছে। ’ ‘নতুন অফিসার মানে মি. সুহাস চৌধুরী?’ ‘নামটাম জানি না। শান্তিটুকু বুঝি উঠেই যায় এলাকা থেকে।

রফিক সাহেব খুন হলেন, একজন গার্ড পাওয়া যাচ্ছে না। থানা থেকে কনস্টেবল উধাও। শুনেছি উধাও হওয়ার দিন সে ইন্সপেক্টরের সাথেই ছিল। ’ আশিক মার দিকে তাকালো। ছলোছলো চোখে মাও আশিকের দিকে তাকিয়ে আছেন।

‘আসুন ইন্সপেক্টর, বসুন। ’ রাজীব সাহেব সুহাস চৌধুরীকে বসতে দিলেন। রাকিব সাহেব পাশে দাড়িয়ে। ‘আপনি দাড়িয়ে কেন? বসুননা রাকিব সাহেব। ’ ‘না, ঠিক আছি।

’ রাকিব সাহেবের উদ্দেশ্যে একটু হেসে দিলেন ইন্সপেক্টর। মি. রাকিবও মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে ঘর থেকে দ্রুত সরে গেলেন। ‘আপনার ছোট ভাই কোথায়? আসেননি?’ ইন্সপেক্টর কথাতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়েন রাজীব সাহেব। ‘কই ডাকুন। ও হ্যাঁ আমি বলছিলাম কি যদি আপনাদের বাড়ির সকলে আসে তো....’ রাজীব সাহেব ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন।

সায়মন হঠাৎ ঘরে ঢুকে এক কোণে দাড়িয়ে রইল। ইন্সপেক্টর মুচকি হেসে ইশারা করলেন কাছে আসার জন্য। মাথা নাড়ল সায়মন। কিছুক্ষণ পর একপা দুপা করে নিজেই ইন্সপেক্টরের কাছে আসল। ‘নাম কি?’ ‘সায়মন।

’ ‘কোন ক্লাসে পড়?’ ‘ক্লাসে তো পড়ি না। দাদু বলত আমি ‘যাদুতে’ পড়ি। ’ ‘যাদু ! সেটা আবার কি?’ ‘আমিতো জানিনা দাদু জানত। ’ ‘তোমার দাদুকে তুমি খুব ভালবাস না?’ কিছু বলে না সায়মন। নীরব দৃষ্টিতে শুধু দেওয়ালে টাঙ্গানো দাদুর ছবিটা দেখে।

ইন্সপেক্টরও সেদিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। ‘কি হলো, বললে নাতো তোমার দাদুকে তুমি ভালবাস কিনা?’ ‘বাসি। দাদুও আমাকে বাসত। ’ ‘তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে? দাদুকে মিস করছ, না?’ ‘দাদুও আমাকে মিস করছে। জান চাচ্চু দাদু সেদিন ছোট চাচ্চুকে খুব দেখতে চেয়েছিল।

’ ‘তারপর, তিনি এলন?’ ‘নাহ্, কি করে আসবে চাচ্চুতো আকাশে। ’ ‘আকাশে !’ আঁতকে ওঠেন ইন্সপেক্টর। ‘হ্যাঁ চাচ্চু একটা গাড়িতে করে আকাশে গিয়েছিল আবার সেই গাড়িতে করে চলে এসেছে। ‘তাই বুঝি। ’ একে একে বাড়ির সকলে ড্রইং রুমে ঢুকে পড়েন।

সায়মনকে কোন থেকে নামিয়ে উঠে দাড়ালেন ইন্সপেক্টর মিসেস হাসান এই কয়দিনে আরও বুড়িয়ে গেছেন। সবার দিকে একপলক দেখে একটু হেসে দিলেন ইন্সপেক্টর। ‘জ্বী বলুন। সবাই এসে গেছে। ’ রাজীব সাহেব একটু এদিক ওদিক দেখে ইন্সপেক্টরকে তার কাজ শুরু করতে বললেন।

‘আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে তবে আমি আপনাদের সবাইকে কিছুনা কিছু প্রশ্ন করতে চাই। ’ ‘না না আপত্তি কি বলছেন। আমরাও তো নিজেরা চাই বাবার খুনিকে বেড় করতে। তার জন্য সে সাহায্য লাগে তা আমরা করব। ’ বড় বউ আশ্বাস দিলেন ইন্সপেক্টরকে।

এই সময় রাহাত সাহেব মুখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলেন। রাহাতকে দেখেই ইন্সপেক্টর দাড়িয়ে গেলেন। রাহাতও হতভম্ভ হয়ে গেলেন। দুজনে এদিক ওদিক দেখে আবারও চোখ স্থির করছেন। ‘আমার ছোট ভাই।

’ রাহাতের দিকে এগিয়ে গেলেন ইন্সপেক্টর। হাত বাড়িয়ে দিলেন হ্যান্ডসেক করার জন্য। ‘‘I am inspector Suhas Chawdhury.’’ ‘আমি রাহাত। ’ ‘আশ্চর্য ! আপনি বাংলা জানেন?’ ‘আমি বাঙ্গালী। ’ ‘I know কিন্তু শুনেছি আপনি অনেকদিন দেশে আসেননি।

তাই ভাবলাম যদি বাংলা ভুলে যান। ’ সোফায় ইঙ্গিত করে রাহাতকে বসতে বললেন ইন্সপেক্টর। নিজেও বসলেন। রাকিব সাহেব আপনি যদি চান তবে একটা প্রশ্ন করি। আকস্মিক প্রশ্নে একটু কেঁপে উঠলেন মি. রাকিব।

ঘামছেন দরদর করে। তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন সবাই। মি. রাকিব সবার দিকে একবার তাকালেন। নির্দোষ ভঙ্গিতে তিনি ঘাম মুছতে মুছতে বললেনÑ ‘আমি এমনিভাবেই ঘামি তাইনা বড় ভাইয়া?’ রাজীব কিছু বললেন না। মাথাটাও নাড়ালেন না।

পায়ের ওপর পা তুলে ঠিকঠাক হয়ে বসলেন ইন্সপেক্টর। ‘আপনি জানেন ব্যাপারটা?’ মাথা নিচ করলেন রাহাত। ‘ইন্সপেক্টর। ’ সবাই মিসেস রফিকের দিকে চাইলেন। ‘জ্বী বলুন।

’ মিসেস রফিকের কাছে ঘেঁষে বসলেন ইন্সপেক্টর। ‘এদের বাবার একটা মাটির হাঁস ছিল। ’ ‘এটা কোন কারণ হল?’ রাকিব প্রশ্ন করে বসলেন। ইন্সপেক্টর হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে মিসেস রফিককে কথা চালিয়ে যেতে বললেন। ‘সেখানে ছিল ১০ ক্যারোট ওজনের দুটো হীরা।

’ ‘ডায়মন্ড!’ সমস্বরে সকলের চোখ বড় বড় হয়ে উঠল। ইন্সপেক্টর এবার উঠে দাড়ালেন। মনে হচ্ছে তিনি যা জানার তা জেনে গেছেন। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন তিনি। যাবার সময়ও সেই মিষ্টি হাসিটা হেসে দিলেন সবার উদ্দেশ্যে।

আফসুটস্বরেই রাহাতের মুখ দিয়ে বের হল- ‘বড়ই সন্দেহজনক। ’ ‘প্লীজ একটু দাড়ান প্লীজ, প্লীজ। ’ লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখলেন কে যেন দৌড়ে আসছে। গাড়ি দাড় করালেন ইন্সপেক্টর। পুলিশ জীপের কাছে চলে এল আশিক।

‘কি ব্যাপার? কে আপনি? গাড়ি থেকে নামলেন ইন্সপেক্টর। ‘আমি ...........’ এতটুকু বলেই থেমে গেল সে। গাড়ির পিছনে ছোটা কম কথা ! ইশারায় পুলিশকে জানিয়ে দিল একমিনিট। ‘Sorry, আমি আশিক। রাজীব চাচ্চুদের বাড়ির পাশে থাকি।

’ ‘খুনের ব্যাপারে কিছু বলবে?’ ‘হ্যাঁ হ্যাঁ ওইটাই। ’ আজ রাতের ঘটনা পুরোটাই বলে দিল সে। ইন্সপেক্টর মন দিয়ে শুনছেন আর মাঝে মাঝে মুচকি হাসছেন। ‘Thanks boy. তবে আর কখনও বোকাদের মত এমন ঝাউ জঙ্গলে আসবানা। Ok’ এদিক ওদিক তাকিয়ে আশিককে সাবধান করে দেন ইন্সপেক্টর।

মাথা নাড়ে আশিক। ইন্সপেক্টর গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন। মিসেস রফিক সায়মনকে সাথে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন রাতে। এমন সময় অস্পষ্ট একটা ছায়া ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। কিছু একটা কুজতে লাগল হন্যে হয়ে।

বোঝা যাচ্ছে লোকটা মুখোশধারী। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাড়িয়ে রইল সে। তারপর ধীর পায়ে মিসেস রফিকের কাছে আসল। নাকের কাছে হাত রেখে এপাশ ওপাশা ঘুরল একবার। আবারও কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইল ঠাঁয়।

খুটখাট শব্দ ঘুশ ভেঙ্গে গেল মিসেস রফিকের। সামনে একজন অদ্ভুতুরে লোককে দেখে চিৎকার দিলেন তিনি। বাড়ির সবার ঘুম প্রায় ভেঙ্গে গেল। মিসেস রফিকের কাছে ছুটে আসলেন সবাই। এতক্ষণ ঘর থেকে পালিয়ে গেছে লোকটি।

যাওয়ার সময় আরেকজন লোকের সাথে তিনি গাড়িতে উঠলেন। বারান্দায় ছুটে এসে রাজীব সাহেব দেখলেন কারা যেন গাড়ি করে পালিয়ে যাচ্ছে। * আশিকের ঘরের ল্যান্ডফোনটা বেজেই চলছে। রান্নাঘর থেকে মিসেস চৌধুরী একবার উকি দিলেন ছেলের ঘরে। ছেলে অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

মনে মনে ছেলেকে গালি দিলেন বার কয়েক। ছেলে যে এত শব্দেও জাগা পায়না। বিরক্ত হয়ে ফোনটা তুললেন আশিকের বাবা। ‘কে বলছেন?’ ‘আমি মাফি, আশিকের বন্ধু। আঙ্কেল?’ ‘হ্যাঁ বাবা আশিক তো ঘুমোচ্ছে।

তুমি পড়ে ফোন কর। ’ ‘না আঙ্কেল, ওকে একটু ডেকে দেন না। কুব জরুরী। আচ্ছা ঠিক আছে লাগবে না। ’ ফোন রেখে দিলেন মি. চৌধুরী।

ছেলের দিকে ঘুরে নাকে হাত দিলেন। নাহ্ বেঁচে আছে মাথাটা এপাশ ওপাশ দুলিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন। ‘মাফি ফোন করেছিল। কিসেন দরকার তোমাকে। ’ নাস্তার টেবিলে আশিককে জানিয়ে দিলেন কথাগুলো।

আশিক কোন কথা বলল না। ‘ওজে একটা ফোন করে দিও!’ মাথা নাড়ে আশিক। এই সময় ফোনটা বেড়ে উঠল। রিসিভার তুলল আশিক। ‘হ্যালো!’ ‘আশিক?’ ‘কিরে মাফি?’ ‘আজ একটু ক্যাম্পাসে আসতে পারবি?’ ‘আজ?’ ক্যালেন্ডারটা এক পলক দেখে নিল আশিক।

২৫ ডিসেম্বর। ‘আজতো ছুটির দিনরে মাফি!’ ‘জানি, জানি। তবুও একটু আয়নারে ভাই। জরুরী কথা আছে তোর সাথে। ’ ‘বাসায় চলে আয়না।

’ ‘এটা বাসার ব্যাপার না। Top Secret. আয়না Please’ ‘আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু সময়?’ ‘এই ধর সাড়ে দশটা। ’ এবার ঘড়ির দিকে তাকালো আশিক। আটটা বাজে।

‘Ok bye.’ রিসিভার নামিয়ে রাখল দুজনে। এতক্ষণ ধরে আশিকের কথা শুনছিলেন মিসেস চৌধুরী। ছেলে টেবিলে বসার সাথে জেকে ধরলেন তিনি। ‘কি ব্যাপারবে আশিক? খুনের মামলা?’ ‘আরে ধুরমা তুমি আর না। সবসময় উল্টাপাল্টা ভাব।

ওতো জানেই না রফিক দাদু খুন হয়েছেন। হয়তোবা পরীক্ষার ব্যাপারে কিছু বলবে। ’ ‘তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু বাবা ভুলেও যেন খুনের ব্যাপারে জড়িয়ে যাসনা। ’ হো হো করে হেসে উঠল আশিক।

মাও হেসে দিলেন। কিন্তু বুঝলেন না ছেলে কেন হাসছে। রাতের ঘটনায় সবাই বেশ চিন্তিত। মি. রাজীব ইন্সপেক্টরকে ফোন পাচ্ছেননা। শুধু রাকিব সাহেব সবার গতিবিধী লক্ষ্য করলেন।

একটা সিগারেট ধরিয়ে চলে গেলেন ঘরে। ‘কি দেখলে? প্রবা জিজ্ঞাসা করলেন রাকিবকে। হাত উঁচিয়ে জানিয়ে দিলেন সব টিক আছে। দুষ্টু হাসি ফুটে উঠল প্রবার মুখে। ‘কিরে মাফি? কি দরকার বল।

’ ক্যাম্পাসে পায়চারি করছিল মাফি। আশিককে দেখে থেমে গেল। চোখে মুখে একটা বিশ্ময়, ভয় ! দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাতে ঘুম হয়নি। ‘মাফি ! ঘুমাসনি রাতে?’ ‘নাহ্। বোস।

’ ক্যাম্পাসটা আজ বেশ ফাঁকা। তবুও কথাবলার সময় বারকয়েক দেখল মাফি। ‘সিরিয়াস কথা রে আশিক। ’ ‘Topic কি?’ ‘খুন। ’ চোখ বড় বড় হয়ে গেল আশিকের।

তবে কি মার কথা সত্যি হবে? ‘I’m sorry to say it’s about you. ‘মানে কি?’ ‘তোদের বাড়ির পাশে রফিক হাসান খুন হয়েছেন না। দোস্ত, তালিকায় আছিস। ’ বুকটা ধক করে উঠল আশিকের। তার মানে মা যতটা ভেবেছেন তার চাইতেও ভয়ঙ্কর এই ইন্সপেক্টর। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিল।

কেন যে সে মার কথা শুনলনা। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিল সে। ‘Details বল। ’ ‘তুই তো জানিস, শীতের রাতে আমার ঘুম হয় না। কাল রাতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

রাত তখন আনুমানিক দেড়টায় একটা সিগারেট ধরিয়ে হাঁটছিলাম। তিন চারটা বাড়ি পর হওয়ার পর একটা আওয়াজে থমকে দাড়াই। একটু সামনে এগিয়ে আধো আলো আধো আধারের একটা বাড়ি দেখতে পাই। সেখানে সম্ভবত তিন থেকে চারজনের একটা দলছিল। আরেকটু এগিয়ে গেলাম সেখানে দেখি আমাদের নতুন ইন্সপেক্টর।

’ ‘সুহাস চৌধুরী ! তারপর....?’ আশিক ভয় পেয়ে গেল। কথা বলতে বলতে ঘেমে গেছে মাফি। টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে নিল সে। ‘তারপর, ইন্সপেক্টর শুধু তোর নামটাই নিচ্ছিল। বলে একটা ছেলেকে তো অন্ততপক্ষে পাওয়া গেছে আশিক।

’ মাথায় হাত রাখল আশিক। কি বলবে কিছু ভেবে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ রইল দুজনে। ‘আমি রাত্রেই তোকে ফোন করতে চেয়েছিলামরে আশিক। ’ ‘ঠিক আছে, আর কিছু শুনেছিস?’ ‘শুনলেও বুঝিনি।

’ যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল আশিক। ক্যাম্পাস থেকে বেড়িয়ে রিক্সা ডাকল। কিন্তু কোথায় যাবেচ বুঝতে পারছে না। ইন্সপেক্টর সাথে দেখা করবে নাকি মাকে সব বলে দিবে। নাহ মাকে বলা ঠিক হবে না।

ঘড়ি দেখল। প্রায় ১ টা। সোজা চলে গেল রফিক সাহেবের বাসায়। ‘ওমা ! আশিক না এটা। ’ আশিক কে দেখে খুশি হলেন সারা।

‘এতদিন পর যে বাবা? পাশেই থাক অথচ আসনা। ’ ‘সময় হয় না চাচি। আসতে তো চাই। ’ ‘ তা যা বললে। তোমার দাদু খুন হলেন তাকেও শেষবার দেখতে আসলে না।

‘কি করব গো চাচি, পরীক্ষা ছিল। ’ ‘এমা, বাহিরে দাড়িয়ে থাকবে নাকি ভিতরে আস। ’ ‘না চাচি ভিতরে যাব না। একটা কথা ছিল। ’ ‘বল।

’ ‘ইন্সপেক্টর এসেছিলেন আজকে?’ ‘না তো। কোন সমস্যা?’ ‘না, না, না। এমনি বললাম। আসি চাচি। ’ বিদায় নিয়ে চলে গেল সে।

আর কিচু ভাবতে তার ইচ্ছে করছে না। রাত থেকেই রাহাত বেশ উত্তেজিত। কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। মুঠোফোনটা বারবার দেখছে। মিসকল লিস্টচেক করছে।

একটা নাম্বার কল দিয়েও রিসিভ হচ্ছে না। ‘ধ্যাৎ। ’ বলেই বিছায় ছুয়ে ফেলে দিল ফোনটা। ঘর থেকে বেড়িয়ে যাবার সময় এবার বেজে উঠল ফোন। ‘হ্যালো ! চূ........’ ‘অনাকাঙ্খিত ফোনের জন্য দুঃখিত।

’ ‘কে আপনি?’ ‘ইন্সপেক্টর সুহাস চৌধুরী। চিনতে অসুবিধা হবে না নিশ্চই। ’ ‘ই.... ই.... ইন্সপেক্টর!’ ‘আসছি। ’ লাইনটা কেটে গেল। ফোন টা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে রইলেন রাহাত।

* আজ আশিকের কিছুই ভাল লাগছেনা। গলির মধ্যে পায়চারি করছে। বাড়িতে যেতে সাহস নেই। মুখটা বিষন্ন। মা ঠিকই বুঝতে পারবেন ছেলে কোন ঝামেলায় পড়েছে।

আর এটা যে খুনের বিষয় তাতে মার সন্দেহ থাকবে না। ঘড়ির কাটা টিকটিক করে ৪-৫ টা গেল। নিজেকে অপরাধী ভাবতে লাগল সে। মায়ের কথা না শোনার কারণে বাব বার আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইছে। ‘আশিক নাকি? কেমন আছ?’ হক চকিয়ে উঠল আশিক।

সুহাস চৌধুরী পিছনে দাড়িয়ে। মুখে সেই মিষ্টি হাসি। ঢোক গিলল সে। হাত পা তার ঠান্ডা হয়ে আসছে যেন অবশ হবে। এই প্রথম বারের মত ইন্সপেক্টর এর মুখে হাসির রেখা মিলে গেল।

অবাক হয়ে তিনি আশিককে ছুয়ে দেখলেন। ‘তুমি কি অসুস্থ ?’ ইন্সপেক্টরের কাছ থেকে দু হাত পিছাল আশিক। ‘কই না তো। I’m tataly fit.’ ‘No Something wrong.’ ‘না না আমি পুরোপুরি সুস্থ। ’ ‘তাই বল আমি তো ভেবেছিলাম..... Ok চল।

’ ‘কোথায়?’ আরেকবার ঢোক গিলল আশিক। ‘জ্বী আমি অসুস্থ। ’ মিনমিন করে নিজেকে বলল সে। ‘কিছু বললে?’ ‘নাহ্। ’ অনিচ্ছা সত্ত্বেও জীপে ওঠে বসল।

একেবারে জড়োসরো হয়ে বসেছে সে। তবে আশিক ছাড়াও যে জীপে আরও লোক আছে তা সে উপলব্ধি করল। গাড়ি এসে থামল রফিক সাহেবের বাসার সামনে। রাজীব সাহেব বারান্দাতেই বসে ছিলেন। ইন্সপেক্টরকে দেখে উঠে দাড়ালেন।

‘Good evening.’ ‘evening. কি ব্যাপার বলেন তো ইন্সপেক্টর। আজ আসতে এত দেরী করলেন কেন? জানেন কাল রাত্রিবেলা....’ ‘কথাটা ঠান্ডা মাথায় শুনলে better হবে। কি বলেন?’ ‘Oh ! Sorry আসুন। ’ আশিক জীপ ঘেঁষে দাড়িয়ে ছিল। উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল জীপে আর কে আছে।

ইন্সপেক্টর কাছে এসে হাত দিলেন ঘাড়ে। লাফ দিয়ে পিছন ফিরে তাকালো সে। ‘চল যাওয়া যাক। ’ ‘জ্বী যাচ্ছি। ’ সবগুলো দাঁত বেড় করে হাসার চেষ্টা করল সে।

আজ মিসেস রফিক। নিজেই এসেছেন ইন্সপেক্টরের কাছে। ‘আস্সালামু আলাইকুম, চাচি। ’ উঠে দাড়ালেন ইন্সপেক্টর। ‘ওয়ালাইকুম আস্সালাম।

বস বাবা। তুমি কি খুনিকে ধরতে পারবে বাবা। আমরা যে অনিরাপত্তায় ভুগছি। ’ টুপ করে একফোটা চোখের পানি পড়ল তার। আচল দিয়ে মুখ মুছলেন তিনি।

সমবেদনা বোধ হল ইন্সপেক্টরের। ‘মি. রাজীব রাতে কি হয়েছিল? ‘রাতে মায়ের ঘরে একজন মুখোশধারী লোক ঢুকেছিল। চিৎকার শুনে ঘরে আসতেই লোকটি পালিয়ে যায়। এবং পরে দুজনকে দেখি গাড়ি নিয়ে চলে যাচ্ছে। ’ ‘হুম।

’ বলেই ইন্সপেক্টর দাড়িয়ে গেলেন। টবে রাখা ক্যাকটাসের গায়ে হাত-দিয়ে জানালার কাছে দাড়ালেন। আশিকের এ সময়টাতে বেশ অস্বস্থি লাগছে। চেনা মানুষগুলোকে আজ তার খুব অচেনা লাগছে। সবাই তাকিয়ে আছেন ইন্সপেক্টরের দিকে।

মোড় ঘুরে রাহাতের কাছে গেলেন ইন্সপেক্টর। ‘মি. রাহাত আপনি কত বছর বিদেশে ছিলেন?’ ‘৭ বছর। ’ কিছুটা ভয়জড়িত কণ্ঠে উত্তর দিলেন তিনি। ‘৭ বছর ! দেশে আসলেন কবে?’ ‘৩ দিন আগে। ’ ‘লন্ডন থেকে এত দ্রুত আসলেন কি করে?’ ‘মানে কী? এসবের সাথে তো খুনের সম্পর্ক নেই।

’ ‘ভুলে যাবেন না প্রত্যেকে প্রত্যেকের উপর নির্ভর করে। ’ ইন্সপেক্টর সোফায় এসে বসলেন। ‘আপনারা কেউ হয়তো বা জানেননা মি. রাহাত ৩ দিন নয় ৩ বছর আগে দেশে এসেছেন। ’ ‘৩ বছর ! কি বলছেন কি আপনি?’ ঘোরবিরোধিতা করল রাহাত। সবার চক্ষু স্থির।

‘ইন্সপেক্টর আমার ভাই ৩ দিন আগে দেশে এসেছেন তা আপনিও জানেন। ’ বিরক্তি নিয়ে কথাগুলো বললেন মি. রাজীব। ‘দেখুন, আপনার ভাই যেদিন এসেছেন সেদিন লন্ডন থেকে বালাদেশের সকল রাতের ফ্লাইট বন্ধ ছিল because the weather was not so good. So, স্বভাবতই প্রশ্ন আসবে আপনার ভাই আসলো কি করে? লন্ডন থেকে বাসে তো আর আসননি। কি?’ নীরব হয়ে রইলেন সকলে। একে অপরের মুখ চাওয়াচায়ি করতে লাগলেন।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকিয়ে রইলেন ইন্সপেক্টর। তারপর উঠে গেলেন গাড়ির কাছে। কিছুক্ষণ পর একজন কনস্টেবল ও একটি লোকসহ ফিরে এলেন ঘরে। আশিক উঠে দাড়াল। এই কনস্টেবল তো উধাও হয়েছিলেন।

’ ঘাবড়ে গেলেন রাহাত। ‘চিনতে পারছেন মি. রাহাত?’ ‘নাহ্ আমি দেখিনি এনাকে কখনও। ’ ‘কিন্তু এ লোক যে বলছে সে আপনাকে চেনে। তবে কি মিথ্যে বলেছেন মি. চূড়ান্ত?’ লোকটির দিকে ঘুরে দাড়ালেন ইন্সপেক্টর। ‘অসম্ভব।

আমি মিথ্যে বলিনি। রাহাত আমার বন্ধু। ৩ বছর ধরেই সে আমার সাথে ব্যাবসা করে। ’ ‘রাহাত সাহেবকে আমিও চিনতাম। তাই তাকে প্রথম দেখেই থমকে দাড়াই।

আর খুনটা হয় রাহাত সাহেবকে ঘিরেই। রাজীব সাহেব এবার উঠে দাড়ালেন। ‘ইন্সপেক্টর আপনি আমার ভাইকে অপদস্থ করছেন যা অযৌক্তিক। খুনিকে ধরতে পেরেছেন কিনা সেই কথা বলুন। ’ দ্বীর্ঘ শ্বাস ছাড়লেন ইন্সপেক্টর।

এগিয়ে গেলেন রাহাত হাসান। ‘না-ভাইয়া উনি যা বলছেন সব ঠিক। আর এটাও সত্যিই আমি ৩ বছর আগে দেশে এসেছি। ’ ‘তোমর মাথা ঠিক আছে?’ রাকিব বিশ্বয় ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলেন। ‘হ্যাঁ ভাইয়া ঠিক আছে।

ইন্সপেক্টর আপনি যা ধারণা করেছেন, যা জেনেছেন সব সত্যি। ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ঝামেলা হওয়াতে ৩ বছর আগে বহি®কৃত হয়ে দেশে চলে আসি। বাড়িতে আসার সাহস হল না। যদি তোমরা আমাকে তাড়িয়ে দাও। তাই বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করে শেয়ার ব্যবসা করি।

কিন্তু মাঝখানে এখানেও ঝামেলা বাধে। টাকা আত্মসাতের মিথ্যা মামলা হয় আমার নামে। কিছুই বুঝে না উঠে বাবার আলমারি থেকে টাকা নিতে আসি ঘটনার দিন। কিন্তু বিশ্বাস করুন ইন্সপেক্টর। আামি খুন করিনি।

আমি ঘরে ঢোকার আগেই সেখানে দুজনকে আবিষ্কার করি। আড়াল হলাম। দেখলাম ওরা আলমারি থেকে সব ব্যাগে ঢুকাচ্ছে। বাবা জাগা পেয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে বাবাকে উপুর্যোপূরি ছুরিকাঘাত করতে থাকে। নীরব কান্না ছাড়া আমার করার কিছুই ছিল না।

চোখের সামনে বাবাকে খুন হতে দেখলাম। আমায় সন্দেহ করবে ভেবে দ্রুত সেখান থেকে পালিয়ে যাই। ’ বলতে বলতেই মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে পড়লেন রাহাত। দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে ডূকরে কেদে উঠলেন। বাড়ির আর সকলেও কছাদছেন।

এমন সময় একটি প্রিজন ভ্যান এসে দাড়াল বাড়ির সামনে। কয়েকজন কনস্টেবল দুজন লোককে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে আসলেন। আশিক চমকে গেল এসে তার বাবা আর গার্ড! ‘আপনাদের বাবার খুনি। ’ ‘অসম্ভব। ’ আশিক চেঁচিয়ে উঠল।

‘এটাও সম্ভব। মি. সামাদ চৌধুরী রফিক হাসানের খুনি। আর চূড়ান্ত তার সহযোগী। ‘মানে!’ চূড়ান্ত ভড়কে গেলেন। ভ্রু কুচকে গেল তার।

’ ‘গল্পটা আপনি খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন মি. চূড়ান্ত। বন্ধুর নামে ষড়যন্ত্র করে তাকে ফাঁসানোর জন্য টাকা যাতে তিনি ম্যানেজ না করতে পারেন সেজন্যে নিজেরাই টাকা গায়ের করতে চেয়েছিলেন। রাহাত হাসান, আপনাকে ফাঁসানোর জন্যই এরা দুজন চাল চেলেছিল। একজন বন্ধুর বেশে একজন অদৃশ্য হয়ে। ’ সামাদ চৌধুরী কিছু বললেন না।

মাথা নিচু করে আছেন। ‘খনিকে ধরা কঠিন হত, যদি না আশিক বলত খুনি যে জানালা দিয়ে ঢুকেছে তা শুধু ওদের বাড়ি থেকেই দেখা যায়। আর সায়মন সে যদি না বলত মৃত্যুর সময় দাদু ছোট চাচ্চু অর্থাৎ রাহাতকে দেখতে চেয়েছিলেন। আসলে তিনি রাহাত না সামাদ বলে আপনাদের খুনির পরিচয় বলেছিলেন। ’ ‘কিন্তু এই গার্ডকে পেলেন কোথায়?’ মিসেস রফিক জিজ্ঞাসা করলেন ইন্সপেক্টরকে।

‘আসলে ঐ রাতে গার্ড খুনিদের বাধা দেয় কিন্তু তারা সে বাধা মানে নি। তাই রাতেই সে ছুটে থানায় যায়। জীবনের শঙ্কা থাকায় তাকে কিছুদিন আত্মগোপন করতে বলি। সত্যি বীর আপনাদের এই গার্ড। ’ চূড়ান্ত এবং সামাদ চৌধুরী নীরব দাড়িয়ে আছেন।

নির্ঘাত-ফাঁসি হবে তাদের। বাবার কাছে এগিয়ে গেল আশিক। বাবাকে কি বলবে বুঝে পাচ্ছে না। এই সময় কোনটা করা উচিৎ ঘৃনা না কি সমবেদনা তাও তার অজানা। সেতো নিজেও চাইত রফিক দাদুর খুনি ধরা পড়–ক।

বাবা দুহাত চেপে ধরলেন আশিকের। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পাচ্ছেন না। চোখাচুখি হয়ে আছেন দুজনে। আর অঝোর ধারায় বইছে অশ্র“। প্রবার দিকে চোখ রাঙ্গালেন রাকিব সাহেব।

ভাগ্যিস স্ত্রীর কথামত হীরা চুরি করেনি। নির্দোষ ভঙ্গিমা করলেন প্রবা। ‘ভ্যানে ওঠাও এদেরকে। ’ কনস্টেবলকে আদেশ দিলেন ইন্সপেক্টর। গাড়ি স্টার্ট দিল।

বাহিরে দাড়ালেন সবাই। ইন্সপেক্টর রয়ে গেলেন। ‘রাহাত সাহেব আপনি যদি প্রথমেই আমাকে সাহায্য করতেন এতটাও বিলম্ব হত না। ’ ‘আসলে........ ’ আমতা আমতা করলেন রাহাত। ‘আসলে বাড়িতে আপনার ভাবমূর্তি নষ্ট হত কি?’ বলেই দুজনে হেসে উঠলেন।

রাজীব সাহেব কপালে চিন্তার রেখা নিয়ে এলেন ইন্সপেক্টর এর কাছে। ‘আচ্ছা ইন্সপেক্টর কিছুতেই বুঝতে পারছিনা আপনার কনস্টেবল.....’ ‘ও হো বলাই হয় নি। ঐ কনস্টেবলটা আপনাদের বাড়িতে নজর রাখছিল সবসময় লুকিয়ে। আজ রাতে সে লোকটি আপনার মায়ের ঘরে ঢুকেছিল সে রাহাতের বন্ধু। Sorry বন্ধু বললে ভুল হবে।

মি. চূড়ান্ত। আর পালাবার সময় আমার কনস্টেবল তাকে থানায় কৌশলে নিয়ে আসে। Then আমরা তার কথাতে বুঝতে পারি খুনির পরিচয়। আর খুনিকে ব্যস্ত রাখতেই প্রকাশ করেছিলাম ‘কনস্টেবল উধাও। ” কি বুঝেছেন?’ মাথা নাড়েন রাজীব সাহেব।

আজ হাসান পরিবার বেশ খুশি। ’ শুধু আশিক বিপর্যস্ত। সবাইকে একবার দেখে বেড়িয়ে গেল ধীর পায়ে। কেউ সে তাকে লক্ষ্যই করছে না। কিছুদূর গিয়ে একটা খালের পাড়ে বসল আশিক।

বেজে উঠল মুঠোফোন। মায়ের ফোন। বাবা আর মা এই সন্ধ্যাবেলায় ছাদে বসে নাস্তা করে। আজও হয় তোবা নাস্তা তৈরী করে রেখেছেন। বাবার ফোন বন্ধ তাই বুঝি ছেলেকে ফোন করে জানতে চাইছেন স্বামীর খবর।

আবারও দুচোখ জুরে বর্ষা নামল। কিন্তু কি বলবে আশিক মাকে ? যে অজানা ভয়ে মা তাকে আগলে রাখতে চেয়েছিল সেটা যে বাবা তাদের জীবনের সাথে জাড়িয়ে দিয়েছে। শূন্যতায় বুকটা হু হু করে উঠল তার...............। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।