এদেশে যারা অন্যায়ের রাজা হাতে তাদের রাজদন্ড; আমরা হবো সত্য, হাতে ন্যায়দন্ড। রাজার পক্ষে নিযুক্ত রাজবেতনভোগী রাজকর্মচারী। আমাদের পক্ষে সকল রাজার রাজা, সকল বিচারকের বিচারক, আদি অন্তকাল ধরে সত্য – জাগ্রত আল্লাহ... একটি আনকমন পোস্ট । ধৈর্য সহ পুরোটা পড়লে অশেষ উপকৃত হবেন।
ধরণী, দ্বিধা হও!
কুরআন মাজীদে মীরাছের আহকাম স্পষ্টভাবে ঘোষিত হয়েছে।
মীরাছের মানদন্ড, ওয়ারিছগণের হিস্যা এবং আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়ের পর বলা হয়েছে-‘এইসব আল্লাহর নির্ধারিত সীমা। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করলে আল্লাহ তাকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত; যেখানে তারা স্থায়ী হবে এবং এটা মহাসাফল্য।
‘আর কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হলে এবং তাঁর নির্ধারিত সীমা লংঘন করলে তিনি তাদেরকে অগ্নিতে নিক্ষেপ করবেন; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং তার জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি। ’-সূরা নিসা (৪) : ১৩-১৪
ভয়াবহ বিষয় এই যে, বর্তমান মুসলিম-সমাজে একদিকে যেমন পারিবারিকভাবে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করা হচ্ছে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নাফরমানী করা হচ্ছে অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নাফরমানী ও সীমালঙ্ঘনের জন্য রীতিমতো ‘আইন’ প্রণয়নের প্রস্তাব করা হচ্ছে! কুরআনের বিধান সম্পর্কে সাধারণের অজ্ঞতা ও অবহেলার সুযোগে একশ্রেণীর লোক কুরআনের দ্ব্যর্থহীন নীতি ও বিধানে পর্যন্ত বিকৃতি ও পরিবর্তনের দুঃসাহস করছে!
সম্প্রতি ল’ কমিশনের পক্ষ হতে পুত্রহীন পিতার পরিত্যক্ত সম্পদে কন্যার কুরআন-নির্ধারিত অংশ পরিবর্তনের যে
প্রস্তাব করা হয়েছে এবং যে সকল যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করা হয়েছে সে সম্পর্কে কিছু বিষয় দায়িত্বশীলদের গোচরে আসা দরকার। নতুবা ঐসব যুক্তি-তর্কের সঠিক ‘মূল্যায়ন’ সম্ভব হবে না।
Recommendation of the law commission for possible increase of Daughter's share in the succession of parent's property in absence of son-
শীর্ষক ঐ সুপারিশে ১৯৬১ সালে প্রণীত Muslim Family Laws Ordinance-এর চতুর্থ ধারাকে মূল ভিত্তি ধরা হয়েছে এবং ঐ কুরআন বিরোধী পরিত্যক্ত ধারার ভিত্তিতে কুরআনী আইনকে ‘অযৌক্তিক’ বলার দুঃসাহস দেখানো হয়েছে।
অথচ কর্তব্য ছিল ঐ কুরআন বিরোধী অসার ও অযৌক্তিক ধারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে কুরআনের যৌক্তিক ও বিকল্পহীন ধারা প্রতিষ্ঠা করা। তা না করে ঐ মৃত ধারাটিকে পুনর্জীবিত করা হয়েছে এবং আরেকটি নতুন কুরআন বিরোধী আইন প্রবর্তনের জন্য চার পাঁচ দশক আগে আঁতুর ঘরেই মৃত্যুবরণকারী কিছু অসার ও অবাস্তব যুক্তি পুনরায় উপস্থাপন করা হয়েছে। এজন্য কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট ঘোষণা এবং যুক্তি-তর্কের আলোকে ঐ ধারার ভিত্তিহীনতা ও বর্জনীয়তা আবার স্মরণ করা দরকার। এতে প্রস্তাবনায় উল্লেখিত `reasons and arguments'-এর ‘শক্তি’ ও ‘স্বরূপ’ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।
প্রথমে মীরাছের মানদন্ড সম্পর্কে কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট ঘোষণা তুলে ধরছি।
সূরাতুন নিসার ৭-৮ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
لِلرِّجَالِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ وَلِلنِّسَاءِ نَصِيبٌ مِمَّا تَرَكَ الْوَالِدَانِ وَالْأَقْرَبُونَ مِمَّا قَلَّ مِنْهُ أَوْ كَثُرَ نَصِيبًا مَفْرُوضًا وَإِذَا حَضَرَ الْقِسْمَةَ أُولُو الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينُ فَارْزُقُوهُمْ مِنْهُ وَقُولُوا لَهُمْ قَوْلًا مَعْرُوفًا
‘পুরুষদের জন্যও সেই সম্পদে অংশ রয়েছে, যা পিতামাতা ও নিকটতম আত্মীয়বর্গ রেখে যায়। আর নারীদের জন্যও সেই সম্পদে অংশ রয়েছে, যা পিতামাতা ও নিকটতম আত্মীয়বর্গ রেখে যায়, চাই সে (পরিত্যক্ত) সম্পদ কম হোক বা বেশি। এ অংশ (আল্লাহর তরফ হতে) নির্ধারিত।
‘আর যখন (মীরাছ) বণ্টনের সময় (ওয়ারিশ নয় এমন) আত্মীয়, ইয়াতীম ও মিসকীন উপস্থিত হয়, তখন তাদেরকেও তা থেকে কিছু দাও এবং তাদের সাথে সদালাপ কর।
’
এই আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায়, মীরাছের হক্বদার হওয়ার মানদন্ড মৃতের ‘আকরাব’ বা নিকটতম (Nearer) হওয়া। এটি ৬ নং আয়াতের "الأقربون (আলআকরাবূন) শব্দে স্পষ্ট বলা হয়েছে। সুতরাং স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিছু আত্মীয় বাদ পড়বে, যারা মৃতের দূরবর্তী (remoter)। তবে তাদের সম্পর্কেও পরের আয়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, মীরাছ বণ্টনের সময় তারা হাজির হলে তাদেরকেও কিছু দাও এবং সুন্দর কথা বল।
এই আয়াত থেকে আরো জানা যায়, মীরাছের অধিকারী হওয়ার মানদন্ড এতীম বা মিসকীন হওয়া নয়।
একারণে মীরাছের অধিকারীদের কথা বলার পর এতীম মিসকীনের কথা আলাদা করে বলা হয়েছে এবং নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে যে, মীরাছ বণ্টনের সময় তারা উপস্থিত হলে তাদেরকেও কিছু দাও এবং সুন্দর কথা বল।
তো কুরআন বলে, মৃতের মীরাছ এতীম-মিসকীনের সহায়তার জন্য নয়; বরং তা নিকটতম আত্মীয়দের প্রাপ্য। এতীমের সহায়তার জন্য রয়েছে ‘নাফাকা’ ও ‘সাদাকা’র ব্যবস্থা আর মিসকীনের জন্য আছে ‘যাকাত’ ও ‘সাদাকা’র বিধান।
এরপর দুই আয়াত পরে ১১-১২ নম্বর আয়াতে কয়েক শ্রেণীর ওয়ারিছের হিস্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। এরা সর্বাবস্থায় ঐ নির্ধারিত হিস্যা পাবে।
পরিভাষায় এদেরকে যাবিল ফুরূয বলে। এদের মধ্যে আট প্রকার হলেন নারী আর চার প্রকার পুরুষ। বিস্তারিত ফারাইয-গ্রন্থাদিতে দ্রষ্টব্য।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের এই নীতি ও বিধানের প্রায়োগিক পন্থা স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন-
الحقوا الفرائض بأهلها، فما بقي فهو لأولى رجل ذكر
তোমরা ‘ফারাইয’ (নির্ধারিত হিস্যা) তার হিস্যাদারদের কাছে পৌঁছে দাও।
এরপর যা অবশিষ্ট থাকে তা নিকটতর পুরুষের। (আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর সূত্রে ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম ও অন্যান্য)
তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার দ্বারা কুরআনের এই নীতি প্রমাণিত যে, ‘যাবিল ফুরূয’ (যাদের হিস্যা নির্ধারিত) সর্বাবস্থায় মীরাছ পাবে। এরা হিস্যা নেওয়ার পর অন্যান্য আত্মীয়দের মাঝে মৃতের ‘আক্বরাব’ বা নিকটতম (nearer) আত্মীয়রা অবশিষ্ট সম্পদের অধিকারী হবে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে দূরবর্তীরা (remoter) স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাদ পড়বে। তবে আগেই বলা হয়েছে, বাদ-পড়াদের সম্পর্কেও কুরআনের নির্দেশনা, মীরাছ বণ্টনের সময় তারা এলে তাদেরকেও কিছু দাও এবং তাদের সথে সুন্দর কথা বল।
এখানে মনে রাখা দরকার, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যাখ্যা শুধু ‘ব্যাখ্যা’ নয়, তা আল্লাহর বিধান। এ কারণেই আল্লাহর রাসূলের ‘ব্যাখ্যা’ অনুসারে সালাত আদায় করলে আল্লাহর বিধান অনুসারেই সালাত আদায় করা হয়, তাঁর ‘ব্যাখ্যা’ অনুসারে যাকাত দিলে আল্লাহর বিধান অনুসারেই যাকাত দেওয়া হয়। এভাবে সওম ও হজ্ব; এভাবে সকল ইবাদত, সকল আহকাম। একই কারণে আমরা যখন তাঁর ‘ব্যাখ্যা’ অনুসারে মীরাছ বণ্টন করি তখন কুরআনের বিধান অনুসারেই তা বণ্টন করা হয়। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহর ঘোষণা-
لتبين للناس ما نزل اليهم
আরো ঘোষণা-
وما ينطق عن الهوى ان هو الا وحى يوحى
আর তিনি নিজ প্রবৃত্তি হতে কিছুই বলেন না।
এ তো ওহী, যা তার প্রতি প্রেরিত হয়। -সূরা নাজম (৫৩) : ৩-৪
সুতরাং যাঁরা মীরাছের বিষয়ে কুরআন-সুন্নাহর ‘নিখুঁত ব্যাখ্যা’ (`Fresh interpretation') পেতে আগ্রহী তাদেরকে আল্লাহর রাসূলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হাদীস ও সুন্নাহতেই তা অন্বেষণ করতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁরা যদি আল্লাহর রাসূলের ব্যাখ্যা থেকে বিমুখতা প্রদর্শন করেন (নাউযুবিল্লাহ) তাহলে বোঝা যাবে, তাদের `Fresh interpretation' অন্বেষণের অর্থ অন্য কিছু।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক ব্যাখ্যাকৃত কুরআন মজীদের ঐ মূলনীতি অনুসারেই পুত্রের বর্তমানে পৌত্র বাদ পড়ে যায়। এটি আল্লাহর রাসূলের সাহাবাদের (`his contemporaries') মাঝেও সর্বসম্মত ছিল।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সনদ অনুযায়ী তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ফারাইয-বিশেষজ্ঞ সাহাবী হযরত যায়েদ ইবনে ছাবিত রা.-এর ফয়সালাও সহীহ বুখারীতে আছে। তিনি বলেছেন-
ولد الابناء بمنزلة الولد إذا لم يكن دونهم ولد ذكر، ذكرهم كذكرهم، وأنثاهم كأنثاهم، يرثون كما يرثون، ويحجبون كما يحجبون ولد الابناء بمنزلة الولد إذا لم يكن دونهم ولد ذكر، ذكرهم كذكرهم، وأنثاهم كأنثاهم، يرثون كما يرثون، ويحجبون كما يحجبون، ولا يرث ولد الابن مع الابن.
পুত্রদের সন্তানও পুত্রের মতো যখন তাদের সামনে (মৃতের) কোনো পুত্রসন্তান না থাকে। ছেলেরা ছেলেদের মতো এবং মেয়েরা মেয়েদের মতো, এরা মীরাছ পাবে যেমন ওরা পায়, এরা বাদ দেবে যেমন ওরা বাদ দেয়। আর পুত্রের সন্তান পুত্রের উপস্থিতিতে উত্তরাধিকারী হবে না। ’
এটি ইমাম বুখারী তা’লীক করে এনেছেন।
সুনানে সায়ীদ ইবনে মানসূরে তা সনদসহ বর্ণিত আছে। (ফতহুল বারী)
সুতরাং এই দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন যে, নিকটতর আত্মীয়ের উপস্থিতিতে দূরবর্তী আত্মীয়ের বাদ পড়ার বিধান, বা পুত্রের উপস্থিতিতে পৌত্রের বাদ পড়ার বিধান কুরআনের কোনো আয়াত, বা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো নির্ভরযোগ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত নয়।
'There is no Qur'anic verse of authoritative Hadith which excludes orphaned grandchildren from inheriting their grandfather's property.
এ দাবি তাঁরাই করতে পারেন যাদের সত্যের সাথে বিন্দুমাত্রও সম্বন্ধ নেই।
সূরা নিসার উপরোক্ত (৬ নং) আয়াতের বিষয়ে এটিও স্বীকৃত যে, এর দ্বারা জাহেলী যুগের অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটেছে, যখন মৃতের পরিত্যক্ত সম্পদে শুধু প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষকেই অধিকার দেওয়া হত, যারা গোত্র ও পরিবারের পক্ষে অস্ত্র ধারণ করত। নারী ও বালকের কোনো অধিকার স্বীকৃত ছিল না, এমনকি তারা মৃতের নিকটতম হলেও।
অন্যভাষায়, প্রাচীন জাহেলিয়াতে মীরাছের মানদন্ড ছিল প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হওয়া। কুরআন মজীদ ঐ জাহেলী মানদন্ড বাতিল করেছে এবং ঘোষণা করেছে যে, মীরাছের মানদন্ড নিকটতর আত্মীয়তা। সুতরাং এই মানদন্ডে উত্তীর্ণ সবাই মৃতের পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে অংশ পাবে। সে নারী হোক বা পুরুষ, প্রাপ্তবয়স্ক হোক বা অপ্রাপ্তবয়স্ক।
কুরআনের এই মানদন্ড বর্তমান জাহিলিয়াতকেও খন্ডন করে, যা `Principle of representation' নামে মীরাছের এক অবাস্তব মানদন্ড উদ্ভাবন করেছে এবং এরই ভিত্তিতে পুত্রের বর্তমানে পৌত্রকে মীরাছের অধিকারী ঘোষণা করেছে।
সুতরাং একথাও সত্য নয় যে, পুত্রের উপস্থিতিতে পৌত্রকে বাদ দেওয়ার বিধান প্রাক-ইসলামী যুগের রীতি থেকে আহরিত, যে রীতিতে অপ্রাপ্তবয়স্ক বালকদেরকে মীরাছের অধিকারী মনে করা হত না।
The exclusion was based on pre-Islamic practice, which gave all property rights to male members capable of carrying arms to defend the interest of the tribe or the family.
কারণ ঐ জাহেলী রীতিকে তো কুরআনই বাতিল করেছে এবং নিকটতর আত্মীয়তাকে মীরাছের মানদন্ড ঘোষণা করেছে! এই মানদন্ডের কারণেই পুত্রের উপস্থিতিতে পৌত্র মীরাছ থেকে বাদ পড়ে, প্রাক-ইসলামী রীতির কারণে নয়।
সূরা নিসার ঐ মানদন্ড দ্বারা ঐ বিভ্রান্তিরও নিরসন হয়, যা শুধু তারাই ছড়াতে পারেন, যারা মানুষকে ইসলামের নীতি ও বিধানের প্রতি বিরূপ করতে আগ্রহী। তা এই যে, নাতীর পুত্র থাকা অবস্থায় দাদা নাতীর সম্পত্তি থেকে মীরাছ পেতে পারে। তবে কেন নাতী দাদার পুত্র থাকা অবস্থায় তার সম্পদ থেকে হিস্যা পাবে না?
উপরে কুরআন ও সুন্নাহর সুস্পষ্ট নির্দেশনা থেকে যাবিল ফুরূয ও আসাবার মাঝে মীরাছ বণ্টনের যে পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে তা জানা থাকলে যে কেউ বুঝবেন, দাদা এইজন্য নাতীর সম্পদ থেকে অংশ পাবে যে, কুরআন মজীদে তার হিস্যা নির্ধারিত।
সুতরাং যাবিল ফুরূযের একজন হিসাবে তিনি তার অংশ পাবেন। পক্ষান্তরে পৌত্র এজন্য পাবে না যে, সে আসাবার অন্তর্ভুক্ত, যারা নির্ধারিত হিস্যার অধিকারীরা হিস্যা নেওয়ার পর অংশ পায়। তাদের মাঝে নিকটতরের উপস্থিতিতে দূরবর্তী বাদ পড়ে যায়। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা সুস্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দিয়েছেন।
সুরাতুন নিসার আয়াতের দ্বারা ঐ বিভ্রান্তিরও নিরসন হয়, যেখানে সাধারণ মানুষকে আবেগাক্রান্ত করার জন্য সম্পূর্ণ আলাদা দু’টো বিষয়কে এক করা হয়েছে।
বলা হয়েছে যে, ইসলাম তো এতীমের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার। সুতরাং যে আইন দাদার সম্পত্তি থেকে এতীমের উত্তরাধিকার বিলুপ্ত করে তা কখনো কুরআন-সুন্নাহর চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না।
The Qur'an has time and again expressed great solicitude for the protection and welfare of the orphans and their property. Any law depriving them of inheriting their grandfather's property would go entirely against the spirit of the Qur`an.
এ ধরনের কথা কেবল মীরাছের কুরআনী মানদন্ড সম্পর্কে অজ্ঞতা বা অসাধুতাপ্রসূতই হতে পারে। কুরআন অবশ্যই এতীমের অধিকার রক্ষা করেছে, এমনকি সূরাতুন নিসারই অনেক আয়াত এতীমের অধিকার সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। কিন্তু মীরাছের বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা।
এখানে মানদন্ড এতীম হওয়া নয়, মৃতের নিকটতর হওয়া। সুতরাং এতীমের অধিকার রক্ষার প্রসঙ্গ তুলে মীরাছের মানদন্ড বাতিলের অর্থ কুরআনের এক বিধান দ্বারা অন্য বিধান বাতিলের অপচেষ্টা। এটা কি কুরআন-সুন্নাহর চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ?
দ্বিতীয়ত, উপরোক্ত যুক্তি মেনে নিলে প্রশ্ন হবে, এ যুক্তি শুধু এতীম পৌত্রের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হবে কেন? কেন তা এতীম ভাতিজা-ভাতিজি, এতীম ভাগ্নে-ভাগ্নী ও অন্যান্য এতীমদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না? কেন বলা হবে না যে, কুরআন তো এতীমের অধিকার সংরক্ষণ করেছে; সুতরাং যে বিধান এতীম ভাতিজা-ভাতিজি, এতীম ভাগ্নে-ভাগ্নী ও অন্যান্য এতীমের অধিকার বিলুপ্ত করে তা কুরআন-সুন্নাহর চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী?
কুরআন তো বিধবার অধিকারও সংরক্ষণ করেছে। তাহলে মৃতের পরিত্যক্ত সম্পদ থেকে তার বিধবা খালা-ফুফু এবং বিধবা চাচী-মামীকে কেন হিস্যা দেওয়া হবে না? কেন বলা হবে না যে, যেই বিধান এদেরকে মীরাছের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তা কুরআন-সুন্নাহর চেতনার সম্পূর্ণ বিরোধী?
কুরআন তো প্রতিবেশীর অধিকারও সংরক্ষণ করেছে। তাহলে মৃতের মীরাছ থেকে তার নিকট ও দূরের সকল প্রতিবেশীকে কেন হিস্যা দেওয়া হবে না? কেন বলা হবে না যে, যেই আইন প্রতিবেশীকে মীরাছের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তা কখনো কুরআন-সুন্নাহর চেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে পারে না?
এ ধরনের অসংখ্য প্রশ্ন একের পর এক উঠতেই থাকবে, যে পর্যন্ত না স্বীকার করা হবে যে, এতীমের অধিকার এবং মীরাছের মানদন্ড সম্পূর্ণ আলাদা দু’টো বিষয়।
এতীমের সহায়তার জন্য আছে নাফাকা ও সাদাকার বিধান, পক্ষান্তরে মীরাছ নিকটতম আত্মীয়দের প্রাপ্য। দু’টোকে এক করে বিভ্রান্তি সৃষ্টির সুযোগ নেই।
এ পর্যন্ত আমরা কুরআন মজীদ ও সহীহ (মুতাওয়াতির বিল মা’না) হাদীস থেকে মীরাছের মানদন্ড আলোচনা করেছি এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের কিছু প্রশ্নের জবাবও দিয়েছি। এখন এই ভুইফোঁড় Principle of representation সম্পর্কেও কিছু কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই।
এক. এই নীতি কুরআন মজীদের কোন আয়াত এবং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন হাদীসে আছে? যদি না থাকে; যদি বিপরীত নীতি কুরআন-সুন্নাহয় থাকে তাহলে কেন এই ‘নীতি’কে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আখ্যা দেওয়া যাবে না?
দুই. সবাই জানেন, মৃতের পরিত্যক্ত সম্পদ ঐ সকল ওয়ারিশের মাঝেই বণ্টিত হয়, যারা তার মৃত্যুর সময় জীবিত ছিল।
কিন্তু উপরোক্ত নীতি অনুসারে মীরাছ বণ্টনের সময় একজন মৃত ব্যক্তিকে জীবিত ধরা হয়েছে এবং তাকে হিস্যাদার করা হয়েছে। অতপর পুনরায় তাকে মৃত গণ্য করা হয়েছে এবং তার পক্ষ হতে প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়েছে। প্রশ্ন এই যে, এভাবে মৃতকে জীবিত করা, এরপর পুনরায় তাকে মৃত গণ্য করা ও তার পক্ষে প্রতিনিধি নিয়োগ করা-এই বালখিল্যতা কোথায় কোন দলীলে অনুমোদন করা হয়েছে?
দ্বিতীয়ত, মীরাছ বণ্টনের সময় যদি মৃত পুত্র বা কন্যাকে (Predeceased son or daughter) জীবিত ধরা যায় তাহলে অন্য মৃত ওয়ারিছদেরকেও কেন জীবিত ধরা যাবে না? এক্ষেত্রে পুত্র-কন্যা এবং অন্যান্য আত্মীয়ের মাঝে পার্থক্য করার বিধান কুরআনের কোন আয়াতে বা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন হাদীসে আছে?
তৃতীয়ত, মৃত পুত্রকে যদি জীবিত ধরা যায় তাহলে শুধু ঐ পুত্রকেই কেন, যার সন্তান-সন্ততি আছে?
নিঃসন্তান মৃত পুত্রকে কেন জীবিত ধরা যাবে না এবং তার অন্যান্য ওয়ারিশকে কেন তার প্রতিনিধি গণ্য করা যাবে না?
চতুর্থত, মৃত পুত্রের শুধু সন্তান-সন্ততিকেই কেন প্রতিনিধি (Representative) সাব্যস্ত করা হবে? অন্যান্য ওয়ারিশ কেন তার প্রতিনিধি হতে পারবে না? প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে এই পার্থক্য কুরআনের কোন আয়াত বা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন হাদীস থেকে নেওয়া হয়েছে?
এই সকল প্রশ্নের জবাব দেওয়ার এবং Principle of representation-এর কারণে মীরাছ-দাবির ক্ষেত্রে যে অরাজকতা সৃষ্টির শক্তিশালী সম্ভাবনা আছে তার দায় কে গ্রহণ করবেন? এই অদ্ভূত নীতির প্রস্তাবকারীগণ, না যারা জনগণের সাথে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কোন আইন প্রণয়ন না করার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সেই দায়িত্বশীলগণ?
তিন. এই অদ্ভুত নীতির ‘ফল’গুলোও একটু পরখ করুন। কথায় আছে, ‘বৃক্ষের তার ফলে’ পরিচয় পাওয়া যায়।
এক ব্যক্তি মৃত্যুকালে এক কন্যা ও এক নাতনী (মৃত পুত্রের কন্যা) রেখে গেছেন।
কুরআনের বিধান অনুযায়ী কন্যা পরিত্যক্ত সম্পদের অর্ধেক ও নাতী এক ষষ্টমাংশ পাবে। কিন্তু Principle of representation অনুযায়ী বিধান এই দাড়ায় যে, মৃতের নিজের কন্যা পাবে সম্পদের এক তৃতীয়াংশ, আর নাতনী পাবে দুই তৃতীয়াংশ! কারণ নাতনী যে তার মৃত পিতার প্রতিনিধি!
এহেন হাস্যকর ও অবাস্তব ‘নীতি’র সাথে ‘সংঘর্ষ’ হয়েছে বলে যাঁরা মীরাছের কুরআনী বিধান সম্পর্কে মন্তব্য করেন-
Although illogicality of the position is apparent in the face ... তাঁদের ‘জ্ঞান’ ও ‘প্রজ্ঞা’র উপর অশ্রুবর্ষণ ছাড়া আর কী করা যাবে?
উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত যে সকল যুক্তি-তর্ক উপস্থাপিত হয়েছে-এগুলো অনেক আগে থেকেই বলা হচ্ছে। ১৯৬১ সালে যখন নাতীর মীরাছ সংক্রান্ত আইন প্রণীত হয়, ঐ সময়ই আলিমগণ এইসব ত্রুটি চিহিত করেছেন। জানি না আমাদের
প্রস্তাবকারীগণ ঐ শক্তিশালী পর্যালোচনাগুলোও পাঠ করেছেন, না একমুখী ও সীমাবদ্ধ অধ্যয়নকেই দেশ ও জাতির জন্য আইন প্রণয়নের পক্ষে যথেষ্ট মনে করেছেন। বাস্তবতা যেটাই হোক তা অত্যন্ত দুঃখজনক।
তো এই হচ্ছে Principle of representation এর স্বরূপ ও সারবত্তা এবং এর পক্ষে উপস্থাপিত `reasons and arguments' এর ‘শক্তি’ ও ‘ভিত্তি’। এরই ভিত্তিতে যখন নতুন কোনো ‘বিধান’ প্রস্তাব করা হয় তখন ঐ বিধানের দুর্দশা সহজেই অনুমান করা যায়।
এর চেয়েও বড় কথা এই যে, ঐ নতুন ‘বিধান’টিও সরাসরি কুরআন মজীদের বিরোধী।
সূরাতুন নিসার ১১ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-(তরজমা) ‘আল্লাহ তোমাদের সন্তান সম্বন্ধে নির্দেশ দিচ্ছেন : এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার সমান; কিন্তু শুধু কন্যা (দুই বা) দুই এর অধিক থাকলে তাদের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই তৃতীয়াংশ। আর মাত্র এক কন্যা থাকলে তার জন্য অর্ধাংশ।
...’
তো আলোচিত প্রস্তাবের সারকথা হচ্ছে একটি ভিত্তিহীন নীতির ‘ভিত্তি’তে কুরআনের দ্ব্যর্থহীন বিধান পরিবর্তনের প্রস্তাব। উপরন্তু এহেন অপকর্মের শিরোনাম যখন দেওয়া হয়, ‘ইজতিহাদ’ `Increase of Daughter's share in the absence of son by Ijtihad' তখন শুধু এটুকুই বলা যায়-‘ধরণী দ্বিধা হও!’
গবেষণামূলক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর মুখপত্র মাসিক আলকাউসার জুলাই-আগস্ট-২০১২, শাবান-রমযান-১৪৩৩ ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।