জীবনের গল্প বলে যাই গল্পের মতো করে...
তার পিছনে সবসময়ই গুপ্ত আততায়ী লাগিয়ে রেখেছিলো আমেরিকা। কিন্তু তারপরও নিজের জায়গায় তিনি ঠায় থেকে গেছেন। আর দেখেছেন আমেরিকার নয়জন প্রেসিডেন্টকে মতায় আসতে এবং পর্দার আড়ালে চলে যেতে। কেনেডির গুপ্তহত্যাসহ তাদের কয়েকজনকে চির বিদায় নিতেও দেখেছেন। এ বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বাচলে হয়তো তিনি তার সময়কার দশম প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় আরোহণও দেখে যেতে পারবেন।
কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো এবার স্ব ইচ্ছায় মতা থেকে সরে দাড়াচ্ছেন। তাকে নিয়ে এই লেখাটা একটি দৈনিকে ছাপা হয়েছে। তারপরও ব্লগে দিয়ে দিলাম দুটি উদ্দেশ্যে। ১. আমার সাথে সাথে ব্লগাররাও জানতে পারবেন অনেক না জানা তথ্য। ২. লেখাটা নিজের ব্লগে সংরতি থেকে যাবে।
আমেরিকার আরোপিত ৪৫ বছরের কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা যা আজও পূর্ণ মাত্রায় বহাল আছে কিউবাতে। ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে দেশের ক্ষমতার পালা বদলের পর আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়া ভিন্নমতাবলম্বী কিউবানদের নিয়ে ১৯৬১ সালে সিআইএ (ঈওঅ) পরিচালিত একটি পূর্ণ মাত্রার সামরিক আগ্রাসন এবং বিভিন্ন সময়ে চালানো মোট ৬৩৮টি প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য হামলা ব্যর্থ করে দিয়ে প্রায় অর্ধ শতাব্দী, ৫০ বছর কিউবাকে শাসন করেছেন ইস্পাত কঠিন স্নায়ুর অধিকারী নেতা ফিডেল ক্যাস্ট্রো।
এ সময়ের মধ্যে আমেরিকার নয়জন প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতায় আসতে এবং পর্দার আড়ালে চলে যেতে দেখেছেন তিনি। কেনেডির গুপ্তহত্যাসহ তাদের কয়েকজনকে চির বিদায় নিতেও দেখেছেন। এ বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বাচলে হয়তো তার সময়কার দশম আমেরিকান প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় আরোহণও দেখে যেতে পারবেন।
২০০৬ সালের জুলাই থেকে এতোদিন অসুস্থতার কারণে ক্ষমতা থেকে দূরে সরে ছিলেন তিনি। এর মধ্যে বহুল আলোচিত-সমালোচিত এ নেতাকে নিয়ে মিডিয়ায় অনেক ধরনের জল্পনা-কল্পনা হয়েছে। কিউবান মিডিয়ায় প্রায়ই খবর প্রচারিত হতো তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। শিগগিরই আবার ক্ষমতা গ্রহণ করবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর হয়নি।
পুরোপুরি সুস্থ আর হতে পারেননি ফিডেল ক্যাস্ট্রো।
অবশেষে নিজের সময় ফুরিয়েছে বুঝতে পেরে তিনি নিজেই গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এ সম্পর্কিত সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়েছেন। নিয়তির অমোঘ বিধান মেনে নিয়ে নিজেকে পরিণতির হাতে সমর্পণ করেছেন তিনি। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি নিজের শারীরিক অক্ষমতার কথা অকপটে স্বীকার করে জাতির উদ্দেশে এক ঘোষণায় বলেছেন, তিনি খুব অসুস্থ। তাই কিউবার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না।
আমেরিকা-বৃটেনসহ বিভিন্ন পশ্চিমি দেশ, তার অজস্র সমালোচক ও দেশের বাইরের ও ভেতরের ভিন্নমতাবলম্বী, সবার জন্য হতবাক করা এ স্বীকারোক্তির মধ্যে দিয়ে নিজের সুদীর্ঘ কালের এবং বহু বিতর্ক সৃষ্টিকারী এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটালেন তিনি।
‘সব সময়ই আমার ইচ্ছা ছিল শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত দেশের সেবা করে যাওয়া’ কিউবার কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক গ্রানমা-য় গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ছাপা হওয়া এক আর্টিকলে লেখেন তিনি। ‘কিন্তু বর্তমানে আমার যে শারীরিক অবস্থা, তাতে দেশের জন্য কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিতে ক্ষমতা আকড়ে থাকা হবে দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। তাই আমি ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে চাইছি।
’
৮১ বছর বয়স্ক ফিডেল ক্যাস্ট্রোর এ ঘোষণা সারা বিশ্বে অনেকটা শক ওয়েভের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তার শত্রু-মিত্র সবাই ভাবতে থাকে, কিউবায় সত্যি সত্যি কোনো নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে কি?
গ্রানমা-য় ক্যাস্ট্রোর আর্টিকল ছাপা হওয়ার তিন দিন পর রবিবার জবাবটা পেয়ে যায় সবাই, যখন কিউবান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির কাউন্সিল অফ স্টেটের অধিবেশনে দেশের নতুন প্রেসিডেন্ট ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানের নাম হিসেবে তার পরিবর্তে ৭৬ বছর বয়সী ছোট ভাই রাউল ক্যাস্ট্রোর নাম ঘোষণা করা হয়।
কিউবার জনগণের ওপর এর কি প্রভাব পড়তে পারে? খবর পেয়ে আফ্রিকান দেশ রুয়ান্ডা সফররত প্রেসিডেন্ট বুশ প্রশ্ন করেন। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর শাসনামলে তারা নিষ্পেষিত হয়েছে। নিজেদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য তাদের জেল খাটতে হয়েছে।
তাদের মুক্ত সমাজে বাস করতে দেয়া হয়নি। তাই এটাকে আমি কিউবার জন্য পুরনো অধ্যায় থেকে নতুন অধ্যায়ে উত্তরণের শুরু হিসেবে দেখছি।
মিস্টার বুশের এ মন্তব্য প্রতিধ্বনিত হয় বৃটেনসহ বেশ কিছু ইওরোপিয়ান দেশ এবং ক্যাস্ট্রো সরকারের নিগ্রহের শিকার প্রবাসীর মুখে।
তবে ক্যাস্ট্রোর পদত্যাগের কারণে দেশে যে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে, সে বিষয়ে দেশের মানুষ তেমন নিশ্চিত নয়। আমেরিকা প্রবাসী এক কিউবান অসভালডো পায়ার মতে মিস্টার ক্যাস্ট্রো যে প্রশাসন গড়ে রেখে গেছেন, তার বিদায়ে সে প্রশাসনের মুঠো যে শিথিল হবে, সে রকম আশা তিনি করেন না।
অন্য অনেক কিউবানও অসভালডো পায়ার সঙ্গে একমত।
আমি বুঝতে পারছি না কি বলবো, বলেছেন হভানার এক গারবেজ কালেক্টর বা ময়লাওয়ালা আলেক্সিস। আমি কেবল এ সিস্টেমের হাত থেকে মুক্তি চাই। এ ব্যবস্থা চিরকাল চলতে পারে না।
উল্লেখ করা যেতে পারে, বছরের পর বছর কিউবানদের মধ্যে এমন একটা ধারণা প্রচলিত ছিল যে ফিডেল ক্যাস্ট্রোর মৃত্যু হলে বা তিনি পদত্যাগ করলে তার বিশেষ প্রশাসনের বিলুপ্তি ঘটবে।
নতুন প্রশাসন কেমন হবে, তার প্রধান কে হবেন, সে সম্পর্কিত কোনো ধারণা অবশ্য ছিল না সাধারণ মানুষের।
এক সময়ের অত্যন্ত সফল মাইক্রো ম্যানেজার ফিডেল ক্যাস্ট্রো দীর্ঘকাল থেকে দেশ ও প্রশাসনের নেতৃত্বই দিয়ে এসেছেন, কিন্তু তার উত্তরসূরি কে হবেন সে বিষয় এতোকাল অস্পষ্টই রেখেছেন। কিউবার মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের জন্মই হয়েছে তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করার পর, তাই শতকরা প্রায় পচাত্তর ভাগ কিউবান তাকে ছাড়া আর কোনো নেতা চেনে না। ক্যাস্ট্রো ছাড়া দুনিয়া অচল, এমন ভাবনায় অভ্যস্ত তারা।
ক্যাস্ট্রো কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা গ্রানমা-য় নিয়মিত লিখতেন।
এ রকম এক কলামে তিনি একবার লিখেছিলেন : ডিসেম্বরে তিনি আর অফিসে থাকবেন না।
আসল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কিউবান বলেন, ২০০৬ সালের জুলাইয়ে ক্যাস্ট্রো অসুস্থ হয়ে পড়ায় সবাই ধরে নিয়েছিল তিনি আর ফিরে আসছেন না। মানুষ তাকে ছাড়াই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল।
ওই সময়ে তলপেটে জটিল অপারেশন করা হয় ফিডেল ক্যাস্ট্রোর। তার আগে ছোট ভাই রাউল ক্যাস্ট্রোসহ আরো ছয়জনের হাতে অস্থায়ীভাবে দেশের ক্ষমতা অর্পণ করে গিয়েছিলেন তিনি।
এ পর্যন্ত রাউল যথেষ্ট কার্যকর ভাবেই দেশ পরিচালনা করেছেন।
তবে এ সময়ের মধ্যে রাউল টের পেয়ে গেছেন টিকে থাকতে হলে জনসাধারণের জন্য প্রশাসনকে কিছুটা ছাড় দিতেই হবে। দেশে অতিরিক্ত সংখ্যক ‘নিষেধাজ্ঞা’ বলবৎ আছে বলে সমালোচনাও করেছেন তিনি। শাসন ব্যবস্থার মধ্যে নানা ঘাটতি নিয়ে আলোচনার জন্য ন্যাশনাল ডিবেটের আয়োজন করেছেন।
এসব দেখে সাধারণ কিউবানদের অনেকে মন্তব্য করেন, জনগণকে রাজনৈতিকভাবে না হলেও অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা দেয়া ছাড়া রাউলের কোনো উপায় নেই।
হাভানার এক বিশ্লেষক কৌতুক করে বলেন, এখানকার মানুষ বলে তারা এতোদিন ফিডালিস্টাসের খপ্পরে ছিলেন, সোশালিস্টাসের খপ্পরে নয়।
খোলামেলা এসব মন্তব্যের পরও রাউল কিছু কিছু ক্ষেত্রে দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়েছেন। বিশ্লেষকদের ধারণা, নতুন প্রশাসনের অধীনে কিউবার সিস্টেমে কোনো পরিবর্তন যদি আসেও তা আসবে ধীরে ধীরে। সময় নিয়ে।
তাদের আশা রাউল কিউবানদের নতুন নতুন কাজের ক্ষেত্র বাড়ানোর দিকে নজর দেবেন।
সেসবের মধ্যে থাকবে হোটেল-রেস্টুরেন্ট ব্যবসা, ট্যাক্সি ড্রাইভিং প্রভৃতি। তবে সভিয়েট ইউনিয়নের পরিণতির কথা মনে রেখে তিনি হয়তো কিউবানদের যথেচ্ছ বিদেশ ভ্রমণ এবং পলিটিকাল পার্টি গঠন প্রভৃতির ব্যাপারে বিধি নিষেধ অতীতের মতোই বহাল রাখবেন।
কিছু কিছু কিউবা বিশেষজ্ঞের ধারণা চল্লিশ দশকের শেষ দিকে চিয়াং কাই শেকের কুয়োমিংটান বা জাতীয়তাবাদী সরকারকে উৎখাত করে কমিউনিস্ট মাও সে তুং যে নতুন মডেলের চায়নার গোড়া পত্তন ঘটিয়েছিলেন, রাউল হয়তো কিউবাকে তার সমকক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করবেন। একই সঙ্গে রাজনীতির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেই ধীরে ধীরে মুক্ত অর্থনীতির পথে পা বাড়াবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।