অনুতাপ নিপীড়িত ব্যাথিত জনের শক্তিধরে অস্ত্রধারী শত সিপাহের জলের ওপর বন দোলে...
রাকিব কিশোর
থইথই স্বচ্ছ পানিতে ভাসছে এই বন। সেই পানির আয়নায় সারাটা দিন নিজের চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে চিরসবুজের এই সোয়াম্প ফরেস্ট। নৌকা নিয়ে ঘুরতে হয় এই বনে। বানর আর সাপের সঙ্গে দোস্তি করে ঢুকতে হয়। এই বনটা মায়ার, এই বনটা ছায়ার, এই বনটা অনেক কিছু না-পাওয়াকে পাওয়ার।
সিলেটে অবস্থিত বাংলাদেশের ভাসমান বন এই ‘রাতারগুল ফরেস্ট’।
এ বছরের জুনের শুরুতে গিয়েছিলাম মিঠা পানির এই ভাসমান বন দেখার জন্য। বিধি বাম, মোটামুটি শুকনো কাদার ভেতর বনের গহিনে হেঁটেই ভ্রমণের পিপাসা মেটাতে হয়েছে সেবারের মতো। বুঝেছিলাম, এ বন দেখতে হলে আসতে হবে বর্ষাকালে। নীল-সবুজের রহস্যে হারিয়ে যেতে হলে ঢুকতে হবে জলের সঙ্গে।
তাই সেবার ঘাড় উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা জারুলগাছটাকে আবার আসব বলে কথা দিয়ে চলে এসেছিলাম ধুলোর নগরে।
জুলাইয়ের বৃষ্টিকে আরও কিছুদিন গা-ছাড়া ভাব নিয়ে পড়তে দিয়েছিলাম, যখনই খবর পেলাম সিলেটের বনে বান ডেকেছে, তখনই বেরিয়ে পড়লাম ছোট্ট পোঁটলাটা নিয়ে। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখি সেখানে নববিবাহিত রকি ভাই এবং রেদওয়ান দাঁড়িয়ে আছেন। নীল-সবুজের বন তাঁদেরও ডাকছে। ওদিকে ফেসবুকে খবর পেয়ে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে আহসান ভাই এবং লুৎফর ভাইও রওনা দিয়েছেন খুলনা থেকে।
বিশাল সুন্দরবন ফেলে তাঁরা আসছেন সুন্দর আরেকটা বন ছুঁয়ে দেখতে। পাঁচ সদস্যের এই দলের একটাই উদ্দেশ্য, একটা বিশাল বন কীভাবে জলের ওপর হেলে-দুলে ভাসতে থাকে সেটা দেখা।
সিলেট শহরে নেমেছি ভোর পৌনে পাঁচটায়, জনমানবহীন খাঁ-খাঁ রাস্তায় এগোচ্ছি একটা অটোরিকশার আশায়। গন্তব্য পাহাড়ের পাড় ঘেঁষে নীলচে পানিতে শুয়ে দোল খাওয়া আশ্চর্য সুন্দর এক উপজেলা গোয়াইনঘাট। অবশেষে একটি অটোরিকশা পাওয়া গেল, যেটি গোয়াইনঘাট যেতে চায়।
আর দেরি না করে উঠে পড়লাম তিন চাকার বাহনে।
ভরা বর্ষায়, ভেজা মেঘের কুয়াশার ভেতর দিয়ে সিলেট শহর পেছনে ফেলে বিমানবন্দরের রাস্তা ধরে এগোতে থাকলাম শালুটিকরের দিকে। এক পাশে পাহাড়ের সারি মেঘ কোলে নিয়ে ঘুমুচ্ছে, আরেক পাশে চেঙ্গীর খালের পানিতে পড়ি পড়ি করেও গা ছোঁয়াচ্ছে না ভোরের বৃষ্টি। এই চেঙ্গীর খাল জায়গাটা অদ্ভুত সুন্দর। খালের ওপর বিশাল একটা ব্রিজ শুয়ে আছে, সেখানে দাঁড়িয়ে পুরো শালুটিকর দেখা যায়।
খালের পানিতে শিকড় গেড়ে ভাসতে থাকা একেকটা বাড়িকে মনে হচ্ছে একেকটা দ্বীপ।
এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে বেড়াতে গেলেও নৌকা দিয়ে যেতে হয়। আমাদের অটোরিকশা এগোতে থাকল চেঙ্গীর খালের পাড় ধরে। সামান্য একটা ইটের রাস্তায় প্রকৃতির কত বিস্ময়, কত সৌন্দর্য যে লুকিয়ে থাকতে পারে, তা এখানে উঁকি না দিলে বুঝতে পারতাম না। দুই পাশে হাঁটু সমান পানি।
সে পানির রং আবার সাদাটে-নীল। দেখে মনে হবে যেন জলজ্যান্ত আকাশটা টেনে মাটিতে নামিয়ে এনেছে এই শুকনো একাকি রাস্তাটি। এই রাস্তা কিছু দূর সোজা গিয়েই খেয়ালি বালিকার মতো বেঁকে গেছে একদিকে। আরও কিছুটা গিয়ে দুষ্টু বালকের মতো লাফ দিয়েছে ব্রিজের ওপর দিয়ে। মাঝেমধ্যে খেলার মেজাজে কয়েক ফুট করে ডুব দিয়েছে ক্রমশ জমতে থাকা পাহাড়ি ঢলে।
আশ্চর্য সুন্দর এই রাস্তার এক পাশজুড়ে রয়েছে ভারতের পাহাড়গুলো। আরেক পাশে রয়েছে জলে ভাসতে থাকা মুগ্ধ বাংলাদেশ।
সকাল ১০টায় আমরা পৌঁছালাম গোয়াইনঘাট বাজারে। সেখান থেকে একটা ট্রলার রিজার্ভ নিলাম ‘রাতারগুল’ বনের উদ্দেশে। ভারতের পাহাড় থেকে ঝরছে ছোট-বড় অসংখ্য ঝরণা।
সেগুলোর পানিই মিশেছে এখানে। কাচের মতো স্বচ্ছ পানি। এক টানে ৮-১০ ফুট পরিষ্কার দেখা যায়। আশপাশে মোষেরা গা ডুবিয়ে আয়েশ করে ঢেঁকিশাক চিবুচ্ছে। আমাদের ট্রলারের পানি তাদের গায়ে লাগতেই ঘাড় ঘুরিয়ে মৃদু একটা ধমক দিয়ে আবার দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে শাক চিবুতে থাকে।
একসময় ট্রলার ভেড়ে ‘রাতারগুল’ ফরেস্টের বিট অফিসে। সেখানে চকচকে নতুন নৌকা নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন বিট অফিসের কর্মী হুমায়ুন ভাই। পড়িমরি করে সবাই ছোট নৌকায় উঠতে গিয়ে দেখি লুৎফর ভাই গায়েব। বন বিভাগের টয়লেটে গিয়ে তিনি বিপুল বিস্ময়ে চেয়ে আছেন পেছনের বিশাল বনের দিকে। সেখানে পানির দোলনায় দুলছে হিজলের বন।
সেই সম্মোহন এড়ানো অসম্ভব। কোনোমতে তাঁকে ঠেলেঠুলে নৌকায় ওঠালাম। জানালাম, হাঁ করে থাকার সুযোগ সামনে আরও আছে। রওনা দিলাম পানির দেশে।
বনের সীমানায় ঢুকতেই এলোমেলো হয়ে গেল আগে থেকে সাজিয়ে রাখা সব পরিকল্পনা।
চোখের সামনে তব্দা মেরে দেওয়া সবুজের মশারি, টলটলে পানি হইচই করে ছুটে যাচ্ছে এক গাছের কোল থেকে আরেক গাছের বুকে। পাতাগুলো নিচু হয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি খেলছে পানির সঙ্গে। বনে ঢোকার পর থেকেই নিশ্চুপ হয়ে গেছেন সারাক্ষণ বকবক করতে থাকা রকি ভাই। একটু শব্দও যেন এ বনে মানায় না। ছলাৎ ছলাৎ শব্দে নৌকা চলছে গাছের ডাল ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
মাঝেমধ্যে ডালের বাড়ি খাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে শুয়ে পড়ছে সবাই।
হিজল আর করচগাছের গড়নটাই আলাদা। অনেকটা জিগজ্যাগ আকারে বেড়ে উঠেছে এই গাছগুলো। কাচের মতো স্বচ্ছ পানিতে ক্রমাগত নড়ছে তাদের প্রতিবিম্ব। ভাবতে অবাক লাগে, এক মাস আগে এই বনের মাঝ দিয়ে খালি পায়ে হেঁটেছিলাম।
এখন সেখানে ১০ ফুট পানি। রোদের আলো পড়ে একেবারে তলার মাটি পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সেখানে জেলেরা ব্যাঙ বেঁধে টোপ হিসেবে ঝুলিয়ে রেখেছেন বোয়াল মাছ ধরার জন্য। প্রতিটি গাছের শিকড় দুলছে পানির ওপর। ইচ্ছা হলে নৌকা থেকে লাফিয়ে নেমে গোসলও করা যেতে পারে ঠান্ডা এই পাহাড়ি জলে।
কিন্তু সেটা করতে দিলেন না হুমায়ুন ভাই। চোখ গাছের ওপরে তুলে আমাদের দেখালেন দুইটা সাপ চুপচাপ শুয়ে শুয়ে অতিথিদের দেখছে। এখন আপ্যায়ন না করতে চাইলেই হয়! সাপ দেখে চুপসে যাওয়া রেদওয়ানকে ঠেলেঠুলে উঠিয়ে বানরের ঝাঁক দেখালেন আহসান ভাই। আমাদের দেখেও তারা কোনো গা করল না।
এর মধ্যেই আকাশ কালো করে মেঘ ধেয়ে এল।
প্রকৃতি নিজের কাছে রাখা সব সৌন্দর্য একেবারে উজাড় করে দেখাতে চায় আগত অতিথিদের। টুপটাপ বৃষ্টি শুরু হলো ‘রাতারগুল’ জুড়ে। এতক্ষণ চুপচাপ শান্ত হয়ে থাকা বনটা মুহূর্তেই নড়েচড়ে উঠল। গাছগুলো যেন গা-ঝাড়া দিয়ে শরীর থেকে পানি ফেলে দিচ্ছে। পাতার সাপগুলো হেলে-দুলে নেমে গেল পানিতে।
অনেকক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া হয়েছে। এবার খাবার খোঁজার পালা তাদের। আমরাও চাইনি তাদের খাবার হতে। তাই ভাসমান এই বন থেকে বের হয়ে এলাম।
নৌকা ছেড়ে আমাদের ট্রলারে করে ধীরে ধীরে ভাসমান বনটা ফেলে আসছি।
আর বারবার পেছন ফিরে তাকাচ্ছি। আবার আসব এই বনে। ভরা পূর্ণিমায় চাঁদের আলোতে গাছের ফাঁকে ফাঁকে থইথই পানিতে উথাল-পাথাল জ্যোৎস্না দেখতে আবার আসব এই ঢেউয়ের বনে।
কীভাবে যাবেন
সিলেট থেকে দুভাবে ‘রাতারগুল’ বনে যাওয়া যায়। বিমানবন্দরের পাশ ঘেঁষে শালুটিকর পাড়ি দিয়ে চেঙ্গীর খালের মায়াবী রাস্তাটি দিয়ে গোয়াইনঘাট বাজার পর্যন্ত অটোরিকশায় যাবেন।
সিলেট থেকে গোয়াইনঘাট পর্যন্ত অটোরিকশা ভাড়া নেবে ৪৫০ টাকা। সেখান থেকে একটা ট্রলার ৮০০ টাকা দিয়ে ভাড়া করে চলে যাবেন ‘রাতারগুল বনে’। আর সৌন্দর্যের বাকি অংশটুকু দেখতে হলে বনে ঢুকতে হবে ছোট্ট একটা নৌকা নিয়ে। ফেরার পথে গোয়াইনঘাট নেমে জাফলংয়ের ঠান্ডা পানিতে গোসলটা সেরে আসতে পারেন। ওটা খুব বেশি দূরে নয়।
আর অন্য পথটা হলো সিলেট থেকে মোটরঘাট হয়ে। সেটার কথা নাই বা বললাম। জীবনে যদি মনে রাখার মতো কোনো স্মৃতি নিয়ে ঘরে ফিরতে চান, তাহলে গোয়াইনঘাটের রাস্তাটা দিয়েই ঘুরে আসুন।
‘রাতারগুল’ যেতে চাইলে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যাবেন। এর পরে বা আগে গেলে বনে পানি পাবেন না ।
Click This Link ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।