আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে একে দেব পদচিহ্ন/ আমি স্রষ্টা-সূদন, শোকতাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন প্রথমেই বলে রাখি যারা এই বিষয়টার ওপর জ্ঞানী-গুণী, প্রবল বিজ্ঞ, তুখোড় বিশ্লেষণ, আর অসংখ্য রেফারেন্স আশা করেন, তারা যেন আমার এই লেখাটি না পড়েন। আমার এই লেখাটি স্রেফ আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং মতামতের আলোকে লেখা।
গত ১২ই অগাস্ট স্বাস্থ্য ও পরিবার-কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক নেয়া এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, এবার থেকে এস.এস.সি. এবং এইচ.এস.সি পরীক্ষার সম্মিলিত ফলাফল অনুযায়ী মেডিকেল কলেজগুলোতে নবাগত শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। নূণ্যতম ৮ জি.পি.এ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে এই নির্বাচন করা হবে। আমার ভেবে অবাক লাগছে, সম্পূর্ণ মহাজোট সরকারের মধ্যে কি একজনও এমন ছিল না যে এই সিদ্ধান্তটা সম্পর্কে একটু চিন্তা করতে পারল না?
সরকারের পক্ষ থেকে এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, ‘প্রতিবছর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা ব্যাপকহারে কোচিং সেন্টারগুলোতে ভর্তি হয়।
এটি বন্ধ করার জন্যেই সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর থেকে হাস্যকর অজুহাত আর কি হতে পারে? সরকার এখন মেডিকেল ভর্তি কোচিং বন্ধ করতে ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ করে দিয়ে এস.এস.সি আর এইচ.এস.সি পরীক্ষার ভিত্তিতে ভর্তি করাবে। তখন, ছাত্র ছাত্রীরা এস.এস.সি আর এইচ.এস.সি.পরীক্ষার কোচিংয়ে ছুটবে। তখন সরকার আবার এস.এস.সি আর এইচ.এস.সি.পরীক্ষার কোচিং বন্ধ করার জন্যে এস.এস.সি আর এইচ.এস.সি.পরীক্ষাই বন্ধ করে দেবে। কি অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা আমাদের সরকারের!
পরদিন যা হবার ঠিক তাই হল।
শিক্ষার্থীরা এই হাস্যকর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমে এলো। প্রতিবাদ শুধু ঢাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। বরং দেশের প্রতিটি শহরে প্রতিবাদের খবর পাওয়া গেল। নতুন পদ্ধতি বাতিলের দাবিতে গতকাল চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, দিনাজপুর, টাঙ্গাইলে মানব-বন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এই আন্দোলনের সময় আমার পিসি নষ্ট ছিল।
তাই অনলাইনে এর প্রতিবাদ সম্পর্কে ঠিক মত জানতে বা অংশগ্রহণ করতে পারি নি। তখন আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমাকে বলে আমাদের কিছু বড় ভাই আগামীকাল শহীদ মিনার থেকে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলনে নামছে। আমি যাব কি’না তার সম্পর্কে জানতে চায়। আমি এখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছি। তার থেকে বড় কথা মেডিকেলে ভর্তি হবার কোন ইচ্ছেই আমার নেই।
কিন্তু, আমার মনে হয়েছিল সরকারে নেয়া এই সিদ্ধান্তটি ভুল। হয়ত এর দ্বারা আমি নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি না, কিন্তু দেশের নাগরিক হিসেবে এই ভুল সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করা আমার দায়িত্ব। তাই, পরদিন শাহবাগের আন্দোলনে আমি নিজেও অংশ নিই।
এখন নিজের অবস্থানের কিছু কারণ ব্যাখ্যা করি:
আগামী ১২ অক্টোবর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হবে। মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষাও কাছাকাছি সময়ে হয়ে থাকে।
গত বছর ২৩ সেপ্টেম্বর সারা দেশে একযোগে সরকারি ও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা হয়। বাংলাদেশের সব মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজ মিলিয়ে মোট আট হাজার ৪৯৩টি আসন রয়েছে। এস.এস.সি. ও এইচ.এস.সি. জি.পি.এ-৫ পেয়েছে, এ রকম পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ হাজারের কাছাকাছি, এদের ভেতর থেকে দুই হাজার ছেলেমেয়ে কেমন করে আলাদা করা হবে? এর সম্পর্কে অনুসন্ধান করে জানতে পারি যদিও এই দেশে এস.এস.সি. ও এইচ.এস.সি. পরীক্ষায় নম্বর তুলে দিয়ে গ্রেড পদ্ধতি করা হয়েছে কিন্তু সেই নম্বরগুলো কোনও এক গোপন জায়গায় রাখা থাকে। সেই গোপন নম্বরগুলো গোপনে ব্যবহার করে খুবই গোপনে কিছু ছেলেমেয়েকে বেছে নেওয়া হবে। এই অসাধারণ পদ্ধতির কথা শুনে আমি হতবাক! এমনিতেই এই পদ্ধতি আমাদের কলেজে ভর্তি পরীক্ষার পরিবর্তে ব্যাবহার করায় কেউই খুশি নয়।
আমি নিজেই যখন জানতে পারছি না আমি কত নম্বর পেয়েছি আর আমার পরিবর্তে একই গ্রেড পেয়ে যে চান্স পেল সে কত নম্বর পেয়েছে, তখন কি যুক্তি আছে আমার সেটি মেনে নেবার?
আবার ধরা যাক, একটা ছেলে বায়োলজিতে খুব ভাল। কিন্তু তার বাংলায় এ+ আসেনি। তার মানে বায়োলজি ভাল পারা সত্ত্বেও সে মেডিকেলে চান্স পাবে না বাংলার কারণে। এটি কতটা যৌক্তিক?
তার থেকেও বড় কথা হচ্ছে আমাদের দেশের এস.এস.সি/এইচ.এস.সি পরীক্ষা কতটা মানসম্পন্ন? কয়েক দিন আগে আমার এক বন্ধুর কাছে শুনতে পাই, ‘তার এক পরিচিত ছেলের সব বিষয়ে এ+ কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানে এসেছে এ- খাতা পুনর্বিবেচনার আবেদন করেও লাভ হয়নি। পরে প্রায় হাজার পঁচিশেক(সব ধরণের খরচসহ) টাকা খরচ করে সে তার খাতা দেখতে চায় পরে দেখা যায় তার আগের ছাত্রের সাথে তার খাতা গুলিয়ে গেছে।
সে আসলে গোল্ডেন এ+ ই পেয়েছে। ’ একই ঘটনা যে অন্য কারও ক্ষেত্রে ঘটেনি তার নিশ্চয়তা কি? এটাই আমাদের এস.এস.সি/এইচ.এস.সি পরীক্ষার চিত্র। তার ওপর নির্ভর করে একজন শিক্ষার্থীর সারাটা জীবন। আমার নিজের স্কুলেই আমাদের প্রথম তিনজন ছাত্রের গোল্ডেন এ+ আসেনি। অথচ, দ্বিতীয় শাখার রোল ৩ গোল্ডেন এ+ পেয়েছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে সে যেই ছেলেটার খাতা হুবহু দেখে গোল্ডেন এ+ পেল সেই ছেলেটারই গোল্ডেন এ+ আসেনি।
আন্দোলনটা শুরু হবার সাথেই শুনতে পাই, ‘এই আন্দোলনে মদদ দিচ্ছে দেশের কোচিং সেন্টারগুলো। আমার বাবা শাহবাগ থানার সাব-ইন্সপেক্টর। তার কাছেই জানতে পারি ঘটনা সত্য। বেশ কিছু পত্রিকাও তাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করে: প্রথম আলোর দু’টি রিপোর্টে বলা হয় “ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের উসকানি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কয়েকটি কোচিং সেন্টারের বিরুদ্ধে।
কোচিং সেন্টারগুলোর জমজমাট ব্যবসাকেন্দ্র রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকেই গতকাল সোমবার বেলা ১১টার দিকে কিছু শিক্ষার্থী মিছিল বের করেন। উল্লেখ্য, জি.পি.এ. এর ভিত্তিতে ভর্তি শুরু হলে কোচিং ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। ” আরেক রিপোর্ট বলা হয় “গত রোববার স্বাস্থ্য ও পরিবার-কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পরীক্ষা-বিষয়ক নীতিনির্ধারণী সভায় পরীক্ষা ছাড়াই ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে এম.বি.বি.এস. ও বি.ডি.এস. কোর্সে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তির সিদ্ধান্ত হয়। এই খবর প্রচারিত হওয়ার পরই গত রোববার বিকেল থেকে বিভিন্ন কোচিং সেন্টারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে মুঠোফোনে খুদে-বার্তা পাঠানো হয়। ”
এত অবাক হবার কিছু নেই।
কোচিং সেন্টারগুলো যেহেতু এই ভর্তি পরীক্ষার ওপরই টিকে আছে তাই তারা এটি টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করবেই। আমি নিজেও খুব ভাল করেই জানি ভর্তি পরীক্ষার জন্যে শিক্ষার্থীরা কতটা গণহারে কোচিং সেন্টারগুলোতে ভর্তি হয়। আমি নিজেও কলেজ ভর্তি পরীক্ষার জন্য একটা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছিলাম। অবশ্য পাঁচটা দিন ক্লাস করার পর বুঝতে পারলাম, এর চেয়ে বরং যদি এই সময়টা আমি আমার পাঠ্যবইয়ে শুধু চোখ বুলিয়েও যাই তাহলেও আমার অনেক বেশি উপকার হবে। নিজে মুখস্থ-বিদ্যাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করি বলেই আর এগোই নি।
তাছাড়া পরিবার থেকেও যথেষ্ট স্বাধীনতা আমি পাই। কিন্তু আমার মত স্বাধীনতা আমাদের ৯৯% শিক্ষার্থী পায় না। প্রথম আলোতে সম্প্রতি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার বলেন, “পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমাদের সবার দায়িত্ব এই ছেলেমেয়েগুলোকে কিছুদিনের জন্য হলেও একটু বিশ্রাম নিতে দেওয়া, একটু স্বস্তিতে থাকতে দেওয়া। কিন্তু তারা এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম নিতে পারে না। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর-মুহূর্ত থেকে তাদের ভর্তি কোচিং শুরু হয়ে যায়।
দেশে বিশাল বিশাল কোচিং সেন্টার তৈরি হয়েছে, মাফিয়া থেকেও তারা বেশি ক্ষমতাশালী। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন তারা বের করে ফেলে, পরীক্ষার্থীদের অভিভাবকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়ে গোপনে সারা রাত পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করিয়ে পরদিন পরীক্ষা দিতে নিয়ে যায়। ”
কিন্তু, কোচিং সেন্টারের এতে ভূমিকা কতটুকু? আমি নিজেই বলেছি, নিজে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়েও আমি গিয়েছি স্রেফ বিবেকের তাড়নায়। আর যারা সরাসরি এর জন্য ক্ষতিগ্রস্ত তারা কি ছুটে আসবে না? ভাড়া করে বা উস্কানি দিয়ে ছোটখাটো রাজনৈতিক কর্মসূচি সফল করা যায়। আন্দোলন হয় না।
আন্দোলন করতে হলে ভেতর থেকে প্রেরণা লাগে। সেটা তাদের আছে বলেই এমনটা হয়েছে।
অনেকেই বলছে, ‘মেডিকেলের এক ঘণ্টার ভর্তি পরীক্ষা কেবল মুখস্থ-বিদ্যার প্রদর্শন। ’ আমার প্রশ্ন হচ্ছে আমার এস.এস.সি/এইচ.এস.সি পরীক্ষা কি ভিন্ন কিছু? আর তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে যদি এই পদ্ধতি মুখস্থ-ভিত্তিক হয়েই থাকে তবে পদ্ধতি বদলাতে হবে। মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলে দেয়া হাস্যকর।
আন্দোলনকারীদের দেয়া স্মারকলিপিতে বলা হয়, “অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী এস.এস.সি. বা এইচ.এস.সি. জি.পি.এ-৫ পায় না। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষায় নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে মেডিকেলে ভর্তি হতে পারেন। কিন্তু জি.পি.এ-৫ বা প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী ভর্তি করা হলে তাঁদের আর কোনও সুযোগ থাকবে না। ”
সবশেষে বলব সরকার যে দুর্নীতির স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার সবথেকে বড় প্রমাণ হচ্ছে, এই সিদ্ধান্ত শুধু মেডিকেলের জন্য নেয়া হল কেন? যদি সরকার সত্যিই কোচিং বন্ধ করতে চাইত তবে, একসাথে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ করা হত। কিন্তু সেটা হয়নি।
এর থেকে প্রমাণিত হয় সরকারের সিদ্ধান্ত কোচিং সেন্টার বন্ধ করার সিদ্ধান্ত শুভ নয়। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।