আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্কুল শিক্ষক: দারিদ্রতার বৃত্তে ঘুরপাক খাওয়া একটি ঘুড়ি

পৃথিবীতে অনেক মানুষ। সবারই দুটি চোখ কিন্তু এদের বেশিরভাগই অন্ধ। একটি পরিবার। সদস্য সংখ্যা ছয়। তিন ছেলে এক মেয়ে নিয়ে দেখতে বেশ ছিমছাম গুছানো সংসার।

পরিবার কর্তা সমাজের সম্মানিত ব্যাক্তি। সমাজে ভদ্র হিসেবে গণ্য। কোনো ঝামেলাহীনভাবেই কেটে যাচ্ছে সংসার। সুখী সংসার যাকে বলে আরকি। সর্বস্তরের লোকজনই তাকে সম্মান করে।

তবে প্রভাব-প্রতিপত্তি তার কিছুই নেই। তাতে কি? সবাই তাকে সমীহ করে। ব্যক্তি হিসেবে তিনি সমাজ সচেতনও বটে। এতক্ষণ যা বললাম, তা একজন শিক্ষকের জীবনের একটি দিক। যে দিকটি সূর্যের আলোর পাশে অবস্থিত।

যার কারণে আমরা সহ পুরো সমাজ সেটা দেখতে পারি। এখন প্রশ্ন, তাহলে অপর পাশটি? হ্যাঁ, অপর পাশটি আমরা দেখতে পাই না। কারণ ওটা যে অন্ধকার হয়ে আছে। অন্যভাবে বললে, এটা যে সূর্যের উল্টোদিকে আছে। আর যদি আরেকটু খোলাসা করে বলি তাহলে শিক্ষক তার জীবনের এই অংশটি সচেতনতার সাথে আড়াল করে রেখেছেন।

অবশ্য এ জন্য তাকে কোনো দোষ দেওয়া যায় না। কারণটাও ব্যাখ্যা করবো। তবে তার আগে কয়েকটি ঘটনা শুনুন। ছয়জনের সংসারে কাপড়চোপড় কম নয়। বেশ কাপড়চোপড়ই লাগে তাদের।

যা আবার অতিরিক্ত বলা চলে না। আরাফাত সাহেব তার পরিবারের জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাপড়-চোপড় কখনওই ক্রয় করেন না। কিন্তু যে অল্প কয়টা কাপড়চোপড়ই উনি কিনেন না কেন, এগুলো গুছিয়ে রাখার মতো তার ঘরে কোনো বস্তু নেই। না কোনো ওয়ারড্রপ, না কোনো আলমারী। সদ্য ক্রয় করা কয়েকটি নতুন হ্যাংগারই তার ভরসা।

তাছাড়া ঘরের আরও কিছু জিনিসপত্র আলমারীর অভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। আরাফাত সাহেব থানা সদরের একটি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। মাস শেষে পাওয়া ফিক্সড মাইনে দিয়েই তার চলতে হয়। এর বেশি খরচ করার কোনো সামর্থ তার নেই। খরচ করলেই দেনা বেড়ে যাবে।

এখন দেনার যা অবস্থা, তা সহ্য করার মতো। কিন্তু এর থেকে যদি বেড়ে যায়, তবে আরাফাত সাহেবের পক্ষে তা বহন করা কঠিন হয়ে যাবে। তবে আরাফাত সাহেব বার বার শুকরিয়া আদায় করেন যে, তার সংসারে অসুখ-বিসুখ কি জিনিস তা কেউ চিনে না। অসুখ জিনিসটা তার সংসারে নেই বললেই চলে। তবে একটি দুশ্চিন্তা আরাফাত সাহেবেকে সব সময় ভুগায়।

যদি কোনো সময় সংসারের কেউ অসুস্থ হয়, তবে এই খরচ উনি কিভাবে আঞ্জাম দিবেন? গত বছর মেয়েটার অজানা এক জ্বরের চিকিৎসা করতেই তাকে ঋণ করতে হয়েছে। যা এখনও শোধ করা হয়নি। কয়েক বছরের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য অসুস্থতা বলতে এটাই। এই মাপা মাপা খরচের খাতায় আলমারী বা ওয়ারড্রোপের খরচটা যে অনেকটা পাহাড় সমান। তবে আরাফাত সাহেবের স্ত্রী শাহনাজ বেগম এই পরিস্থিতি কিছুতেই মানতে রাজি না।

তার বক্তব্য হলো, ওয়ারড্রোপ না অন্তত একটি আলমারী খুবই জরুরী। তাতে ঘরের অন্যান্য টুকটাক জিনিসপত্রও রাখা যাবে। অন্যদিকে আরাফাত সাহেবের যুক্তি হলো, এই সামান্য টাকাটাই কোথা থেকে আসবে? এই তর্ক বহুদিন চলতে থাকলো। তবে তর্কের একটি শব্দও ঘরের বাইরে যায়নি। শুনেনি ভদ্র সমাজের কেউ।

এভাবে আরও পাঁচটি বছর কেটে গেলো। আরাফাত সাহেব একদিন একটি আলমারী কিনিয়ে আনলেন। তের হাজার টাকা দামের একটি স্টিলের আলামারি তার ঘরে আসলো। আমরা এবং সমাজ দেখলো, আরাফাত সাহেব বেশ স্বচ্ছল হয়েছেন। ঘরে ষ্টীলের আলমারী আনিয়েছেন।

এখন আমি আপনাদের দেখাতে চাই, সূর্য়ের উল্টোপাশের চিত্র। তর্কটি ছিল শাহনাজ বেগমের ছলনা। একটা নাটকও বলতে পারেন। তবে অভিনয়ের খাতিরে নয় জীবনের তাগিদে। শাহনাজ বেগম লুকিয়ে লুকিয়ে আলমারীর জন্য সঞ্চয় করছেন।

বিভিন্ন খরচ থেকে তিনি কাটছাট করে কিছু টাকা আলাদা করে রাখছেন। কিন্তু বিপদ ঘটলো একদিন। মুখ ফসকে প্রায় বলেই ফেলেছিলেন স্বামীর কাছে। তারপর থেকে স্বামীর মুখ বন্ধ করার জন্য শাহনাজ বেগম শুরু করলেন এই বাহানা। যেন স্বামী কোনোমতেই টের না পায় যে, তিনি টাকা জমাচ্ছেন।

কারণ স্বামীর হাতে গেলেই টাকাটা সংসারের কাজে বা ঋণ পরিশোধে খরচ হয়ে যাবে। পাঁচ বছরের শাহনাজ বেগমের সঞ্চয় এবং আরাফাত সাহেরেব দুই হাজার টাকা ঋণের সমন্বয়ে এই আলমারী। সমাজ দেখেছে তের হাজার টাকার আলমারী। কিন্তু দেখতে পায়নি আরাফাত সাহেবের পরিবারের পাঁচ বছরের কষ্ট। দেখতে পারেননি একটি নারী তার স্বাদ-আহ্লাদ, শখ বিসর্জন দিয়ে টাকা জমাচ্ছে, সংসারের জন্য একটি আলমারী কিনবে বলে।

দেখতে পারেনি, কাপড় কিনতে হবে বলে একটি মহিলা তার স্মৃতি জড়িত বিয়ের কাপড়গুলো ট্রাংক থেকে বের করে ব্যবহার করছে। দেখতে পারেনি পাঁচটি বছর একটি পরিবার কিভাবে মুখরোচক খাবার থেকে বহুদূরে বসবাস করেছে। দেখতে পারেনি, এক মায়াবতী গৃহিনীর চোখের জলে ভিজে উঠা আঁচলের কোণটি। দেখতে পারেনি, নিঝুম রাতে ঢুকরে কেঁদে উঠা অসহায় গৃহীনির আর্তনাদ। ওই যে বলেছিলাম, এই পাশটি সূর্যের উল্টোদিকে! গতকাল এক জেলের সাথে কথা বলছিলাম।

যে কিনা একটি জেলে গ্রুপের সাথে কাজ করে। তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, সে দৈনিক ২৫০ থেকে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত পায়। এখন গড়ে যদি দৈনিক তার আয় ৩৫০ টাকা ধরি, তাহলে তার মাসিক আয় হচ্ছে প্রায় ১০,০০০ টাকার উপরে। যা দিয়ে জেলে ষ্ট্যাটাসের একটি পরিবার মোটামুটি ভালভাবেই চলতে পারে। এখন আসুন একজন স্কুল শিক্ষকের পরিবারের দিকে।

একজন স্কুল শিক্ষক যে বেতনটুকু পান তা দিয়ে কি তার সংসার চলে? আমরা কি কখনো খোঁজ নিয়ে দেখেছি শিক্ষকদের সংসারগুলো কিভাবে চলে? না! আমরা এই সমাজের লোক জানি না। শিক্ষকরা কিভাবে তার সম্মান বাচিয়ে, আত্মমর্যাদার খাতিরে, মুখলজ্জার কারণে অভাবে থেকেও অভাবকে লুকিয়ে রাখছে এই খবর আমরা সমাজের মানুষেরা জানি না। এ জন্য তাকে কোনো দোষ দেয়া যায় না। তার স্ট্যাটাস যদি সমাজে জেলের সমান হতো, তার সম্মান যদি জেলের সমান হতো, মানুষের দৃষ্টিতে তিনি যদি জেলের মতো সাধারণ মানুষ হতেন, তবে তিনিও পারতেন। কিন্তু তিনি তো জাতির পথপ্রদর্শক।

আগামী দিনের সম্ভাবনার বাতি জেলে দিচ্ছেন আমাদের প্রতিটি সন্তানের হৃদয়ে। আমরা কি ভাবছি, তাকে এই ৫/৬ হাজার টাকা দিয়েই তার কর্মের পরিপূর্ণ প্রতিদান দিয়ে দিচ্ছি। এরকম ভেবে থাকলে আমি বলবো, কখনওই না। কখনওই না। শিক্ষকের শ্রমের এই প্রতিদান কখনওই আমাদের পক্ষে আদায় করা সম্ভব নয়।

আর আদায় করার চিন্তাও কোনোদিন আমরা করিনি। তাই আজ অবস্থার দিকে একবার তাকানতো। শিক্ষাটাকে নিয়ে একদল লোক ঝুঁকিহীন ব্যবসা শুরু করেছে। যেখানে টাকা ছাড়া কোনো কথা নেই। টাকা দিবেন শিক্ষা নিবেন।

Give an take ষ্টাইলে। আমরাও ঝাঁপিয়ে পড়ছি। যেখানে বেশি টাকা সেদিকেই দৌড়াচ্ছি, ভাবছি ওখানেই সবচেয়ে ভালো সার্ভিস পাওয়া যাবে। হ্যাঁ, এটা এখন সার্ভিস সেন্টার। শিক্ষালয়ের গন্ধ এর গা দিন দিন লোপ পাচ্ছে।

আজকে এ বিষয়ে এর চেয়ে বেশি বলবো না। সরকারী স্কুলের শিক্ষকদেরকে দিয়ে বর্তমানে বাইরের অনেক কাজও করানো হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলি, বর্তমানে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ তাদের দিয়েই করানো হচ্ছে। আর প্রাইভেট স্কুলগুলোতে শিক্ষকদেরকে দিনমজুরেরর মতো খাটানো হচ্ছে। শিক্ষকরা সেখানে মর্যাদার জন্য বা জাতির সেবার জন্য নয়, কাজ করছেন টাকার জন্য।

Just like a worker. এই কথাগুরো শুনার পর কেউ যদি আমার দিকে আঙ্গুল তুলতে চান, তবে তার জন্য এতটুকু জানিয়ে রাখছি যে, আমিও কিছুদিন ঢাকার একটি নামকরা প্রাইভেট স্কুলে শিক্ষকতা করেছি। আর এটুকুও জেনে রাখা দরকার যে, একজন স্কুল শিক্ষকের সংসার খুব কাছ থেকে দেখেই কথাগুলো বলছি। কারণ স্কুলশিক্ষক এর সন্তান আমি। যাক, কথা সেটা না। কথা হলো, স্কুল শিক্ষক যে সামাজিক পদমর্যাদার বিষয় তার সাথে তার বেতনের কোনো সংগতি নেই।

বাধ্য হয়ে শিক্ষককে অন্য আরও কোনো রাস্তার সন্ধান করতে হয়। যেন সংসারটা এই উর্দ্ধমুখী বাজারে টালমাটাল হয়ে না যায়। কারণ বাজারে মূল্যস্তর যে হারে বাড়ছে শিক্ষকের বেতন তার ১০% হারেও বাড়ছে না। তাই সে বাধ্য অন্য কিছু করতে। হয়তো তাকে টিউশনি করতে হয় অথবা অন্য যেকোন কিছু।

আমি একজন শিক্ষককে দেখেছি, শিক্ষকতার পরের সময়টুকু সে দোকানদারি করে। চিন্তা করুন তো, বিষয়টি কতটুকু দৃষ্টিকটু। একজন শিক্ষক তার সংসারের খরচ সামলাতে দোকানদারী করছে। দোকানদারী করাটাকে আমি কখনও খাটো করে দেখি না। তাই বলে একজন স্কুলশিক্ষকের দোকানদারী করাটাকে আমি মেনে নিতে পারিনি।

আপনারা পারবেন কি না, আমি জানি না। বাড়তি ইনকাম করতে গিয়ে অনেক সময় নৈতিকার সংজ্ঞার বাইরে চলে যান শিক্ষক। তখন আপাতদৃস্টিতে আমরা তাকে ঘৃ্ণ্য হিসেবে গণ্য করি। শিক্ষক জাতির কলংক হিসেবে চিহ্নিত করি। কড়া সমালোচনা করি।

কিন্তু একবারও কি ভেবেছি, আচ্ছা ওই শিক্ষকের মাসিক বেতন কতো? তার সংসারে মাসিক খরচ কতো? প্রতিমাসের খরচের যে ঘাটতিটুকু, সেটা পুরো হয় কিভাবে? না আমরা খোঁজ নেইনি। কারণ ঐ যে বলেছিলাম, এ পার্শ্বটি সূর্যের উল্টোদিকে। সর্বশেষ যেটা বলতে চাই সেটা হলো, শিক্ষকের ব্যালেন্স শীটের দিকে কি আমরা কখনওই তাকাবো না? এভাবেই কি চলতে থাকবে শিক্ষকদের জীবন। সেই পুরোনো বৃত্তেই ঘুরপাক খাবে তাদের জীবন ঘুড়ি ??? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.