আমার স্কুল: গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল ঢাকা
আমার স্কুল ছিল ঢাকার গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল। স্কুল জীবনে আমি এতটা দুষ্ট ছিলাম না। শান্ত শিষ্ট ভদ্র স্বভাবের- স্যার রা খুব পছন্দ করতেন- সবসময় সামনের বেঞ্চে বসতাম প্রতিদিন- ক্লাসে মোটেই দুষ্টামি করতাম না।
এ হেন আমি একদিন আমর এক বন্ধুর সাথে মিলে করেছিলাম মহা -দুষ্টামী।
তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি- আমার বন্ধু প্রতীক একদিন কোথা থেকে যেন যোগাড় করে আনলো কাগজে মোড়া এক ধরণের লোমের মত দেখতে সাদা সাদা অদ্ভূত বস্তু।
আমাকে চুপি চুপি জানালো এগুলোর নাম বিড়াল চিমটি - গায়ে লাগলে খুব চুলকায়। আমি বল্লাম এগুলো দিয়ে কি হবে? সে বল্ল- টিফিনের সময় সবাই বাইরে গেলে তুই আমাকে সাহায্য করবি- কাজ আছে। আমি সরল বিশ্বাসে ( আমাদের বর্তমান আমলাদের মত দায় মোচন অধ্যাদেশের সুযোগ নিয়েতার কথায় রাজী হলাম। কি করতে হবে? না তেমন কিছু না - টিফিনে যখন ক্লাস খালি থাকবে তখন থেমে থাকা সিলিং ফ্যানের উপর এই লোমসদৃশ সাদা বস্তুগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে- আমি ছিলাম সম্ভবত ক্লাসের সবচেয়ে লম্বা ছেলে- এজন্য কিনা জানিনা- অথবা আমার ভালোমানুষি ইমেজের কারণে সে আমাকে বেছে নিয়েছিল।
বন্ধুর কথামত কাজ করলাম।
এরপর সে প্রস্তাব করলো চল বাসায় যাই- মানে ইস্কুল পালাই। আমার তো মাথায় হাত- কষ্মিন কালেও আমি ইস্কুল পালাইনি। প্রতীক বল্ল- এরপর স্কুলে থাকলে যা করেছিস তার জন্য টিসি খাবি। ভয়ে তো আমি আধমরা। এখন ফ্যানগুলোর উপর থেকে ওগুলো সরানোর কায়দাও নাই।
প্রতীক গটগট করে পেছনের এডুকেশন এক্সটেনশন সেন্টার দিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল। আমি তো মহা ফাঁপড়ে।
শেষ মেশ পেট ব্যথার কথা বলে একটা দরখাস্ত নিয়ে ফজলুল আবেদীন স্যার (ক্লাস টিচার) এর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। অন্য কাউকে ছুটি দিতে হাজারো প্রশ্ন হতো- কিন্তু আমার বেলায় স্যাররা খুবই উদার।
যা হোক পরের ঘটনা পরদিন শোনা-----------------
টিফিনের পর ফিফথ পিরিয়ড খায়ের সারের- আরবী ক্লাস।
বন্ধুরা সব খেলাধুলা করে ঘামতে ঘামতে ক্লাসে বসেছে। ফূল স্পীডে ফ্যান ছাড়া হলো। স্যারও ক্লাসে এসে গেছেন। শূরু হলো বিড়াল চিমটির একশন- প্রথমে ঘাড় মাথায় চুলকানি-= স্যার সহ সবার শরীরে লাল চাকা দাগ- এরপর বিশাল গণ চুলকানির আসর- কেউ কিছু বুঝতে পারলো না- সহকারী প্রধান শিক্ষক এসে ক্লাস ছুটি দিলেন- কেউ কেউ স্কুলের কলেই গোসল করল। ঘটনা রয়ে গেল রহস্যাবৃত।
প্রতীক কিন্তু এই ঘটনা চেপে রাখতে পারল না- ফলে যা হবার তাই হলো। আমি সহ প্রতীকের ভাগ্যে বেদম শাস্তি (ল্যাবরেটরি স্কুলে শাস্তি তখনকার দিনে বিখ্যাত ছিল,এখন তো শাস্তি দেয়া হয় না)- টিসির হুমকি- বাসায় চিঠি পাঠানোর হুমকি- অভিভাবক ডাকা হলো প্রতীকের। আমি অল্পের উপর দিয়ে বেঁচে গেলাম - খালি কিছু উত্তম মধ্যম খেয়ে। (সরল বিশ্বাসে করা কাজের জন্য???) বিষয়টি নিয়ে এখনও আমাদের স্কুলের বন্ধু মহলে হাসাহাসি হয়- এত বছর পড়েও এ ঘটনা মনে করে আমার কোনো কোনো বন্ধু আমার মাথায় একটা করে ঠূঁয়া দিয়ে দেয়।
এই ঘটনার সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ চরিত্র হচ্ছে প্রতীক।
মাহবুবুর রশিদ প্রতীক- ক্লাস সেভেনে সে চলে যায় পাবনা ক্যাডেট কলেজে- সেখানে এসএসসি তে ফার্ষ্ট স্ট্যান্ড করে রাজশাহী বোর্ডে- দুষ্টামীর কারণে ক্যাডেট কলেজ থেকে বের হয়ে এসে ভর্তি হয় ঢাকা কলেজে। আবার প্রতীকের সাথে পুণঃবন্ধুত্ব। এইচএসসি তেও স্ট্যান্ড করে সে (তখন জিপি্এ ছিল না)। ভর্তি হয় বুয়েটে। ছাত্রবস্থায় বিয়ে করে।
পাশ করে ভালো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। প্রায়ই নানা ডাক্তারি পরামর্শের জন্য আমার কাছে ফোন করত- কোম্পানির ক্যালেন্ডার ডায়েরী দিয়ে যেত নিয়ম করে।
এরপর ----------------------------
২০০৪ এ ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কে মুন্সিগন্জের কাছে এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় প্রতীক তার স্ত্রী সহ। দুর্ঘটনা স্থলে ছুটে যায় মুন্সিগন্জের সার্কেল এএসপি - নাহিদ হোসেন। লাশ উদ্ধার করে নাহিদ দেখতে পায় পরিচিত বন্ধুকে।
ঢাকা কলেজে তারও সহপাঠি ছির প্রতীক।
প্রতীকের রেখে যাওয়া একমাত্র সন্তান 'অর্নিক্স 'পড়ে ল্যাবরেটরি স্কুলে-ক্লাসের ফার্স্ট বয় সে। দাদীর সাথে থাকে। কিছুদিন আগে তার শোকস্তব্ধ দাদাও মারা গেছেন।
প্রতীক আমার বন্ধু- তার কথা মনে হলে মনটা এখনো খারাপ হয়ে যায়- বুকের ভেতরটা কেমন যেন খালি খালি লাগে।
মনে হয় টাইম মেশিনে চড়ে যদি আবার স্কুল জীবনে চলে যাওয়া যেত- কোনোভাবে যদি পাল্টে ফেলা যেত আমাদের ভবিতব্য------------।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।