খুব বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজলে নাকি ঠান্ডা-কাশি হয়, তাই ভেজা নিষেধ। মাঝেমধ্যে নিষেধ মানতে ইচ্ছে করে না। বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সব সময় তো বৃষ্টি হয় না।
এখন বৃষ্টি হচ্ছে। এখন খুব বৃষ্টি হচ্ছে। এখন দুপুর। ঘরের মধ্যে বসে, জানালা খুলে বৃষ্টি দেখা যায়। জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায়, মেঘ দেখা যায়।
বৃষ্টি হলে, বৃষ্টি দেখা যায়। যেমন, এখন বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির শব্দ শোনা যাচ্ছে। শনশন করে বৃষ্টি হচ্ছে। রিমঝিম করে বৃষ্টি হচ্ছে।
ঝরঝর করে বৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও হয়তো, কোনো জঙ্গলের মধ্যে শরশর করে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি হচ্ছে বলে, আকাশ মেঘে ঢাকা বলে, এই দুপুরে রোদ নেই। দুপুরবেলার দিনটাও কেমন ছায়া ছায়া লাগছে। এই দিনটা ছায়া ছায়া দিন।
এই দিনটা মেঘলা মেঘলা দিন। দিনটা বৃষ্টিঝরা দিন। এখন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হচ্ছে। কিছুই পড়তে ইচ্ছে করছে না। কিছুই লিখতে ইচ্ছে করছে না।
কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না। বাবা বাসায় নেই, তাই কারও সঙ্গে কথাও বলা যাচ্ছে না। বাবাকে একটা ফোন দেওয়া যায়, কিন্তু বাবা তো অফিসে খুব ব্যস্ত। তবু বাবার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ফোনে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
বাবা কখন বাসায় আসবে?
আমার বাবা শিল্পী, আর্টিস্ট। বাবা ছবি আঁকে। বাবা গতকাল বলেছে, ‘চর্যা, চারকোলে তোকে আঁকব। ’
আমি বলেছি, ‘আঁকো। ’
বাবা হেসেছে।
তারপর বাবার হাসি হঠাৎ থেমে যায়। বাবা বলে, ‘নাহ্, তোকে আমি চারকোল দিয়ে কেন আঁকব? তুই তো আমার রঙিন পাখি, তোকে আঁকব প্যাস্টালে। কালারফুল করে আঁকব। ’
‘আচ্ছা। আমিও তোমাকে রং-পেনসিলে আঁকব।
’
বাবা বলল, ‘তুই কি এঁকে আমার মুখ মেলাতে পারবি চর্যা?’
আমি বলেছি, ‘খুব পারব। আমি আর্টিস্টের মেয়ে না?’
‘তোর তো বয়স মাত্র সাত। কদিন পরেই আটে পড়বি। পারবি আঁকতে?’
বাবা আমাকে পরীক্ষা করতে চায়। আমি জানি, বাবার মুখ মিলিয়ে এঁকে আমি ঠিকই পাস করব।
আমি যে পারব, তা আমি জানি। আমি জলরঙেও ছবি আঁকছি। জলরঙে আঁকাটা আরও মজার। বাবাও খুব জলরঙে ছবি আঁকে। গত পরশু বাবা জলরঙে তিনটা ছবি এঁকেছে।
তিনটা ছবিই বৃষ্টির ছবি। প্রথম ছবিতে বাবা এঁকেছে গ্রামের ছবি। ছবিতে গ্রামের একটি রাস্তা। একটি ছেলে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। ছেলেটি হয়তো স্কুলে যাচ্ছিল।
বইখাতা বুকের জামার মধ্যে লুকিয়ে সে হাঁটছে। কারণ কী জানো? বাবা এঁকেছে। বৃষ্টি হচ্ছে আর ছেলেটি বৃষ্টির মধ্যে হাঁটছে। বইখাতা যেন ভিজে না যায়, ছেলেটি সেই চেষ্টা করছে। দ্বিতীয় ছবিটা বাবা এঁকেছে একটা পাহাড়ের ছবি।
সে ছবিতেও বৃষ্টি আঁকানো হয়েছে। পাহাড়ের ঢালে ছোট ছোট ঘর। পাহাড়ের গায়ে মেঘ আটকে আছে মনে হচ্ছে। ছবিটা আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। বাবাকে বলেছি, ‘পাহাড়গুলো কোথাকার?’
‘কুমিল্লার।
’
‘পাহাড়গুলোর নাম কী?’
‘লালমাই পাহাড়। ’
‘আমি লালমাই পাহাড়ে যাব। চূড়োয় উঠব। ’
‘আচ্ছা। আচ্ছা।
’ বাবা কথা দিয়েছে, অফিস থেকে ছুটি পেলেই আমাকে লালমাই পাহাড়ে নিয়ে যাবে। ’
তৃতীয় ছবিতে বাবা এঁকেছে, কাকে? এক মা, বৃষ্টির মধ্যে তার বাচ্চাটাকে নিয়ে একটি পুকুরের ধার দিয়ে হাঁটছে। বললাম,
‘বাবা, বাচ্চাটা এত ছোট কেন?’
বাবার মুখ ভারী হয়ে গেল। বাবা বলল, ‘বাচ্চারা তো ছোটই থাকে চর্যা। তুই তো এখনো খুব ছোট।
’
‘হুম। ’
‘হুম’ বলা মানে, বাবা তাকায় আমার দিকে। তারপর অনেকক্ষণ বাবা কথা বলল না। আমিও চুপচাপ। বাবার কি মন খারাপ হয়ে গেল? বললাম, ‘বাবা, ধ্রুব আঙ্কেলের নাকি মা নেই?’
‘বাবাও নেই ধ্রুব আঙ্কেলের।
’
ধ্রুব আঙ্কেলও ছবি আঁকে। উত্তম আঙ্কেলও ছবি আঁকে। মামুন আঙ্কেলও ছবি আঁকে। আমার খুব ভালো লাগে, এতগুলো আর্টিস্ট আঙ্কেল আমার। শুধু কি আর্টিস্ট আঙ্কেল? কবি আঙ্কেল আছে, শিল্পী আঙ্কেল আছে, হাসি আঙ্কেল আছে, গোঁফ আঙ্কেল আছে, দাড়ি আঙ্কেল আছে, পাগল আঙ্কেল আছে।
যখন আরও ছোট ছিলাম, আমার ভূত আঙ্কেল ছিল, ডাইনোসর আঙ্কেল ছিল, দাঁত আঙ্কেল ছিল, দাঁতভাঙা আঙ্কেলও ছিল।
বাবাকে বলেছি, ‘বাবা, তুমি তোমার মায়ের ছবি আঁকো না কেন?’
বাবা আমার কথায় হঠাৎ আনমনা হয়ে যায়। বাবার মুখ কালো হয়ে যায়। বাবার চোখের কোনায় হঠাৎ চিকচিক করে ওঠে। বাবা আমাকে সান্ত্বনা দিতে চান, ‘আঁকব আঁকব।
আমার মায়ের ছবি আমি আঁকব। ’
আমি আর কথা বলতে পারি না। রাতে ঘুমানোর সময় বাবা আমার ঘরে এল। আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে চোখ বুঝে শুয়ে ছিলাম। বাবা হয়তো ভেবেছে, আমি ঘুমোচ্ছি।
বাবা বিছানায় বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বাবা কোনো কথা বলে না। হঠাৎ আমার মুখের ওপর এক ফোঁটা গরম পানি পড়ে। আমি চোখ মেলে তাকাই। বাবার চোখে চোখ পড়ে।
বাবা আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। বাবা গুমরে কেঁদে ওঠে। আমি কী করব বুঝতে পারি না। অনেকক্ষণ বাবা আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে রাখে। বাবার গলায় কান্না আটকে যায়।
বাবা বলে, ‘চর্যা, তোর জন্য খারাপ লাগছে। ’
‘কেন বাবা?’
‘আমার মা মারা গেছে, আমি তো অনেক বড় হয়ে গেছি। কিন্তু তুই তো এখনো অনেক ছোট। তোর বয়স সাত। ’
‘তাতে কী বাবা? তুমি যাও, ঘুমোও এখন।
’ আমিই বাবাকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করি। বাবা আমাকে রেখে উঠে পড়ে। তারপর আমাকে বলে, ‘চর্যা, আমার ছবি তোকে আঁকতে হবে না। তুই তোর মায়ের একটা ছবি আঁকিস। ’
‘ঠিক আছে।
তাহলে তুমিও তোমার মায়ের ছবি আঁকবে। ঠিক আছে বাবা?’
বাবা আমার ঘর থেকে চলে যায়। যাওয়ার সময় বাল্বের সুইচ অফ করে দিয়ে যায়। ঘর অন্ধকার হয়ে যায়। আমি অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে মনে মনে মায়ের মুখ দেখতে পাই।
আমার মা মারা গেছে গত মাসেই, ক্যানসারে। আচ্ছা, দুনিয়াতে এত ওষুধ, ক্যানসারের ওষুধ থাকবে না কেন?
মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে আমার চোখ ভিজে ওঠে। চোখের পানি বালিশে পড়ে। আমার খুব কষ্ট হয়। আমার খুব কান্না আসে।
মা, মা, তোমাকে আমি খুব মিস করি। মা, তুমি কেমন আছো আমাকে ছাড়া, বাবাকে ছাড়া? মা, মা, তুমি কি আমার ভাবনা টের পাচ্ছ? তুমি কি জানো না, তোমার চর্যার কষ্ট হচ্ছে খুব? কখন ঘুমিয়ে পড়েছি, জানি না।
এখন দুপুর। বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। আমি জানালার ধারে বসে ভাবছি, ‘বাবা যদি আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরত, বাবার সঙ্গে বেড়াতে বেরুব।
বাবার সঙ্গে মায়ের কবর দেখতে যাব। ’
আমি একটা কবিতা মুখস্থ করছি কয়দিন ধরে। এখন আবার মনে হচ্ছে, কবিতাটি পড়ি। সম্পূর্ণ কবিতাটি আমি মুখস্থ করবই। জানো, সেই কবিতার প্রথম লাইন কী? মাকে আমার পড়ে নাকো মনে...বাকি লাইনগুলো তোমরা তোমাদের মতো পড়ে নাও...
......................................................................................................
চর্যার বাবা শিল্পী মাসুক হেলাল।
চর্যার বয়স সাত। গতমাসেই ক্যান্সারে মারা গেছেন চর্যার মা। আজ প্রথম আলোতে প্রকাশিত এই গল্পের ইলাস্ট্রেশন হিসাবে চর্যার পোর্ট্রেট এঁকেছেন তার বাবা মাসুক হেলাল। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।