ক্ষুধার্ত থেকো, বোকা থেকো। জুন মাসের শুরুর দিকে আমার স্কুল ও কলেজের কয়েকজন বন্ধুর সাথে মৌলভীবাজার গিয়েছিলাম নতুন আবিষ্কৃত হামহাম জলপ্রপাত দেখার জন্য। আমার জন্য হামহাম জলপ্রপাত দেখাটা খুব স্মরণীয় একটি অভিজ্ঞতা। হামহাম জলপ্রপাত সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের কুরমা বনবিটের গহীন অরণ্যে অবস্থিত। কমলগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০কিঃমিঃ পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত রাজকান্দি পাহাড়ের কুরমা বনবিট এলাকার আয়তন ৭ হাজার ৯৭০ একর।
কুরমা বনবিট এলাকার পশ্চিমদিকে চাম্পারায় চা বাগান, পূর্ব-দক্ষিণে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত। এই বনবিটের প্রায় ৮.৫ কিঃমিঃ অভ্যন্তরে দৃষ্টিনন্দন এই হামহাম জলপ্রপাতটির অবস্থান। কমলগঞ্জ- কুরমা চেকপোষ্ট পর্যন্ত প্রায় ২৫কিঃ পাকারাস্তা। কুরমা চেকপোষ্ট থেকে চাম্পারায় চা বাগান পর্যন্ত ১৫কিঃমিঃ মাটির রাস্তা। সেখান থেকে আবার প্রায় ৫ কিমি. দূরে সীমান্ত এলাকায় আদিবাসীদের বসতি কলাবনপাড়ায় যেতে হয়।
সেখান থেকেই দুর্গম জঙ্গল শুরু। সেই জঙ্গলের প্রায় ৮.৫ কিঃমিঃ ভিতরে অবস্থিত হামহাম জলপ্রপাত।
গভীর অরণ্যে অবস্থিত অনিন্দ্যসুন্দর হামহাম জলপ্রপাতের কিছু ছবি:
এই জলপ্রপাতের কথা প্রথম শুনি আমার বন্ধু তানভীর মোর্শেদের কাছে। সে গত বছরই তার আর্কি ডিপার্টমেন্টের বড়ভাই দের সাথে যেয়ে হামহাম ঘুরে এসেছিল। ওর কাছ থেকে বর্ণনা শোনার পর থেকেই খুব ইচ্ছা ছিল এই জলপ্রপাত দেখার।
বেশ কিছুদিন আগে আবার আমার আরেক বন্ধু রিফাত(অরবিট) হামহাম থেকে ঘুরে আসে। ওর কাছ থেকেও ভয়ঙ্কর সুন্দর এক বর্ণনা শুনলাম। আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। হঠাৎ করেই একটা সুযোগ এসে গেল। আমার কিছু বন্ধু একটা ট্যুরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল।
আমি তাদেরকে হামহামের কথা বলি। সবাই রাজিও হয়ে গেল। যোবায়ের, তুর্কি, আকন, ফারুক, রাজু, মহসিন, জাকারিয়া, সাইয়েদীল, প্রিয়ম, বর্ণ, তারেক,রিফাত ও আমি-এই ১৩ জন হামহাম জয়ের মিশনে অংশ নেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করলাম। আমরা প্রায় সকলেই দীর্ঘদিনের সহপাঠী। প্ল্যান ছিল ৩০ তারিখ রাতের ট্রেনে আমরা শ্রীমঙ্গল যাব।
কিন্তু ২৭ তারিখ ট্রেনের টিকেট কাটতে যেয়ে ফারুক জানাল যে ৩০ তারিখ নাকি কোন ট্রেন শ্রীমঙ্গল যাবে না। তাই বাসের টিকেট কাটতে হল। ৩০ তারিখ রাত সোয়া ১১টার বাস আসল রাত সাড়ে ১২টায়। যাই হোক, এখান থেকেই আমাদের মিশন আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হল। ভার্সিটি লাইফের ব্যস্ত ও একঘেয়ে জীবন থেকে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও মুক্তির স্বাদ নিয়ে আমরা শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে ছুটে চললাম।
সাইয়েদীল, জাকারিয়া ও রাজুর আড্ডা ও হাসাহাসির শব্দে ভাল করে ঘুমাতেও পারলাম না। গভীর রাতে ড্রাইভারের ডাকাডাকিতে সবার ঘুম ভাঙল। আমরা তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। চারদিকে তখন শুধুই অন্ধকার ও মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। (এই তুমুল বৃষ্টি শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল) একটু পর পর ঘন গাছের সারি ও জলাভূমি।
সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আশেপাশে কোন লোকালয়ও নেই। ড্রাইভার বলল অপরদিক থেকে কোন গাড়ি না আসা পর্যন্ত সামনে যাওয়া যাবে না। কারণ এরকম সময়েই নাকি ডাকাতি হয়। আমরাতো বেশ ভয় পেয়ে গেলাম ।
হামহাম দেখতে এসে যদি ডাকাতির কবলে পড়তে হয়। প্রায় আধা ঘন্টা পর অপরদিক থেকে একটা বাস আসল। সেই বাসের ড্রাইভার বলল তারাও নাকি ভয়ের কারণেই থেমে ছিল। আমরাও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। রাতের আঁধারে বৃষ্টির বুক চিরে আবার আমরা এগিয়ে চললাম।
রাতের শেষ প্রহরের দিকে আমার ঘুম ভেঙে গেল। হালকা অন্ধকারে পাহাড়ী আঁকাবাঁকা রাস্তার চারপাশের চা বাগান গুলোর অপরূপ সৌন্দর্যের আভা কিছুটা হলেও আমি পাচ্ছিলাম। কিন্তু সৌন্দর্য একা উপভোগ করা যায় না। পিছনে তাকিয়ে দেখি সবাই ঘুমে অচেতন। তখন বর্ণ হঠাৎ আমাকে ডাক দিল।
আমরা দুজন নিরবে এই মায়াবী সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকলাম।
সকাল পৌঁনে ৫টার দিকে আমরা শ্রীমঙ্গলে বাস থেকে নামলাম। হামহাম জলপ্রপাত অভিযানের কথা চিন্তা করে আমরা সবাই বেশ উত্তেজিত ছিলাম। কিন্তু তখনও জানতাম না যে কি কঠিন ও বিপদসংকুল এক অ্যাডভেঞ্চার আমাদের জন্য অপেক্ষা করতেছে।
সকাল পৌঁনে ৫টার সময় আমরা শ্রীমঙ্গল নামলাম।
হালকা নাস্তা, প্রকৃতির ডাকের সাড়া, দুপুরের জন্য বিস্কুট,রুটি,পর্যাপ্ত পানি কেনা প্রভৃতি কাজ করতে করতেই বেশ কিছুটা সময় চলে গেল। হোটেলের একটি রুম ভাড়া করে সেখানে আমাদের সবার ব্যাগ, কাপড়-চোপড়, জুতা ইত্যাদি রাখলাম। শুধু ২টা ব্যাগে আমাদের ক্যামেরা, মোবাইল, টাকা পয়সা ও দুপুরের খাবার-দাবার সাথে নিলাম। অবশেষে সাড়ে ৬টার দিকে আমরা ২টা সিএনজি ভাড়া করে রওনা দিলাম। সিএনজি দুইটার সাথে শর্ত ছিল তারা আবার আমাদেরকে শ্রীমঙ্গল নামিয়ে দিবে।
পার সিএনজি ভাড়া ১৫০০ টাকা। আমাদের যাত্রা শুরু হল।
কমলগঞ্জ- কুরমা চেকপোষ্ট পর্যন্ত প্রায় ২৫কিঃ পাকারাস্তা। কুরমা চেকপোষ্ট থেকে চাম্পারায় চা বাগান পর্যন্ত ১৫কিঃমিঃ মাটির রাস্তা। সেখান থেকে আবার প্রায় ৫ কিমি. দূরে সীমান্ত এলাকায় আদিবাসীদের বসতি কলাবনপাড়ায় আমাদেরকে যেতে হবে।
সেখান থেকেই দুর্গম জঙ্গল শুরু। সেই জঙ্গলের প্রায় ৮.৫ কিঃমিঃ ভিতরে অবস্থিত হামহাম জলপ্রপাত। যাই হোক, পাকা রাস্তা পর্যন্ত আমরা ভালভাবেই আসলাম। কিন্তু মাটির রাস্তা শুরু হতেই বিপত্তি শুরু হল। বিগত দুইদিন ধরে খুব বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল।
একটু পর পর সিএনজি থেমে যাচ্ছিল। তখন আমাদের সবাইকে নেমে সিএনজি কে ঠেলা দিয়ে চালাতে হচ্ছিল। মাঝে মাঝে লোকালয় দেখা গেল । সেখানকার লোকজন আবার সেইদিন হামহাম যেতে নিষেধ করল। কারণ প্রচুর বৃষ্টি হওয়াতে হামহাম যাওয়াটা খুব রিস্কি ছিল।
কোনমতে আমরা যখন কলাবনপাড়া তে পৌঁছালাম তখন প্রায় ১০টা বাজে। কলাবনপাড়া থেকে আমরা একজন ভাল গাইড সাথে নিলাম। একই সাথে হাঁটার জন্য বাঁশ, জোঁক থেকে বাঁচার জন্য নারিকেল তেল, লবণ নিলাম। এবার শুরু হবে আমাদের আসল যাত্রা। আল্লাহ্র নাম নিয়ে আমরা সবাই জঙ্গলে প্রবেশ করলাম।
এই সময়টার বা এই পথটার বর্ণনা দেয়া সবচেয়ে কঠিন। এখানে না আসলে এই পথের ভয়াবহতা ও প্রতিকূলতা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। গভীর ঘন জঙ্গলের ভিতর প্রায় সাড়ে আট কিঃমিঃ আমাদেরকে হাঁটতে হয়। এই পথের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ছিল জলাভূমি। জলাভূমি দিয়ে গেলেই তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছানো যায়, চারপাশের পাহাড় ও ঘন জঙ্গল দিয়ে হাঁটার কোন পরিবেশ ছিল না।
মাঝে মাঝে আমরা ডাঙা দিয়ে হাঁটছিলাম। সেখানে আবার জোঁকের ভয়। নারিকেল তেল খুব বেশি কাজে দেয় না, কিছুক্ষণ পরই তেল ধুয়ে যায়। আমরা প্রায় সবাই জোঁক নিয়ে খুব ভীত ছিলাম। আমাদের কারোরই জোঁক নিয়ে পূর্ব কোন অভিজ্ঞতা ছিল না।
তবে তুর্কির ছিল। সে আগেও একবার এখানে এসেছিল। একটা পর্যায়ে আমরা বুঝলাম যে জোঁক লাগাটা এখানে স্বাভাবিক, জোঁক থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। আমাদের সবারই প্রায় ১৫ থেকে ২০ টার মত জোঁক লাগে। শুরুতেই জোঁক চোখে পড়লে সহজে ছাড়ানো যায়।
কিন্তু একটু দেরী হলেই ছাড়াতে কষ্ট হয়। আমার গলাতে পর্যন্ত জোঁক লাগে। সবচেয়ে রিস্ক ছিল প্রিয়মের। তার জননাঙ্গের পাশেই জোঁক লাগে। সে একটু দেরীতেই সেটা টের পায়।
পরে সেটা ছাড়ানো গেলেও বেশ কিছুক্ষণ তার ব্লিডিং হয়। এরপর থেকে একটু পর পর আমরা সবাই নিজেদের হাফ প্যান্টের ভিতরে চেক করতেছিলাম। পায়ে একটা পাতা লাগলেও আমরা ভয় পেয়ে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল এই বুঝি আবার জোঁক লাগল। জাকারিয়া মনে হয় একটু বেশিই ভীত ছিল।
ও একটু পর পর আন্ডারওয়ার চেক করতেছিল। আমাদের মাঝে বর্ণ জোঁক ছাড়ানোর জন্য বেশি খ্যাতি লাভ করে। ও হাত দিয়ে টান দিয়ে সবার জোঁক ছাঁড়িয়ে দিচ্ছিল। প্রায় অর্ধেক পথের পর একটা উঁচু পাহাড়(মাকাম পাহাড়) পার হতে হয়। সেই পাহাড়ে উঠা ও নামা খুব রিস্কি ছিল।
একে তো পাহাড় টা খুব খাড়া ছিল, তারপর আবার বৃষ্টিতে সেই পাহাড় খুব পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিল। একজন পা পিছলে পড়ে গেলে তার নিচের সবাই পড়ে যেত। সে ক্ষেত্রে ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশঙ্কা ছিল। ভাগ্য ভাল সেরকম কিছু ঘটেনি। এই পাহাড়টি ছিল জোঁকে ভরা।
তাই আমরা এই পাহাড়টির নাম দিলাম জোঁক পাহাড়। পাহাড়ের উপরে উঠার পর আমরা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। তখন হালকা খাওয়া-দাওয়া করলাম। খাওয়া-দাওয়ার সময় সম্ভবত প্রিয়মের জননাঙ্গ পর্যন্ত জোঁক উঠে যায়। তাই আমরা পাহাড়ের ওই জায়গাটি প্রিয়মের নামে নামকরণ করলাম।
জলাভূমির একটু বর্ণনা দেয়া দরকার। জলাভূমির প্রায় অর্ধেকটা পথ আমাদের বুক সমান পানি ছিল। তার মধ্যে দিয়ে আমাদেরকে হাঁটতে হয়েছে। তুর্কি বলল, ওরা আগে যখন এসেছিল তখন যেসব পথ শুকনো ছিল, তার বেশির ভাগেই এখন পানি উঠে গেছে। প্রায় ১২-১৫টার মত সাঁকো আমাদেরকে পার হতে হয়েছে।
বেশির ভাগ সাঁকোই পানির স্রোতে ভেসে গিয়েছিল। সেখানে আমাদের কে বাঁশ ধরে ভেসে ভেসে পার হতে হয়েছে। দুই জায়গাতে জলাভূমি(স্থানীয় ভাষায় 'গাঙ') বেশ চওড়া ও পানি খুব গভীর ছিল। তখন সাঁতরে পার হতে হয়। সেখানে একটু বিপত্তি ঘটে।
কারণ আমরা ৩-৪ জন সাঁতার পারতাম না। আমি আগেই সাথে করে 'লাইফ জ্যাকেট' নিয়েছিলাম। সেটি তখন বেশ কাজে দেয়। কয়েক জায়গাতে আমাদেরকে সাঁকো বানিয়ে পার হতে হয়েছে। পানির নিচে অনেক জায়গাতে কাঁটা যুক্ত লতা ছিল।
সেখানে খুব কষ্ট হয়েছে। তার উপর জলাভূমির আশেপাশের লতাপাতা গুল্মে জড়ানো ছিল অনেক রকমের 'স্যাঙ্গা'। কয়েকটা দেখতে অবশ্য খুব সুন্দর ছিল। একটু খেয়াল করে পথ চললে দু'একবার সাপও চোখে পড়বে। আমরা ৩-৪ জন সাপ দেখেছিলাম।
কিন্তু কাউকে বলিনি। কারণ সেক্ষেত্রে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। ডাঙাতে কয়েকবার বানরও চোখে পড়তে পারে।
অর্ধেক পথ পার হওয়ার পর পাথুরে পাহাড়ের মাঝে ঝিরিপথ পড়বে। ঝিরিপথে পানির গভীরতা কম হলেও রিস্ক কম নয়।
কারণ এখানে স্রোতের বিপরীতে পাথরের উপর দিয়ে হাঁটতে হবে,তার উপর পাথর গুলো খুবই পিচ্ছিল। একটু অসতর্ক হলেই আঁছাড় খেতে হবে। আর যেখানে স্রোত বেশি সেখানে আঁছাড় খেলে ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা যে কতবার আঁছাড় খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। একবার বেশ বিপদ হয়ে যেত।
মহসিন একবার আঁছাড় খেয়ে ভেসে যাচ্ছিল। ভাগ্য ভাল যে শেষ মুহূর্তে সে একটা পাথর ধরে আটকে থাকে। এজন্য সে খাদে পড়ে যায়নি। আমরা ওর স্মরণে সেই অংশের নাম দিলাম 'মহসিন খাল'। ঝিরিপথ দিয়ে যাওয়ার সময় আশেপাশে পাথুরে পাহাড় থেকে আরো কয়েকটি ছোট ছোট ঝরণার মত পানির ধারা চোখে পড়বে।
আমরা সেগুলোর কয়েকটা মজার নামও দিলাম। যেমন, 'হামহামে আর আসমু না' ঝর্ণা, 'আম্মু তুমি কই' ঝর্ণা...ইত্যাদি।
সাধারণত জঙ্গলের ভিতরে প্রায় ২ ঘণ্টা হাঁটার পথ হলেও অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশ ও আমাদের বেশ অনভিজ্ঞতার কারণে হামহাম পৌঁছাতে আমাদের বেশ সময় লেগে যায়। জলাভূমি,গাঙ, পাহাড়, ঝিরিপথ পাড়ি দিয়ে জঙ্গলের ভিতর প্রায় চার ঘন্টার বেশি সময় হাঁটার পর সোয়া ২টায় যখন আমরা হামহাম জলপ্রপাতের সামনে আসলাম, তখন আমরা ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। কিন্তু হামহাম জলপ্রপাতের সামনে আসার পর আমাদের সকল ক্লান্তি চলে গেল।
সেই দৃশ্য ভোলার নয়। হামহামের সৌন্দর্য দেখে আমাদের সকল ক্লান্তি চলে গেল। আমরা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। এত গভীর জঙ্গলে যে এত সুন্দর জলপ্রপাত থাকবে,সেটাই তখন চিন্তার অতীত মনে হচ্ছিল। এই বৃষ্টির মৌসুমে হামহাম তখন তার ভরা যৌবন নিয়ে বিকশিত।
সে যেন তার সকল দম্ভ নিয়ে ঘোষণা করছে, এটাই আমার রাজ্য। এখানে কারোর স্থান নেই। এখানে আসতে হলে তোমাকে ঝুঁকি নিয়েই দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হবে। কিছুক্ষণ পর আমরা যখন সম্বিৎ খুঁজে পেলাম, তখন আমরা সবাই হাফ প্যান্ট খুলে ফেললাম। তখনও কারো হাঁটু, কারো কোমর থেকে জোঁক ছাড়াতে হল।
এই দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এখানে সম্ভবত আমাদের কারোরই আর আসা হবে না। প্রায় ৫০ মিনিট হামহামের সামনে লাফালাফি ও ছবি তোলার পর ৩টার সময় আমরা হামহামকে শেষ বিদায় জানিয়ে সেই দুর্গম পথে যাত্রা শুরু করলাম। আমরা বুঝলাম না তুর্কি কেন এখানে দ্বিতীয়বার আসল। সে নিজেও বেশ আফসোস করতে লাগল। কিন্তু হামহাম কে দেখার পর তার আর কোন আফসোস ছিল না।
কারণ, প্রথমবার সে যখন এসেছিল তখন হামহামে এত পানি ছিল না,এত জোঁকও ছিল না। আমরা ভেবেছিলাম হামহাম থেকে আসার সময় পানি কমে যাবে। কিন্তু আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হল। ফেরত আসার সময় জলপ্রপাতের পানিতে গাঙ ও জলাভূমির গভীরতা আরো বেড়ে গিয়েছিল। তারপরও আসার ক্ষেত্রে সময় বেশ কম লাগল।
প্রায় আড়াই ঘন্টা হাঁটার পর সাড়ে ৫টার দিকে আমরা দুর্গম জঙ্গল থেকে বের হয়ে কলাবনপাড়া তে আসলাম, তখন আমাদের প্রায় বিদ্ধস্ত অবস্থা। সারা শরীরে ব্যথা, অনেক জায়গা লাল, অজানা পোকার কামড়, বিশেষ করে পা এর অবস্থা বেশি খারাপ ছিল। একে তো পা এর উপরে জোঁকের অনেক কামড়ের ক্ষত, তার উপরে পা এর নিচে পাথর ও কাটার আঘাতের অনেক ক্ষত। তারপরও আমরা লাকি ছিলাম কারণ, কারো বড় কোন ইনজুরি হয়নি। ভয়ঙ্কর সুন্দর এক অনুভূতি নিয়ে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমরা আবার শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
আমরা হামহাম ঘুরতে এসেছিলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম এটা আসলে ঘোরাঘুরির বিষয় নয়। এটা একটা অভিযান বা অ্যাডভেঞ্চার। আমাদের প্রায় সবারই এটা জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা পরিপূর্ণভাবে লিখে প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তারপরও কিছু লেখার চেষ্টা করলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।