আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অবসান

তরুণদের ভাল কিছু করার আকাঙ্খা যখন তারনা দেয়, একটা দেশ তখনই অগ্রসর হয়। পাক্কা ১টা ঘণ্টা পুকুরে সাতার কেটে বেড়ালাম, ঝুম বৃষ্টির মাঝে, দিনটা আসলে আজ ঈদের না দিনটা আজ আমারই মনে হচ্ছিলো বারবার। ঈদ কে কেন আমি আমার দিন দিয়ে দিবো, ও কে? হাত পায়ের আঙ্গুলগুলো সাদা হয়ে গেছে, যেই দিন মরে যাবো সেই দিন ও যেন বৃষ্টি হয়। আমার নিথর দেহ গরম পানি আর বরইয়ের পাতাতে না বৃষ্টিতে ধুয়ে যাবে। কারন আমি তো গরম পানিও পছন্দ করি না, না বরইয়ের পাতা।

বরই ছোট বেলায় থাকে শক্ত, কষকষে, আর যখন বুড়ো হয়ে যায় তখন মানুষের চামড়ার মতো ঔ শুকায়া যায়। কিন্তু আমি তো চির যৌবন পছন্দ করি বার্ধক্য বা বাল্য কোন কালই না। তবে সব ফলই এমন। তবুও কেন জানি আমার বরই কক্ষনই তেমন একটা ভালো লাগতো না। শীতের দিনও আমি ওই ঠাণ্ডা পানিতেই গোছল করি।

প্রকৃতি যা দেয় তাই অসাধারণ সুন্দর। আমরা মানুষরাই গরম করে নষ্ট করি। যার জন্য স্বাধীনতা আমাদের সৃষ্টিকর্তা দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু অধিকার দেন নাই। দিলেউ আমরা তার হয়তো অতিপ্রয়োগ করি। তাই হয়তো একদিন হিসেব ও দিতে হবে তার কাছে।

যে দিন মরে যাবো সে দিন যেন ঝুম বৃষ্টি হয়। কেন জানি ভাবতে ইচ্ছা করে আকাশ আমার দুঃখে কাঁদবে ওইদিন। বাতাশ গুলো দিশেহারা হয়ে ছুটবে এদিক ওদিক। গাছের পাতা গুলো বুঝবেই না কোন দিকে যাবে। পাখি গুলো কিছু না বুঝে চুপটি করে বসে থাকবে ওদের নীড়ে, কে জানে ওদের বাবু গুলো হয়তো ওই দিন না খেয়েই থাকবে।

মরে গিয়েউ আমার আত্মা ওদের কথা ভেবে কষ্ট পাবে। আমার সেই কষ্ট গুলো আমার প্রিয় জনের অশ্রু হয়ে ঝরবে। এ জন্যই হয়তো মানুষ মরে গেলে তার আত্মার কান্না গুলো প্রিয় জনের চোখ হয়ে ঝরে। কারন সে তো কাঁদতে পারে না। দাদা মারা গেলেন আমি একটুও কাঁদি নাই।

তিনি মারা যান শেষ রাতে, ফজরের একটু আগে। আমার বাড়ি, পাশের বাড়ি, তার পাশের বাড়ি সুদ্ধ লোক ছিল ওই রাতে আমাদের বাড়িতে। দাদা মারা যান ৯৫ বছর বয়সে। সবাই বলতেন তিনি নাকি অনেক ভালো মানুষ ছিলেন, তিনি নাকি সবাই কে ভালো উপদেশ দিতেন, ভালো কাজ করতে বলতেন, তাই তিনি ভালো মানুষ ছিলেন। মানুষটা আমাকে, কিভাবে অন্ধকার রাতে চাঁদের আলোর অনুপুস্থিতে ভয়কে ভয় করতে না, ভালবাসতে হয় শিখিয়ে ছিলেন।

দাদা মারা যান ভোঁর রাতে, ফজরের আজানের কিছুক্ষন আগেই। সকালে আব্বু আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সবাই কাদতেছে আমি তোর চোখে পানি দেখি নাই একবারও। বলেছিলাম, মানুষ জন্মায়ই মরে যাবার জন্য। এইটাই নিয়ম, আর যা নিয়ম তাই ডিসিপ্লিন। যা আপনি আমাকে সেই ছোট্ট থেকে শিখিয়ে শিখিয়ে বড় করেছেন।

আব্বু বোধয় অবাকই হয়েছিলেন আমার কথায়। এর পর যা জিজ্ঞেস করেছিলেন তা আমার মনে থাকবে আজীবন আর আমি যা উত্তর দিয়েছিলাম তা আব্বুর মনে থাকবে। আব্বু জিজ্ঞেস করেছিলেন "আমি যে দিন মারা যাবো সেই দিনও কি কাঁদবি না?" আমি বলেছিলাম আমি যখন মরে যাবো তখন আমার ছেলে যদি আমার দাফনের ব্যবস্থা না করে কান্নাকাটি করে তাহলে আমার আত্মা শুধু কষ্টই পাবে কিন্তু এই নিষ্ঠুর পৃথিবী থেকে মুক্তি পাবে না। এবং আমি আমার সন্তানকে তার জন্মের পর কাঁদতে শিখাবো না, বারবার নতুন করে বাঁচতে শিখাবো। আব্বু আমাকে আমাদের পুরান বাড়ির পারিবারিক কবর স্থানে নিয়ে গেলেন তার পর।

এমন একটা সময় হয়তো আমার সময়েও ঘটবে। আমার সন্তান আমার মৃত্যুর পর কাঁদবে না। কাঁদবে শুধুই আমার মা। লোকজন জড়ো হয়ে কবরের মাটি খুরতে থাকবে আর আকাশ কেঁদে বৃষ্টি নামাবে। কবরের মাটি কাটা যে কতো কষ্টের তা বুঝতে পাড়ছিলাম দাদার কবরের মাটি খোঁড়ার সময়।

আব্বু মাথার দিকটার সম্ভবত উত্তর দিকটাই হবে, ওই দিকের মাটি সরিয়ে আমাকে বললেন পায়ের দিকটার মাটি খুড়তে, অনেকই দাঁড়িয়েছিল পাশে কিন্তু কিছু কাজ আব্বু নিজে করে কিছু আমাকে দিয়ে করিয়ে পরে ওদের হাতে ছেড়ে দিলেন বাকিটা। আমাকে পায়ের দিকটা দেয়ার একাটাই কারন খুজে পাই, তা হচ্ছে আমি সহজে পা ছুয়ে কাউকে সালাম করতাম না। দাদাকেউ না। আমার যুক্তি ছিল মানুষ শুধুই আল্লাহ্‌র সামনে মাথা ঝুকাবে আরেক জন মানুষের সামনে অবশ্যই না। দাদা হেঁসে বলতেন তোর বিয়ার সময় দেখবো তুই তোর শ্বশুর শাশুড়িকে পা ধরে সালাম করস কিনা, যদি করস তাহলে ওই দিনই আমার সব সালাম উসুল করে নিবো, না করলে তোর বৌয়ের কাছে তোরে যাইতে দিবো না।

এই জন্যই হয়তো আব্বু আমাকে পায়ের পাসটাই করালেন। যাই হোক হয়তো বিয়ের সময় শ্বশুর শাশুড়ি সহ সকল মুরুব্বীকে পায়ে ধরেই সালাম করবো ঠিকই, তাইতো দাদা আগেই মারা গেলেন। কবরের মাটি কাটার সময় অনেক কষ্ট নিয়েই মাটি কাটতে ছিলাম। কারন আমার চোখ ভেঙ্গে কান্না আসতেছিল, মন চাচ্ছিলো হাউ মাউ করে কাঁদি, আর অন্য কেউ একজন ভেতর থেকে বলতে ছিল না কাঁদা যাবে না। কারন দুঃখ কে লাই দিলে নাকি ঘাড়ে চড়ে বসে।

তাই না কেঁদেই কষ্টকে ভিতরে দাফন করেই কবরের একটা পাশ খুরতেছিলাম। আমার কবরের একটা মাটিও আমি আমার কোন আত্মীয়কে খুড়ার অধিকার দিবো না। সে দিন আরও বৃষ্টি হবে, মাটি খোঁড়াবে আর পানি জমবে, এই কষ্টের কাজ কোন প্রিয় জন করুক তা আমি অন্তত চাব না। রোজ হিসাবে খাটা কামলারা আছে, ওরাই পানি সিচবে আর মাটি খুঁড়বে। আব্বুর হজের এহ্রামের প্রথম কাপড়টা হচ্ছে আমার কাফনের কাপড়, আমি চেয়েই রাখছিলাম।

অনেক আগেই ঠিক করা এইটা। ওইটা ধুয়া ও নিষেধ, আমি আমার আব্বুর গ্রাণ সাথে নিয়ে যাবো নতুন জায়গায় যাওয়ার সময়। আমাকে যখন কাফনের কাপড় পরানো হবে আমার আত্মা তখন তা চেয়ে দেখবে, যেন ঈদে বাবার দেয়া নতুন জামা পরে সন্তান বেড়াতে যাচ্ছে। যখন আমাকে আমার কবরের পাশে নেয়া হবে তখনও বৃষ্টি হতেই থাকবে, বৃষ্টির পানিতে কবর ভরে যাবে, যেন বৃষ্টির পানিও চায় না আমি যাই। তাই ও আমার কবরের জায়গা টুকু দখল করে বসে আছে।

কিন্তু আমি যে সবাই কে নিষ্ঠর হতে শিখিয়েছি, তাই আমাকে সেই ভেজা মাটির কবরেই শুয়িয়ে দিবে সবাই। যে মানুষটা বৃষ্টিতে ভিজতে অসম্ভব ভালবাসে সে কবরে শুয়ে শুয়েও বৃষ্টিতে ভিজবে। আর বৃষ্টিও তাকে আগে যেমনটা ভালোবাসতো তেমন টিই বেসে যাবে। আকাশ কেঁদে তখনও বৃষ্টি ঝরাচ্ছে আমার দুঃখে আর তা কেবল আমিই বুঝতেছিলাম। এভাবেই দাফন ক্রিয়া শেষ হবে।

দিনে অন্তত একবার মৃত্যুর কথা ভাবতে চাই, কারন নাকি ভাবতে হয়। এটাই যে নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। ভেবে ভেবে সব কিছু থেকে মায়া কাটাইতে চাই, পারি না। বেচারি মায়ার ও কপাল পোড়া, যতই কাটাইতে চাই ততই বাড়ে, ঠিক পুকুরের মতো, পুকুর নাকি যতই কাটা হয় ততই বাড়ে, ওই পুকুরটার মতো যেখানে আমার স্বপ্নের শুরুটা হয়েছিল, যেখানে পাক্কা ১টা ঘণ্টা .। .।

.। .। । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।