প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে সম্বিৎ ফিরে পেল রিমি। স্পিড ব্রেকারের ওপর দিয়ে অনেক গতিতে যাওয়ার কারনে রিমিকে রিক্সায় প্রবল ঝাকুনিটা খেতে হল। খানিকটা, না খানিকটা না সম্পূর্ণই অন্য মনস্ক ছিল। সে ভাবছিল তার মার কথা। মার সামনে যেয়ে কিভাবে দাঁড়াবে, কিভাবে কথা বলবে, কিভাবে মা বলে ডাকবে, মা তাকে কিভাবে গ্রহন করবে, প্রথম দেখায় তাকে চিনবে কিনা এই সব।
আজ ১৮ বছর পর দেখা হচ্ছে মার সাথে। ১৮ বছর পর না বলে প্রথমবার দেখা করতে যাচ্ছে বলাই ভাল। শেষ দেখা যখন দেখেছিল সেই সময়ের কথা রিমির কিছুই মনে নেই। কারন তখন যে ওর বয়স মাত্র ৬ মাস।
রেবেকা খানম সকাল থেকে রান্না করছেন।
অনেকগুলো পদ রেধেছেন। সাথে কিছু চকলেট আর আইস ক্রিমও কিনে এনে রেখেছেন। যদি মেয়ে এসব পছন্দ করে। আনন্দের অশ্রুতে তার চোখ বার বার ভিজে যাচ্ছে। মেয়ের জন্যে অপেক্ষার প্রহর তার শেষ হচ্ছে না।
মেয়েটাকে আজ কতো বছর পর আবার দেখবে। মেয়েটাকি আগের মতই আছে, চেহারা পেয়েছিলো তার নিজের। চেহারায় কটটুকু পরিবর্তন হয়েছে কে জানে। মেয়ের কাছ থেকে মা ডাক শোনার জন্যে ব্যাকুল হয়ে বসে আছেন রেবেকা।
এই বাড়িটাই তো, হ্যা, ঠিকানা তো তাই বলে।
মা কি বাসায় আছে। দরজা কি মা’ই খুলবে নাকি অন্য কেউ। অন্য কেউ খুললে নিজেকে কি বলে পরিচয় দেবে সে। আমি একটা অনাথ আশ্রম থেকে এসেছি এটা বলবে নাকি আমি পিতৃ পরিচয়হীন রেবেকা খানমের মেয়ে। বুঝে উঠতে পারছে না ।
ধোয়াটে লাগছে সব কিছু। “ আফা কি এইখানেই নামবেন?” রিক্সাওয়ালার কথায় চেতন ফিরে পেল রিমি। ভাড়া মিটিয়ে নেমে পরল রিক্সা থেকে। অনেকটা অভিমান, অনেকটা আবেগ আর তীব্র বাসনা নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়াল রিমি। দরজার সামনে অনেকক্ষণ দাড়িয়ে থেকে অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে একবার মৃদু কড়া নাড়ল দরজায়।
গণ্ডগোলের মাঝামঝি সময় তখন। একদিন এলাকার চেয়ারম্যান কিছু মিলিটারিসহ হানা দেয় তাদের বাড়িতে। মাঝ রাতে দরজায় বুটের লাথির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় বাসার সবার। বাবা সবাইকে খাটের নিচে লুকাতে বলে বের হন। চেয়ারম্যান বাবার কাছে ভাইয়াদের খোঁজ করলে বাবা তা বলতে অস্বীকার করেন।
সাথে সাথেই প্রচণ্ড গুলির শব্দ। বাবা লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। ভাইয়ারা আর মা স্থির থাকতে না পেরে তারাও বের হয়ে আসে ঘর থেকে। আমি আর ছোট বোন তখন পাশের ঘরের বেড়ার ফাঁকা দিয়ে সব দেখছিলাম। ভাইয়ারা আর মা বের হওয়ার সাথে সাথে তাদেরকেও নির্মম ভাবে খুন করে পিশাচরা।
আসলে ভাইয়াদের খোঁজেই এসেছিল ওরা। কিভাবে যেন ওরা খবর পেয়েছিলো ভাইয়ারা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিবে। তাই তাদের খুজতে মাঝরাতে বাড়িতে আসে ওরা। এরপর আমার ঘরের দিকে আসতে থাকলে আমি আর ছোট বোন খাটের আড়ালে লুকাই। কিন্তু পার পেলাম না।
চুলের মুঠি ধরে টেনে আমাদের ঘর থেকে বের করে আনে ওরা। আমার ৮ বছরের আদরের ছোট বোনটার ওপর হায়েনাগুলো একসাথে ঝাপিয়ে পড়ে। আমার চোখের সামনে একে একে ওরা ৮/৯ জন হায়েনা পাশবিক অত্যাচার চালায়। আমি চেয়ারম্যান চাচার কাছে অনেক কাকুতি মিনতি করলাম ওকে ছেড়ে দেয়ার জন্যে। কিন্তু চাচা আমার কথায় কোন কর্ণপাতই করলো না।
ওদের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বোনটা আমার তখনই এই জগত সংসারের মায়া ত্যাগ করে অন্য ভুবনের পথে পা বারিয়েছে। তারপরেও পাষণ্ডদের অত্যাচার থামেনি। ওই নিরব নিথর দেহের ওপরই চালাতে থাকে তাদের অত্যাচার। এরপর একটা জিপে করে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় কোথাও। সেখানে গিয়ে দেখি বিভিন্ন বয়সের মেয়ে বীভৎস অবস্থায় রয়েছে।
দরজা কারো গায়ে কাপড় নেই, যার গায়ে একটু খানি আছে তা দিয়ে শরীরের ওপরের অংশ ঢাকে তো নিচের অংশ বের হয়ে যায়, আবার নিচের অংশ ঢাকতে চাইলে ওপরের অংশ বের হয়ে যায়। কেউ কেউ দেখলাম অচেতন হয়ে পড়ে আছে। পরের দিন থেকেই বুঝতে পারলাম কেন মেয়ে গুলোর এই অবস্থা। কারন আমার পরিস্থিতিও যে ওদের মতই হয়েছিল। কতো মাস এভাবে ছিলাম জানিনা।
একদিন কিছু লোক এসে উদ্ধার করে নিয়ে যায় আমাদের। আমাদের একটা পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে আমার খোঁজ বের করেন আমার এক মামা। তিনি আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে তোলেন। মামাদের কাছে আমার আদরের কমতি ছিল না তখন।
সবাই চেষ্টা করত আমি যেন আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা ভুলে যাই। কিছুদিন পর হঠাত বুঝতে পারলাম আমি নতুন কাওকে পৃথিবীতে আনতে যাচ্ছি যার বাবা কে আমি জানি না। মামা মামি আর সব আত্মীয়রা চাচ্ছিল যে আসতে চাচ্ছে এই নির্মম পৃথিবীতে তাকে আসতে না দিতে। কিন্তু আমি মন থেকে সায় পাচ্ছিলাম না। এর বাবার পরিচয় না থাকুক মায়ের পরিচয় তো আছে।
আমার সন্তান, গর্ভে তো আমিই নিয়েছি। আমিই একে মানুষ করবো। শেষে আমার জিদের করনে আমি জন্ম দিলাম আমার, আমার নিজের একটা মেয়ে। কিন্তু দুরভাগ্য, মামাদের কারণে মেয়েটাকে আমি বেশিদিন আগলে রাখতে পারিনি। বাধ্য হয়ে ওকে দিয়ে দিতে হয়েছিল একটা অনাথ আশ্রমে।
নিজের স্মৃতিটাকে ঝালিয়ে নিলো রেবেকা।
হঠাত দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। কড়া নাড়ার শব্দই তো? নাকি মনের ভুল। এর মধ্যেই কয়েকবার কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে ছুটে গিয়ে দরজা খুলে হতাশ হতে হয়েছে রেবেকাকে। দরজা খুলে কাওকেই দেখতে পাননি।
এবার কি সত্যিই কড়া নাড়ার শব্দ হোল নাকি এবারও মনের ভুল। তারপরেও রেবেকা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছেন দরজার দিকে। হয়তো সত্যিই এসেছে। অবশ্যই এসেছে। এবার তার মনে হচ্ছে দরজা খুলে নিরাশ হবেন না।
দেখতে পাবেন শত কষ্টের বিনিময়ে জন্ম দেয়া তার নিজের মেয়েকে যাকে তিনি নিজের আদর স্নেহ মমতা দিয়ে বড় করতে পারেন নি, পারেন নি নিজের ছায়ায় রেখে মানুষ করতে। দরজার সামনে দাড়িয়ে বুক কাঁপছে তার। আসতে আসতে দরজার দিকে হাত বাড়ান রেবেকা। তার হাত পা অসাড় হয়ে আসছে। তিনি জানেন না দরজা খোলার পর মুহূর্তে কি হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।