ব্লগিং হোক আগামীর...
আবারো একবছর বয়স বেড়ে গেলো। আরও একটি ঈদ এসে চলে যাচ্ছে। যে যাই বলুন না কেনো, ছোট্টবেলার মতো অ'সাম ঈদ এখন আর করা হয় না।
ছোটবেলার ঈদের আনন্দ শুরু হয়ে যেত আসলে স্কুল ছুটির দিন থেকেই। বন্ধের খুশির সাথে সাথে জুটতো একগাদা ছুটির পড়া।
ছুটির শুরুতেই একটা রুটিন করতাম, কোনদিন কোনটা পড়বো, টিভিতে কোনদিন আলিফ লায়লা দেখবো। আলিফ লায়লাটা রুটিন মেনে দেখা হইতো, পড়াশোনা আর হইতো না! বসে বসে জল্পনা-কল্পনা করতাম ঈদে কি করবো। ঈদ উপলক্ষে তৈরি হওয়া কার্ডের দোকান থেকে কয়েকটা কার্ড কিনে গিফট করতাম জানি দোস্তদের। এভাবে একদিন দুইদিন করে চলে আসতো সেই মহেন্দ্রক্ষন। ঈদে বাড়ি যাওয়া।
চাঁদের পালকি চড়ে, আসলো সবার ঘরে..আসলো খুশির ঈদ..
ছোটবেলায় সব ঈদেই বাড়িতে যেতাম। আমার নানুবাড়ি-দাদুবাড়ি পাশাপাশি । (বুঝতেই পারছেন, প্রেমের মড়া জলে ডোবে না ! ) ভ্রমন হতো ট্রেনে অথবা বাসে। বাসে যাওয়া মানে বিশাল জ্যম পার হয়ে ঢুলুঢুলু শরীরে বাড়িতে পৌছানো। ট্রেনের জার্নিটাই বেশি মজা লাগতো।
ঝুকঝুক ট্রেনের দোলানী ছাড়াও অন্য আকর্ষন ছিল ট্রেনের বিভিন্ন আইটেমের হকারগুলো। অবশ্যই খেতাম ট্রেন ডাইনিং এর কাটলেট আর বোম্বাই টোস্ট।
গ্রামে গেলে প্রথম আনন্দ ছিল দাদী-নানীর সাথে দেখা হওয়া। তখন হয়তো বাকী থাকতো ২-১ টা রোযা। মান-সম্মান ঠিক রাখার জন্য রোযাও রাখতাম।
(নামায-রোযা শুরু করছি ক্লাস সিক্স-সেভেনে থাকতে। তার আগে শখ করে দুই একটা রাখতাম আরকি! ) গ্রামে যাওয়া মানেই পুকুরে নামা। একবার নামলে আর উঠতে ইচ্ছা করতো না। অন্য কাজিন রাও থাকতো। তাদের সাথে কিছু একটা খেলাধূলা হতোই।
একটা মজার জিনিস যেটা শহরে উপভোগ করা যায় না, সেটা হলো ঈদের চাঁদ দেখা। ঈদের আগের রাতে গ্রামের মোটামুটি সব আন্ডাবাচ্চাই হাজির হতো বড় মাঠটায়। চাঁদ দেখে মনের সুখে ঘুমাতাম কারন কাল সকালে ঈদ। ঘুমানোর আগে, বিটিভিতে ঈদ উপলক্ষে কোনো একটা ম্যগাজিন অনুষ্ঠান দেখাতো, সেটা দেখে নিতাম। (আগে সিরিয়াস টিভি দর্শক ছিলাম।
টিভি এখন চোখেই দেখি না!)
ও মোর রমযানের ঐ রোযার শেষে এলো খুশির ঈদ...
ঈদের দিন সক্কাল বেলা। কার আগে কে গোসল করবে সেই প্রতিযোগীতা। এই দিন আর পুকুরে নামার সুযোগ হইতো না। গোসল সেরে নতুন জামা-কাপড় পরে লাইন ধরে সবাইকে সালাম করতাম। নগদে বুইঝা নিতাম সালামীটা।
(সে কি লজ্জা পাওয়ার ভান করতাম!) তারপর একটা জায়নামায বগলদাবা করে রওনা দিতাম ঈদগাহের ময়দানে। সঙ্গে ছোটখাটো একটা দল। রাস্তায় চলত চলতে সেই দল ভারী হতো।
ঈদগাহ টা আসলে স্কুলের বড় মাঠ। প্রতিবছর ঈমাম সাহেব একই বয়ান দিতো।
যার কারনে সেইটা মুখস্থই ছিল! ঈদগাহে যাওয়ার মূল আকর্ষন কিন্তু নামায পড়া না! এটা ভাবলে ভুল করবেন! ঈদগাহের মাঠের পাশেই বসতো মেলা। খুব অল্প দামের মধ্যে এমন কোনো খেলনা নাই যে সেখানে পাওয়া যেত না। সমবয়সী সব কাজিনরা মিলে ঝাপিয়ে পরতাম। সালামীর টাকা একটু কমিয়ে কয়েকটা খেলনা বাড়িয়ে নিতাম। সবচেয়ে প্রিয় ছিলো পিস্তল আর বিভিন্ন রকম বাঁশি।
বাঁশি নিয়ে একটা ঘটনা আছে! একধরনের বাঁশি আছে যেটার একমাথায় বেলুন লাগানো থাকে। ফু দিয়ে বেলুন ফুলিয়ে ছেড়ে দিলে বাঁশি বাজতে শুরু করে। কাহিনী হচ্ছে, দোকানী সবসময় এক ধরনের বিশেষ ব্র্যন্ডের বেলুন সরবরাহ করতো। (কিসের বেলুন,কোন ব্র্যন্ড, কি আসয় বিষয়, কইতাম পারতাম না, বুঝে নিন ) প্রথম যে বার এই বেলুন (প্যকেট সহ..ছোটদের জন্য বলছি..এটা প্যকেটে থাকে! ) কিনে বাড়ী রওনা দিলাম, মনের মধ্যে একটা খচ খচ করতে লাগলো। আমি জানতাম কিছু একটা ঘটনা আছে এই বিশেষ বেলুনকে ঘিরে, কিন্তু ঘটনা কি সেটা জানা ছিলো না।
(সত্যি বলতে কি, এখনো জানার সুযোগ হয় নাই...হে হে..এহেম.. ) প্যকেট নিয়ে তো বাসায় আসলাম। বসার ঘরে সব মুরব্বি নারী পুরুষ বসা। আমি সবার সামনেই মোড়ক উন্মোচন করলাম। আমি ভাবতেই পারি নাই ভেতর থেকে এই রকম তেল বের হবে। ঘিন্নাই লাগতেছিল।
এমন সময় এক মুরব্বী আইসা আমারে উদ্ধার করলো। প্যকেট সহ বেলুনটা বাইরে ফেলে দিলো। ( ফেললি কেন, রাখতি, পরে তোর কামে লাগতো ! ) এরপর থেকে আর ঐ বেলুনের সান্নিধ্যে আসা হয় নাই।
আরেক দফা কোলাকুলি সেরে নিতাম নামাযের পরেই। এরপরে শুরু হতো কার কতো সালামী হলো এবং খেলনা কেনার পর কতো বাকি আছে সেটা গোনার পালা।
মজার ব্যপার, সবার মোটামুটি সমান হইতো। একজনের টাকার পরিমান দেখে আরেকজনে দেয় কিনা! মাঝখানের খাবার পর্ব ছিল। তারপরে যথারীতি বসে যেতাম বোকা বাক্সটার সামনে। যেদিন ফিরে আসতাম সেদিন খুব খারাপ লাগতো। আর স্কুলের ছুটি শেষ হলে কষ্টের এক একটা খাতা খোলা।
শুরুতে পড়াশোনা করে দুনিয়া উল্টাইয়া ফেলার যে প্ল্যন থাকতো সেটা আর বাস্তবের মুখ দেখতো না..পদ্মা সেতুর মতো আর কি! তবে স্কুল শুরুর দিন সবার সাথে কোলাকুলিটা করতাম...মাশাল্লাহ..বিশেষ বিশেষ স্টাইলে! বান্ধবীদের সাথে কোলাকুলির সুযোগ হয় নাই কখনো!
এরপরে আরেকটু বড় হয়ে গেছি। গ্রামে আর নিয়মিত যাওয়া হয় না। তবে বড় হওয়ার পর একটা অন্য ব্যপার টের পেলাম। গ্রামের কিছু দুষ্টু ভাবী আছেন! দেবর দেখলেই তাদের মুখে রহস্যময় একটা হাসি চলে আসে। হাতে মেহেদী আর মুখে পান নিয়ে ওনারা হেলে দুলে কথা বলেন।
ঈদের আগের রাতে মেহেদী লাগানো হয়। সেই মেহেদী উৎসবে ডাক পরে দেবরদের। বিশেষ করে বয়সে পোলাপান দেবরদের। একটু বয়স্ক দেবররা আবার অন্য লাইনে কথা বলে !
শহরের ঈদ বলতে কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়কার ঈদের কথাই বলতে হয়। চাঁদ দেখা নাই, সালামীর তেমন বাড়াবড়ি নাই।
শুধু বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজিটা হয়। আর একসাথে শপিং এ যাওয়া। রোযার মধ্যে একটা ইফতার পার্টিও বাঁধা ধরা। ঈদের দিন বিভিন্ন বাসায় ঘুরে অথবা ঈদের আগের দিন সবাই বসে ঠিক করতো এই বছর কোন বান্ধবীর বাসায় গিয়ে বান্ধবীর মাকে চমকে দেয়া যায়। প্ল্যান ঠিকই করতো, কিন্তু বাস্তবায়ন আর হতো না।
অন্তত আমি কোনোদিন সুযোগ পাই নাই। এখন বুঝি, হারামী গুলা একা একা যার যার পছন্দের বান্ধবীর বাসায় যাইতো। আর আমি ঘরে বইসা আঙ্গুল চুষতাম।
তারপর অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। বন্ধুরা সবাই এখন পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, পৃথিবীর সবদিকে ভারসাম্য রক্ষার তাগিদে, পৃথিবী যাতে একদিকে হেলে না যায় আর কি! কাজিনরাও বড় হয়ে নিজ নিজ জগতে ব্যস্ত হয়ে গেছে।
বন্ধুরা যার যার পছন্দের বান্ধবীকে নিজের ঘরে এনে রেখেছে! এখনো তারা সেই বান্ধবীর বাসায় যায়, কিন্তু বর হয়ে!
আর আমি। যাত্রাবাড়ীর জ্যমের ভয়টা এখন গ্রামের ঈদের আকর্ষণের চাইতেও ভয়ংকর মনে হয়। ট্রেনের এতো লোক দেখলে মাথা ঘুরায়। জায়নামায বগলদাবা করে আর ঈদের নামায পড়তে যাই না। ঈদ কার্ড এখন আর কেনা হয় না।
অজানা অচেনা মানুষকে আর্থিক সম্পর্ক রক্ষায় ঈদ কার্ড পাঠানো হয়। বন্ধুদের জন্য এসএমএস বা ফেইসবুকই ভরসা। (আফসোস..ঈদ মোবারক বললেই কোলাকুলি করতে ইচ্ছা করে, কিন্তু ফেইসবুকে এই সুবিধা এখনো চালু করে নাই। ) খেলনা বা বেলুন কোনোটাই কেনা হয় না। ফার্মেসীতে গেলে মাঝে মাঝে ঐ বেলুনের দিকে তাকিয়ে থাকি।
দামটাও জিজ্ঞেস করা হয় না। আড্ডা দিতে হয় নিজের সাথেই। ভাবীরাও মেহেদী লাগানোর আব্দার করে না। আগের মতো এখনো ভাবতে থাকি কোন বান্ধবীর বাসায় যাওয়া যায়?
সামুর সবাইকে ঈদ মোবারক!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।