ওই যে নদী যায়রে বইয়া...
প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলের বিষয়ে পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশের জের ধরে আমার ওপরে নেমে আসে পরপর চারটি সাজানো মামলা নামের দুর্যোগ। আমার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ (প্রথম আলো) সপরিবারে আমাকে নিয় গেলেন পত্রিকাটির ঢাকার কার্যালয়ে। আমার বিরুদ্ধে সাজানো মামলার খড়্গ চালানো শুরু হয় ২০০৯ সালের ৮ সেপ্টেম্বর রাত থেকে। ১০ সেপ্টেম্বর রাতের মধ্যে ধর্ষণের অভিযোগ এনে করা একটি মামলাসহ মোট তিনটি মামলা করা হয়। ১২ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১২টার দিকে আমরা প্রথম আলো কার্যালয়ে পৌঁছাই।
সরাসরি চলে যাই মতি ভাইর (প্রথম আলো সম্পাদক) কক্ষে। আমাদের দেখেই মতি ভাই ভীষণ ব্যস্ত হযে পড়লেন। এরই মধ্যে উপ সম্পাদক মুকুল ভাই (আবদুল কাইউম), সুমনা আপা (সুমনা সারমিন), সহযোগী সম্পাদক মিজান ভাই (মিজানুর রহমান খান), বার্তা সম্পাদক লাজ্জাত ভাই (লাজ্জাত এনাব মহসি), প্রশাসনিক কর্মকর্তা আনোয়ার ভাই (আনোয়ার হোসেন চৌধূরি), ওই সময়কার সহকারী ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) আলম ভাই (মো. নুরুল আলম) মতি ভাইর কক্ষে এলেন। ঢাকা অফিসের পৌঁছানোর পরও আমাদের উৎকণ্ঠা কাটেনি। সংক্ষিপ্ত আলাপনে মতি ভাই আমাদের কাছ থেকে জেনে নিলেন সার্বিক পরিস্থিতি।
এর পর মামলা সংক্রান্ত কাগজপত্র চেয়ে নিলেন। ওগুলো পর্যালোচনা করে মিজান ভাই বললেন একটি মামলায়ও বিচারিক আদালত বা নিম্ন আদালত থেকে জামিন পাওয়া যাবে না। শুনে অনেকটা ঘাবড়ে গেলাম। মতি ভাই বললেন 'ভয় করো না। ধৈর্য ধরো, আমি নিজে তোমাদের জন্য পত্রিকায় লিখব।
আমরা এ মামলাগুলো নিয়ে উচ্চ আদালতে যাব। '
আনোয়ার ভাই আমাদের থাকার খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। প্রথম আলো কার্যালয়ের কাছে একটি হোটেলে উঠলাম আমরা। হোটেলে উঠে মনে হল, এবার হয়তো আমাদের যাযাবর জীবন শুরু হল। হোটেলে মালামাল রেখে চলে গেলাম প্রথম আলো কার্যালয়ে, আমি একা।
এদিকে চুয়াডাংগার সাংবাদিক সনি ভাইও (মো. শাহ আলম সনি) সাজানো মামলার শিকার হয়ে সপরিবারে প্রথম আলোর ঢাকা কার্যালয়ে চলে এসেছেন দুদিন আগে। ১২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা থেকে সনি ভাই আর আমি যেন মাণিক-জোড়। সারাক্ষণ একই সঙ্গে।
আদালত বন্ধ থাকায় মামলার জামিন আবেদনের ব্যাপারে কোনো কাজ করা যাচ্ছে না। তবে কৌশলগত দিক নিয়ে নিযমিত আলোচনা হচ্ছে।
হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও মতি ভাই নিয়মিত আমাদের জন্য সময় দিতেন। আমাদের বিষয় নিয়ে ভাবতেন। মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে হাস্য-রস করতেন।
১৩ সেপ্টেম্বর নিউজ ডেস্ক থেকে আলীম ভাই (আলীম উজ জামান) ফোন করে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। সোজা চলে গেলাম তাঁর কাছে।
তিনি আমার হাতে একটা লেখা দিয়ে একটি ডেক্সটপ দেখিয়ে সেটি অন করতে বললেন। আমি ডেক্সটপ অন করার পর পর তিনি আমোকে আরো কিছু কৌশল দেখিয়ে দিয়ে বললেন, এবার এই নিউজটা এডিট (সম্পাদনা) করুন। আমি অতিরিক্ত মনযোগ ও সতর্কতার সঙ্গে সম্পাদনার কাজটি করলাম। কাজ শেষে আলীম ভাইকে জানালে তিনি সেটির একটি কপি প্রিন্ট করে দিতে বললেন। প্রিন্ট কপি তাঁর হাতে দিলাম।
তিনি সেটি কয়েকবার পড়লেন। এর পর তিনি দুই তিন বার হাত-তালি দিয়ে ডেস্কের সবাইকে কাছে ডাকলেন। সবাই কাছে আসলে তিনি বললেন, লিপটন ভাই পাস করেছেন। বিষয়িটি সম্পর্কে কিছু না বুঝে আমি বোকার মত আলীম ভাইর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছু সময়।
হ্যাঁ, এর পর থেকে প্রতি দিন আমি আলীম ভাইর সঙ্গে নিয়মিত ডেস্কে কাজ করে যাচ্ছিলাম।
সংবাদ সম্পাদনার কাজ। (একজন সাব এডিটর যা করেন)। বিকেল চারটা থেকে রাত ১০টা। কোনো কোনো দিন রাত দেড়টা পর্যন্তও ডেস্কে থেকেছি।
বেশি রাত পর্যন্ত অফিসে থাকায় একটা বাড়তি সুবিধা ছিল।
সেটি হল মতি ভাইর সঙ্গে বেশি সময় পাওয়া। রাত দশটার পর মতি ভাই নিউজরুমে ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে কথা বলেন। বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। আর আমিও মতি ভাইর পেছনে ঘুরঘুর করতাম। আমার জীবনের এত বড় একটা দুর্যোগের পর প্রথম আলোর কার্যালয়ে, মতি ভাইর সান্নিধ্য আমার সকল দুশ্চিন্তা যেন মুছে দিয়েছিল।
আমি মনেই করিনি আমার কোনো সমস্য রয়েছে। চারটি মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভূক্ত আসামী আমি। এত মানসিক চাপের মধ্যেও যখন মতি ভাইর কাছে যেতাম, তখন মনে হত কোনো সমস্যাই নেই আমার। যা কিছু ঝামেলা হচ্ছে সবই তুচ্ছ। মন্ত্র-মুগ্ধের মত শুধু মতি ভাইর কথা শুনতাম।
এমনি করে কেটে গেলো অনেকটা দিন। ঈদ ঘনিয়ে আসলো। মতি ভাই বললেন, এক কাজ করো, ঈদের ছুটিতে সপরিবারে বেড়িয়ে আসো। দেশের যেসব যায়গায় যাওয়া হয়নি সেসব যায়গায় ঘুরে আসো। আমরা অফিস থেকে গাড়ির ব্যবস্থা করে দিই।
ঘুরে আসলে মন ভালো থাকবে।
বললাম, বেড়াতে যেতে ইচ্ছে করছে না। আমরা এখানেই থাকবো। মতি ভাই বললেন, 'ভেবে দেখো। ' ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।