ওই যে নদী যায়রে বইয়া...
২০০৯ সালের ২১ আগস্ট। পত্রিকায় এলাকার একজন প্রভাবশালীর অবৈধ দখল সংক্রান্ত বিষয়ে আমার লেখা একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সঙ্গত কারণেই প্রভাবশালী ওই ব্যক্তি আমর ওপর ক্ষুব্ধ হন। পরের দিন ২২ আগস্ট বিকেলে ওই প্রভাবশালী ব্যক্তির তাঁর দুজন অনুসারীকে দিয়ে আমার বাসায় একটি মিষ্টির প্যাকেট পাঠান। তাঁরা মিষ্টির প্যাকেটটি আমার বাসায় রেখে বলেন, সাহসী এবং বস্তুনিষ্ঠ প্রতিবেদন পত্রিকায় প্রকাশের জন্য শুভেচ্ছা ও অভিনন্দনসহ অমুক ভাইয়া ( অবৈধ দখলবাজ সেই প্রভাবশালী) আপনার জন্য এই মিষ্টি পাঠিয়েছেন।
যা ই হোক, পুরো বিষয়টি আমাকে ভাবিয়ে তুলল। আমি নিশ্চিত যে, ওই প্রভাবশালী এবার আমার পেছনে লেগে গেছেন। মনে হল বিষয়টি কেমন যেন বাংলা সিনেমার 'ডিপজল' স্টাইলের দিকে মোড় নিচ্ছে। আমি পুরো ঘটনা নিয়ে পত্রিকা অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপ করলাম। আমাকে বলা হল সতর্ক থাকতে।
এর পর ৬ সেপ্টেম্বর ওই প্রভাবশালীর অনুসারীদের আরেকটি অপকর্ম (এটিও দখলবাজির ঘটনা) সংক্রান্ত বিষয়ের তথ্য ও আলেকচত্রি সংগ্রহ করতে গেলাম আমার শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে একটি উপশহরে।
৭ সেপ্টেম্বর ওই তথ্যগুলো দিয়ে প্রতিকবদন তৈরি করতে শুরু করেছি। কিছু স্বাক্ষাতকার নেওয়া বাকি। ওগুলো নিতে আরো ২-৩ দিন লাগবে। এ অবস্থায় ৮ সেপ্টেম্বর রাতে আমার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির সাজানো অভিযোগ তুলে প্রভাবশালী ওই নেতার অনুসারীরা থানায় একটি মামলা দায়ের করে।
মামলায় আমার ছোট ভাইকেও আসামী করা হয়। শুধু মামলা করেই ক্ষান্ত হয়নি ওরা। ওই রাতেই আমার বাসায় পুলিশ পাঠিয়ে আমাকে ওই মামলার আসামী হিসেবে গ্রেপ্তার করানোর চেষ্টা করা হয়। আমি গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু বাসায় পুলিশের হানায় বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন আমার মা ও বাবা।
ওই সময় পুলিশের পাশাপাশি ওই প্রভাবশালীর ক্যাডাররা আমার বাসায় ঘরের বাইরে অবস্থান নেয়। তারা বিভিন্ন রকমের ভীতিকর মন্তব্য করতে থাকে। এতে আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন আমার বাবা ও মা। বিশেষ করে আমার মা অনেকটা অপ্রকিতস্থ হয়ে পড়েন।
পরে ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা গেছে, আমার মায়ের ওই রাতে ছোটখাটো একটা স্ট্রোক হয়েছিল।
পুলিশ ও ওই প্রভাবশালীর ক্যাডারদের চোখ এঁড়িয়ে গ্রেপ্তার হয়রানি থেকে রেহাই পেতে ওই রাতেই আমি এলাকার বাইরে সরে যাওয়ার চিন্তা করি। এক বন্ধুকে ফোন করে জরুরি ভিত্তিতে আমার জন্য একটি মোটরসাইকেল পাঠাতে বললাম। রাত প্রায় দেড়টা। আমরা মোটরসাইকেলে এলাকা ত্যাগ করছিলাম। ওই সময় পেছন থেকে আরো কয়েকটি মোটরসাইকেল আমাদের ধাওয়া করে।
পরে জানতে পেরেছি, পুলিশ ও প্রভাবশালী ওই নেতার ক্যাডাররা আমাদের ধরার জন্য পিছু নিয়েছিল। এলাকা ছাড়ার সময় আমার পরনে ছিল একটি টি-শার্ট ও লুঙ্গি। হাতে কোনো টাকা পয়সা নেই। সম্বল শুধু একটি মুঠোফোন।
রাত আড়াইটার দিকে শহর থেকে দূরে নদীর পাড়ে গিয়ে একটি জেলেনৌকা দেখতে পেলাম।
অনুরোধ করায় নৌকার মালিক এক জেলে ওপারে পার করে দিতে রাজি হলেন। আমরা নৌকায় উঠে বসলাম। জেলে ভদ্রলোক আলো জ্বালিয়ে আমাদের দেখে চিনতে পারলেন। ওপারে পৌঁছানোর পর নৌকা থেকে নামতে যাচ্ছি, তখন জেলে ভদ্রলোক বলনে, স্যার, কিছু মনে করবেন না। 'আপনেরা বড় কোনো বিপদে পড়েছেন, বুঝতে পারছি, আপনাগো হাতে কোনো টাকা-পয়সা নাই।
' এ কথা বলে নৌকার ছাউনির মধ্যে বিছানার ভাজ খুলে তিনি কিছু টাকা বের করলেন। হাতে দিয়ে বললেন, 'স্যার ফিরাইয়া দিবেন না। তাইলে খুব কষ্ট পাবো। '
ওঁর কাছ থেকে টাকাগুলো না নিয়ে পারলাম না। গুনে দেখি ৬০০ টাকা।
বললাম আপনি কাল সকালে টাকাগুলো পেয়ে যাবেন।
পারে উঠে উনি আমাদের কিছুটা পথ এগিয়ে দিলেন। এর পর শুরু হল অন্ধকারে পথ চলা। আমাদের জেলা ছাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী জেলার একটি উপশহরে পৌঁছালাম। তখন ভোর সোয়া ছয়টা।
খবর নিয়ে শুনি ওই প্রভাবশালী নেতার অনুসারীরা রাত থেকে পুরো এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে লোক দিয়ে পাহারা বসিয়েছে আমাদের ধরার জন্য। ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে জেলা শহরে কর্মরত সংবাদকর্মীরা বিষয়টি জানার জন্য আমাদের এলাকায় পৌঁছান। ওই সময় সেই প্রভাবশালীর অনুসারী ক্যাডাররা হামলা চালান জেলা থেকে আসা সংবাদকর্মীদের ওপর। তারা কয়েকজন সংবাদকর্মীকে লাঞ্ছিত করে। তাঁদের ক্যামেরা ভাঙচুর করে।
পরে র্যাবের সহযোগিতায় তাঁরা জেলা সদরে যেতে সক্ষম হন।
পুরো দিনটি কাটে টান টান উত্তেজনায়্। কী করব, কী করা উচিত এ সব ভাবছি। রাতে এক বাসায় আস্তানা গেড়ে কোনো রকম কাটিয়ে দিলাম। ১০ সেপ্টেম্বর সকালে প্রভাবশালী ওই নেতা এলাকায় যান।
আর এতে করে তাঁর অনুসারীরা আরো বেশি উস্কানি পান। আমার বিরুদ্ধে প্রকাশ্য জনসভায় বক্তৃতা করেন প্রভাবশালী ওই নেতা এবং তাঁর কয়েকজন অনুসারী। জনসভা শেষে তারা আমার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অশালীন স্লোগানসহ মিছিল করে। আমার ও আমার পরিবারের ওপর মানসিক চাপ আরো বাড়তে থাকে।
১০ সেপ্টেম্বর রাতে আমার বিরুদ্ধে থানায় পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে পরপর আরো দুটি সাজানো মামলা দায়ের করা হয়।
এর মধ্যে একটি মামলা করা হয় ধর্ষণের অভিযোগ এনে। অপরটি প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ। ১১ ডিসেম্বর সকালে আমি সরাসরি ফোন করি আমার পত্রিকার সম্পাদকের কাছে। আমার বিরুদ্ধে পরপর তিনটি সাজানো মামলা দায়েরের কথা তাঁকে জানাই। তিনি একটু ভেবে আমাকে বলেন, সপরিবারে ঢাকা অফিসে চলে যেতে।
আমি তাঁকে জানাই, আমি এলাকা থেকে অনেক দূরে রয়েছি। তখন তিনি আমাকে ঢাকা অফিসে চলে যেতে বলেন। আর পরিবারের অন্য সদস্যদের ব্যাপারে ঢাকা থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আমাকে জানান। আমি ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা করলাম। পরিবারের অন্য সদস্যরাও ঢাকা অফিসে পৌঁছে গেছে।
তবে আমার মা ও বাবা এলাকায় থেকে গেলেন। এর পর আমার বিরুদ্ধে আরো একটি সাজানো মামলা করা হয় ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায়। এ মামলাটিতেও প্রতারণা ও বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়।
উল্লেখ্য, আমার বিরুদ্ধে করা চারটি সাজানো মামলার তিনটিতেই আমার ছোটভাইকেও আসমী করা হয়। শুধুমাত্র ধর্ষণের অভিযোগ এনে করা মামলাটিতে আমাকে একা আসামী করা হয়।
আমাদের বিরুদ্ধে করা সাজানো হয়রানিমূলক মামলাগুলোতে এমন সব ধারা যোগ করা হয়েছিল যে, নিম্ন এবং বিচারিক আদালতে ওই মামলাগুলোতে আমাদের জামিন হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন আইনজীবীরা। এ অবস্থায় আমাদের পত্রিকার সম্পাদক মহোদয় আইন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, উচ্চ আদালতে (সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ) আমাদের জামিনের জন্য আবেদন করা হবে।
রমজান মাস। উচ্চ আদালতের কার্যক্রম বন্ধ। সে কারণে আমাদের আরো বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হল।
২০০৯ সালে ৪ অক্টোবর দুপুর। আব্বার সঙ্গে কথা হচ্ছিল ফোনে। বললাম মা কে দিন। মা'র সঙ্গে কথা বলব। তখন আব্বা বললেন, তোমার মা'র শরীরটা একটু খারাপ তাই ঘুমাচ্ছেন।
ওই দিন সন্ধ্যায় মা'র সঙ্গে কথা হল। কথায় মনে হল মা অনেক বেশিই অসুস্থ। আবার মন খারাপ লাগতে শুরু করল। মা'র সঙ্গে কথা শেষ করে আমাদের পরিবারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত এমন একজনকে ফোন করে বললাম তুই একটু বাসায় গিয়ে দেখে আয়- মা কেমন আছেন। ও আমাকে বলল, ভাইয়া, আমি রাত ১১টার পর যাব।
এখন যাওয়া যাবে না। আমি ওকে অনেকটা ধমকের সুরে বললাম, আমি বলছি এখনই যা। ও তখন আমতা আমতা করে বলল, ভাইয়া, আমি চাচিআম্মাকে দেখতে গেলে আমার বড় বিপদ হবে। তার পরও আমি রাতে পালিয়ে গিয়ে তাঁকে দেখে আসব। আমি বললাম তোর আবার কী বিপদ হবে।
ও তখন বলল, চাচিআম্মা অনেক অসুস্থ। আমি তাঁর জন্য অসুধ দিয়ে আসতাম। এ সব টের পেয়ে ভাইয়ার (সেই প্রভাবশালীর) লোকজন আমাকে থ্রেট (হুমকি ) দিছে। তারা আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছে, তুমি যদি আর ওই বাসায় যাও, তাহলে তোমার বিরুদ্ধে থানায় তিনটি মামলা করা হবে।
বললাম, থাক তোর আর যাওয়ার দরকার নেই।
পরে এলাকায় ফিরে জেনেছি, আসলে ওই সময় আমার মা, বাবা দুজনই ভীষণ অসুস্থ ছিলেন। আর আমার অসুস্থ মা-বাবার জন্য যাঁরা ওষধ নিয়ে যেতেন তাঁদের সবাইকেই মামলা করে হয়রানি করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ওই হুমকিদাতাদের মধ্যে আমার এক সময়কার খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু দুএকজন সংবাদকর্মীও রয়েছেন। তাঁরা যে শুধু আমার সহকর্মীই তাই নয়, আমার সহপাঠীও ছিলেন। আমার মা তাঁদেরকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন।
আমি অবাক হলাম, ওদের সঙ্গে তো আমার ভাল সম্পর্কই ছিল! আমার বিরুদ্ধে মামলাগুলো হওয়ার পরপরই ওদের ভেতরের চেহারাটা বেরিয়ে এলো! আসলে কি এত দিন আমার সঙ্গে ভালো সম্পর্কের নামে এক ধরণের ভনিতা করেছে?
এ ধরণের মুখোশধারী বন্ধুরা আসলে প্রকৃত বন্ধূ নয,এরা প্রথম সারির উঁচু মানের প্রতারক, বিশ্বাস ঘাতক। এরা হাসতে হাসতে যে কোনো মানুষকে খুনও করতে পারে। অন্তত আমার সে রকমই মনে হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।