ব্লগে আজ আমার যাত্রা শুরু হলো , রাস্তা ঘাট সব আজব আজব লাগতাসে!! একটা বই হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি । নাড়াচাড়া করছি । খুলে দেখার সাহস হচ্ছে না । মনে হচ্ছে মলাটের ভাজ খোলার সাথে সাথে একটা মৃত মানুষের আত্মা এসে আমার ওপর ভর করবে । যার মৃত্যুর রাজসাক্ষী হয়ে আমি এখনো বেচে আছি ।
ভয়ের সাথে কিছুটা আত্মগ্লানি ও বোধহয় কাজ করছে এখন । মনে পরে গেছে প্রবাদ টাও - অতিকায় হস্তি লোপ পায় , আর বীর দর্পে টিকিয়া থাকে তেলাপোকারা । এই ৩৬৫ দিন তার থেকে বেশি বেচে থেকে আমি মানবসমাজের কি উপকারটা করতে পেরেছি , কি অবদান রাখতে পেরেছি আমার চারপাশে ? আপাত দৃষ্টি তে হয়তো কিছুই না । শুধু আমার কিছু কাছের মানুষ কে অযাচিত কষ্ট পাওয়া থেকে বাচাতে পেরেছি । কিন্তু গোটা বাংলাদেশ কে অপরিমেয় কষ্ট বা ক্ষতি থেকে তো বাচাতে পারিনি আমি ।
সেতো ঠিকই একটা চিরস্থায়ী বিরাট শুন্যতা আর ক্ষতস্থান রেখে চিরদিনের জন্য আমাদের সবার মাঝ থেকে হারিয়ে গেলো ! নতুন কোরে আবার কিছু একটা দিয়ে যাবার প্রচণ্ড চেষ্টার মাঝ থেকে খুব আকস্মিক ভাবেই ! 'কাগজের ফুল' সিনেমার শুটিং লোকেশন দেখে ফেরার পথে ।
'তারেক মাসুদ' কি জানি নামটা লিখতে যেয়েও বোধয় হাতটা ঈষৎ কেপে উঠলো কিনা ! জন্ম ১৯৫৬ সালে ফরিদপুর এ । মৃত্যু ১৩ আগস্ট ২০১১ মানিকগঞ্জ এর ঘিওর উপজেলায় এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ।
আক্ষরিক অর্থে আমাদের তারেক মাসুদের জন্ম ১৯৮২ সালে , চিত্র শিল্পী এস এম সুলতানের উপর নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র আদম সুরত এর মধ্য দিয়ে । মুলত বিকল্প ধারার চলচিত্র নির্মাণ এর হাতে খড়ি তার এখান থেকেই হয়েছিল ।
ফিল্মের উপর কোন ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়ায় তিনি আদম সুরত এর কাজ শুরু করেন । তার মনে হয়েছিল সুলতান কে নিয়ে ছবি বানালে একদিকে যেমন একজন বড় মাপের মানুষের ডকুমেনটেশন হবে , ঠিক তেমনি ছবি বানাতে গিয়ে ছবি বানানোর শিক্ষা টাও হবে । স্বশিক্ষিত হওয়া যাবে । এই চিন্তা ধারা থেকেই বোঝা যায়, কাজ শুরুর প্রথম থকেই তিনি বাংলাদেশের অন্যসব চলচিত্র নির্মাতাদের থেকে কতখানি বেশি সৃজনশীল এবং বিকল্পমনা ছিলেন । এই একটা মাত্র প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণই ভিত গড়ে দিয়েছিল তার ভবিষ্যৎ চলচ্চিত্র বিনির্মাণ এর ।
পেয়েছিলেন একটু তেই ভেঙ্গে না পড়ার মানসিক শক্তি । । খুব দ্রুত নাম জশ প্রতিপত্তির দিকে ধাবিত হতে তিনি কখনো ইচ্ছুক ছিলেন না। দীর্ঘ একটা বিরতির পর মুক্তিযুদ্ধের সময় ধারণকৃত দেশি বিদেশি আনেকগুলো ফুটেজ কে সম্পাদনা করে তিনি সৃষ্টি করেন এক অনবদ্য প্রামাণ্য চিত্র মুক্তির গান । মুলত এটি আমেরিকান সাংবাদিক লিয়ার লেভিন এর ধারণকৃত কোলকাতার শরণার্থী শিবিরের দৃশ্য গুলোর বুদ্ধি ব্রিত্তিক, স্বাধীন সম্পাদনার ফল ।
যে ছবিটা দেখে গ্রাম বাংলার প্রত্তন্ত অঞ্চলের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ কে নতুন ভাবে উপলব্ধি করতে শেখে ।
১৯৯৯ , মুক্তি পায় তার অন্য আর একটি চলচ্চিত্র মুক্তির কথা । নির্মাতার ভাষায় "মুক্তির গান ছবিতে যা নেই, আমরা মুক্তির কথা দিয়ে তার পূর্ণতা দেবার চেষ্টা করেছি "।
এরপর একে একে নির্মিত হয়েছে নারীর কথা ২০০০, নরসুন্দর-২০০৮ ।
২০০২ সাল, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হল একটা অধ্যায় ।
মাটির ময়না ! বিশ্বের নামি দামি সব চলচ্চিত্র উৎসব এ অবিশ্বাস্য রকমের সাফল্য পেয়ে প্রথম বারের মত বাংলাদেশকে এক অতুচ্চ জাইগাতে আসীন করলো । পেল কান চলচ্চিত্র উৎসব এ' সমালোচক পুরস্কার ' । বাংলাদেশের প্রথম কোন ছবির অস্কারে মননয়নের সম্মান ও এই বিরল গুণী পরিচালকের হাত ধরে আসা । তবে সবথেকে পরিহাসের বিষয় আমাদের নিজ মাটিতেই বেশ কিছুদিনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল চিত্র টি।
এরপর দীর্ঘ বিরতির পরে কাগজের ফুল নির্মাণ এর উদ্যোগ গ্রহন ।
সেটার লোকেশন দেখতে প্রভাত ফেরির আলোয় পুরো ইউনিট , কাথেরিন মাসুদ, মিশুক মুনির সহ ১৩ই আগস্ট ২০১১ মানিকগঞ্জের দিকে যাত্রা ...
১৩ই আগস্ট , ২০১২ আমি বইটা হাতে নিয়ে এখনো নাড়াচাড়া করছি । কাপাকাপা হাতে মলাট টা উল্টাতেই চোখ আটকে গেল একটা বাক্যের ওপর । আমার ই এক বন্ধুর লেখা - তোমার পথেই ও থেমে গেছে , ওকে জানো ! মনটা কেমন যেন এক ঘোরের মধ্যে যেয়ে স্থির হয়ে গেলো !
চোখ বন্ধ করলে এখনো মনের পর্দায় একটার পর একটা দৃশ্য , শব্দ, বর্ণ সহো স্পষ্ট ভেসে ওঠে । সকাল আনুমানিক ১১। ৪৫ ।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে বাসের মধ্যম গতিতে ছুটে চলা । চালকের পিছনের সিট টা হেলিয়ে আমার আয়েশি ভঙ্গিতে বসে থাকা । কানে যথারীতি লং জার্নির অভ্যাস মতো লো ভলিউম এ বেজে যাওয়া কোন রোম্যান্টিক গানের সুর । বাক পেরতেই সামনে একটা সাদা রঙের মাইক্রো বাস । তারপর গগনবিদারী একটা শব্দ ।
মুহূর্তেই শত সহস্র হয়ে কাঁচ ভাঙ্গা গুড়াতে সমস্ত শরীর ভরে যাওয়া । বাসটার গাছে ধাক্কা খেতে খেতে বিপদজনক ভাবে খাদের কিনারায় এসে থেমে যাওয়া । চোখের সামনে ড্রাইভার আর হেল্পার এর সাদা শার্ট এ লাল টকটকে ছোপ ছোপ রক্ত। পিছনে বাচ্চা আর মহিলাদের জোর গলার কান্না । সামনে দরজা ভাঙ্গার আপ্রান চেষ্টা ।
মনেহয় ১৫ মিনিটের মত হবে । তখন ও জানিনা বাইরে কি ভীষণ বিভীষিকা অপেক্ষা করছে !
৫ জন জলজ্যান্ত মানুষ বাইরে পড়ে আছে । কল্পনাতীত ভাবে মৃত ! সেই বর্ণনা সত্যিই এখানে আর টানতে ইচ্ছা করছে না । মাথা টা কেমন জানি ভারি ভারি লাগছে !!
শেষ করবো এই মহান ইচ্ছেখুশির সৃষ্টিকর্তারই কিছু বলে যাওয়া অমোঘ সত্য কথন দিয়ে ।
" আমার মনে হয় কিছু জাতি আছে, যারা অমৃত সম্ভাবনাময় ।
কিন্তু ট্রাজেডির যে চরিত্র, সেটা হচ্ছে অসম্ভব সম্ভাবনাময় অথচ সামান্য একটি ছোট জাইগায় সেই বিরাটত্বের থমকে যাওয়া । এটা একটা জাতিরই বৈশিষ্ট্য । আমাদের জাতির নিয়তি কিনা, জানিনা । আমরা বঙ্গবন্ধু থেকে জহির রায়হান, আলমগির কবির কে হারিয়েছি "।
যিনি একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে গ্রহনযোগ্য , আস্থাবান হয়ে ওঠেন , ঠিক তখনই তাকে চলে যেতে হয় বিচিত্র কারনে ।
ঠিক একই রকমের কালো অধ্যায় আবার লেখা হয়ে থাকল বাংলাদেশের ইতিহাসে । কিন্তু আর কতদিন , আর কতকাল্ ধরে, এই হতভাগ্য জাতি শুধু নিয়তির নিষ্ঠুর বলিদান হবে !! সচেতন ভাবে কি নিজেদের নিয়তির অন্ধকার যাত্রা কে রুখে দেওয়া যায় না , করা কি যায় না পরিবর্তন এই অভিশপ্ত ধারাটাকে??!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।