আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তাহলে তো আর অবশিষ্ট কিছুই থাকবে না

তাহলে তো আর অবশিষ্ট কিছুই থাকবে না ফকির ইলিয়াস ============================================ বিএনপি তাদের দলীয় কার্যালয় নয়াপল্টনের সামনে পহেলা বৈশাখ পালন করেছে। টিভিতে অনুষ্ঠানগুলো দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। বিএনপি সমর্থিত সুকণ্ঠী গায়িকা বেবী নাজনীন গান গাইছিলেন। ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ গানটি যখন গাওয়া হচ্ছিল, তখন ম্যাডাম খালেদা জিয়াও ঠোঁট মেলাচ্ছিলেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।

ম্যাডাম গানও গাইতে পারেন! হ্যাঁ, পুরো বাঙালিয়ানায় ভরপুর ছিল অনুষ্ঠানটি। আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খবরটি বিভিন্ন চ্যানেলে দেখি। আর ভাবি, যদি হেফাজতে ইসলামের নেতারা এই দেশের শাসনভার পেয়ে যায়, তবে কি ম্যাডাম এমন করে গান গাইতে পারবেন ? নেচে দর্শক মাতাতে পারবেন বেবী নাজনীন ? ‘আমার ঘুম ভাঙাইয়া গেলো রে মরার কোকিলে’-এমন সুর তুলতে পারবেন তিনি? না পারবেন না । পাঠক এর পরের খবরটি পড়–ন। হেফাজতে ইসলাম প্রধান আল্লামা শাহ আহমদ শফি বলেছেন, ‘আমি রাজনীতি করি না।

কখনো ক্ষমতায় যাবো না। কাউকে ক্ষমতায়ও নেবো না। আমি চাই সরকার আমাদের দাবিগুলো মেনে নিক। ’ আল্লামা শফি বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। যারা আল্লাহ, তার রাসুল এবং ইসলাম ধর্মকে নিয়ে কটূক্তি করছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিক।

তাহলেই আমরা আমাদের অবস্থানে ফিরে যাবো। ’ (সূত্র-বাংলামেইল২৪ ডটকম, ১৬ এপ্রিল ২০১৩ ) অন্যদিকে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সম্পাদক মওলানা মঈনুদ্দিন রুহী বলেছেন- হেফাজতে ইসলাম, ইসলামি দলগুলোকে এক করে নির্বাচনে প্রার্থী দিতে চায়। দেশে ইসলামি শাসন কায়েমই হবে তাদের উদ্দেশ্য। আর ইসলামি শাসন কায়েম হলে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেত্রী কোনো নারী হতে পারবেন না। ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন এসব কথা।

মওলানা মঈনুদ্দীন রুহী জানান, হেফাজতে ইসলাম নিজে কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। তবে হেফাজতে ইসলাম চায় দেশে ইসলামি শাসন কায়েম হোক। বাংলাদেশ একটি মুসলিম রাষ্ট্র, কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্র নয়। ইসলামি শাসন কায়েমের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আর সেজন্য ইসলামি রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে হবে।

তিনি জানান, আগামী নির্বাচনে হেফাজতে ইসলাম নিজে কোনো প্রার্থী দেবে না। তবে হেফাজতে ইসলাম সমমনা ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোকে এক করে নির্বাচনে প্রার্থী দেয়ার চিন্তা করছে। সেক্ষেত্রে জামাতে ইসলামীকে তাদের জোটে নেয়া হবে কিনাÑ জানতে চাইলে তিনি বলেন, জামাতের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। জামাতের সঙ্গে তাদের আদর্শের মিল নেই। সুতরাং জামাতকে সমমনা ইসলামি জোটে নেয়ার প্রশ্নই ওঠে না।

ঘোাষিত তেরো দফা দাবি নিয়ে কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইসলামি রাষ্ট্র নয় বলে তারা নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কোনো কর্মসূচি দেননি। কিন্তু ইসলামি রাষ্ট্রে নারী নেতৃত্ব থাকতে পারে না। তিনি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেত্রী যেই হোন না কেন। তাই পুরোপুরি ইসলামের আইনকানুন চালু করতে হলে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা দরকার। হেফাজতে ইসলাম চায় বাংলাদেশ একটি ইসলামি রাষ্ট্র হোক।

এটা দেশবাসী ইতোমধ্যে জেনে গেছেনÑ হেফাজতে ইসলাম নিজেকে অরাজনৈতিক দাবি করলেও তাদের সঙ্গে সরাসরি ইসলামী ঐক্যজোট, নেজামে ইসলামীসহ বেশ কয়েকটি ইসলামি দল কাজ করছে। দলের নেতারা আবার হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটিতেও আছেন। এসব দলের কোনোটি আবার বিএনপির নেতৃত্ব ১৮ দলীয় জোটের সদস্য। সব মিলিয়ে যা দাঁড়াচ্ছে- তা হলো, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া যাদের নিয়ে আন্দোলন করছেন, সুযোগ পেলে ওরাই তাকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরাবে। তারপরও খালেদা জিয়ার ঐসব শক্তি দরকার, যারা অন্তত আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরাবে।

এটা খুবই শঙ্কার কথা বাংলাদেশে, মসজিদের মাইক ব্যবহার করে বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ানো হচ্ছে। চট্টগ্রামে এই অপব্যবহার হয়েছে খুবই জঘন্যভাবে। সাঈদীর রায় ঘোষণার দিন গভীর রাতে চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয়, আকাশে চাঁদে সাঈদীকে দেখা যাচ্ছে। অনেক জায়গায় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোকজনকে জড়ো হয়ে সাঈদীকে চাঁদে দেখার আহ্বান জানানো হয়। সাঈদীকে চাঁদে দেখতে গিয়েও সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় পরিকল্পিতভাবে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় এবং চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক অবরোধ করে রাখে জামাত-শিবির।

এরপরে গেলো মার্চ মাসে, সরকারিভাবে শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানোর কর্মসূচির দিন পটিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালীসহ পুরো দক্ষিণ চট্টগ্রামে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় ভারত থেকে আনা ক্যাপসুলগুলো খেয়ে শিশুরা মারা যাচ্ছে। অতিসম্প্রতি ফটিকছড়ি উপজেলার ভুজপুর থানার কাজিরহাট বাজারে আওয়ামী লীগের হরতাল বিরোধী মিছিল চলাকালে ভয়াবহ গুজব ছড়িয়ে সহিংসতার ঘটনা ঘটানো হয়। এতে ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের তিন কর্মী নিহত হন এবং অর্ধশতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী আহত হন। জামাত-শিবিরের কর্মীরা এবং গুজবে বিভ্রান্ত স্থানীয় জনতা মিলে এসময় শতাধিক মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহন পুড়িয়ে দেয়। ধর্মীয় স্থাপনাকে দলীয় কাজে লাগিয়ে এই যে হীন কর্ম- তা কি প্রমাণ করে না একটি শ্রেণী দেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে চায়? এদের আসল উদ্দেশ্য কী- তা দেশের মানুষকে বুঝতে হবে।

আমরা জানি মসজিদের মাইকের যে কারো প্রবেশাধিকার থাকার কথা নয়। তাহলে তারা মসজিদের মাইক দলীয় কাজে কিভাবে ব্যবহার করছে? এই বিষয়গুলো খোলাসা হওয়া দরকার। অন্যদিকে বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত প্রজন্মের পাশে থাকবে কিনাÑ তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেক বিশিষ্টজন। গণজাগরণের চেতনাকে হয় দলীয়করণ না হয় থামিয়ে দেবার নানা কথা ভেসে বেড়াচ্ছে। যদিও গণজাগরণের কোটি কর্মীরা তা আমলে আনছেন না।

ঢালাওভাবে ‘নাস্তিক’ খেতাব দিয়ে যেসব ধর্মীয় মৌলবাদী মূলত বাংলাদেশকে ‘বাংলাভাই- শায়খ রহমান’ এর কায়দায় জঙ্গি দেশ বানাতে চাইছে, ওরা নানা উসকানি অব্যাহত রেখেছে। যা সরকার ও জনগণ কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয়। আমরা জানি, কোনো দেশে মিডিয়া আক্রান্ত হলে তা বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা বড় করে প্রচার করে। এই সরকারের হাতে বন্দী কয়েকজন ব্লগারের বিষয়েও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঝড় উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক মানবতাবাদী ও মুক্তমনাদের অন্যতম বৃহৎ সংগঠন সেন্টার ফর এনকোয়েরি- (সিএফআই)-এর পক্ষ থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র সেক্রেটারি জন কেরিকে লেখা ওই চিঠিতে অবিলম্বে আটক চার ব্লগারের মুক্তির জন্য তার হস্তক্ষেপ চাওয়া হয়েছে।

‘বাংলাদেশকে বলুন অবিশ্বাসীদের প্রতি নিপীড়ন বন্ধ করতে’ শিরোনামে লেখা হয়েছে এই চিঠি। প্রয়াত দার্শনিক ও লেখক পল কার্জ প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনের পক্ষ থেকে গত ১১ এপ্রিল জন কেরিকে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘সিএফআই ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার ওপর আগ্রাসন সংক্রান্ত বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। ’ চিঠিতে বলা হয়েছেÑ ‘ইতোমধ্যে বাংলাদেশের রাজধানীর রাস্তায় হাজার হাজার উগ্রপন্থী ইসলামি আন্দোলনের নেতারা মিছিল করেছে ব্লাসফেমি আইন বাস্তবায়ন এবং আরো ব্লগারকে গ্রেপ্তারের দাবিতে। তারা বলেছে, ২৫ এপ্রিলের মধ্যে তাদের দাবি মেনে নেয়া না হলে তারা আরো বড় ধরনের সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি করবে। ’ ‘বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংবলিত আর্টিকেল ১৮ ও ১৯-এর অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষরকারী একটি দেশ।

এই অঙ্গীকারনামায় দেশের প্রতিটি ব্যক্তিকে ধর্ম, বিশ্বাস ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা প্রদানের নিশ্চয়তা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সরকারের কেবল নতুন ব্লাসফেমি আইন প্রত্যাখ্যান করাই উচিত নয়, সেই সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সংক্রান্ত বিদ্যমান আইনগুলোও বাতিল করা প্রয়োজন। ’ চিঠির কপি পাঠানো হয়েছে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক অ্যামবাসেডর-এট-লার্জ সুজান জনসন কুককেও। সেন্টার ফর এনকোয়েরি ছাড়াও বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ব্লগারদের মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছে। এগুলো হলো- ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিস্ট এন্ড এথিকাল ইউনিয়ন (আইএইচইইউ), এথিস্ট অ্যালায়েন্স ইন্টারন্যাশনাল (এএআই), কমিটি ফর স্কেপটিকাল এনকোয়েরি, কাউন্সিল ফর সেক্যুলার হিউম্যানিজম, ফ্রি সোসাইটি ইনস্টিটিউট অব সাউথ আফ্রিকা, রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডার, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট ও গ্লোবাল ভয়েস এডভোকেসি।

বাংলাদেশ এখন যে অবস্থায় পতিত হতে যাচ্ছে- তাতে এদেশে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। দেশে শিল্প-ভাস্কর্য মৌলবাদীদের হাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। শিল্পীর কণ্ঠ, বাউলের একতারা, চলচ্চিত্রের রুপালি পর্দা স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে। যেমনটি আফগানিস্তান-ইরান-পাকিস্তানে হয়েছে কিংবা হতে যাচ্ছে। বিষয়গুলো প্রধান দুটি দলের অনুধাবণ করা দরকার।

দেশের মানুষ ষোলো কোটি। তাই ধর্মীয় মৌলবাদীরা তাদের একটি ভোটব্যাংক আছে বলে দাবি করতেই পারে। এসব মধ্যযুগীয় ধারণাবাদীদের কাছে উন্নয়ন-প্রগতি-প্রকৌশল জিম্মি হয়ে যাবে? ভোটের জন্য আমাদের রাজনীতির কর্ণধারেরা দাসখত দেবেন এদের কাছে? তিরিশ লাখ শহীদের রক্তে ভেজা এই দেশে তা কল্পনা করা যায়? ভোট নিয়ে মজমা যে যতোই খেলুন না কেন- ভোটের মালিক এদেশের মানুষ। তারাই ঠিক করবেন ভোট কাকে দেবেন। তবে একথা ঠিক এদেশের মানুষ মৌলবাদীদের বরাবরই প্রত্যাখ্যান করেছেন।

ভবিষ্যতেও করবেন। কিন্তু আজ যারা ভ্রান্ত মতবাদ ছড়িয়ে একাত্তরে পারজয়ের শোধ নিতে চাইছে তারা প্রগতির দাবিদার বড় দুদলের প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ মদত পাবে কেন? যদি তাই হয়, তাহলে তো মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর আদর্শের অবশিষ্ট কিছুই এই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রাজনীতিবিদরা আর রেখে যেতে পারবেন না। ------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ // ঢাকা // : শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০১৩ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.