আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"পাঠকের নিজস্ব হুমায়ূন"

স্বপ্ন দেখি এবং চেষ্টা করি সত্যি করার এই লিখা টি জনপ্রিয় লেখক আনিসুল হক এর। সামুর পাঠক দের উদ্দেশ্য করে তুলে ধরলাম। হুমায়ূন পড়ে প্রথম কেঁদেছিলাম আমি যখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন। শহীদ স্মৃতি হলে থাকি। বন্ধু তাজুল আমার উল্টো দিকের রুমে থাকে।

ও বলল, হুমায়ূন আহমেদের নির্বাসন পড়ো। তুমি কাঁদতে বাধ্য। আমি বললাম, পড়েছি। কই, কান্না তো আসেনি। তারপর একদিন, কোনো এক ছুটির সকালে নির্বাসন বইটা হাতে নিলাম আবারও।

এক পাতা দুপাতা করে পড়ছি। বুঁদ হয়ে গেলাম। ঘণ্টা দুয়েক পরে বইটা যখন শেষ হয়ে আসছে, আমি হু হু করে কাঁদছি। আমি তাড়াতাড়ি ছুটে গেলাম পাশের রুমে। তাজুলকে ডেকে বললাম, তাজুল, তাজুল, আমার চোখের দিকে তাকাও।

কী দেখছ! অশ্রু। আমি নির্বাসন পড়ছিলাম। আমি যে গল্পটা বললাম, বাংলাদেশের অন্তত এক কোটি মানুষ হুমায়ূনকে নিয়ে এ রকম কোনো না কোনো গল্প বলতে পারবেন। গাড়িতে বসে এবিসি রেডিও শুনছি। হুমায়ূন আহমেদ মারা গেছেন, বেতারবন্ধু ঘুরেফিরে সেই প্রসঙ্গেই কথা বলছেন।

একবার তিনি বললেন, ‘আমি প্রথম হুমায়ূন পড়ি ক্লাস সেভেনে থাকতে। ’ আমি ওই বেতারবন্ধুর নাম জানি না, তাঁকে চিনি না। কিন্তু কেন তিনি ভাবছেন যে তিনি কোন ক্লাসে থাকতে প্রথম হুমায়ূন পড়লেন, সেটা জানা তাঁর শ্রোতাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ? প্রথম আলো বন্ধুসভার পাতায় ইমাম হাসান লিখেছেন, ‘সপ্তম শ্রেণীতে উঠে একটি নতুন বই পাই। বইটির নাম শঙ্খনীল কারাগার। ’ এই ইমাম হাসানও খুব বিখ্যাত কেউ নন, কিন্তু তিনিও কেন এই তথ্যটা জানানো প্রয়োজন বলে বোধ করলেন।

বোধ হয়, একজন লেখক তাঁর পাঠকের অভিজ্ঞতার অংশ, তার পরিবারের একজন হয়ে ওঠেন। একটা বই তার ঘরের ভেতরে ঢুকে যায়, তার বইয়ের র‌্যাকে থাকে, বিছানায় বালিশের পাশে স্থান পায়, আর কখন, কীভাবে, জীবনের কোন সময়টা ওই বইটা (বা ওই চলচ্চিত্রটা) তাকে গ্রস্ত করে রেখেছিল, সেটা তার, ওই পাঠকের আত্মজীবনীরই অংশ হয়ে যায়। হুমায়ূন আহমেদ যেহেতু বেশি পাঠকের প্রিয়, বেশি মানুষের ঘরে ঠাঁই পেয়েছেন, সেহেতু বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রত্যেকে হুমায়ূন আহমেদকে তাঁর আপনজন বলে মনে করেন, তাঁর চলে যাওয়াটাকে তাঁদের ব্যক্তিগত ক্ষতি বলে মনে করছেন—মনে করছেন, এটা তাঁদের পরিবারের কোনো সদস্যেরই চলে যাওয়া। কিংবা হয়তো তারও বেশি। লেখক তাঁকে হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন, আনন্দ দিয়েছেন, বিনোদন জুগিয়েছেন—শুধু তা-ই নয়, তাঁর মন, তাঁর ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছেন।

ফলে হুমায়ূনের চলে যাওয়া তাঁর নিজের অস্তিত্বের একটা অংশের চলে যাওয়া। তিনি নিজের ভেতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করছেন। আমার ভাস্তি হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর খবর পেয়ে অনেক কান্নাকাটি করেছে। ভাবি আমাকে এই খবর দিচ্ছেন। তখন আমার ভাই বললেন, ‘মেয়ের কথা কী বলব, আমার নিজেরই তো অবস্থা খারাপ, রাতের বেলা ঘুম ভেঙে গেলে বিছানায় উঠে বসে থাকলাম, কী যে একটা হাহাকারের মতো লাগছে, হুমায়ূন আহমেদ আর নেই।

’ আসলে প্রত্যেকেরই আছে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে নিজস্ব গল্প, অনেক গল্প। কে কবে কখন প্রথম হুমায়ূন পড়লেন, কোন বইটা তাঁকে কাঁদাল, কোন বইটা খুব হাসিয়েছে, কোন বইটা ঘোরগ্রস্ত করেছে। আর আছে তাঁর টেলিভিশন নাটক, চলচ্চিত্র, গান। অন্য সব পাঠকের মতো, দর্শকের মতো আমারও আছে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে অনেক ব্যক্তিগত স্মৃতি। না, আমি তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়া না-হওয়ার কথা বলছি না।

বলছি একজন পাঠক বা দর্শক হিসেবে হুমায়ূনকে কখন পেলাম, কীভাবে পেলাম, সেসব কথা। আমরা বড় হয়েছি হুমায়ূনের কালে। হুমায়ূনের নন্দিত নরকে বের হয় ১৯৭২ সালে, তখন আমি পড়ি ক্লাস টুয়ে। আমি যখন বুয়েটের ফার্স্ট ইয়ারে, তখন এইসব দিনরাত্রি দেখানো হচ্ছে টেলিভিশনে। হুমায়ূন আহমেদ তাই আমাদের প্রজন্মের বেড়ে ওঠার অংশ।

আমি সব সময়ই মনে মনে হুমায়ূন আহমেদকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা দিয়ে এসেছি যে তিনি আমাদের বেড়ে ওঠার কালটাকে আনন্দপূর্ণ করে তুলেছিলেন। রংপুর শহরে কেটেছে আমার ছোটবেলা। খুব বেশি বই তো তখন ওই শহরে পাওয়া যেত না। সত্যি কথা বলতে কি; নিমাই, ফাল্গুনি, নীহাররঞ্জনের বটতলার পাইরেটেড সংস্করণ ছাড়া বাজারে কোনো বই-ই ছিল না। সেই কালে বেরোতে লাগল ঈদসংখ্যাগুলো।

ঈদসংখ্যা উল্টিয়ে দুটো জিনিস আছে কি না খুঁজতাম—সৈয়দ শামসুল হক এবং হুমায়ূন আহমেদ। তখন এবং এখনো ঈদসংখ্যা হাতে পাওয়ার পরে সবার আগে পড়ি ওই হুমায়ূন আহমেদই। তারপর শুরু হলো টেলিভিশনে হুমায়ূন আহমেদের নাটক। ইশ্, যে রাতে হুমায়ূনের নাটক হতো, সেই রাতটাকে মনে হতো একটা উৎসবের রাত। কী যে একটা অনির্বচনীয় আনন্দ হতো সেসব নাটক দেখে, দেখার সময়ে, দেখার পরে।

হুমায়ুন ফরীদি যে বুড়োর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, তাঁকে বাচ্চা মেয়েটা বলল, আপনার যাওয়া লাগবে না, সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতরটা কী মোচড়টাই না দিয়ে উঠেছিল! তারানা হালিম বললেন, ‘না, হাসছি কই, এই রকম একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আমি হাসব’, বলেই তিনি ফিক করে হেসে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে পুরো ড্রয়িংরুমে আমরা হেসে উঠলাম খিকখিক করে। সেসব দিন কি এই বাংলাদেশের নিম্নমধ্যবিত্ত ঘরগুলোয় আর কোনো দিনও আসবে? সাদাকালো টেলিভিশন ড্রয়িংরুমে। টিউবলাইটের মতো আলো জানালা দিয়ে ঠিকরে বেরোচ্ছে রাতের অন্ধকার চিরে। তাই দেখে দু-চারজন পথচারীও টেলিভিশন দেখার জন্য সেই জানালায় দাঁড়িয়ে পড়েছে।

ভেতরে টেলিভিশনের সামনে তিন সারি দর্শক। প্রথম ভাগে, মেঝেতে গৃহপরিচারক বা পরিচারিকারা। তারপর টুল নিয়ে একটু অল্প বয়সীরা। শেষে চেয়ারে, সোফায় মুরব্বিরা। খাটে কলেজে পড়া সদস্যরা।

এর মধ্যে চশমা চোখে দাদি-নানি গোছের কেউ আছেন। কী হচ্ছে? না, হুমায়ূন আহমেদের নাটক হচ্ছে। ঈদের রাতগুলোয় হুমায়ূন আহমেদের নাটক আমরা যেন দেখতাম না, রীতিমতো গিলতাম। হুমায়ুন ফরীদি গৃহশিক্ষক, তাঁকে আটকে রাখা হয়েছে একটা ঘরে, তাঁর বাথরুম পেয়েছে... নাটক হচ্ছে, এই সময় দোরঘণ্টি বেজে উঠল। কে এই ব্যাক্কল মেহমান, হুমায়ূনের নাটকের সময় বাসায় আসে? আমাদের রংপুরের ঢেউটিনে ছাওয়া বাসায় আসতেন বারী ভাই, মোহাম্মদ বারী—এখন থিয়েটার আর্টের প্রধান সংগঠক, নাট্যজন।

পরে তাঁকে বলে দেওয়া হয়েছিল, বারী, তুমি হয় আগে আসবে, না-হয় পরে আসবে; নাটক চলাকালে প্রবেশ নিষেধ। ঈদে মাঝেমধ্যে অন্য নাট্যকারের নাটকও হতো। সেসবে আমাদের আশ মিটত না। আমার বড় ভাই বললেন, সরকারের উচিত আইন পাস করা, যত দিন হুমায়ূন আহমেদ থাকবেন, তত দিন হুমায়ূন আহমেদের নাটক ছাড়া আর কারও নাটক ঈদে টেলিভিশনে প্রচার করা যাবে না। কোথাও কেউ নেই যখন বিটিভিতে প্রচারিত হচ্ছে, তখনকার একটা রাতের কথা মনে আছে।

আমি, আদিত্য কবির আর আমিনুর রশীদ বাইরে বাইরে ঘুরছি। হঠাৎ মনে হলো, কোথাও কেউ নেই প্রচার করা হবে একটু পরে। আশপাশে কার বাসা আছে? জ ই মামুনের। আমরা ছুটতে শুরু করলাম। কী যে প্রাণপণ সেই ছোটা।

যেন একটু পরে কারফিউ হবে, তাই কারফিউয়ের আগেই একটা নিরাপদ স্থানে ঢুকে পড়তে হবে। আর যা-ই করি না কেন, কোথাও কেউ নেইয়ের কোনো পর্ব মিস করা যাবে না। হুমায়ূনের বই পড়ে নিশ্চয়ই অনেকবার আপন মনে হেসে উঠেছি। একটা দিনের কথা মনে আছে। বই পড়তে পড়তে খিকখিক করে হেসে উঠেছি।

ঘটনাটা এই রকম: বাড়ির কর্তা চা খাবেন। চায়ের ওপরে দুধের সর ভাসুক, এটা তাঁর পছন্দ নয়। কিন্তু দেখা গেল, চায়ের ওপরে ঠিকই সর ভাসছে। তিনি পরিচারিকাকে বললেন, একটা চামচ আনো, এই সর তুলে ফেলতে হবে। পরিচারিকা একটা ভাত তোলা বিশাল চামচ নিয়ে হাজির।

তিনি বললেন, আমি এই চামচ দিয়ে কী করব? পরিচারিকা বলল, চামচের উল্টা দিক দিয়া তুলেন। আমি বই পড়া বন্ধ করে একা একা খিলখিল করে হাসতে লাগলাম। আমার উচ্চতাভীতি আছে। দেশের ভেতরে বিমান যখন আকাশে ওঠে, তখন আমি খুব ভয় পাই। একদিন বিমানে আমার সঙ্গে ছিল হুমায়ূন আহমেদের একটা বই।

যেই না হাতে নিয়েছি, অমনি ডুবে গেছি তার ভেতরে। কখন যে বিমান আকাশে উড়েছে টেরই পাইনি। হয়তো ভেঙে পড়লেও টের পেতাম না। এই গুণটাকে আমরা কী বলব, যে একজন লেখকের বই যে কোনোখানে বসে পড়তে আরম্ভ করলে কিছুক্ষণের মধ্যে তার ভেতরে নিমজ্জিত হওয়া যায়! আগুনের পরশমণির শেষ দৃশ্য দেখে কার না চোখে জল আসবে। ওই সিনেমার উদ্বোধনী প্রদর্শনী দেখে এসে ভোরের কাগজ সম্পাদক মতিউর রহমান আমাদের বললেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা চেতনা চিৎকার করে আমরা যতটা না করতে পেরেছি, হুমায়ূনের এক সিনেমা তার চেয়ে বেশি কাজে লাগবে।

হুমায়ূন আহমেদ তাঁর বই দিয়ে, সিনেমা দিয়ে অনেকবার কাঁদিয়েছেন। সর্বশেষ কাঁদালেন দুদিন আগে। ইউটিউবে একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানের ভিডিও কেউ আপলোড করেছে। একটা টিভি চ্যানেল সেটা দেখাচ্ছে। নিউইয়র্কের কোনো বাড়িতে বসেছে একটা ঘরোয়া আসর।

টেবিলে বসে শাওন গান গাইছেন। মরিলে কান্দিস না আমার দায় ও জাদুধন। হুমায়ূন আহমেদ মেঝেতে বসে আছেন। বোঝাই যাচ্ছে, ক্যানসারের চিকিৎসা নিতে নিউইয়র্ক যাওয়ার পরের সময় এটা। শাওন খুব দরদ দিয়ে গানটা গাইছেন।

হুমায়ূন আহমেদের চোখে জল এল। তিনি চোখ মুছতে লাগলেন। এই দৃশ্য দেখে আমার দুচোখ আপনা-আপনিই ভিজে গেল। আমাদের বেড়ে ওঠার সময়টাকে যিনি আনন্দপূর্ণ করে রেখেছিলেন, তাঁকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে চেয়েছিলাম। সেটা জানানো হয়নি।

কিছু কথা তো হয়েছে আমার তাঁর সঙ্গে। এই কথাটা কেন বললাম না? এর আগেই তিনি মরে গেলেন। এখন যদি বলি, হুমায়ূন আহমেদ কি তা শুনতে পাবেন? স্যার, আপনার বই পড়ে, আপনার নাটক দেখে আমরা বড় হয়েছি। আমাদের মন, আমাদের চেতনা, আমাদের গদ্য গড়ে উঠেছে আপনার প্রভাবে। আমাদের নিম্নবিত্ত টানাটানির শৈশব-কৈশোর কিন্তু খুবই আনন্দপূর্ণ ছিল।

সেই আনন্দের একটা বড় অংশ আপনার অবদানে ঋদ্ধ। আপনাকে ধন্যবাদ। হুমায়ূন স্যার, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।