বসে আছি পথ চেয়ে.... একটি পুরনো গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। রাস্তায় কয়েকজন অল্পবয়সী ছেলে একটা রাবারের বল কুড়িয়ে পেয়েছিল। বলটি কে নেবে এই নিয়ে তাদের মধ্যে ভীষণ কলহ বেধে যায়। রীতিমতো বাদবিতণ্ডার পরে শেষে তারা নিজেদের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেয়, সবচেয়ে বেশি মিথ্যা কথা যে বলতে পারবে সে-ই বলটার মালিক হবে।
এমন সময় সেই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন এক অতিশয় নীতিবাগীশ ভদ্রলোক।
ছেলেদের এই কাণ্ডকারখানা দেখে তিনি খুব বিচলিত বোধ করলেন। তিনি তাড়াতাড়ি ছেলেদের বাধা দিয়ে বললেন, একি সাংঘাতিক কথা। তোমরা মিথ্যা কথা বলতে যাবে কেন? এই যে আমাকে দেখছ জানো, আমি জীবনে কোনদিন মিথ্যা কথা বলিনি।
ছেলেরা এই কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে তাদের কুড়িয়ে পাওয়া বলটা ভদ্রলোকের হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, এই বলটা আপনি নিন।
নীতিবাগীশ ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে বললেন, সেকি! বলটা আমাকে কেন? আমি কেন নেব? ছেলেদের দলপতি জানাল, আপনি যা বললেন, তার চেয়ে সেরা মিথ্যা কথা আমরা কেউই বলতে পারব না।
তাই বলটা আপনিই পেলেন।
প্রত্যেক মানুষই কমবেশি মিথ্যা বলে। কেউ প্রয়োজনে বলে, কেউ আবার মনের আনন্দে বলে। তবে বিনা কারণে, বিনা প্রয়োজনে নির্বিকারভাবে মিথ্যা কথা বলে এমন লোকও আমাদের সমাজে কম নেই। কেউ কেউ অহঙ্কার করার জন্য মিথ্যা কথা বলে।
অফিসের বসরা যেমন বলে থাকেন, আমার চেয়ে ভাল ইংরেজি এ অফিসে একজনও জানে না। কিংবা কাজে ফাঁকি দেয়া আমার ডিকশনারিতে নেই।
আমাদের বন্ধু-বান্ধবরাও বিস্তর মিথ্যা বলে। অনেকেই আছে যারা বঙ্গবাজার থেকে আনকোরা এক মাল গায়ে চাপিয়ে বলে, এটা আমার আঙ্কেল নিউজার্সি বা আন্টি 'এলে'(লস-এঞ্জেলেস) থেকে পাঠিয়েছেন!
অনেকে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে অথবা জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জেরায় জর্জর হয়ে মিথ্যা কথা বলে। দেরি করে অফিসে পৌঁছে ঊর্ধ্বতনের কাছে, রাতে দেরি করে বাসায় ফিরে বউয়ের কাছে মিথ্যা কারণ দেখানোরও অনেকের প্রয়োজন পড়ে।
স্কুলের ক্লাসে ছাত্রছাত্রীরা মিথ্যা বলবে কিংবা অফিসে বসের কাছে কনিষ্ঠ সহায়ক অসত্য অজুহাত দেবে কাজ না করার, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। বাড়ির কাজের লোক বাজার করে এসে সত্যি হিসাব দেবে, কিংবা লম্পট স্বামী স্ত্রীর কাছে সত্য বিবৃতি দেবে, এরকম আশা করাটাও অন্যায়।
এগুলোর তবু কার্যকারণ আছে। এসব মিথ্যা ভাষণের প্রয়োজন বোঝা কঠিন নয় এবং যে মিথ্যা বলছে তার কাছে এর প্রয়োজনও রয়েছে। কিন্তু এর বাইরে এক ধরনের প্রয়োজনহীন মিথ্যা কথা আছে।
মনের আনন্দে নির্দ্বিধায় উল্টোপাল্টা ডাইনে-বাঁয়ে মিথ্যা বলা অনেকের স্বভাব এবং বলতে না পারলে তারা দম বন্ধ হয়ে পেট ফেটে মরে যাওয়ার অবস্থায় পৌঁছে যায়। ডাকটিকেট জমানো ও পুরনো মুদ্রা সংগ্রহের মতো অনেকের হবি হচ্ছে মিথ্যা বলা। তবে এসব মিথ্যা খুবই সাধারণ এবং নির্দোষ। এ ধরনের মিথ্যা কারও কোনোক্ষতির কারণ হয় না। স্রেফ গল্প দেয়ার জন্যই তারা এ ধরনের মিথ্যা চর্চা করে থাকে।
যেমন কবে কোথায় কোনো মেয়ে তার প্রেমে পড়েছিল, কবে একদিন একাই দুই ছিনতাইকারীকে পাকড়াও করেছিলÑ এসব মিথ্যাচার কারও কোনো ক্ষতির কারণ হয় না। তবে সব ধর্মেই এ কথা বলা আছেÑ মিথ্যা বলা মহাপাপ। এই আপ্তবাক্য অবশ্য মিথ্যুকদের সত্য কথা বলার ক্ষেত্রে খুব একটা প্রভাবিত করতে পারেনি। সুযোগসন্ধানীরা স্বার্থ-সুবিধা ও প্রয়োজনমতো ঠিকই মিথ্যা চর্চা অব্যাহত রেখেছে।
সত্য কথা বলে ফায়দা হাসিল হয় না।
এ জগতে যে যত স্বার্থপর, লোভী, ভ-, ধান্দবাজ, দুই নম্বর তার তত বেশি মিথ্যা কথা বলতে হয়। সব দুই নম্বরী মিথ্যা দিয়ে ঢাকতে হয়। জ্ঞানী-গুণীরাও বিষয়টি অনুধাবন করেছেন। তাই তারা সত্য বলার ব্যাপারে নমনীয় মনোভাব দেখিয়েছেন।
‘সদা সত্য কথা বলিবে’ এই মহৎ উপদেশ বাক্য সব সময় গ্রাহ্য নয়।
প্রকৃত জ্ঞানীরা বলেছেন, অপ্রিয় সত্য কথা বলবে না। হয়তো জ্ঞানীদের রুচি ও বিবেকে বেধেছিল, তাই তারা সরাসরি বলতে পারেননি, ‘প্রিয় মিথ্যে কথা বলো’।
বিদেশী প্রবাদ আছে, যে মিথ্যা কথা কাউকে সান্ত¦না দেয়, সুখী করে, সে অনেক ভাল যে সত্য কথা কাউকে আঘাত করে, আহত কার তার চেয়ে। এসব তত্ত্বকথা আপাতত থাক। আমরা বরং এ বিষয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করি বর্তমান জমানায় চারদিকে মিথ্যারই জয়জয়কার।
বর্তমানে শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, প্রেমিক-প্রেমিকা, পুলিশ, আমলা, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রীরা তো মিথ্যা বলেনই; এমনকি ধর্মগুরুরা পর্যন্ত মিথ্যা কথা বলেন।
তবে মিথ্যা বলার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতানেত্রীরা আপসহীন ও অপ্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়েছে। স্বার্থ হাসিলের জন্য, দায় এড়াতে (পিঠ বাঁচাতে) এবং প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে এমন মিথ্যা চর্চা পৃথিবীর ইতিহাসে অন্য কেউ কখনও করেছে কিনা সন্দেহ।
আমাদের দেশের নেতানেত্রীরা সত্যের ধারেকাছেও বড় বেশি ঘেঁষেন না। তারা নিজেরা তো অসত্য বলেনই, এমনকি রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীকেও অসত্য চর্চায় পারঙ্গম করে তুলেছেন।
র্যাবের কথাই ধরা যাক। র্যাবের ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘এনকাউন্টার’ সংক্রান্ত খবরগুলো মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় এই মিথ্যাচারের নমুনা। ‘অমুক সন্ত্রাসীকে আটকের পর তাকে নিয়ে অমুক জায়গায় যাওয়া হয় অস্ত্র ও তার সঙ্গী সন্ত্রাসীদের আটক করতে। সে সময় তার সহযোগীরা র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। র্যাবও পাল্টা গুলি ছোড়ে।
একপর্যায়ে সন্ত্রাসী অমুক ক্রসফায়ারে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। ’ ‘ক্রসফায়ারের’ এ কাহিনিগুলোর চেয়ে নির্জলা মিথ্যা আর কী হতে পারে? অথচ এই কাহিনিগুলোই বিএনপি-আওয়ামী লীগ উভয় আমল ধরেই চলছে।
যারা দুর্নীতি করেছেন, তারা বলে আমি নির্দোষ। যারা জঙ্গি সৃষ্টি করছেন, তাদের মদদ দিয়েছেন, তারা বলেন, না ওসব মিথ্যা কথা। আমি মহান।
কেউ তার অপরাধ স্বীকার করেন না, হাতেনাতে ধরা পড়লেও না। যাদের যা করার কথা তারা তা করেন না। অথচ নিয়মিত প্রতিশ্রুতি দেন। প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দিলে অস্বীকার করে বসেন। এভাবে মিথ্যা আর অসত্যের চাদরে সব কিছুকে ঢেকে ফেলা হয়েছে।
সবাই যেন মিথ্যা বলার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কেউ সত্য কথা বলছেন না। তারা অবশ্য মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিতও করতে পারছেন না। আজকের মিথ্যাকে আগামীকালই সত্য হিসেবে কবুল করছেন। তারপর শুরু করছেন নতুন করে মিথ্যাচার।
প্রশ্ন হলো, হাশরের ময়দানে এই জাতির কী হবে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।