আপনিই মিসির আলি? একটু বিব্রত হেসে ভদ্রলোক জবাব দেন, জ্বী আমার নাম মিসির আলি। প্রথমেই একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে নেওয়া দরকার। আমার নাম মিসির আলি, আর আমি একটি কলেজে পড়াই। দরজা বন্ধ করে মিসির আলি ভেতরে আসেন। এক সপ্তাহ পর ক্লাশের ফাঁকে কলেজের টিচার্স কমনরুমে বসে মিসির আলি চা সহযোগে পত্রিকা পড়ছিলেন।
বেয়ারা এসে খবর দেয়, 'স্যার আপনের কাছে এক লোক আসছে। 'মিসির আলি গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। আত্মীয়-স্বজনদের সামাজিক অনুষ্ঠানগুলো যতোটা সম্ভব এড়িয়ে চলেন মিসির আলি। এর পেছন অন্যতম কারণটি অর্থনৈতিক। এসব অনুষ্ঠানে যাওয়া মানেই গুচ্ছের টাকা খরচ।
উপহার কেনা, ট্যাক্সি ভাড়া করে যাওয়া-আসা। কোনো মানেই হয় না। তার চেয়ে বাড়িতে পোলাউ মাংস রেধে খাওয়া অনেক ভালো।
আকাশে বিদু্ৎ চমকাচ্ছে। উঠে গিয়ে জানালাগুলো বন্ধ করে দেন মিসির আলি।
একটু আফসোস হয়। একটু আগে যদি বৃষ্টিটা শুরু হতো তাহলে ভাত না চড়িয়ে খিচুরি রান্না করতেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করে চুলা থেকে ভাত নামিয়ে আবার খিচুড়ি চড়িয়ে দেন। বৃষ্টি আর বজ্রপাতের শব্দে প্রথমে দরজায় নক করার শব্দ শুনতে পাননি মিসির আলি। কিছুক্ষণ পর নিশ্চিত হন, কেউ কড়া নাড়ছে।
এই দুর্যোগের রাতে আবার কে এলো! দরজা খুলে মিসির আলী অবাক। আপনিতো মিসির আলি। আপনার অনেক বুদ্ধি। অনেক অলৌক বিষয়ের লৌকিক সমাধান দিয়েছেন আপনি। আজকে আপনার কাছ থেকে আমার সমস্যার একটা সমাধান নিয়ে যাবো।
হুমায়ুন আহমেদের মিসির আলি কখনও হারিয়ে যাবে না । আমাদের মাঝে থেকে রবীন্দ্রনাথ নজরুল হারিয়ে যায়নি । মিসির আলি, বাংলাদেশের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় চরিত্র। মিসির আলী কাহিনীগুলো রহস্যমাত্রিক। মিসির আলির কাহিনীগুলো ঠিক গোয়েন্দা কাহিনী নয়, কিংবা 'ক্রাইম ফিকশন' বা 'থ্রিলার'-এর মতো খুনি-পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়া নয়, কিংবা বরং মনস্তাত্ত্বিক, বিজ্ঞাননির্ভর এবং প্রচন্ড যুক্তিনির্ভর কাহিনীর বুনটে বাঁধা।
হিমু চরিত্রটির পুরোপুরি বিপরীত। তরুণ হিমু চলে প্রতি-যুক্তির (anti-logic) তাড়নায় ; অপরপক্ষে বয়োজ্যেষ্ঠ মিসির আলি অনুসরণ করেন বিশুদ্ধ যুক্তি (pure logic)। এই যুক্তিই মিসির আলিকে রহস্যময় জগতের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটনে সাহায্য করে।
"এইসব বই বাজেয়াপ্ত হওয়া দরকার। এবং এ ধরনের বইয়ের লেখকদের কোনো জনমানবহীন দ্বীপে পাঠিয়ে দেয়া দরকার।
তাদেরকে সেখানে খাদ্য দেওয়া হবে। লেখালেখি করার জন্য কাগজ-কলম দেয়া হবে। তারা কোনো বই লিখে শেষ করামাত্র ক্যাম্পফায়ারের আয়োজন করে লেখা পোড়ানো হবে। আবর্জনা মুক্তি দিবস উপলক্ষে গানবাজনার উৎসব হবে। " মজার ব্যাপার কি জানেন, উদ্ধৃত করা লাইনগুলো কিন্তু স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদেরই লেখা।
"মিসির আলি UNSOLVED"-এর একটি গল্পে১, গল্পের ছলেই "Stefan Grey" নামক এক লেখকের "Windows of the mind"২ বই সম্পর্কে কথাগুলো বলেছেন তিনি, এবং যা সম্পর্কে তাঁর অভিমতও প্রকাশ করেছেন এভাবে — 'বিজ্ঞানের নামে অবিজ্ঞানের ব্যবসা। '
ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ মিসির আলি চরিত্রটির ধারণা প্রথম পেয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটার ফার্গো শহরে, স্ত্রীর সাথে গাড়িতে ভ্রমণের সময়। চরিত্রটির ধারণা মাথায় চলে এলেও তিনি মিসির আলি চরিত্রের প্রথম উপন্যাস "দেবী" লিখেন এই ঘটনার অনেকদিন পর। উপন্যাসের কাহিনী অনুসারে মিসির আলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের "মনোবিজ্ঞান" (Psychology) বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক। মিসির আলির বয়স ৪০-৫০-এর মধ্যে।
তাঁর মুখ লম্বাটে। সেই লম্বাটে মুখে এলোমেলো দাড়ি, লম্বা উসখো-খুসকো কাঁচা পাকা চুল। প্রথম দেখায় তাঁকে ভবঘূরে বলে মনে হতে পারে; কিছুটা আত্মভোলা। তাঁর হাসি খুব সুন্দর, শিশুসুলভ। মিসির আলির স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো।
মিসির আলি ক্লাসরুমে ঢুকেছেন। তাঁর পড়ানোর বিষয় এবনর্মাল বিহেভিয়ার। ক্লাসে ঢুকেই তিনি বললেন, আমি মিসির আলি, তোমাদের এবনর্মাল বিহেভিয়ার পড়াতে এসেছি। পড়ানোর সময় কী করলে আমার আচরণকে তোমরা এবনরমাল বলবে? ছাত্রছাত্রীরা কোন কথা বলল না। তারা তাদের শিক্ষককে যাচাই করে নিতে চাচ্ছিল।
মিসির আলি বললেন, আচ্ছা আমি যদি এই টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে লেকচার দেই, তোমরা কি আমার আচরণকে অস্বাভাবিক বলবে? একজন ছাত্র বলল, হ্যাঁ। মিসির আলি বললেন, প্রাচীন গ্রিসে কিন্তু শিক্ষকেরা টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে লেকচার দিতেন। তারাঁ মনে করতেন শিক্ষক সবচেয়ে সম্মানিত, তাই তাঁদের অবস্থান হবে উঁচুতে। তাদের কাছে এটি অস্বাভাবিক মনে হত না। কাজেই অস্বাভাবিকতার সংজ্ঞা কী? সংজ্ঞা হল, যা দেখে আমরা অভ্যস্ত নই, তার বাইরে কিছু দেখা-করাই অস্বাভাবিক।
হুমায়ুন আহমেদের বলেন- "মিসির আলি এমন একজন মানুষ, যিনি দেখার চেষ্টা করেন চোখ বন্ধ করে। যে পৃথিবীতে চোখ খুলেই কেউ দেখে না, সেখানে চোখ বন্ধ করে দেখার এক আশ্চর্য ফলবতী চেষ্টা। [মিসির আলি] একজন মানুষ, যাঁর কাছে প্রকৃতির নিয়ম-শৃঙ্খলা বড় কথা, রহস্যময়তার অস্পষ্ট জগৎ যিনি স্বীকার করেন না। " মিসির আলি একজন ধূমপায়ী। তিনি 'ফিফটি ফাইভ' ব্র্যান্ডের সিগারেট খান।
তবে তিনি প্রায়ই সিগারেট ছেড়ে দেবার চেষ্টা করেন। তাঁর শরীর বেশ রোগাটে আর রোগাক্রান্ত। নানারকম রোগে তাঁর শরীর জর্জরিত । প্রায়ই অসম্ভব রোগাক্রান্ত হয়ে তাঁকে হাসপাতালে থাকতে হয় এবং শেষ পর্যন্ত তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসেন।
মিসির আলি যুক্তিনির্ভর একজন মানুষ বলেই অসম সাহসিক।
মিসির আলি প্রকৃতির বিষ্ময়ে বিষ্মিত হলেও প্রচন্ড যুক্তির বলে বিশ্বাস করেন প্রকৃতিতে রহস্য বলে কিছু নেই। তিনি সন্দেহবাদী হওয়াসত্ত্বেয় ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী অর্থাৎ একজন আস্তিক। মিসির আলি মূলত নিঃসঙ্গ একজন মানুষ, মোটামুটি সব উপন্যাসে তাঁকে এভাবেই দেখানো হয়। কিন্তু "অন্য ভূবন" উপন্যাসে মিসির আলি বিয়ে করে ফেলেন বলে উল্লেখ আছে। কিন্তু পরবর্তি উপন্যাসগুলিতে আবার তাঁকে নিঃসঙ্গ একজন মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
এপ্রসঙ্গে লেখক নিজেই স্বীকার করেন যে, "এটি বড় ধরণের ভুল" ছিলো। মিসির আলির মতো চরিত্র বিবাহিত পুরুষ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়।
মিসির আলি চরিত্রটি যা দাঁড়ায়: মিসির আলি ভালোবাসার গভীর সমুদ্র হৃদয়ে লালন করেন, কিন্তু সেই ভালোবাসাকে ছড়িয়ে দেবার মতো কাউকেই কখনও কাছে পান না। ভালোবাসার একাকীত্বে জর্জরিত মিসির আলির নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে বিভিন্ন সময় কিশোরবয়সী কাজের লোকের উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন: "আমি এবং আমরা" উপন্যাসে "বদু" নামের একটি, ১৫-১৬ বছরের কাজের ছেলের উল্লেখ রয়েছে।
এরকম কাজের লোককে মিসির আলি লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেন। আবার "অন্য ভূবন" উপন্যাসে "রেবা" নামের একটি কাজের মেয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।
হুমায়ূন আহমেদের এই জনপ্রিয় চরিত্রটিকে বিটিভির পর্দায় বেশ কয়েকবার নিয়ে আসা হয়েছে। অনেক খ্যাতিমান টিভি অভিনেতা অভিনেত্রীরা মিসির আলির উপন্যাস-কেন্দ্রিক নাটকে অভিনয় করেছেন। তবে অধিকাংশ নাটকে মিসির আলির চরিত্র রুপায়ণে ছিলেন প্রখ্যাত নাট্যাভিনেতা আবুল হায়াত।
এছাড়া প্রয়াত অভিনেতা আবুল খায়ের একবার এই চরিত্রে রুপদান করেছেন।
মিসির আলিকে নিয়ে উপন্যাস গুলো হলো- দেবী (সিরিজের প্রথম উপন্যাস), নিশীথিনী ("দেবী"র ধারাবাহিক উপন্যাস), নিষাদ, অন্য ভূবন, বৃহন্নলা, বিপদ, অনীশ, মিসির আলির অমীমাংসিত রহস্য, আমি এবং আমরা, তন্দ্রাবিলাস, হিমুর দ্বিতীয় প্রহর (হিমু চরিত্রের সাথে মিসির আলির সাক্ষাৎ), আমিই মিসির আলি, বাঘবন্দি মিসির আলি,
কহেন কবি কালিদাস, হরতন ইশকাপন, মিসির আলির চশমা, মিসির আলি, আপনি কোথায়?, মিসির আলি আনসল্ভ্ড, নলিনী বাবু B.Sc (প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১০), যখন নামিবে আঁধার (প্রকাশঃ ফেব্রুয়ারি ২০১২)। ভয় ("ভয়", "জিন-কফিল" ও "সঙ্গিনী" নামক তিনটি গল্পের সংকলন)
একবার তার ইচ্ছে হল নিজের হাতে মেয়েটির চোখের জল মুছে দেন - পর মুহূর্তেই মনে হল - না, নিশির চোখের জল মুছিয়ে দেবার দায়িত্ব তার না। তার দায়িত্ব জলের উৎস খুজে বের করা। এই কাজটা তিনি করেছেন।
তার দায়িত্ব শেষ হয়েছে। মেয়েটি যদি তার চোখের জল মুছতে চায় তাহলে তাকেই তা করতে হবে। ( তন্দ্রাবিলাস-৯৬ পৃষ্ঠা) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।