আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কামরাঙ্গা সবার জন্য নিরাপদ নয়

কামরাঙ্গা ফল বিশ্বে বিভিন্ন নামে পরিচিত যেমন_ স্টার ফ্রুট (তারা ফল) ক্যারামবোলা প্রভৃতি। এই ফলটির উৎপত্তি মূলত শ্রীলঙ্কায়। পরবর্তী সময়ে ভারত, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন, চীনসহ ইউরোপ-আমেরিকা মহাদেশে চাষ হয় এবং এটি বিশ্বব্যাপী টক-মিষ্টি ফল হিসেবে বেশ পরিচিত। কিন্তু উচ্চ মাত্রার ভিটামিন সি সমৃদ্ধ কামরাঙ্গায় উল্লেখযোগ্য আরো রয়েছে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন বি৯ (ফোলেট) মিনারেল হিসেবে রয়েছে পটাশিয়াম ফসফরাস জিংক প্রভৃতি। এটি এন্টি অক্সিডেন্টের ভালো উৎসই শুধু নয় এর রয়েছে এন্টি মাইক্রোবিয়াল এবং ক্যানসার বা অস্বাভাবিক কোষ অপরাসরণের ক্ষমতা।

কামরাঙ্গা ফলের মধ্যে যতই গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন এবং মিনারেল থাকুক না কেন, পাকা কামরাঙ্গা জুস যতই সুস্বাদু লাগুক না কেন কামরাঙ্গার মধ্যে এমন দুইটি উপাদান রয়েছে যা মানব শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ ঘটাতে পারে এবং অতীতে বহু মানুষের কামরাঙ্গা খাবার কারণে মৃত্যু ঘটেছে এমন কি এই ফল খাবার ১ ঘণ্টা পরেই মৃত্যু ঘটার মতো ঘটনা ঘটেছে। খাবার পর যে সব লক্ষণ বা প্রতিক্রিয়া দেখা যায় তার মধ্যে বিরামহীন হেচকি , বমি বমি ভাব, মাথা ঘুরানো, মানসিক ভারসাম্যহীনতা প্রভৃতি। চায়নার এক শহরে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকদের মধ্যে ১০ জন কামরাঙ্গা খেয়ে অসুস্থতা বোধ করে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সবাই পরবর্তী সময়ে মারা যায়। এই মৃত্যু ঝুঁকি তাদের জন্য যারা বিভিন্ন কিডনি রোগে ভুগছেন। যেমন কিডনি দুর্বল, কিছুটা নষ্ট, প্রায় কাজ করছে না অথবা পুরোটা নষ্ট অর্থাৎ ডায়ালসিস করতে হচ্ছে বা কিডনিতে পাথর রয়েছে এসব ক্ষেত্রে কামরাঙ্গা গ্রহণকারী ব্যক্তি উপরোক্ত লক্ষণসহ মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।

এরমূল কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে কামরাঙ্গায় রয়েছে উচ্চমাত্রায় অক্সালিক এসিড যা দুর্বল কিডনির জন্য মারাত্মক হতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে ১০০ মিলিলিটার কামরাঙ্গার জুসে ০.৫০ গ্রাম অক্সালিক এসিড রয়েছে। এক সূত্রে জানা যায় বাংলাদেশের একজন ৫০ বছর বয়ষ্ক রোগী হঠাৎ কিডনি বিকল হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে চিকিৎসকরা এর কারণ পরীক্ষা করতে কিডনি বায়োপসি করে দেখা যায় তার কিডনিতে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র অক্সোলেট স্ফটিক কণিকা রয়েছে। সাওপলো বিশ্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে কামরাঙ্গা গ্রহণকারীদের মধ্যে ৩২ জনের মধ্যে ৩০ জনের হেচকি লক্ষণ দেখা দেয়। ৩ ভাগের ২ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে বমি হয়, মানসিক ভারসাম্যহীনতার কম লক্ষ্য করা গেছে।

সুস্থ কিডনি যাদের রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে কামরাঙ্গা গ্রহণ করা যেতে পারে। কারণ তাদের ক্ষেত্রে এমন লক্ষণ দেখা যায়নি। কিন্তু ব্রাজিলিয়ান গবেষকরা গবেষণায় দেখলেন কামরাঙ্গার এমন একটি উপাদান আছে যা অন্যকোনো ফলে নেই। যা দুর্বল বা কিডনি ফেইলিয়র রোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর আর তা হল নিউরো টক্সিন। গবেষকরা বলেছেন, যাদের কিডনি সঠিকভাবে কাজ করছে তাদের কিডনি এই মারাত্মক ক্ষতিকর নিউরো টক্সিনকে ছেঁকে রক্ত থেকে প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয় ফলে ব্রেনের নিউরনের ওপর এবং নার্ভাস সিস্টেমের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না।

সুতরাং সুস্থ ব্যক্তিদের পরিমাণ মতো কামরাঙ্গা খেতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যাদের কিডনি দুর্বল বা অকার্যকর তাদের কিডনি এই মারাত্মক নিউরো টক্সিনকে বের করে দিতে পারে না। ফলে এটি ব্রেন এবং নার্ভাস সিস্টেমের ওপর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, ফলে মাথা ঘোরা, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, কোষের শক্তি কমে যেতে থাকা, কোষের ওপর টান বা খিচুনি অনুভব করা বা খিচুনি হওয়া, অজ্ঞান হয়ে পড়া এমনকি কোমাতে চলে যাওয়া ঘটনা ঘটে। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় যে নিউরো টক্সিন কি এবং এটি আমাদের কিভাবে ক্ষতি করে কিছু জানা দরকার। কামরাঙ্গায় থাকা নিউরো টক্সিন আমাদের ব্রেনে নিউরনের কার্যক্ষমতাকে আটকে দেয়।

আমাদের ব্রেনে ৫০ বিলিয়ন নিউরন রয়েছে এবং নার্ভাস সিস্টেম, আমাদের শরীরের সমস্ত কর্মকা-, অনুভূতি, সংবাদ প্রেরণ, সাড়া দেওয়া, সংবাদ পেঁৗছানো সবই নিউরনের কাজ। কিন্তু নিউরো টক্সিন এই গুরুত্বপূর্ণ নিউরনের ওপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ড্যামেজ করে, ফলে নিউরন তার কাজ সঠিকভাবে করতে পারে না। সুতরাং দুর্বল কিডনি, নষ্ট হতে থাকা কিডনি, ক্রনিক কিডনি ডিসিস অথবা একেবারেই নষ্ট হয়ে যাওয়া কিডনি রোগী (ডায়ালাইসিস করছেন) যদি কামরাঙ্গা ভুল করে গ্রহণ করেন এটি তাদের দ্রুত মৃত্যুর কারণ ঘটাতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে একেবারেই অল্প অর্থাৎ অর্ধেক কামরাঙ্গা অথবা আট আউন্স কামরাঙ্গার সরবত বা জুস মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এবং মৃত্যুও হতে পারে। সুতরাং কিডনি দুর্বল বা ঠিকমত কাজ করছে না এমন রোগী কামরাঙ্গা থেকে সাবধান।

গর্ভবতী মায়েরা যদি কামরাঙ্গা খান তবে তা নিজের জন্য এবং গর্ভজাত শিশুর জন্য ক্ষতির কারণ ঘটতে পারে। এ বিষয়ে ঢাকা শিশু হাসপাতালে শিশুদের কিডনি রোগের জন্য যে সকল শিশুরা চিকিৎসা নিতে আসে তাদের কিডনি সমস্যার কারণ হিসেবে গর্ভবস্থায় মায়েদের কামরাঙ্গা গ্রহণ করাকে অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ বলে অনেক চিকিৎক মনে করেন। তবে যাদের কিডনি সুস্থ রয়েছে তাদের ক্ষেত্রে কামরাঙ্গা পরিমাণ মতো গ্রহণ করা যেতে পারে বলে বিশ্বের গবেষকরা বলেন। তবে আমি মনে করি 'প্রিভেনশন ইস বেটার দেন কিউর'। যা খেলে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে সেটা খাওয়ার দরকার কি? ফলের কি অভাব রয়েছে! এমনিতেই বাংলাদেশে কোনো না কোনোভাবে কিডনি রোগে ভুগছেন এমন রোগীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি বলে বাংলাদেশের কিডনি বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন এবং ভয়ঙ্কর সংবাদ হচ্ছে শতকরা ৯০% কিডনি রোগী জানেই না যে তার কিডনি রোগ রয়েছে।

সুতরাং কামরাঙ্গা না খাওয়াই ভালো। ফলজ গাছ হিসেবে কামরাঙ্গা না লাগানোই ভালো। সচেতনতাই সুস্থ থাকার উপায়। সুতরাং কামরাঙ্গার মধ্যে থাকা যে দুটি রাসায়নিক উপাদান ১. অক্সিলিক এসিড ২. নিউরো টক্সিন রয়েছে যা অন্যকোনো ফলমূল ও সবজির মধ্যে পাওয়া না গেলেও কোন কোন শাকসবজি ফলের মধ্যে অক্সালিড এসিড রয়েছে যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর নয় যা শরীরের জন্য নিরাপদ বা ক্ষেত্র বিশেষে প্রয়োজন রয়েছে। তবে পালং শাকে নিরাপদ পর্যায়ে অক্সালিড এসিড থাকলেও কিডনি রোগীদের বেশি না খাওয়া ভালো।

মূল লেখক: ড. মো. আলমাসুর রহমান ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।