আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অতঃপর কামরাঙ্গা

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।

আচমকা সাড়াশব্দহীন রাস্তায় মাথাখোলা দামী একটা গাড়ী যার নামটা ঠিকভাবে দেখতে পায়নি হুশ করে প্রবল আড়ম্বরে তার কিছু পাশ দিয়ে চলে গেলো । ছোট ছোট প্লাস্টিকের চায়ের কাপ থেকে শুরু করে চিপসের প্যাকেট সমেত যার যার বাসার কাছের কোন দোকানে বিক্রি করে কোনভাবে একবেলার খাবার যোগাড় করা বছর দশেকের দুইটি বাচ্চা ছেলে নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত । একটু কান খাড়া করে শুনলে বুঝতে পারা যায় আজকের দিনে কার ব্যাগে কুড়ানো জিনিসপত্র কিংবা চেয়েচিন্তে নেওয়া ইউজলেস গার্বেজের সংখ্যা বেশী সেই নিয়েই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সেই মাপে নিজেদের পৃথিবী দেখতে বাধ্য হওয়া তারা পরস্পরের সাথে বাদানুবাদে ব্যাপৃত । জাম গাছের পাতাগুলো সাংসারিক জোয়ালে বিপর্যস্ত গৃহবধূর মতো প্রাণহীন হয়ে যেই জায়গায় সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই জায়গাই বছর কুড়ি আগে প্রেমময় যুগলের হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে ছোট ছোট কথার জাল তৈরী করার সাক্ষী ছিলো এখন দেখলে তা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় ।



দুই চোখ দিয়ে রফিক সবকিছুর উপরে চোখ বুলিয়ে যায় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কিছুই লক্ষ্য করেনা । যেই বিপন্নতার মধ্যে অবগাহন করতে করতে মানুষ একসময় ভিক্ষা কিংবা অপরে করুণা মিশ্রিত সহানুভূতির অহংপূর্ণ দানকেও স্নেহের সাথে জড়িয়ে ধরে প্রাপ্তির সুখ খোঁজে ঠিক সেই সময়টাই কি তার এখন এসেছে ? নাকি সেই সময়টার বীজ অনেক আগেই বপিত ছিলো এখন তার অনিবার্য পরিণতিটাকেই চাক্ষুস করছে ? একটা প্রশ্ন মনে আসতেই আরেকটি প্রশ্ন এসে যুক্ত হলো । রফিক জানে এমনই হয় । এমনটাই হবে সবসময় । বোধশক্তিহীন সময়ে মানুষ নিজের মুখোমুখি দাঁড়ালে খুব সম্ভবত সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া প্রশ্নগুলো একের পর এক মাথায় এসে ইতোমধ্যেই পরাভূত চিন্তাশক্তিকে আরো ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যায় ।

সে ভাবে ঘাত – প্রতিঘাতের অমোঘ যেই টানটান প্রতিযোগীতায় সে জীবনের এই পর্যায়ে এসে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়েছে তার থেকে সামনের দিকে চোখ রাখবার সঞ্জিবনী সুধা কোন পরম আকাঙ্খিত প্রেরণার বাক্সে লুকিয়ে আছে ?

ততোমধ্যে আশেপাশে মানুষজনের সংখ্যা আরো বেশ বেড়ে গেছে । মাত্রই অতিক্রম করা রাস্তার মতো মোটেও একাকী নয় এই রাস্তাটা । ঠিক সেই জন্যেই কি পরিবেশের মতো বাতাসটাও বৈচিত্র্যময় ? মুক্তি খুঁজতে কিংবা অবক্ষয়ের পথে পা বাড়ানো যেই কারণেই হোক এই উন্মুক্ত জায়গার কোথা থেকে যেন গাঁজার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে । তার নাক কুকুরের মতো তীক্ষ্ণ কখনোই ছিলোনা তবু সে ঘ্রাণ পায় । পেয়ে তার বিশেষ কোন প্রতিক্রিয়া হয়না ।

তবে সে আশ্চর্য এবং একইসাথে স্মৃতিকাতর হয় যখন কারো ব্যাগ কিংবা ঝুড়ি থেকে কামরাঙ্গার গন্ধ বাতাসে ভেসে ভেসে আসে । তার মতো অগণিত প্রাকৃতজনের জন্য অভিশপ্ত এই শহরে বৃষ্টির দিনের সোঁদা মাটির মতো কোন চিরচেনা আপন গন্ধ কোত্থেকে এসে নিমেষে মুখে সামান্য একটুকু হাসির উপলক্ষ্য বয়ে নিয়ে আসতে পারে সেটা অচিন্তনীয়ই বটে । কৈশোরে যেই প্রণয়িনীকে মফস্বলে কামরাঙ্গা গাছের নিচেই গোটা গোটা হরফে কিন্তু একগাদা ভুল বানানে ভরা চিঠি লিখে অপরাধীর মতো মুখ করে কাঁপাকাঁপা হাতে প্রাপকের হাতে পাঠিয়েছিলো তার কথা মনে পড়ে গেলো । যদিও গেই ঘটনাটির পরবর্তী প্রবাহ আদপেই সুখকর কিছু ছিলোনা । প্রাপকের বাবা কর্তৃক প্রেরকের বাবার কানে এই খবর পৌঁছালে পীঠের উপর গুনে গুনে টানা দশটি বেতের সপাং সপাং বাড়ি পড়েছিলো তবু এই মুহূর্তে তা রোমন্থন করতে এতো ভালো লাগছে !!!!!!


নিজ প্রাত্যহিক গন্তব্যের কাছাকাছি চলে এলে রফিক ভাবলো গত পরশু আহমেদের মা দীর্ঘদিন বিছানায় অসুস্থ পড়ে থেকে অবশেষে মারা গেছে তাকে সান্ত্বনাসূচক কিছু বলবে কিনা ।

পরমুহূর্তেই তার মনে হলো এই ধরণের ভড়ঙে ভরা কেজো কথার আসলেই বিশেষ কোন তাৎপর্য্য নেই । পরিণত বয়সে আসলে এই ধরণের অস্বস্তিকর পরিবেশে আসলে কেবল সেই নিজেকে গুটিয়ে রাখতে ভালোবাসে নাকি প্রত্যেকেই তার মতো করে ভাবে কিনা রফিক বলতে পারেনা । সে মনঃস্থির করলো যে এসবের কিছুই করবেনা । এর কোন মানে হয়না আসলে । তাছাড়া আজকে ঘন্টা দশেক হলো বাড়ীর বাইরে আছে ।

ঘেমে নেয়ে যেই ক্লান্তি চোখেমুখে এসে ধরা দিয়েছে সেটা কাটিয়ে উঠা আবশ্যক বলে মনে করলো রফিক । তার উপর আজকে সারাদিনে তার উপর দিয়ে যা যা গেছে তাতে নিজেকে স্থিতবস্থায় রাখার বিকল্প নেই । মাথার উপর দিয়ে যেই একরাশ আয়ুধ্বংসী চিত্র প্রতিদিন এসে খেলা করে তার মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য নিজেকে ধরে রাখা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পন্থা রফিক জানেনা ।

বাড়িতে ঢুকে রফিকের মনে হলো তার বড্ড কথা বলতে ইচ্ছা করছে কারো সাথে । স্নানঘরে হাতমুখ ধুতে ধুতে সেই ইচ্ছাটা বাড়তে থাকলে দীর্ঘশ্বাসটা বেরই হয়ে এলো ।

যদিও বড্ড নিদারুণ এই বাস্তবতা অনেক আগে থেকেই গা সওয়া হয়ে গেছে তার । তবু সে এখন নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারছেনা । রফিকের মনে হতে থাকলো তাকে ঠকানো হয়েছে । তার সাথে ইচ্ছাকৃতভাবেই প্রতারণা করা হয়েছে । কিন্তু কে তাকে কিভাবে ঠকিয়েছে তার কোন সদুত্তর রফিকের মাথায় আসছেনা ।

কিন্তু এক পাশবিক ক্রোধে তার সমগ্র মস্তিষ্ক একবার চারিদিকে চক্কর দেওয়ার অবস্থাতেই রফিক কোনভাবে নিজেকে সামলাতে সামলাতে নিজের ঘরে ঢুকলো । দেখলো এতো রাতেও হালকা সবুজাভ আলোটা যার উজ্জ্বলতা বাইরে থেকে দেখা যায়না সেটা জ্বালিয়ে পর্ণা কি যেন একটা লিখছে । রফিক ঘরে ঢুকতেই পর্ণা তার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে পরক্ষণেই আবার লিখতে থাকলো । এদিকে ঘেমো জামাকাপড় ছাড়তে ছাড়তে ততোমধ্যে নিজেকে সামলে নেওয়া রফিক বিছানায় বসতেই পর্ণা লেখা বন্ধ করে যেই কাগজটায় এতোক্ষণ যাবত সে লিখছিলো সেটা রফিকের সামনে রাখতে রাখতে পেলবতাপূর্ণ চাহনীতে রফিকের দিকে তাকিয়েই থাকলো । পর্ণা বাকশক্তিসম্পন্ন হলে রসকষহীন ভঙ্গিতেই না হয় দুই একটা কথা বলতে পারতো তার সাথে ।

আগ্রহ নিয়ে রফিক সেই কাগজটার দিকে হাত বাড়ায় ।

আড়াই পৃষ্ঠার সেই আটপৌরে ভঙ্গিমার লেখাটি পড়তে পড়তে রফিক অনুভব করতে থাকলো যাকে সমাজ বাকশক্তিহীন বলে মনে করে এমনকি কিছুক্ষণ আগে সে নিজেও এমনভাবেই ভেবেছিলো সেই নির্বাক পাঁচ ফুট তিনের হালকা গড়নের বুদ্ধিদীপ্ত মননের সাধারণ বৈশিষ্ট্যহীন চোখের অধিকারিনীই আসলে রফিকের গোপন সেই প্রেরণার বাক্স । রফিকের মনে হতে থাকলো তার ছোট্ট এই ঘরটির বাতাস বুঝি কামরাঙ্গার ঘ্রাণে সিক্ত ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।