আজ আমি, অর্ফিয়ুস, ছিন্ন দেহ, জলে ভাসি একা... লালন সাঁই ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী আধ্যাত্মিক সাধকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি একাধারে বাউল সাধক, বাউল গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। তাঁকে ‘বাউল সম্রাট’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়। গান্ধীরও ২৫ বছর আগে, ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম তাঁকেই ‘মহাত্মা’ উপাধি দেয়া হয়েছিল (তাঁর মৃত্যুর ১২ দিন পর তৎকালীন পাক্ষিক পত্রিকা মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত 'হিতকরীতে' প্রকাশিত একটি রচনায় সর্বপ্রথম তাঁকে "মহাত্মা" হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়)।
লালনের বেশ কিছু রচনাবলী থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে তিনি ধর্ম-গোত্র-বর্ণ-সম্প্রদায় সম্পর্কে আদৌ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না।
ব্রিটিশ আমলে যখন হিন্দু ও মুসলিম মধ্যে জাতিগত বিভেধ-সংঘাত বাড়ছিল তখন লালন ছিলেন এর বিরূদ্ধে প্রতিবাদী কন্ঠস্বর। তিনি মানুষে-মানুষে কোনো ভেদাভেদে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর কাছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ এসবের কোনো মূল্যও ছিল না। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী। “” একটি গানে তিনি বলেছেনঃ
'' সব লোকে কয়
লালন কি জাত সংসারে।
লালন বলে জাতের কি রূপ
দেখলাম না তা-নজরে। । ''
আবার আরেকটি গানে লালন বলেছেনঃ
'' সব লোকে কয়, লালন ফকির হিন্দু কি যবন
লালন বলে, আমার আমি না জানি সন্ধান। ''
কিন্তু মানবতাবাদী লালনকেও ধর্মের লেবাস পরানো থেকে রেহাই দেয়া হয়নি। এর সূত্রপাত ঘটান লালন গবেষকবৃন্দ।
লালন হিন্দু না মুসলমান এ নিয়ে রয়েছে বিস্তর মতভেদ। একদল বলেন তিনি হিন্দু কায়স্থ পরিবারের সন্তান। আবার আরেকদল মনে করেন তিনি সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের সন্তান। মূলত নানাভাবে ব্যাখ্যা করে গবেষকরা নানান সময়ে লালনকে হিন্দু বা মুসলমান বানানোর চেষ্টা করেছেন। তবে মোক্ষম পেরেকটি ঠুকে দেয়া হয় পাকিস্তান আমলে।
আইউব খানের আমলে বাঙালি সংস্কৃতির পাকিস্তানিকরণ বা সোজা কথায় ইসলামিকরণের যে প্রয়াস নেয়া হয়েছিল তা থেকে রেহাই পাননি লালনও। আইউবের পা চাটা অর্ধশিক্ষিত মোনেম খানের বদৌলতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ইত-সিমেন্টের কাঠামো গড়ে উঠে লালনের সমাধির উপর। শুধু তাই নয়, সকল ইসলামি স্থাপত্যের সুকৃতিকে ব্যঙ্গ করে সমাধির উপর লিকলিকে এক গম্বুজ মাথা উঁচিয়ে দাঁড়ায়। ফলে 'লালনের আখড়া' হয়ে যায় 'লালন শাহের মাজার' আর লালন সাঁই' হয়ে যান লালন শাহ! তাতে লালনের অঙ্গে কিছুটা শাহী আভিজাত্য আনা গেল আর সাথে জাত-পাত নিয়ে সকল সন্দেহের অবসান ঘটিয়ে লালনকে খাঁটি মুসলমানও বানানো গেল!
কিন্তু এতো অল্পতেই রেহাই দেয়া হলো না লালনকে। ১৯৬৩ সালে ঔসব কাজ সম্পন্ন করার পাশাপাশি মোনেম খান আরেকখান কাজ করে গেলেন।
লালন সমাধি-প্রাঙ্গণে একটি একতলা দালান নির্মাণ করে সেটাকে লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র বলে ঘোষণা দিলেন। কেন্দ্রের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন জেলা প্রশাসক আর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতেন স্থানীয় জননেতার থেকে একজন। অর্থাৎ বাউলদের দেখভালের দায়িত্ব দেয়া হলো অবাউলদের। যতদূর জানি এ অবস্থার কোনো হেরফের হয়নি। তারপর শুরু হলো লালন-বাণিজ্য।
দোল পূর্ণিমার উৎসবে আখড়ায় (নাকি মাজারে!) বসা মেলা স্পন্সর করে নামজাদা এক টেলিযোগাযোগ কোম্পানি। মেলাকে আকর্ষণীয় করতে তারা সেখানে র্যাফল ড্র'রও আয়োজন করে! শুধু তাই নয়, লালনের জীবনদর্শনের প্রতিচ্ছবি নির্মাণের নামে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র (নাকি ছলচ্চিত্র!) বানিয়ে লালনকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করা হয়।
লালনকে নিয়ে এরকম হীন প্রচারণার মানে কি আমার জানা নেই। শুধু এটুকুই চাইবো, মাজারের সংস্কার থেকে বেড়িয়ে আবার 'লালনের আখড়া' নামে পরিচিতি পাক ছেউরিয়া আর ফকির লালন সাঁইয়ের শরীর থেকে খুলে ফেলা হোক ধর্মের সকল লেবাস। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।