প্রকৃতির বড় রহস্যের আধার হলো পাহাড়। এর ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে রোমাঞ্চের গন্ধ, একটা পাহাড়ের এপাশ-ওপাশ সম্পূর্ণ আলাদা—এপাশে এলোমেলো অবাধ্য মাটি তো ওপাশে থই থই জলের তরঙ্গ, এপাশে কলাগাছের মিছিল তো ওপাশে বাঁশঝাড়ের পাঠশালা। ক্ষণে ক্ষণে বদলায় পাহাড়ের আকাশ, এখানে ব্রেকফেল করা মেঘগুলো সজোরে ধাক্কা খেয়ে কেঁদে ভাসিয়ে দেয় সবুজ কার্পেট। এখানে রংধনু এসে ঝাঁপ দেয় নীলের শূন্যে।
এবার বান্দরবানে আমাদের আসার সংবাদ শুনে সেই রাতে আলীকদম প্রেসক্লাবের সভাপতি মমতাজউদ্দিন ভাই ছুটে এলেন, তিনি আলীকদমের পাহাড় নিয়ে একটা বই-ই লিখে ফেলেছেন—পরামর্শ দিলেন আলীকদমের ‘আলী’র সুড়ঙ্গটা দেখে আসতে।
ওই সুড়ঙ্গের নাকি তিনটা অংশ—একটাতে বাস করে দম বন্ধ হয়ে আসার আতঙ্ক, একটা রয়েছে বাদুড়ের দখলে, আর আরেকটাতে নাকি নিজের রাজত্ব কায়েম করে বসে আছে নিকষ কালো অন্ধকার! সেখানে যেতে হলে সঙ্গে করে আলো নিয়ে যেতে হয়। কেননা, কখনোই নাকি সূর্যের আলো সেখানে ঢোকার অনুমতি পায়নি। রোমাঞ্চের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা আমাদের চোখগুলোতে দপ করে আলো জ্বলে উঠল, যেন এই আলোতেই দূর করব সুড়ঙ্গের ভেতরের সব অন্ধকার।
আলীর সুড়ঙ্গে যাওয়ার পথে ঠান্ডা ঝিরঝিরে এক পানির ধারা পেরোতে হয়। এই খালের নাম ‘টোয়াইন খাল’।
হাঁটুপানির এই খালের ধারা মিশেছে মাতামুহুরী নদীর মূল স্রোতে। খালটা পেরোলেই চোখে পড়ে বড় একটা সাইনবোর্ডে লেখা ‘ঐতিহাসিক আলীর সুড়ঙ্গ’। এবার সেখানে নিজেদের ইতিহাস লিখতে ঢুকে পড়লাম আমরা নয়জন।
পাহাড়ের মাঝ বরাবর উঠে গেলাম। এখানে জুতা রেখে আলীর সুড়ঙ্গের দিকে যেতে হয়।
শুরুতেই পড়ল বহুদিনের জল-কুয়াশায় ভেজা বাঁশের একটা সাঁকো। সেটা পার হতেই মনে হলো দুপাশের পাহাড়ের দেয়ালগুলো হেঁটে হেঁটে অনেকটা গায়ের দিকে চলে আসছে। পাহাড়ের দেয়াল থেকে টপটপ করে মাথার তালুতে পড়ছে হাজার হাজার মাইল পেরিয়ে আসা পানির ফোঁটা। সে ফোঁটা জমে জমে পিচ্ছিল হয়ে পড়েছে একমাত্র পায়ে চলা পথটি। কোনোমতে ভারসাম্য বজায় রেখে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি আর কোনো রাস্তা নেই।
এখন এগোতে হলে কোমর পানিতে নেমে অচেনা জায়গায় পা রেখে চলতে হবে। তা-ও না হয় গেলাম, কিন্তু কিছুদূর পর দুই পা দুই পাহাড়ে রেখে চলতে হবে এমনটা তো কেউ আর আগে থেকে বলে দেয়নি। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়াল যে নিজের কপালে চাপড় মেরে হা-হুতাশ করব সেই পরিস্থিতিও নেই। দুই পা দুই পাহাড়ে রেখে হাঁটছি, হাত সরলেই ১০-১৫ ফুট নিচে ঝপাৎ!
এমন পরিস্থিতিতেই চোখে পড়ল প্রথম গুহাটার মুখ, স্থানীয় লোকেরা সেখানে একটা লোহার মই লাগিয়েছেন, যেটার দুই-তিনটা পাশ জং ধরে বিশ্রীভাবে পড়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে। সেই হুমকিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমরা অল্প ওজনের সাতজন তরতর করে উঠে গেলাম, আটকে গেল আরমান আর অপু ভাই।
অনেক কষ্টে এই দুই ভারী জনতাকে উঠিয়ে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! ভরদুপুরের রোদেও অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার সেখানে, টর্চলাইট-মোমবাতি যার কাছে যা ছিল। তা-ই নিয়ে এগিয়ে গেলাম। আঁঁকাবাঁকা গুহাপথটি শেষ হলো একটা চিপা জায়গায় এসে, এখান দিয়ে কেবলমাত্র খুব চিকন বা ছোট মানুষই যেতে পারবে। নিজেকে সেঁধিয়ে দিলাম সুড়ঙ্গের দুই দেয়ালের চিপার মধ্যে। কয়েক ইঞ্চি গিয়েই বুঝলাম এ আমার কর্ম নয়।
দুই দেয়ালের মাঝে এমনভাবে আটকে গেলাম যে আর নড়াচড়া করার জো নেই। ক্রমেই আতঙ্ক ভর করতে লাগল, শেষমেশ বাকিরা টেনেটুনে বের করে আনল আমাকে। যাঁরা প্রথম সুড়ঙ্গে ঢুকতে চান, তাঁদের একটা কথা জানিয়ে রাখি, অতিরিক্ত উৎসাহী হওয়ার দরকার নেই, আতঙ্ক খুব খারাপ জিনিস। লিকলিকে শরীর হলে বা ওজন ৫০ কেজির কম হলেই কেবল এখানে ঢোকার কথা চিন্তা করবেন, অন্যথায় নয়।
এরপর অভিযান শুরু হলো দ্বিতীয় সুড়ঙ্গের পথে।
পাহাড় এবার আজব খেল দেখানো শুরু করল। রাস্তা বলে কিছু নেই, পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বিশেষ কায়দায় ভারসাম্য বজায় রেখে টানতে হচ্ছে নিজেকে। এখানে বাঁশের কঞ্চি তো ওখানে গাছের ভাঙা গুঁড়ি, আরেকটু সামনে গেলে চোখা পাথর, সারা রাস্তায় যত না পানি, তার চেয়ে বেশি পানি ঘাম হয়ে গড়িয়ে পড়ছে আমাদের কপাল বেয়ে। এমন সময় পুরো আলীকদম কাঁপিয়ে বিকট শব্দে পানিতে পড়লেন তারিক লিংকন ভাই। তাকে বাঁচাব কী! উল্টো সবাই যার যার মাথা বাঁচিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে বসে পড়ল—পাহাড়ে খুব আস্তে শব্দ করতে হয়, তা না হলে অনেক সময় ওই শব্দের ফলে পাহাড়ধসের শুরু হতে পারে।
যা-ই হোক, এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম, কোনোমতে হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে গেলাম দ্বিতীয় সুড়ঙ্গমুখে।
এই সুড়ঙ্গটা ঠিক পাহাড়ের পেটের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। ক্রমেই ঢালু হয়ে যাওয়া সুড়ঙ্গটা শুরুতে এক মাথা সমান উঁচু হলেও ধীরে ধীরে নেমে এসেছে কোমর পর্যন্ত, একসময় হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে হয়। টর্চলাইটের আলোতে ঝলসে ওঠে গুহার দেয়ালে ঝুলতে থাকা শিশিরের ফোঁটা ও চকচক করতে থাকা পাথুরে মেঝে দেখতে দেখতে চোখাচোখি হয় উল্টো ঝুলে থাকা বাদুড়ের সঙ্গে। ডানা ঝাপটে উড়ে যাওয়ার আগে তার কর্কশ শব্দ ভয় ধরিয়ে দেয় মনে।
এটা তাদের রাজত্ব, আমরাই এখানে অনাহূত। কাদায় হামাগুড়ি দিতে দিতে একেকজনের যে চেহারা হয়েছে, তাতে আমারই আতঙ্ক লাগছে, বেচারা বাদুড়ের আর কি দোষ! সুড়ঙ্গের শেষ মাথাটা কুয়ার মতোন, নিজেকে যতটুকু সম্ভব ছোট করে গলিয়ে দিতে হয় এর মধ্যে। আমি সবার পেছন থেকে দেখছি একেক জন করে গায়েব হয়ে যাচ্ছে ওই ক্ষুদ্র কালো গহ্বরটাতে!
মনে একরাশ ভয় নিয়ে হাতে-পায়ে বিস্তর কাদা মাখিয়ে তাড়াহুড়ো করে চোখ বন্ধ করে নিজেকে সঁপে দিলাম ওই অচেনা গর্তে। চোখ খুলেই দেখি চারপাশে দিনের আলোর বিস্ফোরণ। এ এক অন্য রকম অভিজ্ঞতা।
মাথার অনেক ওপরে একটা বানর গাছের মগডালে বসে তালি বাজাতে লাগল। মনে হলো, এই মাত্র যেন একটা জব্বর সিনেমা দেখে শেষ করল!
দিনের আলো ফুরিয়ে যাওয়ায় তৃতীয় সুড়ঙ্গে আর যাওয়া হয়নি। ওটা পরের বারের জন্য রেখে দিয়েছি। আবার আসতে হবে এখানে, বুড়ো পাথরে পা না ছিললে আর ভারী দেয়ালে মাথা না ঠুকলে কিসের আবার অভিযান! সাপ আর বাদুড়ের সঙ্গে এক গুহায় রাত না কাটালে কিসের আমি অভিযাত্রী!
কীভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী যেকোনো বাসে উঠে সোজা চলে যাবেন চকোরিয়াতে। সেখান থেকে চান্দের গাড়ি নিয়ে যাবেন আলীকদম।
অনিন্দ্য সুন্দর এই পাহাড়ি পথে আলীকদম পৌঁছাতে ঘণ্টা খানেকের মতো সময় লাগবে। আলীকদম থেকে যেকোনো রিকশাওয়ালাকে বললেই আপনাকে আলীর সুড়ঙ্গে নিয়ে যাবে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।