খুব জানতে ইচ্ছে করে...তুমি কি সেই আগের মতনই আছো নাকি অনেকখানি বদলে গেছো... কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: দরকার আছে, দরকার নেই
হাসান কামরুল
আনোয়ারায় ও বাগেরহাটে রামপালে ১৩৫০মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রামপালে নির্মিতব্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ভারত বাংলাদেশের যৌথ প্রয়াস। এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অব¯হান সুন্দরবন থেকে মাত্র ৯ কিমি দুরে। কালের কন্ঠ (০৭ জুলাই,২০১২) উপকুলে গড়ে উঠা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি নিয়ে কভার হিস্ট্রি বা লিড নিউজ করেছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মানের নানান প্রতিকুলতা খুব সুন্দরভাবে বিঙ্ঘানসম্মতভাবে সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে।
আসলে বিদ্যুতের এই নাকাল অব¯হায় রেন্টাল বা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যে খুব একটা কার্যকর পদক্ষেপ না তা আজ সর্বজনবিদিত। বিদ্যুতের কঠিন অব¯হায় গ্যাস বা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মানের বিকল্প নেই। যেহেতু গ্যাসের ক্রাইসিস রয়েছে সেহেতু আমাদেরকে কয়লার দিকে ধাবিত হতে হবে। এক কথায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলার বিকল্প নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কোথায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা প্রয়োজন তার সমীক্ষা থাকা বা ¯হান নির্ধারণকরাও জরুরি।
এক. উপকুল হলো সাগরতীরবর্তী ¯হান বা সাগর সমৃদ্ধ এলাকার বর্ধিত পরিধি। যদি এসব অঞ্চলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হয় তবে তা পরিবেশ সহায়ক হবেনা। উদাহরনস্বরুপ রামপালে নির্মিতব্য বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দিকে মনোযোগ দিলে দেখা যাবে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অব¯হান সুন্দরবন থেকে মাত্র ৯ কিমি অদুরে। কিন্তু সুন্দরবনের গুরুত্ব পরিবেশ ও প্রতিবেশগত ভাবেই সর্বাধিক। কারণ সুন্দরবনে বসবাস করে এমন জীব জন্তুর প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ২৪হাজার।
সুন্দরবন পৃথিবীর বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ম্যানগ্রোভ বনগুলোর অন্যতম জীবন্ত স্বাক্ষি। কারণ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন ইতিমধ্যে বিলুপ্তির পথে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ও অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে তবে সুন্দরবনের আকৃতি ও পরিধি সর্ববৃহৎ। এই জন্য সুন্দরবনকে পৃথিবীর বৃহত্তোম ম্যানগ্রোভ বন বলা হয়। এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে যদি সুন্দরবনের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায় তবে তা কি আর্থিক মানদন্ডে পুরণ করা সম্ভব?
দুই: কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে বাজে দিক ডাস্ট বা কয়লাধূলো ব্যব¯হাপনা বা মেইনটেইনেজ করা।
কারন এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রে অতি মিহিরাকৃতির বা অতিক্ষুদ্রকার কণার কোল ডাস্ট সৃষ্টি হয় যা অতি সহজেই বাতাসের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। এ ধরনের ডাস্টে সালফার, সিসা, আর্সেনিক ও অন্যান্য বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত থাকে। যা বাতাসে মিশে বাতাসকে দুষিত করে ফেলে। আর এই দুষিত বাতাস জীববৈচিত্র্য বা বায়োডাইভারসিটিকে বিপন্ন করে তোলে। ফলে কম সহনশীল প্রাণী ও গাছপালা টিকে থাকার প্রতিযোগীতায় পিছিয়ে পড়ে।
কয়লা পুড়ানোর কারণে পৃথিবীর আভ্যন্তরীন তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটে। প্রচুর কার্বন নি:সরণের ফলে বাতাসে সিসাযুক্ত বিষ ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য এ বাতাস ব্যবহার করলে নানান ধরনের নিত্যনতুন রোগের উপসর্গ দেখা দিবে। অধিকন্তু বাতাসের কমপোজিশন বিষাক্ত উপাদানে ভারী হয়ে যাওয়ার কারণে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অভাবনীয়হারে হ্রাস পাবে। আর বৃষ্টিপাতের অভাবে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র সংলগ্ন ও এর আশ পাশ অঞ্চল ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত হবে।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতিঘন্টায় মিঠা পানির প্রয়োজন হয় ৮০০ গ্যালন। অর্থাৎ ১৩৫০ মেগাওয়াট একটা বিদ্যুৎ প্লান্টে দৈনিক মিঠা পানির প্রয়োজন হবে ৫১ কোটি ৮৪ লাখ লিটার। এখন উপকুলে এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হলে মিঠা পানির আধারকে ধ্বংস করতের হবে গভীর নলকূপ বসিয়ে। কারণ উপকুল অঞ্চলজুড়েইতো লবণ পানির আধিক্য।
তিন: কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদিত বর্জ্য ব্যব¯হাপনা সত্যিকার অর্থেই দুরুহ।
এক মেগাওয়াট বিদ্যুতে উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণ ২৫০ টন অর্থাৎ বছরে এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে বর্জ্য উৎপাদিত হবে ২৫০ মেট্রিক টন। তার মানে ১৩৫০ মেগাওয়াট থেকে উৎপাদিত বর্জ্যরে পরিমাণ হবে ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৫শত টন। বর্জ্যের পাশাপাশি বাতাসে মিশ্রিত ধূলা ছাড়া পরিগণিত ডাস্টের পরিমাণ দাড়াবে ৫ লাখ ২১ হাজার ১শত টন (যুগান্তর, উপসম্পাদকীয় পাতা, ১১ মার্চ,১২)। এসব উৎপাদিত বর্জ্য কোথায় রাখা হবে? ঠিকমতো ব্যব¯হাপনা করা না গেলে এসব বর্জ্য খাল বিল নদী নালায় মিশে ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। যেভাবেই এসব ডাস্ট ও স্লাড ব্যব¯হাপনা করা হোকনা কেন তা ভূগর্ভ¯হ পানির স্তরে মারাতœকহারে বা খুব বাজে ভাবেই দুষণ সৃষ্টি করবে।
ফলশ্রুতিতে বিদ্যুৎ অঞ্চলের সুদীর্ঘ এলাকা খাবার পানি শুন্য হয়ে পড়বে।
চার: কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোলিং সিস্টেমে প্রচুর পানি ব্যবহার করতে হয়। ১৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে বৎসরে মোট পানির প্রয়োজন ১৮৭.৫১ বিলিয়ন লিটার। এতদ পরিমাণ পানি ব্যবহার শেষে পুণরায় নদীতে বা আর্টিফিসিয়াল ক্যানেল সৃষ্টি করে বা প্রচলিত সমুদ্রের চ্যানেলে ছেড়ে দিতে হবে। আর ছেড়ে দেয়া পানির গড় তাপমাত্রা থাকবে ৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট।
এত বিশাল পরিমানে গরম পানি নদীতে পড়ামাত্র নদীতে বসবাসকারী জলজপ্রাণী ও গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ সমুলে ধ্বংস হয়ে যাবে।
সাধারণত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কয়লাকে পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। কয়লা থেকে উৎপন্ন তাপকে প্রকৃতিতে অপ্রকৃতি¯হ অবস্হায় ছেড়ে দেয়া হয়। অথবা গরম অব¯হায় পানির মধ্যে শোষন করা হয়। যা উভয় অব¯হায় প্রকৃতিকে বিরুপ করে তোল।
বিদ্যুৎ আমাদের প্রয়োজন। প্রয়োজন নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা। ফুয়েল বেইজড পাওয়ার প্লান্ট থেকে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা সাশ্রয়ী ও জনবান্ধব । কিন্তু তাই বলে কি উপকুল অঞ্চলে? দুইটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দুটি ¯হান নির্ধারন করা হয়েছে, একটি চট্রগ্রামে আনোয়ারায় আর অন্যটি সুন্দরবনের সন্নিকটে রামপালে। কিন্তু কেন? প্রাকসম্ভাব্যতা যাচাই বাছাইয়ে যারা থাকেন তাদেরতো পরিবেশগত ধারণা থাকা দরকার।
কোন প্রকল্প করার আগে ফিজিবিলিটি স্টাডি কেন করা হয়? পরিবেশ ও প্রতিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকেইতো প্রাকসম্ভাব্যতা যাচাই বাছাইয়ের ব্যাপার চলে আসছে। যদি পরিবেশকে বিবেচনায় না আনা হয় তাহলে এইসব ফিজিবিলিটি স্টাডির কি দরকার তা বোধগম্য নয়।
বাংলাদেশে এমন বহু জায়গা রয়েছে যেখানে অপেক্ষাকৃত কম পরিবেশের ক্ষতি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা যায়। উদাহরনস্বরুপ চাপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে কোন একটা পদ্মার চরে যদি ভারত প্রস্তাবিত ১৩৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গড়ে তোলা যায় তাহলে তা পরিবেশের জন্য কম ক্ষতিকর হবে। তাছাড়া ভারত সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় তা সঞ্চালনেও কস্ট কমে আসবে।
আর প্রস্তাবিত আনোয়ারায় প্রকল্পটি না করে যদি লক্ষিপুরে বা সুবিধাসমেত মেঘনা নদীর অববাহিকায় চরাঞ্চলের কোন একটা চরে নির্মাণ করা যায় তাহলে তা সময়োপযুগি হবে। কারণ চরাঞ্চল হওয়ায় মানুষের বিচরন খুব সীমিত। এবং তা সঞ্চালনে জাতিয় গ্রিডে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত সহজ হবে।
আমাদের বিদ্যুতের প্রয়োজন। তারমানে এই না যে সুন্দরবনকে ধ্বংস করে করতে হবে।
সুন্দরবনের সৌন্দর্য্য রক্ষার বিদ্যুৎ উৎপাদনের চাইতেও বেশি জরুরি। কারণ পৃথিবীতে সুন্দরবন একটি। আর এই একটিমাত্র সুন্দরবন বিলুপ্তি হয়ে গেলে পৃথিবী ম্যানগ্রোভ বন শুন্য হয়ে পড়বে। তাই সুন্দরবন রক্ষার গুরুত্ব বিশ্বব্যাপী।
উপকুলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ না করে ভিন্ন অন্যকোন জায়গায় সুবিধামতো ¯হান নির্বাচন জরুরি।
আর পরিবেশের বৃহৎ স্বার্থ বিবেচনায় সুন্দরবনসহ উপকুলবর্তী অঞ্চলকে যেকোন উপায়েই দুষণমুক্ত রাখতে হবে।
হাসান কামরুল: ভূতত্ত্ববিদ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।